ফেইসবুকগ্রস্ততার মনস্তত্ত্ব: মিলেনিয়াল প্রজন্মের দ্বিতীয় জীবন (পর্ব ২/২)

দ্বৈরথে দ্বিচারণ!

অনলাইনের এই নতুন সত্ত্বাকে সাজানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে নিজের অজান্তেই চলে আসে দ্বৈততা; খুব খারাপ একটা দিন কাটিয়ে ফেইসবুকে এসে হয়তো মজার কিছু শেয়ার করলাম, কারও লাইক কিংবা মন্তব্য মনটাকে চাগিয়ে তুলবে এমন আশা মনে নিয়ে। একই সাথে হয়তো তর্ক করছি অনলাইনে একজনের সাথে, আরেক জায়গায় ছবি নিয়ে ফুর্তিবাজ কমেন্ট বিনিময় করছি বন্ধুদের সাথে। হয় না এমন? আমরা যদি আসলেই পরিবার আর বন্ধুদের সাথে পার্টি কিংবা ভ্রমণ কিংবা রোমাঞ্চকর সব কাজে ব্যস্ত থাকি তাহলে ফেইসবুকের জন্য কতটা সময় বরাদ্দ থাকার কথা আসলে? ব্যস্ত সময়ের ফাঁকে এসেও আমরা অনেকে এই দ্বিতীয় জীবন গড়ে যাই একটু একটু করে- সত্য, কিন্তু অনেকের এই আপাত-সুখী জীবন কেবল ফেইসবুকের পাতাতেই সীমাবদ্ধ। এক জরিপে দেখা গেছে, অনলাইনে যে যত বেশি সময় নিয়ে সামাজিকতা রক্ষা করেন (কারণটা বিনোদন হোক কি অন্য কিছু), বাস্তবে সমাজ থেকে তিনি ততটাই বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেন, আশেপাশের মানুষের সাথে যোগাযোগ ততটাই কমে যায়। ‘অনলাইনভিত্তিক’ প্রেম করেন এমন মানুষদের মধ্যে একই সাথে চিন্তাশক্তি আর আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিও দেখা গেছে আরেক জরিপে। ব্যতিক্রম তো আছেই।

বাস্তবজীবনে অনেক কাঙ্ক্ষিত অপ্রাপ্তিগুলো অনলাইনে নিজের দ্বিতীয় সত্ত্বায় আরোপ করি আমরা অনেকেই। যেমন জনপ্রিয়তা চাই কিন্তু কোন কারণে কখনও পাই নি, এমন মানুষও তুলনামূলকভাবে অনেক কম চেষ্টাতেই এখানে সেলিব্রিটি বনে যেতে পারি। একটা ঘটনার দিকে তাকানো যাক। ভালবাসার কোন সম্পর্কই টেকে না বলে মানসিকভাবে খুব দুর্বল এক ভদ্রমহিলা একবার মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে অনলাইনে জীবনসঙ্গী খোঁজার চেষ্টা করলেন। আনকোরা নতুন একটা প্রোফাইল খুললেন তিনি, যেখানে খোদ নামটাও বদলে দিলেন নিজের। পেশায় শিক্ষিকা এই নারী বাস্তবে চোস্ত ভাষায় কথা বললেও অনলাইনে তার ভাষা বদলে গেল স্ল্যাং আর ইমোটিকনের আতিশয্যে। সুবেশী মানুষটা নিজের এমন সব খোলামেলা ছবি শেয়ার করতে শুরু করলেন সেখানে, যার সাথে তার বাস্তব বেশভূষার তেমন মিলও নেই। এক কথায় জীবনে তিনি যা কিছু হতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেন নি, অন্যের চোখে আকর্ষণীয়া হবার এমন সব উপাদানই ঢুকিয়ে দিলেন নতুন ‘সত্ত্বা’য়। যাই হোক, এত সব চেষ্টার ফলে তার সম্পর্ক হলও একজনের সাথে, এবং কিছুদিন পর অবধারিতভাবে দেখাও করলেন তারা। মজার কিংবা আশঙ্কার ব্যাপার যেটাই হোক, দেখা গেল সেই ব্যক্তিও অনলাইনে নিজের এমন এক ছবি এঁকেছিলেন যার সাথে তার আসল ব্যক্তিত্বের আকাশ-পাতাল তফাৎ- ফলশ্রুতিতে সেটা ছিল একই সাথে তাদের প্রথম এবং শেষ দেখা।

