আমি তখন অনেক ছোট। দিন কাটত টম অ্যান্ড জেরি, মিনা কার্টুন দেখে, বাথরুমের বালতিতে হাত ঘুড়িয়ে ঘূর্ণিপাক তৈরি করে, কাগজের নৌকো তৈরি করে কিংবা নতুন খেলনাটা ভেঙ্গে কীভাবে আবার নতুন করে জোড়া লাগানো যায় সেই চেষ্টা করতে করতে। কখনো কখনো আব্বুর কোলে চড়ে পূর্ণিমার থই থই রূপোলী আলোয় অঙ্গ ভেজাতে যেতাম। কখনো আবার তাঁর পরম আদুরে হাতের মাঝে আমার আঙ্গুলগুলো জড়িয়ে দিয়ে পার্কের সবুজে হারিয়ে যেতাম! আব্বুর হাত ধরে পার্কে হাঁটতে হাটঁতে যা দেখতাম , তাই নিয়ে হাজার রকমের প্রশ্ন ছুড়ে দিতাম তাঁর দিকে। আমার ভীষণ কৌতুহলী আধো আধো প্রশ্নের বাণে জর্জরিত হয়ে আব্বু হাসতেন …
ভারী মিষ্টি ছিল সে দিনগুলো! আব্বুর সেই মায়ামাখা হাসিটাকে বড্ড বেশী মিস করি… হয়ত সেই হাসির আড়ালে এক গোছা স্বপ্নও লুকিয়ে থাকত, যা আমি দেখতে পেতাম না।
বই খাতার সাথে আমার সম্পর্কটা তখনও গড়ে ওঠে নি। তবে বইয়ের শেলফের সাথে একটা সখ্যতা মনে হয় ভালোভাবেই গড়ে উঠেছিল। আমার মনে পড়ে, আমি খাবার, পছন্দের খেলনা লুকিয়ে রাখতাম বুকশেলফে বইয়ের ফাঁকে কিংবা টেবিলের ড্রয়ারের কোণে অথবা খাটের নিচে।
ভাইয়া ততদিনে বেশ বড় হয়ে গেছে। ও তখন একা একা স্কুলে যেতে পারে, বিকেল বেলা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যেতে পারে, দিনের বেশিরভাগ সময়ই বাসায় থাকত না ও। রাতে অনেকটা সময় নিয়ে আব্বু ওকে ইংরেজি, অঙ্ক আরও কী কী যেন পড়াতেন। আব্বুর পড়ানো শেষ হলেই স্কুলের হোম ওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত ও। ও যতক্ষণে পড়াশোনা, অন্যান্য কাজগুলো একটু ছাড়িয়ে উঠেছে, ততক্ষণে আমি হয়ত আম্মুর পাশে শুয়ে ঘুমপরীদের সাথে লুকোচুরি খেলায় মত্ত হয়ে গিয়েছি। সেই তখন থেকেই ভাইয়ার সাথে আমার কেমিস্ট্রিটা খুব একটা জমে ওঠে না।
আব্বুর সাথে আমার সম্পর্কটা ছিল ভীষণ রকমের রসালো! আব্বু সরকারী চাকরীজীবী ছিলেন। অফিসে যেতে ৫/১০ মিনিট দেরী হলে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তবুও আমি তার দেখা দিনে খুব কম সময়ের জন্যেই পেতাম। তিনি ছিলেন একশত ভাগ সৎ আর খুবই নিষ্ঠাবান একজন মানুষ। বাসা থেকে মতিঝিলে আব্বুর অফিস বেশ কাছেই ছিল, হেঁটে গেলে বড়জোড় মিনিট বিশেক লাগে। কিন্তু ন’টায় অফিস হলে শুক্রবার বা অন্য কোন ছুটির দিন ছাড়া কোনদিন আমি আব্বুকে সকাল