আহমদ ছফা খুব প্রিয় একজন লেখক। নিম্নের লেখাটি ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়। পাঠকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য টাইপ করে শেয়ার করলাম।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তারিখে সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধের ঘটনাটি আধুনিক ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ যুদ্ধের মাধ্যমে প্রথম ইংরেজরা বাঙলা দেশে তাদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। বাঙলা দেশে উপনিবেশ স্থাপন করার পর গোটা ভারত উপমহাদেশ ইংরেজরা তাদের শাসনাধীনে নিয়ে আসে। ভারতের জনশক্তি, সম্পদ এবং অর্থের সহায়তায় অত্যল্প সময়ের মধ্যে ইংরেজরা এমন একটি সুবিশাল সাম্রাজ্যের মালিক হয়ে বসে, যে সাম্রাজ্যে সূর্য কখনো অস্ত যেত না। ভারতের ইংরেজ সাম্রাজ্যকে ধরে নেয়া হত মহারানীর রাজমুকুটের সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং মূল্যবান রত্ন হিসেবে। আধুনিক উপনিবেশ স্থাপনের ব্যাপারে ইংরেজরা সর্বপ্রথম অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেনি। ইউরোপীয় দেশসমূহের মধ্যে পর্তুগাল এবং স্পেন সর্বপ্রথম উপনিবেশ স্থাপনে মনোযোগী হয়ে ওঠে। ইংরেজরা ছিল উপনিবেশ স্থাপনের প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে কনিষ্ঠ শক্তি। অবশ্য এ সময় ফরাসী, ওলন্দাজ এ সমস্ত ইউরোপীয় দেশগুলো প্রতিযোগিতা করে উপনিবেশ স্থাপনে ব্রতী হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত কিন্তু ইংরেজদের সঙ্গে পাল্লা দেয়া অন্যান্য প্রতিযোগী দেশগুলোর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
পলাশী যুদ্ধের বিজয় ভারত উপমহাদেশে শুধু উপনিবেশ স্থাপনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। এ যুদ্ধের পর ইউরোপীয় শক্তিসমূহ এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে যে-সকল উপনিবেশ স্থাপন করেছে তার সঙ্গে পলাশীর যুদ্ধের একটা গভীর সংযোগ রয়েছে। বস্তুত প্রাচ্যদেশীয় রাজ্যগুলোতে পশ্চিমা দেশসমূহের উপনিবেশ স্থাপনের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে পলাশীর বিজয়কে গণ্য করা যায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এ উপমহাদেশে পলাশীর যুদ্ধের চেয়েও তাৎপর্যসম্পন্ন একটি সম্ভাবনাময় ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান একটি অচিন্তিতপূর্ব ঘটনা। ভারতের জনগণ ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। সেই সংগ্রামের চেহারাটি ছিল অস্পষ্ট এবং ঝাপসা। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, মাওলানা আজাদ এবং প্যাটেল প্রমুখ কংগ্রেস নেতা দাবি করেছিলেন ভারতবর্ষে সমস্ত জাতি মিলে একটি জাতি। কংগ্রেসের এ দাবি খারিজ করে দিয়ে মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ পাল্টা দাবী উত্থাপন করেছিলেন, ভারতের সবলোক এক জাতিভুক্ত নয়, এবং ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়ে রাজনৈতিক লড়াইয়ে নেমেছিলেন। সে সময়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবী নস্যাৎ করে দেয়া ব্রিটিশ কিংবা কংগ্রেস কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি, অবশেষে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর হতে না হতেই বাংলাদেশের মানুষরা অনুভব করতে থাকলেন, তাঁরা একটি স্বতন্ত্র, আলাদা জাতি। পাকিস্তানের অন্য অংশের সঙ্গে ধর্ম ছাড়া ভাষা, সংস্কৃতি এবং জীবন-আচরণ কোনকিছুর মিল নেই। তাছাড়া বাংলাদেশের মানুষরা আরো অনুভব করতে থাকলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর বয়সের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর থেকে সেই বিষয়টি এদেশের চক্ষুষ্মান মানুষদের গভীর চিন্তাভাবনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল