“বাংলাদেশী ন্যানো-বিজ্ঞানী আয়েশা আরেফিন উদ্ভাবন করলেন কৃত্রিম মানব ফুসফুস! বাংলাদেশী বিজ্ঞানীদের বিজয় রথ এগিয়ে চলেছে। এবারের সাফল্য এসেছে একজন তরুণ নারী বিজ্ঞানীর হাত ধরে। আয়েশা আরেফিন টুম্পা ন্যানো-প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করেছেন কৃত্রিম মানব ফুসফুস। যে কারণে বিষয়টি আরও বেশি আনন্দের… … …”
বাংলাদেশের একজন নারী বৈজ্ঞানিক কৃত্রিম ফুসফুস আবিষ্কার করেছেন!
হ্যাঁ, ফেইসবুকে লগইন করলেই গত ক’দিন ধরে এমন একটা খবর দেখতে পাচ্ছি হোমপেইজে। বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা, ব্লগ সাইটে এই খবরটা প্রায় হুবহু একইভাবে পাওয়া যাচ্ছে আর ‘রাশি রাশি, ভারা ভারা’ উপায়ে চলছে শেয়ারিং, কমেন্টিং! অবশ্য এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক! যে দেশ নারী বৈজ্ঞানিকের সংখ্যা সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে কমের তালিকায় দ্বিতীয়, সেই দেশের একজন নারী এমন বিশাল একটা আবিষ্কার করে ফেলেছেন – নিঃসন্দেহে আমাদের জন্যে খুবই আনন্দের ব্যাপার এটা। বিষয়টা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, প্রশংসা হবে – এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
আচ্ছা, এই যে এত শেয়ার-কমেন্ট করছেন, একবার কি লস আলামস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির ওয়েব সাইটে গিয়ে দেখেছেন, আয়েশার এই আবিষ্কার সম্পর্কে সেখানে কি লেখা আছে? কীভাবেই বা করলেন তিনি এত বড় আবিষ্কারটি?
[আয়েশা আরেফিন লস আলামস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতেই গবেষণা করছেন]
আলোচনা-সমালোচনা, শেয়ারিং-কমেন্টিং যা ইচ্ছা করেন, এতে আমার কোন সমস্যা নাই। ‘কৃত্রিম মানব ফুসফুস আবিষ্কার করে ফেলেছেন’ বলে যে এত চেঁচাচ্ছেন, ব্যাপারটা আসলেই কি ঠিক এইরকম? এত সহজ??
মজার ব্যাপার হল, আয়েশার এই আবিষ্কার সম্পর্কে একটু পড়াশোনা করলে দেখা যাবে, তিনি আসলে ‘কৃত্রিম মানব ফুসফুস’ বা ‘artificial human lung’ আবিষ্কার তো করেনই নাই, তিনি যে গবেষণা করেছেন, তা থেকে এমন কিছু আবিষ্কৃত হবার কোন সম্ভাবনাও নাই!
আয়েশা ও তার দল মূলত গবেষণা করছিলেন ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পাল্মোনারি ডিজিজে আক্রান্ত ফুসফুসের কোষ কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে। তিনি চেষ্টা করছিলেন এর একটি প্রতিষেধক তৈরি করতে। এই গবেষণা করতে যেয়েই তিনি কোষীয়ভাবে মোটামুটি মানব ফুসফুসের একটি কৃত্রিম অবস্থা তৈরি করেছেন।
এখন প্রশ্ন হল, ‘কৃত্রিম মানব ফুসফুস আবিষ্কার’ আর ‘মানব ফুসফুসের একটি কৃত্রিম অবস্থা তৈরি’ – এ দু’য়ের মাঝে তফাতটা কোথায়?
‘কৃত্রিম মানব ফুসফুস আবিষ্কার’ – এর মানে হল, ল্যাবরেটরিতে মানুষের যে ফুসফুস আছে, হুবহু সেরকম একটি ফুসফুস তৈরি করে ফেলা। কোনভাবে কোন রোগীর ফুসফুস নষ্ট হয়ে গেলে একটা কৃত্রিম ফুসফুস নিয়ে লাগিয়ে দিলেই সেই রোগী একদম তরতাজা সেই ফুসফুস নিয়ে দিব্যি সুস্থ হয়ে যাবেন! সেই কৃত্রিম ফুসফুস দিয়ে তিনি একদম স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে থাকবেন!
