আহমদ ছফা খুবই প্রিয় একজন লেখক। নিম্নের লেখাটি ১৯৯৫ সালে লেখা হয়।
মহাভারতের একটি প্রসঙ্গ দিয়ে আমার কথা শুরু করি। একবার যুধিষ্ঠিরকে ধর্মরূপী বক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘জগতে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় কি?’
যুধিষ্ঠির জবাবে বলেছিলেন, সব মানুষ মরবে অথচ এ কথাটি সে ভুলে থাকে এটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়। যখনই ফারাক্কার কথাটা মনে জাগে, এ গল্পটির কথা মনে আসে।
আমাদের কারো জানতে বাকি নেই, ফারাক্কা ব্যারেজ বাংলাদেশের অর্ধেক এলাকা কারবালার মতো ধু-ধু মরুভূমিতে পরিণত করেছে। আমেরিকা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে যে ধ্বংসলীলার সৃষ্টি করেছিল, মানুষ মানুষের এতটা সর্বনাশ করতে পারে ইতিপূর্বের ইতিহাসে তার কোন নজির নেই। বিশ্ববিবেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই অপরাধের জন্য ধিক্কার জানিয়েছিল এবং এখনও ধিক্কার জানায়।
হিরোশিমা-নাগাসাকিতে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, আমাদের বাংলাদেশে প্রতিবছর সেই পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। প্রতিবছর এক-একটি হিরোশিমা-নাগাসাকি জন্ম নিচ্ছে। অথচ এখানে তার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। ফারাক্কার ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের জনগণের যে সচেতনতা থাকা দরকার ছিল তার শতাংশের একাংশও নেই। ফারাক্কাকে সবগুলো রাজনৈতিক দল মিলে একটা প্রধান জাতীয় সংকট হিসেবে শনাক্ত করতে পারেনি, এটা জাতীয় জীবনের এক বিরাট ব্যর্থতা। বর্তমানে ফারাক্কা সম্পর্কে যে যা-ই বলুক, সংকট মোকাবেলার সঙ্গে তার সম্পর্ক অত্যন্ত ক্ষীণ, একথা স্বীকার করতেই হবে।
বেগম জিয়াকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনার সরকার ফারাক্কা সমস্যার সমাধানে কি কি বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে – জবাবে বেগম জিয়া কি বলবেন অনুমান করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তিনি বলবেন, আমরা প্রশ্নটি আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপন করেছি। পৃথিবীর মানুষ জেনেছে ভারত আমাদের পানি দিচ্ছে না। আমাদের কর্তব্য আমরা করেছি।
খুব সম্ভবত আগামী নির্বাচনে বেগম জিয়ার দল তাঁর সাফল্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক ফোরামে ফারাক্কার প্রশ্ন উত্থাপনের বিষয়টি তুলে ধরে জনগণের কাছে আবেদন রাখবেন – আমরা ফারাক্কার জন্য লড়ছি। সুতরাং আমাদের ভোট দিন। এ ধরনের কৌশল ব্যবহার করে ভারত-বিরোধিতা উস্কে দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেষ্টা করবেন।
আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ নানা জায়গায় সভা-সমিতিতে ফারাক্কা প্রশ্নে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন এবং এই প্রশ্নে তাঁর দলের অবস্থান কোথায় ব্যাখ্যা করেছেন। তার সারসংক্ষেপ করলে ওই দাঁড়াবে – বর্তমান সরকার ভারতের কাছে দাসখত দিয়ে বসে আছে। অথচ পানির ব্যাপারে কোনকিছুই করতে পারেনি এবং ক্রমাগত জনগণকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ফোরামে তারা ফারাক্কা-প্রশ্ন উত্থাপন করা হলো সবচেয়ে বড় ধোঁকা। ফারাক্কা প্রশ্ন জাতিসংঘের আলোচনায় স্থান পেয়েছে তাতে করে আমাদের পদ্মা নদীতে পানির ঢল নামেনি। জনগণ যদি আগামী নির্বাচনে আমাদের ভোট দেয় এবং আমরা যদি বিজয়ী হই, ইনশা’ল্লাহ্ ভারতকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমাদের হিস্যাটুকু আমরা আনতে পারব।
জামাত নেতাদের প্রশ্ন করলে একই ধরনের রেডিমেড জবাব পাওয়া যাবে। তাঁরা বলবেন – বি.এন.পি ও আওয়ামী লীগের ঈমানের জোর নেই এবং মুসলিম জনগণের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা নেই। তাই তাঁরা ভারতবর্ষের হিন্দুনেতাদের কাছ থেকে কোনদিন পানি আনতে পারবেন না। জনগণ যদি আমাদের নির্বাচনে বিজয়ী করেন ইনশা’ল্লাহ্ আমরা পানি আনব – পদ্মা, মেঘনা, আড়িয়াল খাঁ সবগুলো নদীতে প্লাবন সৃষ্টি হয়ে যাবে।
ফারাক্কা প্রশ্নে আমদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর এ হলো অবস্থান। দুঃসাহসের মতো শোনাবে, তবু আমি বলব ফারাক্কা প্রশ্নে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যে অবস্থান গ্রহণ করেছে তা সংকট মোকাবেলার ব্যাপারে মোটেও সহায়ক নয়। আমি মনে করি আমাদের মেনে নেয়া উচিত, ভারত কোনদিন আমাদের পানি দেবে না। ফারাক্কা ব্যারেজ আমাদের অস্তিত্বের প্রতি একটা বিরাট ষড়যন্ত্র। ভারত ঠাণ্ডা মাথায় দাবার ছকের মতো ধীরেসুস্থে, বুঝেশুনে ষড়যন্ত্র বাস্তবে রূপায়িত করে তুলেছে।
জওহরলাল নেহেরুর সরকার যখন ফারাক্কার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল সেই সময়েই তারা একটা প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। পাছে তৎকালীন পাকিস্তানের তরফ থেকে কোনো বাধা এবং প্রতিবাদ আসে সে আশংকা করে তাঁরা বলেছিলেন – কলকাতা বন্দর চালু রাখার জন্য আমাদের পানির প্রয়োজন; তাই বাঁধ নির্মাণ করে অতিরিক্ত পানি ভাগীরথী খাত দিয়ে প্রবাহিত না করালে কলকাতা বন্দর বাঁচবে না।
কলকাতা বন্দর বাঁচানোর ধুয়াটি তোলারও একটি বিশেষ কারণ ছিল। পশ্চিম বাংলার জনগণ ফারাক্কার কারণে ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন, এরকম প্রবল মত সেই সময়ে পশ্চিম বাংলার সচেতন মানুষদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল। পশ্চিম বাংলার মানুষ যদি বাধা দিতেন তাহলে দিল্লীর শাসকেরা গঙ্গার উজানে বাঁধ তৈরি করতে সক্ষম হত না। পশ্চিম বাংলার লোকদের ভুলিয়ে রাখার জন্য ভারতীয় শাসকেরা একটা স্তোকবাক্য আবিষ্কার করেছিলেন। আর সেটা হলো এই, ‘আমরা পশ্চিম বঙ্গবাসীর স্বার্থেই এই ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করতে যাচ্ছি।’
পশ্চিম বাংলার মানুষ একথা বিশ্বাসও করেছিলেন। তাই এ নিয়ে বিশেষ কোন উচ্চবাচ্য করেননি। যে সমস্ত ব্যক্তি বিজ্ঞান এবং পরিবেশগত যুক্তির কথা উত্থাপন করে এই বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতা করেছিলেন, ভারত সরকার অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে তাঁদের মতামত চেপে রাখতে বাধ্য করেছিল। প্রসঙ্গত প্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্যের কথাটি উল্লেখ করা যায়।