হীরক রাজার দেশে

“We all wear masks, & the time comes when we cannot remove it without removing some of our own skin.” – ফেইসবুকে আমাদের এরকম স্ববিরোধী কাজকর্মের পেছনে একটা বড় কারণ, বাস্তবজীবনের মত এখানে কাজের জবাবদিহিতা কিংবা ঝুঁকি নেই। মানুষের সাথে মিশতে গেলে সেখানে তাকে মুগ্ধ করতে পারা-না পারার শঙ্কা থাকে, ভুল কথা বলে ফেলে কষ্ট দেওয়ার কিংবা তার আচরণে কষ্ট পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, থাকে নিজের অসাবধান বোকা কাজে লজ্জা পাওয়ার অথবা বিব্রত হওয়ার ভয়। অনলাইনে নতুন মানুষদের সাথে বন্ধুত্বে সে সম্ভাবনা কম, যেহেতু আমাদের আচরণ সেখানে অনেকটাই হিসেব-করা। এতে করে সম্পর্ক ঝুঁকিমুক্ত থাকে হয়তো অনেকটাই, কিন্তু তাতে তৃপ্তি আর মানসিক শান্তি কতটা পাওয়া যায় অথবা সঙ্গীর চাহিদা আসলেই  কতখানি মেটে সেটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ যথেষ্ট। এমন কখনও হয় নি- আপনি অনলাইনে খুব তর্ক করলেন কারও সাথে, কিংবা কেউ কারণ ছাড়াই খুব রুক্ষ ব্যবহার করলো, কিন্তু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তার সাথে আপনার সামনাসামনি এ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না? ফেইসবুকের নিরুদ্বিগ্ন তর্ক বাস্তব রূপ নিতে চাইলেই স্বাভাবিক যত অনুভূতি (হেরে যাওয়ার ভয়/প্রিয়জনকে আঘাত দেওয়ার আশঙ্কা) সব একসাথে এসে জেঁকে ধরে নি?

মানুষের পশুসত্ত্বা থেকে ব্যক্তিসত্ত্বায় উন্নীত হওয়ার একমাত্র পথ হল অন্যদের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে তোলা আর নিজের কাজকর্মের দায়ভার নিজেকেই নেয়া- দার্শনিক হেগেল এমনটাই বলেন। আমাদের জীবন আর ব্যক্তিত্ব সার্থক হয় অন্যের স্বীকৃতিতে- সমাজকে যত গালই দিই না কেন, এই সমাজের মানুষগুলোর স্বীকৃতি ছাড়া আমাদের যে কোন কাজই যে কতটুকু অর্থ বহন করে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ।

কিন্তু ফেইসবুক দুনিয়ার কথা স্বতন্ত্র- নিজের কথার দায়ভার নেওয়া কিংবা জবাবদিহিতা তেমন গুরুত্ব রাখে না এখানে; যে কারণে অনলাইনে দিনকে দিন প্রকট হচ্ছে গালাগাল, তর্কবিতর্ক আর হুজুগের বশে বড়সড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার প্রবণতা। নিজের অসম্ভবতম ইচ্ছাগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চমৎকার সুযোগও মেলে ফেইসবুকে। দেখা গেছে, অনেক বিবাহিত মানুষই কোনদিনও-দেখা-না-হওয়া কারও সাথে চুটিয়ে প্রেম করছেন অনলাইনে, যদিও বাস্তব পরকীয়ার মত অন্তর্দহন সেখানে অনুপস্থিত। যন্ত্রের ভেতর দিয়ে চালিয়ে যাওয়া অনৈতিক সম্পর্কে আশ্চর্যজনকভাবেই আমাদের বিবেক কাজ করে না, নিজের সত্যিকারের জীবনসঙ্গীর প্রতি কোন রকম অপরাধবোধও জন্ম নেয় না। এখানে স্মরণ করা যায় এক গবেষণায় অংশ নেয়া অ্যালেক্সের কথা, যে অনলাইনে নতুন সঙ্গিনীকে খুঁজে পেয়ে নিজের প্রেমিকাকে ভুলে গেছে। এবং তাকে এক মনস্তাত্ত্বিক এই সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে বলায় তারপর থেকে সে তাঁর সাথে যোগাযোগই বন্ধ করে দেয়।

তুমি আর নেই সে তুমি!