সাড়ে আটটায় বাসায় থাকতে দেখি নি। অফিসে যাবার বেলায় নির্ধারিত সময়ের আগে চলে গেলেও ফিরতেন ঠিকই আফিস ছুটির বেশ অনেকটা পর! এরপর আবার রাত জেগে হয়ত অফিস থেকে নিয়ে আসা কগজ পত্রগুলো নিয়ে নানান হিসেব নিকাশ, আঁকিবুঁকি, লেখালিখি ইত্যাদি কাজবাজ করতেন। আত্মীয়-স্বজনদের কারো কোন বিপদ আপদ হলে সবার আগে যে মানুষটা ছুটে যেতেন, তিনি আমার আব্বু! পাড়া-প্রতিবেশীর কারও কোন সাহায্যের প্রয়োজন হলে যে মানুষটা সবার আগে এগিয়ে যেতেন, তিনি আমার আব্বু! এতসব কিছুর পর নিজের বউ আর সন্তানকে খুব একটা সময় হয়ত তিনি দিতে পারতেন না। তবে যতটুকু সময়ই আমাদের জন্যে তিনি বের করে আনতেন, পুরোটা সময় নিজেকে উজার করে দিতেন! তাতে কী, আম্মু তবুও মাঝে মাঝেই এসব নিয়ে আব্বুর সাথে রাগ করতেন। হয়ত এটাই স্বাভাবিক। আব্বু কিছুই বলতেন না, শুধু হাসতেন। মাঝে মাঝে হয়ত আম্মুর সাথে সাথে আমিও রাগ করে বসতাম। আব্বু আমাকে টেনে কোলে তুলে নিতেন আর আমি ঝাঁকি দিয়ে সরে যেতাম। তখন আসলে বুঝতাম না। কিন্তু এখন যখন পেনশানের টাকা তুলতে মাঝে মাঝে আব্বুর অফিসে যাই, কাগজপত্রে নাম দেখে কেউ কেউ হয়ত বলে ওঠেন – ‘তুমি আনোয়ার সাহেবের ছেলে! খুব ভালো মানুষ ছিলেন!’, গর্বে আমার বুকটা ফুলে ওঠে। হয়ত মনের অজান্তেই চোখের কোণে দু’ফোটা জলও জমে ওঠে… পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে করিয়ে দেবার কী এমন দরকার?
যাই হোক, সারাদিন বাসায় থাকতাম কেবল আমি আর আম্মু। আমাদের বাসায় কোন কাজের লোক ছিল না। কাজেই, আমার খাবারে ভাগ বসাবে এমন কেউ ছিল না তখন। তবুও খাবার লুকিয়েই রাখতাম। হয়ত সেটা ছিল ঐ বয়সে আমার শিশুসুলভ প্রবৃত্তি, পাছে ভূত এসে নিয়ে যায়! খেলনা নিয়ে যাবে বা খাবারে ভাগ বসাবে এমন কেউ না থাকার পরও যে লুকিয়ে রেখে খুব যে লাভ হত, তা কিন্তু না! পোকামাকড়েরা আমার খেলনাকে ওদের বাসা ভেবে নিত, পিঁপড়ে আর তেলাপোকারা এসে সন্তর্পণে আমার লুকিয়ে রাখা খাবারে ভাগ বসাত, আমি আমার একক সম্পত্তিতে ভাগীদার খুঁজে পেতাম।
খেলনাগুলো হয়ত ওভাবেই রেখে দিতাম, পোকামাকরের ঘরবসতি ভেঙ্গে ওগুলো বের করে আনতে বড্ড মায়া লাগত আমার- ওদের এত সাধের বসতবাড়ী! কিন্তু আম্মু কেমন করে যেন নিষ্ঠুরের মত ওদের বাসা ভেঙ্গে দিয়ে খেলনাগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে তুলে আনতেন!