‘মানব ফুসফুসের একটি কৃত্রিম অবস্থা তৈরি’ – এর মানে হল, এমন কিছু একটা তৈরি করা, যার গঠন অনেকটা ফুসফুসের মত। কিন্তু এটা ফুসফুসের কাজ কোনভাবেই করতে পারে না।
যদি ফুসফুসের কাজই করতে না পারে, তাহলে এটা তৈরি করে লাভটা হল কী?
ধরুন, আপনি নতুন একটা ওষুধ তৈরি করেছেন। আপনি মনে করছেন, এই ওষুধ দিয়ে ব্রংকাইটিস সম্পূর্ণ সারানো যাবে (কথার কথা)। কিন্তু আপনি শুধু এটা মনে করলেই তো হবে না, ব্যাপারটা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। এখন, এই পরীক্ষাটা আপনাকে করতে হবে কোন একটা ব্রঙ্কাইটিস আক্রান্ত ফুসফুসের ওপর। এমন একটা ফুসফুস আপনি কোথায় পাবেন?
ধরা যাক, আপনার বড় বোন ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত (আল্লাহ না করুন)! আপনি কি আপনার ওষুধটা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে ওষুধটা তার ওপর প্রয়োগ করবেন?? অবশ্যই না!!
কারোও ওপরই আপনি তা প্রয়োগ করতে পারবেন না!!
তাহলে উপায়?
এই জায়গাতেই আপনার দরকার একটি ‘ফুসফুসের একটি কৃত্রিম অবস্থা’। আপনার ওষুধে ফুসফুস যেভাবে রেস্পন্স করতো, এটাও অনেকটা একইরকম রেস্পন্স করবে। এই রেস্পন্স দেখে, আপনি বুঝতে পারবেন আপনার ওষুধটা কতটুকু কার্যকর বা আদৌ কার্যকর কিনা! যদি কার্যকর না হয়, আপনি পরীক্ষানিরীক্ষা করে বুঝতে পারবেন, কেন আপনার ওষুধটা কাজ করল না। সেভাবে আপনি আবার নতুন করে ওষুধটাতে পরিবর্তন এনে একে কার্যকর করে তুলতে পারবেন!
মানে, এটা দিয়ে ফুসফুস নিয়ে গবেষণা করবার সুযোগ সৃষ্টি হল। আমরা শুনেছি না, বৈজ্ঞানিকেরা কোন কিছু আবিষ্কারের পর প্রথম সেটা গিনিপিগের ওপর প্রয়োগ করে দেখেন, এটাও সেইরকম।
ফুসফুসের এরকম একটা কৃত্রিম কোষীয় অবস্থা তৈরিকে নিশ্চয়ই ‘কৃত্রিম মানব ফুসফুস’ আবিষ্কার করে ফেলা বলা যায় না!
আরেকটা ব্যাপার হল, যে কৃত্রিম অবস্থাটা তৈরি করা হয়েছে, সেটাও আয়েশার একক কৃতিত্ব নয়। নিউ ম্যাক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় পরিচালিত এই গবেষণা কার্যক্রমটি ছিল সম্পূর্ণভাবে একটি দলগত কাজ। গবেষণা দলের প্রধাণ ছিলেন জেন-হুয়াং হুয়াং। এছারাও সে দলে ছিলেন রিশি আয়ার এবং অ্যান্ড্রু গোমোস নামে লস আলামসের আরও দু’জন বৈজ্ঞানিক। আয়েশা এই গবেষণা দলের তৃতীয় সদস্য।
মানব ফুসফুসের এই কৃত্রিম কোষীয় অবস্থা তৈরি করাটা ‘কৃত্রিম মানব ফুসফুস’ আবিষ্কারের চেয়ে খুব যে কম গুরুত্বপূর্ণ, তা কিন্তু নয়! অবশ্যই অবশ্যই এটা অনেক বড় একটা আবিষ্কার! আর যে গবেষণা দলটি এই দারুণ কাজটি করেছেন, সেই দলের সদস্য আমাদের এই বাংলাদেশের মেয়ে আয়েশা আরেফিন! আমরা এর জন্যে তাঁকে নিয়ে গর্ব করতেই পারি!!