ফেইসবুক এবং বড় পরিসরে পুরো অনলাইন জগতের সবচেয়ে ভয়াল প্রভাব বোধ হয় পড়েছে মানুষের দাম্পত্য কিংবা ভালবাসার সম্পর্কেই, যা কিনা আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী আবেগের জায়গাও। কেবল প্রতারণাই নয়, অনলাইনে যারা প্রেম করেন তারা অনেক সময় সঙ্গীর সাথে এমন সব বাক্য বিনিময় করেন যেটা বাস্তবে কখনোই করতেন না। এখানে মেয়েরা প্রেমিককে এমন সব ছবি দেখাচ্ছেন যেটা অফলাইনে দেখানোর কথা ভাবতেই পারেন নি কখনো- এক জরিপে অংশ নেয়া ২২% মেয়ের বক্তব্যও তাই বলে। আর এ ধরনের কাজ যারা করেন, তাদের বেশিরভাগের বয়সই ২০ থেকে ৩০এর ভেতর, অর্থাৎ অপার সম্ভাবনার তরুণ প্রজন্ম।

এই উদ্ভট ‘ভার্চুয়াল রিয়েলিটি’ই সেই বস্তু যার কারণে দারুণ সময়ানুবর্তী মানুষও অনলাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন এখন নিজের অজান্তেই, এবং কোন দরকারি কাজ ছাড়াই। জরিপে অংশ নেয়া এক নারী জানান, কেনাকাটায় তার আগে তেমন আগ্রহ না থাকলেও আজকাল অনলাইনে শপিং করতে ঢুকলে তিনি মোটামুটি মোহগ্রস্তের মত আচরণ করেন, প্রচুর অর্থ খরচ করেন দরকারি-অদরকারি পণ্য কিনতে গিয়ে। নিজের এমন আচরণের কারণ কী হতে পারে সে কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোবাইলে কিংবা কম্পিউটারের সামনে বসে কিছু কিনতে গেলে সেটাকে ঠিক ‘বাস্তব’ মনে হয় না, বাস্তবে বাজারে গেলে যেমন মাথায় হিসাব-নিকাশ চলতে থাকে তেমনটা হয় না। এমন মানুষও আছেন যিনি বাজারে গেলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছুর দিকে ফিরেও তাকান না, অথচ ফেইসবুকের ব্যবসাসংক্রান্ত পেইজগুলোতে নিয়মিত পণ্যের ছবি দেখে বেড়ান (যাকে বলে ‘উইন্ডো শপিং’)। আরেকজন লোক অনলাইনে ক্যাসিনো খেলতে গিয়ে এমনই বুঁদ হয়ে গিয়েছিলেন যে নিজের ক্রেডিট কার্ড তো বটেই, সাথে স্ত্রীর ক্রেডিট কার্ডও খুইয়ে দেনার দায়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন – তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে এজন্য স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলেও গেছেন। তিনিও প্রায় একই কথা জানিয়েছেন– অফলাইনে এমন কোন কাজ করার আগে যেমন দায়িত্ববোধ কিংবা আইনের চোখরাঙানির কথা মনে পড়ে তার, অনলাইনে সেই বোধ প্রায় নিস্তেজ থাকে।

একজন মনস্তাত্ত্বিক আমাদের ওপর ফেইসবুকের এই প্রভাবকে তুলনা করেছেন অনেকটা পর্নোগ্রাফির প্রভাবের মতই। পর্নোগ্রাফি যেমন মানুষকে জবাবদিহিতা কিংবা বিপদের কোন সম্ভাবনা ছাড়াই ক্ষণকালীন সুখের উপায় করে দেয়, কিন্তু তার খেসারত দিতে হয় পরে সত্যিকারের কোন মানুষকে ভালবাসতে গেলে (পর্নে আসক্ত মানুষ দাম্পত্য সম্পর্কে স্বাভাবিক হতে পারেন না সহজে)- ফেইসবুকও তেমনি আমাদেরকে অনেক সম্পর্কের জালে জড়িয়েও অন্তরঙ্গ সম্পর্কগুলোকে সস্তা আর অগভীর করে তুলছে দিনকে দিন। ফেইসবুক আমাদের মধ্যে কাছে থাকার অনুভূতিই জাগায় কেবল, কিন্তু সেই কাছে আসায় বাস্তবের মত প্রত্যাশা থাকে না অপরপক্ষের কাছে, তাই আমাদের একাকীত্বও আর কাটে না। বিশেষজ্ঞরা জানান, ঠিক একই উপায়ে কাজ করে প্রচলিত পশ্চিমা সেক্স এডুকেশনের পদ্ধতিও।