পিঁপড়ে-তেলাপোকাদের সাথে খাবার ভাগ করে নিতেও আমার বিশেষ আপত্তি ছিল না বৈকি। কিন্তু এখানেও আম্মুর ভীষণ আপত্তি! কোনভাবে যদি আমার লুকিয়ে রাখা খাবার আম্মু খুঁজে পেত, তার স্থান হত ময়লার ঝুড়িতে। খাবারগুলোকে ওভাবে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেয়া দেখে ভারী মন খারাপ হত আমার- পিঁপড়েরা নাহয় একটু মুখই দিয়েছে ওতে, তাতে খাবারগুলোর কী দোষ ছিল?
কখন যেন বুকশেলফের বইয়ের ফাঁকে খাবার লুকোবার ছলে শৈশব আর কৈশোরটাকেও বুকশেলফের আড়ে তুলে রেখেছিলাম। অনেক খুঁজেও এখন আর ওদের হাতের কাছে পাচ্ছি না! আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম, কিছুই বলতে পারল না। মনে হয় পিঁপড়ে-তেলাপোকারা জোট বেধে এসে পুরোটাই খেয়ে গেছে এবারে…
সময়গুলো ঠিক যেন বায়োস্কোপে দেখা ছবির মতন বয়ে চলে যায়! দিন বদলের পালায় অজস্র নিয়ম আর তার চেয়েও অনেক বেশী অনিয়মের মধ্য দিয়ে দিনকে দিন এই শিশু আমিটা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠি, বড় হয়ে যাচ্ছি আস্তে আস্তে! দৃষ্টির সীমানার ওপারে ছোটবেলার মুঠো-বন্দি দিগন্ত দেখতে পাই, চারচাকা শুধুই এগিয়ে নিয়ে যায়, বাঁধনহারা অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে না…
বদ্ধ কুঠুরীর ছোট্ট ঘুলঘুলি দিয়ে ফিনকি দিয়ে আসা ভোরের সোনারাঙ্গা আলোতে অলস বসে থাকা আমার অন্ধকার ছায়া দেখে মাঝে মাঝে মনে হয়, দুনিয়াটাকে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলবার জন্যে এমন বড় হয়ে ওঠার এত তাড়া কিসের? ঘরের কোণে একলা বসে নিশ্চিন্তে রঙিন দিনগুলো কাটিয়ে দেবার মত যথেস্ট ছোট থাকতে দোষ কী এমন? ক’দিন পরই নাহয় বড় হতাম…
আমার ভালোবাসার বোকা শৈশব, আধো আধো কথা বলা,
প্রিয় দুরন্ত কৈশোর, আকাশটাকে দেখতে শেখা – তোমরা ভালো থেকো!
খুব ভালো, মিষ্টি বকুল ফুল আর মিটিমিটি তারার হাসির মত ভালো…
১১ সেপ্টেম্বর, ‘১৩
ঢাকা।
তুই তো ছোটবেলায় বেশ বোকা ছিলি 😛 :love:
আমিও বোকা ছিলাম তবে বোকার থেকে দুষ্ট বেশি ছিলাম 8) 😛
ক’দিন পরই নাহয় বড় হতাম :crying:
লিখাও অনেক ভালো লেগেছে সেই সাথে ছবিটাও 😀
অনুজ, তোর কী মনে হয়– মনি’পু এখন খুব চালাক হইছে!? :thinking: … =))
এইসব কথা পাবলিক প্লেসে বলতে হয় না, ভাইয়া… 😛 😛 🙄
মানে কি?? :haturi: :haturi:
কই, কিছু নাতো!
কিসের মানে জানতে চাইছ? :thinking:
কনফিউজড করে দিলা তো…
তুমি তো বুড়ি, পিচ্চিকাল বহু আগেই পার করে এসেছ!! এখন এসব বলে লাভ কী? :thinking: 😛
আমি বুড়ি??
পিচ্চিকাল বহুকাল আগে পার করে এসেছি মানে? :haturi:
তোমার কী ধারণা তুমি কচি খুকী?? :thinking:
=)) =))
:balancin: …. :beerdrink:
😛 :penguindance: