‘হোয়াট ইজ লাইফ’ পদার্থবিজ্ঞানী আরউইন স্রডিঞ্জারের রচিত ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত পপুলার সায়েন্সের একটি বই। হোয়াট ইজ লাইফ ১ম পর্বে বইটির প্রথম অধ্যায়ের প্রথম তিনটি অনুচ্ছেদের অনুবাদ করার চেষ্টা পোস্ট করা হয়েছিল, এখন পরের তিনটি।
কেন পরমাণু গুলো এত ছোটঃ
একটি অদ্ভুত এবং হাস্যকর প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাকঃ কেন পরমাণুগুলো এত ছোট? সত্যি বলতে, পরমাণুগুলো আসলেই অনেক ছোট। আমাদের দৈনন্দিন ব্যাবহারের প্রতিটা বস্তুই অসংখ্য পরমাণুর একেকটা স্তুপ। এই ব্যাপারটি পাঠকের কাছে সহজবোধ্য করার জন্য অনেক উদাহরন রয়েছে, তবে ভালোগুলোর মধ্যে একটা – যেটা লর্ড কেলভিন ব্যাবহার করতেনঃ ধরা যাক, একগ্লাস পানির সবগুলো অনু আপনি চিহ্নিত করে রাখলেন। এরপর পানিটা সমুদ্রে ঢেলে দিলেন। এরপর সুপারম্যানের সাহায্যে পৃথিবীটাকে এমন ঝাকি দিলেন যাতে ওই এক গ্লাস পানি সাতটা সমুদ্রে সমানভাবে মিশে যায়। এখন যদি, যেকোন সমুদ্র থেকে এক গ্লাস পানি সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখেন। তাহলে দেখবেন, প্রতিটা গ্লাসেই আপনার চিহ্নিত অণুগুলোর অন্তত ১০০টি করে আছে। পরমাণু সমূহের প্রকৃত আকার হলুদ আলোর তরংগদৈর্ঘ্যের ১/৫০০০ থেকে ১/২০০০ এর মধ্যে। এই তুলনাটি বেশ গুরুত্বপূর্ন, কেননা এই তরংদৈর্ঘ্যই মাইক্রোস্কোপের নিচে দৃষ্টিযোগ্য ক্ষুদ্রতম কণার মাত্রা নির্দেশ করে। তারপরো এমন একটি কণাতেও হাজার থেকে লক্ষ পরমাণু থাকতে পারে। তাহলে, কেন পরমাণু এত ছোট? স্পষ্টতই, এই প্রশ্নটির উদ্দেশ্য আসলে পরমাণুর আকার বের করা নয়। বরং, এটা জীবসত্বার আকার, বিশেষ করে আমাদের নিজ দেহের আকারের সাথে জড়িত। অর্থাৎ, পরমাণু বেশ ছোট, যখন আমাদের প্রচলিত দৈর্ঘ্যের এককের সাথে তুলনা করি। পারমাণবিক পদার্থবিদ্যায় আরেকটি প্রচলিত একক হচ্ছে এংস্ট্রম, এটা এতই ছোট যে এর দ্বারা ১ মিটারকে ১০^১০ অংশে ভাগ করা যায়, অথবা দশমিক পদ্ধতিতে একে
০.০০০০০০০০০১মিটার হিসেবে লেখা যায়। পারমাণবিক ব্যাসের ব্যাপ্তি ১ থেকে ২ এংস্ট্রম। এখন ওইসব প্রচলিত একক(যার তুলনায় পরমাণু খুবই ছোট) কিন্তু আমাদের দেহের আকারের সাথে সম্পর্কিত। যেমনঃ ইয়ার্ড একটি প্রচলিত একক। এটা কিভাবে আসল, তার পেছনে একটি গল্প আছে। এক রাজাকে তার সভাসদগণ জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোন একক গ্রহন করা হবে। রাজা তখন তার এক হাত প্রসারিত করে বলেছিলেন ‘আমার বুকের মাঝখান থেকে একেবারে আঙ্গুলের শেষ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য নিয়ে নাও, এতেই চলবে’। সত্যি হোক আর না হোক, এই গল্পটি আমাদের উদ্দ্যেশের জন্য গুরুত্বপূর্ন। সেই রাজা অবচেতনভাবেই নিজ দেহের সাথে তুলনা করে একটি একক দিয়েছেন, কারন অন্য অন্য কিছুর সাথে তুলনা করলে তা হবে দৈনন্দিন ব্যাবহারে