ফেইসবুকের যে কোন বিতর্কিত পোস্টএর মন্তব্যের অংশে চোখ বোলালেই বোঝা যায়, আমরা এই জগতে কতটা অস্থির আর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠি। অফলাইনে যে কথাটা বলার আগে ১০ বার ভাবি, যে কাজ করার কথা ভাবতেও পারি না সেটাও অবলীলায় সম্ভব হয় এখানে। আমাদের স্বাভাবিক সভ্যতা-ভব্যতা, শিষ্টাচারের নিয়ম-কানুন ভুলে অন্য এক নগ্ন নোংরা সত্ত্বা প্রকাশ পায়, কিংবা নতুন করে তৈরি হয় এখানে। এই নব্য স্বভাবগুলো শুধু ‘ভার্চুয়াল’ জগতে সীমাবদ্ধ থাকলেও চলতো হয়তো, কিন্তু ধীরে ধীরে এসব জায়গা করে নিচ্ছে পর্দার বাইরের পৃথিবীতেও।

অনলাইনে অস্বাভাবিক নিষ্ঠুরতার উদাহরণ দেয়া যায় মায়া নামের মেয়েটার জীবন দিয়ে। প্রতিবেশীর মেয়েকে অপমান করায়, সেই প্রতিবেশী জশ নামের এক কাল্পনিক ছেলের প্রোফাইল তৈরি করে অনলাইনে, তারপর ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলে মায়ার সাথে, যেটা শেষমেশ প্রেম পর্যন্ত গড়ায়। কিছুদিন পর সেই কাল্পনিক চরিত্র মায়াকে এত প্রচণ্ডরকম অপমান-অপদস্থ করে যে শেষ পর্যন্ত মেয়েটা আত্মহত্যা করে। এই ঘটনার পর জশের প্রোফাইল থেকে সেই প্রতিবেশী মায়াকে এটা জানিয়ে মেসেজ পাঠায় যে তার মরে যাওয়াই উচিত ছিল।

আর কৌতূহলের ব্যাপার যেটা- স্ক্রীনের বাইরের পৃথিবীতে যেমন আমাদের কিছু সামাজিক আচারপ্রথা আছে, আছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নির্ধারিত সংজ্ঞা- অনলাইনে সেটা কেমন হবে? নতুন আচার যদি প্রয়োজন হয় তবে সেটা কীভাবে তৈরি হবে, কিংবা কে তৈরি করবেন? কেউ আমাদের ওয়ালে বাজে কিছু লিখলে ঠিক কী করবো আমরা? অনলাইনে আমাদের কোন বিব্রতকর ছবি কেউ প্রকাশ করলে কেমন জবাব দেব সেটার? বন্ধুর প্রেমের সম্পর্ক কিংবা বিয়ে ভেঙে গেলে তার প্রাক্তন সঙ্গীকে কি আমরা ‘বন্ধুতালিকা’ থেকে বাদ দিয়ে দেব? পরিচিত কেউ আমাদেরকে ‘বন্ধু হওয়ার অনুরোধ’ পাঠালে আর আমরা সেটা গ্রহণ না করলে, আর তারপর বাস্তবে তার সাথে দেখা হলে কেমন হবে দু’পক্ষের আচরণ?