‘সত্য’ আর ‘সত্যের মত মিথ্যা’ – দু’টো এক জিনিস না। কিন্তু পত্র-পত্রিকা, ব্লগগুলো গণহারে একটা বাজে কথা প্রচার করে যাচ্ছে, আর আমরাও সেই মিথ্যা আরও বেশী বেশী করে ছড়িয়ে দিচ্ছি!! এটা নিশ্চয়ই কাম্য হতে পারে না!
সহজ-সরলভাবে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো উপস্থাপন করা ভালো। এতে করে লোকের মনে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ জান্মায়। কিন্তু তাই বলে ‘অতি-সরলীকরণ’ মোটেও ভালো কিছু নয়! এতে আজ যে আগ্রহটা জন্ম নিলো, কাল সেই আগ্রহটাই অকালে মারা পড়বে!!
কোন নিউজ/রিপোর্ট প্রকাশের আগে, এবং সেই নিউজ/রিপোর্টের তথ্যগুলো একটু যাচাই করে নিন! বিশেষত এই ভার্চুয়াল জগতে, যেখানে মুহূর্তের মাঝেই একটি তথ্য সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে যেতে পারে, সাবধানতার প্রয়োজনীয়তা সেখানে আরও বেশী। আপনার একটু ভুল তথ্য থেকেই ভীষণ কোন বিপদও হয়ে যাওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু না!
‘ইন্টারনেট এর নাগরিকবৃন্দ, সত্য – মিথ্যার জগতে স্বাগতম!’ কিন্তু, দয়া করে তথ্য দেবার আগে একটু যাচাই করে নিন!!
**
আমি নিজেও যে অনেক ভুল বা সঠিকের কাছাকাছি ভুল বা সত্যের কাছাকাছি ধরনের মিথ্যা তথ্য দেই না, তা কিন্তু না! কোন গ্যাঁড়াকলে পড়ে কী যে কখন বলি, শেয়ার করি, নিজেও জানি না! তবে আজকাল কোনকিছু শেয়ার করবার আগে ২/৩ বার ভাবি, আসলেই ঠিক জিনিস শেয়ার করছি কিনা। আমার মনে হয়, এটুকুও আমাদের অনলাইন কমিউনিটিকে এই সত্য-মিথ্যার গোলকধাঁধা থেকে অনেকখানি রেহাই দিতে পারে।
**
শেষ কথা – স্যালুট টু আয়েশা আরেফিন আপু! তুমি বাংলাদেশের গর্ব!!
তথ্যসূত্রঃ
- http://www.priyo.com/2013/09/09/30608.html
- http://www.bd-pratidin.com/2013/09/09/15386
- http://www.lanl.gov/index.php
- http://www.linkedin.com/pub/arefin-ayesha/28/a9/903
- https://aiche.confex.com/…/webprogram/Paper325988.html
- http://www.lanl.gov/…/student-profiles/ayesha-arefin.php
- http://www.lanl.gov/careers/stories/ayesha-arefin.php
আর কত বেকুবি!
অবশ্য মানুষের যাচ্ছেতাই বিশ্বাস করার প্রবণতা অসীম!
কী দেখে যে কে কী বিশ্বাস করি, কোন ঠিক ঠিকানা নাই! সত্যি আমাদের বেকুবিপনার কোন সীমা পরিসীমা নাই! 🙁
এই পোস্টের জন্য শুরুতেই তোমাকে এক কেজি ধইন্যা !
কী যে হয়েছে আজকাল আমাদের, কিছু না বুঝেই কান নিয়েছে চিলে বলে দৌড় লাগায় সব ! শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুব সুন্দর গুছিয়ে কথাগুলো বলেছ। পিলাচ !
আপনাকেও অনেক অনেক ধনে পাতা, লেটুস পাতা পড়ে দেখার জন্যে… :love: :love:
সত্যিই যেন কোন এক থুড়থুড়ে বুড়ো চিৎকার দিয়ে বলে ওঠেন ‘কান নিয়েছে চিলে’, আর আমরা আহাম্মকেরা বুড়োর সে কথাকে অবশ্যপালনীয় কর্তব্য ভেবে অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবেই সেই ‘চিল’র পেছনে ছুটে মাথা কুটে মরি… :wallbash:
ভাই, কালো ছেলে শেষ পর্যন্ত এসে কাক হবে- এটাই তো এখন নিয়মে পরিনত হয়ে গেছে ।