এই ভদ্রলোক ছিলেন ফারাক্কা ব্যারেজের প্রধান স্থপতি। ভারত সরকার তাঁকে স্থপতি হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। কপিল বাবু সব ঘেঁটে-ঘুঁটে যখন বুঝতে সক্ষম হলেন যে, এই বাঁধ পশ্চিম বাংলার মানুষের উপকারে আসবে না, বরঞ্চ তাঁদের একটা সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে ছুঁড়ে দেবে; তখন সবকিছু ব্যাখ্যা করে তিনি একটা পুস্তিকা প্রকাশ করলেন। ভারত সরকার তাঁকে ধরে জেলে পুরে দিল এবং বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটক করে রাখল। কপিল ভট্টাচার্যের মতামত জনসাধারণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে এই সন্দেহ করে দেয়ালে দেয়ালে প্রচারপত্র সেঁটে দিল ফারাক্কার ব্যাপারে, যে কেউ গুজব ছড়াবে তাকে কঠোর দণ্ড ভোগ করতে হবে। আসলে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করার উদ্দেশ্যটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নরকম।
ভারত তার কৃষিব্যবস্থা উন্নত করার জন্য ন্যাশনাল ওয়াটার গ্রিড তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছিল তলে-তলে। সেটা গোপন রেখে কলকাতা বন্দর চালু রাখার কথা বলে পরিকল্পনাকারীরা পশ্চিম বাংলার জনগণকে সম্পূর্ণরূপে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছিল।
ফারাক্কা ব্যারেজ চালু হওয়ার পরও পশ্চিম বাংলার লোক উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন কলকাতা বন্দর আস্তে আস্তে মারা যাবে। ফারাক্কা তাতে নতুন প্রাণসঞ্চার করতে পারবে না। কলকাতাকে বাঁচাবার জন্য ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। সংকটের চেহারাটা তখনই তাঁরা আঁচ করতে চেষ্টা করলেন যখন জানতে পারলেন কেন্দ্রীয় সরকার কানপুরের তেহরীতে গঙ্গা নদীর ওপর আরো একটা বাঁধ নির্মাণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন।
গঙ্গার পানিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার অভিপ্রায় থেকেই তাঁরা প্রথম ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করেছিলেন। তার একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত আছে। এই রচনায় সেটিও বলার চেষ্টা করব।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার গঙ্গার ওপর দ্বিতীয় বাঁধটি নির্মাণের যে সিদ্ধান্ত নিলেন, অনেকে মনে করেন তাতে ভারতের হিন্দী বলয়ের শাসকগোষ্ঠীর একটা বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। বর্তমানে ভারত রাষ্ট্রের জোড়াগুলো কাঁপছে। কাশ্মীরীরা স্বাধীনতা-সংগ্রাম করছে। পাঞ্জাবী শিখরা বিক্ষুব্ধ এবং পশ্চিম বাংলা হলো ভারতের ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোর দুর্বলতম অংশ। অনুকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে পশ্চিম বাংলা ভিন্ন চিন্তা করতে পারে। সে কথা আগাম চিন্তা করে হিন্দী বলয়ের কর্তারা তেহরীতে আরেকটি বাঁধ নির্মাণ করে গঙ্গা নদীর পানির ওপর একচ্ছত্র অধিকার অর্জন করতে চান। যদি সেরকম কোনো সম্ভাবনা দেখা দেয় তাহলে তাঁরা গঙ্গাকে ভারত ও বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়তে দেবে না। তাঁরা গঙ্গার সঙ্গে গোদাবরী কিংবা নর্মদা যে সকল নদী আরব সাগরে গিয়ে পড়েছে তার একটার সঙ্গে জোড় বেঁধে দেবেন। এগুলো আমার নিজের কথা নয়। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিজের জবানিতে প্রকাশ করলাম মাত্র।
ফারাক্কা ষড়যন্ত্রের একটি যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত আছে সে বিষয়ে দু’চার কথা বলতে চাই। গঙ্গা পূর্বে ভাগীরথীর খাত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ত। এটা খুব বেশিদিনের কথা নয়। একটা সময় প্রবল জলপ্লাবনের তোড়ে ভাগীরথীর খাত ছেড়ে দিয়ে পদ্মা নতুন খাত দিয়ে বইতে থাকে। এই নতুন খাতটি সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে বর্তমানে যে অঞ্চলটিকে বাংলাদেশ বলা হয় তার কৃষি, শিল্প এবং বাণিজ্যের সমৃদ্ধি ঘটতে থাকে। এই অঞ্চলে আগে তুলনামূলকভাবে কম মানুষ বাস করত। গঙ্গা প্রবাহ পদ্মা নদী দিয়েই প্রবাহিত হওয়ার কারণে যে উর্বরতা বৃদ্ধি পায় তাই-ই দলে দলে মানুষকে এখানে বসতি স্থাপন করতে অনুপ্রাণিত করেছে। পদ্মা নদীর কারণে এই অঞ্চলে নগর এবং জনপদ সৃষ্টি হয়েছে। ফল-ফসলে-প্রাচুর্যে জীবন শান্তিময় হয়ে উঠেছে। ঐতিহাসিকেরা বলেন, গঙ্গা যদি খাত পরিবর্তন না করত মোঘল আমলে বাঙলা দেশ যে সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল তা কখনো সম্ভব হত না। গঙ্গার খাত পরিবর্তন করার কারণেই কৃষিজীবী মানুষেরা জীবিকার নিশ্চিন্ত অবলম্বন খুঁজে পেয়েছিলেন এবং কৃষিজীবী মানুষের মধ্যে প্রচারিত হয়ে ইসলাম ধর্ম ব্যাপ্তি এবং প্রসার লাভ করেছে। ইতিহাসের নানা পর্যায়ের কথা বলে লাভ নেই। আসল কথা হলো আজকে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সূক্ষভাবে বিচার করলে তার পেছনে পদ্মা নদীর ভূমিকা সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী হতে পেরেছে। মানুষের ইতিহাসের ভাঙ্গাগড়ার ব্যাপারে নিসর্গ একটি বড় ভূমিকা পালন করে, সেকথা নতুন করে বলে লাভ নেই।
ভারতের কর্তাব্যক্তিরা ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করার সময় গঙ্গার এই খাত পরিবর্তনটির কথা মনে করেছিলেন কিনা বলার উপায় নেই। তবে তাঁদের বাস্তব কাজ প্রমাণ করেছে, তাঁরা সেই খাতটি রুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। পদ্মা নদী বাংলাদেশের প্রাণপ্রবাহের প্রতীক। পদ্মার অপমৃত্যু বাংলাদেশের অপমৃত্যু ডেকে আনবে।
‘স্বাধীন বাংলা’ পত্রিকায় ‘ ইসলামাবাদের শয়তান দিল্লীর ঘাড়ে ভর করেছে’ এই শিরোনামে একটি নিবন্ধে খ্যাতিমান লেখক এবং কবি জ্যোতির্ময় দত্ত লিখেছে, পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর বদ্বীপরূপে প্রকৃতি গড়েছিল বাঙলাকে। একা নীলনদের দান মিশর। কিন্তু বহু নদনদীতে নদীময় বাঙলা। সুরমা, পদ্মা, মেঘনা, বিশালাক্ষ্মী, আড়িয়াল খাঁ, কপোতাক্ষ, রূপসা, ভৈরব, রায়মঙ্গল, ইছামতী, গঙ্গা, ভাগীরথী নদী জপমালাধৃত শস্য-শ্যামল সমতল প্রান্তর। এমন করে বাঙলাকে গড়েছিল বিধি, কিন্তু দিল্লীর ধারণা বিধির বিধান ভাঙতে সে সমর্থ হবে। ইয়াহিয়া খানের কাঁধে যে শয়তান একদা ভর করেছিল সেই শয়তান এখন দিল্লীর সুলতানের ঘাড়ে ঘাঁটি গেড়েছে। পূর্ব-পাকিস্তানের ওপর উর্দু চাপানোর চক্রান্তের চেয়েও শয়তানী ষড়যন্ত্র দিল্লীর। উপমহাদেশের মতিভ্রষ্ট নতুন তুঘলকেরা সারা বাঙলাকে রাজস্থান কি বেলুচিস্তানের মরুভূমিতে পরিণত করতে চায়। প্রথমে ফারাক্কা, এখন তেহরী। বাঁধ মাত্রেরই আমরা বিপক্ষে, বাঁধ প্রবাহের বিকৃতি। আজ যদি রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় পদ্মার অপমৃত্যু দেখতেন, শুধু প্রতীকী অর্থে নয়, ফারাক্কার দিকে রোষদৃষ্টি নিক্ষেপ করে গর্জে উঠতেন – ‘বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, ভাঙো।’ আমরা এখানে শুধু জ্যোতির্ময় বাবুর লেখা প্রবন্ধের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করলাম।
আমাদের জানামতে পশ্চিম বাংলায় এ পর্যন্ত ফারাক্কার অভিশাপকে উপজীব্য করে কম হলেও ছয়টি উপন্যাস রচিত হয়েছে। আমাদের দেশের শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে তার কোন প্রতিক্রিয়া নেই কেন? পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় কোনরকম অমানবিক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হলে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা একজোট হয়ে প্রতিবাদ করেন, কাগজপত্রে বিবৃতি দেন, সভা-সমিতির আয়োজন করেন। অথচ চোখের সামনে নিষ্ঠুর ঘটনাটি ঘটছে আমাদের লেখক, কবি, শিক্ষক, সাংবাদিক এবং আইনজীবীদের মধ্যে তার কোনো সাড়া নেই কেন? আমি তাঁদের ওপর কটাক্ষ করে কিছু বলতে চাইনে, কিন্তু ফারাক্কা সংকটটি এমন ভয়াবহ যে, সেটা কারো অবহেলার বিষয় হতে পারে না।
ধরে নিলাম ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এখন ভালো নেই, তাই ভারত পানি বন্ধ করে রেখেছে। কোনো ভারত-প্রেমিক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে আমাদের প্রাপ্য পানি ছাড় দেবে বিশ্বাস করার কোনো কারণও নেই। ভারতের কাবেরী নদীর পানি নিয়ে অন্ধ্র এবং কর্নাটকের মধ্যে যে বিরোধ চলছে, তার প্রতিবাদ করে কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা পনেরো দিন অনশন ধর্মঘট করেছে। পনেরো দিন না খাওয়ার ফলে মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার শরীরের বাড়তি মেদ কমেছে একথা সত্য বটে, কিন্তু কর্নাটকের মানুষ পানি পায়নি। সুতরাং ধরে নেয়া উচিত বন্ধু হোক শত্রু হোক, ভারত আমাদের পানি দেবে না। আমাদের বিকল্প ব্যবস্থার কথা চিন্তা করতে হবে।