অসুবিধাজনক। তাই, এংস্ট্রম এককের প্রতি পক্ষপাত থাকা সত্বেও, নতুন স্যুটের জন্য পয়ষট্টি হাজার মিলিয়ন এংস্ট্রম কাপড়ের বদলে সাড়ে ছয় ইয়ার্ড কাপড় বলতেই একজন পদার্থবিজ্ঞানী স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। অর্থাৎ, এখন এটা বোঝা গেছে আমাদের প্রশ্নটি- দেহ এবং পরমাণুর দৈর্ঘ্যের অনুপাতের সাথে সাথে, পরমাণুর স্বাধীন অস্তিত্বের দিকে। আসল প্রশ্নটি হতে পারেঃ কেন আমাদের দেহকে অবশ্যই পরমাণুর তুলনায় এত বিশাল হতে হবে? আমি কল্পনা করতে পারি বহু রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের তুখোড় ছাত্রের একটি আক্ষেপের বিষয় হল, আমাদের সংবেদনশীল অঙ্গগুলো এতটাই খারাপ যে আমরা একক পরমাণুত অস্তিত্ব বুঝতে পারিনা। আমরা শুধু একটি পরমাণু দেখতে পাইনা, একটি পরমাণুর গন্ধ নিতে পারিনা, একটি পরমাণুকে শুনতেও পাইনা। পরমাণু সম্বন্ধে আমাদের অনুমান, এবং আমাদের সংবেদনশীল অংগ দিয়ে যে আপাত ধারনা পাই, এদের মধ্যে ব্যাপক ফারাক। কেন এমন হতে হবে? এর পেছনে কি কোন অন্তর্নিহিত কারন রয়েছে? আমরা কি এই ঘটনাগুলো থেকে কোন মূলনীতিতে পৌছাতে পারি, যাতে আমরা বুঝতে পারি এবং প্রতিপাদন করতে পারি কেন পরমাণুর জগতের ব্যাপারগুলো আমাদের জানা সূত্রগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন নয়? এখন, এইমাত্র একটা সমস্যা পেলাম যা পদার্থবিজ্ঞানীরা সুন্দরভাবে সমাধান করতে পারেন। এবং, এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পারি।
জীবসত্তার কার্যকারীতার জন্য দরকার সঠিক পদার্থবিদ্যার সূত্রঃ
যদি আমরা এমন জীবসত্তা হতাম যে একটি বা কয়েকটি পরমাণু আমাদের ইন্দ্রিয়ে প্রত্যক্ষ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে, তখন জীবন কেমন হত! এককথায়ঃ তাহলে জীবনের নানান পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়াও হতনা, এমন আজব প্রশ্ন করার মত চিন্তার ক্ষমতাও থাকতনা, অন্যান্য ধারনার সাথে পরমাণুর ধারনাও আসতনা। ব্যাপারটি শুধু মগজ এবং সংবেদী অংগ নয়, অন্যান্য অঙ্গের কার্যকারীতার ক্ষেত্রেও সত্য হবে। তবে আমদের নিজেদের অনুভব, চিন্তা এবং কল্পনা তথা স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে নাড়াচাড়ার প্রতিই আগ্রহ বেশি। যেসব শারীরিক প্রকৃয়া চিন্তা এবং অনুভূতির জন্য কাজ করে, এবং আমাদের দৃষ্টিকোন থেকে যেগুলো এদের সাহায্য করছে বলে মনে হয় । বিশুদ্ধ ও বাস্তব জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে সেটা নাও হতে পারে। স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে নাড়াচাড়া, একটা নির্দিষ্ট শারীরিক প্রকৃয়ার সাথে জড়িত বিষয়গুলোকে গুলো কে আলাদা করতে সাহায্য করবে। যদিও আমরা এ ধরনের ঘটনার সত্যিকার প্রকৃতি সম্পর্কে কিছুই জানিনা। তবে, আমি মনে করি এটা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং মানুষের চিন্তা , দুটোরই সীমার বাহিরে। এই অবস্থায় আমরা একটি প্রশ্নের মুখোমুখীঃ কেন আমদের মগজের মত একটি অংগ, যার সাথে স্নায়ুতন্ত্র সংযুক্ত, তাতে উন্নত চিন্তার সাথে জড়িত শারীরিক প্রকৃয়াগুলো নিয়ন্ত্রনের জন্য এতগুলো পরমাণু প্রয়োজন? কি কারনে এই অংগটি আংশিক বা সম্পুর্নরূপে পরিবেশের সাথে যুক্ত থাকার পরও, একটি পরমাণু দিয়ে প্রভাবিত এবং এই প্রভাব স্মৃতিবদ্ধ করতে পারেনা? এর কারনঃ প্রথমত, যাকে আমরা চিন্তা বলি, তাকে কিছু নিয়ম মেনে চলা লাগে; দ্বিতীয়তঃ আমরা শুধু কোন বস্তু সম্পর্কেই চিন্তা বা স্মৃতি ধরে রাখতে পারি। তাহলে, অনুমান বা অভিজ্ঞতা এদেরও কিছু নিয়ম আছে । এর দুটো ফলাফল রয়েছে, ১.যেই শারীরিক ব্যাবস্থা চিন্তার সাথে গভীরভাবে জড়িত(যেমন আমাদের মগজ), তাকে সুবিন্নস্ত ভাবে থাকতে হবে । অর্থাৎ, এতে যে ঘটনা গুলো ঘটে তাকে পদার্থের সূত্রগুলো শক্তভাবে মেনে চলতে হবে। অন্তত, উচ্চ মাত্রার সঠিকতার সাথে। ২. এই শারীরিক ভাবে সুবিন্নস্ত ব্যাবস্থা, বাহিরের বস্তুর প্রভাবে যে প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা অবশ্যই সংশিষ্ট বস্তুর সাথে জড়িত অনুমান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে হবে। তাই, আমাদের শরীর এবং অন্যান্য বস্তুর মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাঝে অবশ্যই বেশ কিছু নিয়ম কানুন বিদ্যমান, তার মানে এদের পদার্থের সূত্রগুলো শক্তভাবে মেনে চলতে হবে, অন্তত, উচ্চ মাত্রার সঠিকতার সাথে।
পদার্থের সূত্রগুলো পারমাণবিক পরিসংখ্যানের উপর নির্ভর করে এবং এরা শুধুই আসন্নঃ
এবং কেন এসব সম্পন্ন হবেনা যদি জীবসত্বা নির্দিষ্ট সংখ্যক পরমাণু দিয়ে গঠিত হয় এবং একটি বা অল্প সংখ্যক পরমাণুর আঘাতেই প্রতিক্রিয়াশীল হয়? কারন, প্রতিটা পরমাণুই সবসময় সম্পুর্ন বিশৃংখল তাপীয় গতির মধ্যে থাকে, যা তাদের সুশৃংখল আচরনের বিপরীত এবং অল্প সংখ্যক পরমাণুর মধ্যেকার ঘটনাগুলো থেকে কোন সূত্রই প্রতীয়মান হয়না। শুধুমাত্র যখন বিশাল একটা সংখ্যার পরমাণু একসাথে কাজ করে তখনই পরিসংখ্যানিক ভাবে দেখা যায় সূত্রগুলো কাজ করতে শুরু করেছে, এবং পরমাণুর সংখ্যার বৃদ্ধির সাথে সাথে এর প্রভাব আরো স্পষ্টতর হয়। এর মাধ্যমেই ঘটনাগুলো সত্যিকার সুশৃংখল বৈশিষ্ট অর্জন করে। যেসকল পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নের সূত্রগুলোকে জীবসত্বার জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ন ধরা হয় তার প্রতিটিই পরিসংখ্যান ভিত্তিক; এর বাহিরে যেকোন ধরনের নিয়ম বা সূত্র যা কেউ ভাবতে পারে, সবসময়ই অস্থায়ী অথবা পরমাণুর অবিরাম তাপীয় গতির কারনে অচল প্রমাণিত।
যেকোন ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিলে অথবা সাজেশন থাকলে আন্তরিকভাবে উপকৃত হবে।
সময় করে পড়ব 😀
আচ্ছা