বন্ধুমুখর দিনের শেষে

কোন মানুষের পাঁচজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে দেখে তাকে বিচার করার দিন আর নেই। কার্ল মার্ক্সের মতে, পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ পছন্দের পণ্যে এতটাই আসক্ত হয় যে এর দাস হয়ে পড়ে- তার সুখ-শান্তি-সাফল্য সবই নির্ধারণ করে পণ্য। প্রিয় জিনিসটা কিনে যেই অনুভূতি হয় তার নামই হয় সুখ, বাজারদরে বিকোয় আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা। ফেইসবুকের এই জগতেও আমাদের আবেগগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক না হয়ে বস্তুকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে, আমাদের আসক্তি বিশেষ মানুষদের কিংবা তাদের সাথে আমাদের সম্পর্কের প্রতি না- প্রাণহীন একটা মাধ্যমের প্রতি। একমাত্র জীবনটাকে একটা প্রাণহীন জিনিসের দিকে ফেরাতে গিয়ে, খোদ জীবনটাকেই হারিয়ে ফেলছি আমরা কোন এক ফাঁকে। লেখার শুরুর গল্পগুলোর মতন, এই জীবনে থেকেও একটা বিশাল সময় জুড়ে আমরা বাস করছি অন্য একটা জগতে, যার আসলে কোন অর্থপূর্ণ অস্তিত্বই নেই। ভূতুড়ে সময়গুলো কেড়ে নিচ্ছে পরিবারের সাথে বসে গল্পগুজব করা কিংবা একসাথে খাওয়ার মত অমূল্য সময়গুলো; পড়াশোনা করে সমাজের অথবা বাড়ির কাজ করে কাছের মানুষদের প্রতি দায়িত্ব পালনের সুযোগটা; বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা, বাসার সবাইকে রান্না করে খাওয়ানো কিংবা অন্য সব সখও হার মানছে ছোট্ট কম্পিউটারের ভেতরকার এই আশ্চর্য অদৃশ্য জগতের কাছে। যন্ত্র এসে জায়গা দখল করে নিচ্ছে রক্তমাংসের সম্পর্কগুলোর, আমাদের অজান্তেই।

কেবল বন্ধুত্বের সহজলভ্যতাই নয়, ফেইসবুক আমাদের এ কারণেও প্রিয় যে সে আমাদেরকে এই নশ্বর পৃথিবী থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও অন্য কোথাও পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। আবার অনলাইনে যা কিছু করা যায় তার সবটাকে একই প্ল্যাটফর্মেও নিয়ে আসে ফেইসবুক। পরিণাম: ওপরের প্রভাবগুলোর কোনটাই ফেইসবুক যাদের ওপর ফেলতে পারে নি, তারা বাদে বাকিদের মধ্যে দুটো দল তৈরি হচ্ছে- একদল ফেইসবুকের ক্ষতিগুলো বুঝতে পেরেও তা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেন নি বলে হতাশ-বিষণ্ন, আর অন্যরা পুরোপুরি নিজের ‘দ্বিতীয় সত্ত্বা’র মাঝে ডুবে গিয়ে পরিণত হচ্ছেন মানসিকভাবে কমবেশি অসুস্থ মানুষে।

তবে এর সমাধানের উপায় কী? ইন্টারনেট-ফেইসবুক সব ব্যবহার বন্ধ করে আবার আদিম যুগে ফিরে যাওয়া? কিন্তু ফেইসবুকের অবধারিত কিছু সুবিধাকেও তো অস্বীকার করা যাবে না- নির্বাচনী কিংবা ব্যবসায়িক অথবা বিশেষ মতাদর্শের প্রচারণা থেকে শুরু করে ক্লাসের প্রতিদিনকার তথ্যগুলো জানতে পারা আর সহজে, দ্রুত কাছের মানুষদের খোঁজ নিতে পারা; এমন কি আজকাল বিয়ের দাওয়াতও দেয়া হয় ফেইসবুকের মাধ্যমে! তৈরিকারকদেরকে দোষ দেয়া নয়, একটা উপায় হচ্ছে- এসবের ব্যবহার বন্ধ না করে বরং এমন শিক্ষার প্রচলন করা, যা আমাদেরকে সমালোচনা আর বিশ্লেষণের মনোভাব নিয়ে তাকাতে শেখাবে এসব মাধ্যমের দিকে। আমাদেরকে চাইতে শেখাবে সত্যিকারের অন্তর্দৃষ্টি আর বাস্তব অনুভূতির প্রতিফলন ঘটে এমন কিছু, সেই সাথে পার্থক্য বোঝাবে বাস্তব আর অনলাইন সম্পর্কের– জানাবে রক্তমাংসের সম্পর্কগুলো কেন মূল্যবান আর আমাদের বেঁচে থাকার জন্য কেন জরুরি সেটা। আমরা কেন ‘কষ্ট’ করে নিজের জীবন নিজেই যাপন করি, কেন আমাদের চাকরদেরকে বলি না কর্তার জীবনটাকেও যাপন করে দিতে- সাহিত্যিক ভিলিয়ে দো লিলাদঁ-এর মত আমরাও তখন এমন সব প্রশ্ন করতে, ভাবনা ভাবতে শিখবো। ফেইসবুক ব্যবহার যথেষ্ট আনন্দদায়ক- সন্দেহ নেই, কিন্তু এই দ্বিতীয় জীবনকে সাজানোর পেছনে ব্যয় করা সময়টাতে আমাদের প্রথম এবং একমাত্র জীবনকে একইরকম আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করাই কি বেশি কার্যকর হবে না?