ফারাক্কার ফাঁড়া তো রয়েছে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো, ভারত অন্য নদীগুলোর পানিও প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য ক্রমাগত বাঁধ নির্মাণ করে যাচ্ছে। মরুকরণ প্রক্রিয়াটি শুধু উত্তরবঙ্গে সীমাবদ্ধ থাকছে না। অনতি ভবিষ্যতে গোটা বাংলাদেশ রাজস্থানের মতো মরুভূমি হয়ে উঠবে। গঙ্গার পানি নিয়ে গেছে, এখন যমুনা এবং ব্রহ্মপুত্রের পানির দিকে হাত বাড়িয়েছে। দু’দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত চুয়ান্নটি নদ-নদী কোনটার পানি খরার সময় বাংলাদেশে আসতে দেবে না। আমাদের কৃষকের ক্ষেতের পানি টেনে নিয়ে রাজস্থানের মরুভূমিকে শস্য-শ্যামল করে তুলছে ভারত। আর আমাদেরকে উপহার দিচ্ছে চমৎকার সুন্দর চকচকে ধূলিতপ্ত এক-একখানি মরুভূমি।
আমি নিজেকেই প্রশ্ন করি, ভারত আমাদের নিয়ে কি করতে চায়? জাতি হিসেবে আমাদের অপরাধ কি এতই বেশী যে, ভারত এরকম একটি চরম দণ্ড আমাদের দেবে! আমাদের কৃষক, আমাদের প্রকৃতি, আমাদের পশু-পাখি, এদের অপরাধ কি? ভারত কেন এদের সবকিছুকে জ্বলন্ত আগুনে সিদ্ধ করার ব্যবস্থা পাকা করছে? একটি বন্ধুপ্রতিম জনগোষ্ঠী আরেকটি বন্ধুপ্রতিম জনগোষ্ঠীর ওপর এরকম সমূহ-সর্বনাশ সাধনের ষড়যন্ত্র কোথাও করছে, এমন ইতিহাস আমাদের জানা নেই। আমরা কিছু করছি না কেন? ভারত পানি প্রত্যাহার করে আমাদের শাস্তি দিতে চায়, তাদের যদি দয়া-অনুকম্পা না হয় কিছু তো করার উপায় নেই। কেউ তো মোষের শিং থেকে টেনে দুধ বার করতে পারে না। ভারতও আমাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করবে – এটা মেনে নিয়ে আমাদের বিকল্প ব্যবস্থার কথা চিন্তা করতে হবে। আমরা যদি সব ব্যাপার বিশ্বসমাজের সামনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে না পারি, বিশ্বসমাজ আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে কেন? যে শিশু কাঁদে না সে তো দুধ পায় না। আসন্ন সর্বনাশের মুখে আমাদের জাতির মর্মতল ভেদ করা সেই অন্তরস্পর্শী কান্না কোথায়? কোথায় বারো কোটি জনগণের নিবিড় ঐক্য?
আমরা ধরে নিয়েছি ভারত সূক্ষ মারপ্যাঁচে আমাদেরকে জাতি হিসেবে চিত করে ফেলেছে। আমরা তার কবল থেকে কোনদিন উঠে দাঁড়াতে পারব না, এটা কোনদিনই সত্য হতে পারে না। শিশুর যেমন মায়ের দুধে অধিকার, পানিতে আমাদের জনগণের সেরকম অধিকার। ক্ষমতান্ধ রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের জনগণের মানবিক দাবীকে জাতীয় দাবীতে পরিণত করতে পারছে না, এখানেই আমাদের বেদনা। কেউ বলছেন, আমরা ব্যাঘ্র প্রতিবেশীর সঙ্গে বসবাস করছি। বাঘকে ‘বড় মামা’ সম্বোধন করে তার মনে দয়া সৃষ্টি করা ছাড়া আমাদের আর করণীয় কিছু থাকতে পারে না। এগুলো কি মানুষের মতো কথা?
অসাধারণ একটা লেখা। আমার মত দেশ-দশ নিয়ে অসচেতন মানুষদের জন্যও চিন্তা জাগানোর মত। ব্যাঘ্র প্রতিবেশীর সাথে আমাদের সম্পর্কের কোন পরিবর্তনই নেই এতগুলো বছর পরেও। দুঃখজনক সত্যিই।
যাই হোক। পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল এই লেখা পড়তে গিয়ে।
একটানে পড়ে গেলাম, এত অসাধারণ করে উপস্থাপন করেছেন উনি। পঁচানব্বই সালের লেখা বোঝার উপায় নাই। কারণ এখনও আমরা সেই জায়গায়ই দাঁড়িয়ে আছি, বরং আরও নিচে নেমে গেছি। ভারত ব্যাঘ্র থেকে কবে রক্ষা হবে, মানুষ কবে সচেতন হবে কে জানে। আসলেই চিত হয়ে শুয়ে আছে বাংলাদেশ, উপরে ভারতমাতার পদযুগল। 🙁