অনেক মনস্তাত্ত্বিকই ফেইসবুক বিষয়ক আলোচনার পর জানিয়েছেন, তাদের কেউ হয়তো হোম পেইজে সব বন্ধুর খবর আনসাবস্ক্রাইব করে রাখেন, কেউ হয়তো ডিঅ্যাক্টিভেটেড হয়ে চিরতরে ছেড়েই এসেছেন ফেইসবুক, আরও নানান কিছু। আমরা অত ‘গোঁড়া’ হতে চাই না, শুধু অল্প কিছু চিন্তা করতে চাই। পরের বার ফেইসবুকে লগইন করবো যখন, একটু থেমে যেন ভেবে নিই আমরা কেন যাচ্ছি সেখানে। স্ট্যাটাস হোক কি কমেন্ট, যে কোন কিছু লেখার আগে যেন চিন্তা করি এই কথাটা ‘সত্যিকারের জীবনে’ মুখে উচ্চারণ করতে পারবো তো– হোক সে ভাল কোন কথা কি মন্দ, শিক্ষককে নিয়ে মন্তব্য কি ছাত্রকে নিয়ে, পাশের বাসার মেয়ে কিংবা প্রতিবেশীর আচরণ নিয়ে, ক্লাসের বন্ধু কিংবা বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মুখকে নিয়ে। তর্ক-বিতর্কে যেসব শব্দ উচ্চারণ করছি সেগুলো আমাকে কেউ বলতে শুনেছে তো আগে, নিজের কানে? কোন ছবি– সেটা নিজের হোক কি অন্যের– আপলোড  করার আগে যেন হিসেব কষে নিই এই ছবি অফলাইনে আমি কতজনকে দেখাতে চাইতাম; কাভার ফটোতে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া ছবিটা বাড়ির গেটে টাঙিয়ে রাখতে সমস্যা নেই তো আমার? সময় নিয়ে ফেইসবুক আর আমাদের দড়ি টানাটানির খেলায় নিজের এতদিনকার নিশ্চিত হারকে অনিশ্চিত করবো কীভাবে– দিনের শেষে একদম সব কাজ শেষ করে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য ফেইসবুকে উঁকি দেই যদি ঘুমোনোর আগে, একটু সময় কি বাঁচতে পারে? বন্ধুর সাথে মেসেজ আদান-প্রদানের ব্যস্ততায় মায়ের ডাকে সাড়া দিতে ভুলে যাই নি তো, একটু ভেবে দেখি। গত তিন মাসে ফোন করেছি তো একবারও সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে, নাহলে এক্ষুনি যেন দেই।

মানুষ মৃত্যুর দরজায় এক পা রেখে নাকি সবচেয়ে বেশি অনুশোচনা করে জীবনের যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে, তার ভেতর অন্যতম হল পরিবার আর বন্ধুদের সাথে যথেষ্ট সময় না কাটানো। জীবনে দারুণ সফল মানুষদেরকে তাদের সাফল্যের কারণ জিজ্ঞেস করলে সবচেয়ে বেশি যে কথাটা শোনা যায়, তা হচ্ছে কাছের মানুষদের সাথে তাদের চমৎকার সম্পর্ক। এই সম্পর্কগুলো যেন তার সব গৌরব নিয়ে আজীবন আমাদের সঙ্গ দিয়ে যায়, সেটা নিশ্চিত করার জন্যই প্রয়োজন নিজের অনলাইন আচরণকে পরিমিত রাখা– to connect and share with the people in our life

[দুই পর্বে সমাপ্য এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১২ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশ পাওয়া সরবের প্রথম বই ‘তারুণ্যের ২০ কুড়ি’তে।]

[পুনশ্চ: এই লেখার উদ্দেশ্য অতি অবশ্যই কাউকে হেয় করা নয়। ফেইসবুক ব্যবহার করেছেনকিন্তু ওপরের প্রভাবগুলোর একটারও স্বীকার নন কিংবা কখনও ছিলেন না– এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। লেখিকাও তার ব্যতিক্রম নন। যে কোন মানুষই কোন না কোনভাবে এই লেখার সাথে নিজেকে সংযোগ করতে পারবেনকেবল তা ভেবেই এ প্রসঙ্গের অবতারণা। লেখার অংশবিশেষ বিভিন্ন সূত্র থেকে অনূদিত কিংবা আংশিক রূপান্তরিতএবং যেসব ঘটনার উদাহরণ দেয়া হল সেগুলোর প্রতিটাই পুরোপুরি সত্য।

তথ্যসূত্র:

আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং স্কলার এবং ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ডের দর্শন বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর রজার স্ক্রুটনের প্রবন্ধ ‘Hiding Behind the Screen’

ইউনিভার্সিটি অফ কানেক্টিকাটস্ট্যামফোর্ডের শিক্ষক পিটার লোপাটিনের প্রবন্ধ‘Friendship Does Not Compute’

/ ‘দ্য নিউ আটলান্টিস’ জার্নালের সিনিয়র এডিটর এবং ‘ইথিক্স অ্যান্ড পাবলিক পলিসি সেন্টারএর ফেলো ক্রিস্টিন রোজেনের প্রবন্ধ ‘Virtual Friendship and the New Narcissism’

/  ইউনিভার্সিটি অফ নটরডেমের ছাত্র ব্রায়ান বয়েডের প্রবন্ধ ‘The Dotcomrade’

ইউনিভার্সিটি অফ নটরডেম থেকে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির পোস্টডক্টরাল ফেলো গোল অজিন সাঈদির প্রবন্ধ ‘Is Facebook the New Reality TV?’]

মনস্তত্ত্ব সিরিজের আগের দুটি পোস্ট:

সৌন্দর্যপ্রীতির মনস্তত্ত্ব: যদি ভালবাসতেই হয়…

ক্ষুণ্নিবৃত্তির মনস্তত্ত্ব

সামিরা সম্পর্কে

পীচ-গলা তরলে আটকে পা, দুঃস্বপ্ন অন্ধ দুই চোখে/ অসতর্ক হৃদয় পোষ মানে মিথ্যে বলার আফসোসে.../// প্রকাশিত লেখার কপিরাইট সংশ্লিষ্ট লেখক সংরক্ষণ করেন এবং লেখকের অনুমতি ছাড়া লেখা আংশিক বা পূর্ণভাবে কোন মিডিয়ায় পুন:প্রকাশ করা যাবে না।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চিন্তাভাবনা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

8 Responses to ফেইসবুকগ্রস্ততার মনস্তত্ত্ব: মিলেনিয়াল প্রজন্মের দ্বিতীয় জীবন (পর্ব ২/২)

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    স্বপ্ন দেখি একদিন এই সিরিজ এর নিজস্ব বই থাকবে! 😀
    চালিয়ে যাও

  2. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    এই লেখা নিয়া আর কী যে কমু ! কোপাকুপি অবস্থা ! সকলকে কোপাইয়া ফেলছে এই লেখা… :dhisya:

  3. একুয়া রেজিয়া বলেছেনঃ

    খাটনি দেওয়া পোস্ট।

    :huzur:

    তোমার অনুবাদ এবং মনস্তত্ত্ব নিয়ে লেখা পোস্টগুলো আমার বিশেষভাবে প্রিয়। লেখা চলুক- বই আসুক এই বিষয়গুলো নিয়ে।

    শুভ ব্লগিং।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।