মূলত একটি কারণে। ছাত্রসমাজ এবং বুদ্ধিজীবী সমাজের একটি বিরাট অংশ বাংলা ভাষাকে তৎকালীন পাকিস্তানে উর্দুর পাশাপাশি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। সে আন্দোলনের তাৎক্ষণিক যে তাৎপর্য ছিল সেটা ছাড়িয়ে ভাষা আন্দোলনকে আমাদের জাতিগত উত্থানের তোরণদ্বার হিসেবে চিহ্নিত করলে অত্যুক্তি করা হয় না। ভাষা আন্দোলনের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ নিহিত ছিল। এ দু’হাজার সালের বিশ্বের মানুষ প্রত্যেকটা বিষয়ের সঙ্গে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের যে একটি বিশ্বব্যাপী তাৎপর্য রয়েছে সেটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। জাতিসংঘ ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির দিনটিকে পৃথিবীর সকল নির্যাতিত এবং অধিকার-বঞ্চিত ভাষাভাষীদের দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ভাষা আন্দোলনের বীজ থেকেই আমাদের মুক্তিসংগ্রাম বিকশিত হয়েছে। ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের যে স্বাধীন-সার্বভৌম ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে, অনেক রাষ্ট্রবেত্তা এবং সমাজবিজ্ঞানী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সে অভ্যুদয়ের সঠিক তাৎপর্য অনেক সময় উপলব্ধি করতে পারেন না। তাই তাঁরা বলে থাকেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যর্থতা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পরে যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্ব ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল এবং আজাদের সর্বভারত মিলে এক জাতি এ ধারণাটি কি সঠিক? আসলে ভারত একটি বিশাল মহাদেশ। এখানে নানা ধর্ম, নানা ভাষা, নানা জাতি এবং জনগোষ্ঠীর বসবাস। নানা জাতি-গোষ্ঠীর আবাস ভারতকে একটি রাষ্ট্র ধরে নিলে ভারতীয় জনসমাজের মধ্যে পারস্পরিক যে সকল বৈপরীত্য ক্রিয়াশীল রয়েছে সেগুলো ধর্তব্যের মধ্যে আনার প্রয়োজন পড়ে না। ভারতের বিভিন্ন অংশের শিক্ষিত জনগণ এখনো যে ভাষাটির মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কসূত্র রক্ষা করে থাকেন সেটি কোন ভারতীয় ভাষা নয়, ইংরেজী। ভারত-রাষ্ট্র জন্ম নেয়ার ৫০ বছরের মধ্যেও একটি সর্বভারতীয় ভাষা সৃষ্টি করা গেল না। সেটি ভারত রাষ্ট্রের দুর্বলতার একটি মুখ্য দিক। ভারতের মানচিত্রের দিকে তাকালে আসাম, কাশ্মীর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের অহিন্দী অঞ্চলগুলো যেভাবে তাদের দাবী আদায়ের সংগ্রামে একসার অগ্নিগিরির মতো কোথাও ধূমায়িত এবং কোথাও জাজ্জ্বল্যমান তার কোনো রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো সম্ভব হয় না। ভারতের নির্যাতিত জাতিসত্তাসমূহ এবং দলিত জনগোষ্ঠী তাদের মুক্তির দাবীতে দীর্ঘদিন ধরে যে সংগ্রাম চালিয়ে আসছে সেগুলো প্রমাণ করে, ভারত ঠিক এক জাতির দেশ নয়। ভারতে বাঙালী জাতিসত্তা আছে, অহমিয়া জাতিসত্তা আছে, কিন্তু ভারতীয় জাতিসত্তা বলে কোনো বস্তু নেই। এটা ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণ যখন ভাষা আন্দোলন শুরু করেছেন দেখাদেখি আসাম এবং দ্রাবিড় অঞ্চলগুলোতেও ভাষা আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ যখন স্বায়ত্তশাসনের দাবী উত্থাপন করে, এরপর ভারতের নানা প্রত্যন্ত অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম জাগিয়ে তুলেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ভারতের অবহেলিত অঞ্চল এবং নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে ভারত রাষ্ট্রের মূল কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে লড়াই শুরু করেছে এবং সে লড়াই অদ্যাবধি অব্যাহত গতিতে চলছে। ভারতীয় ইউনিয়ন রাষ্ট্রীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারবে কি না সে বিষয়টি ভারতীয় চিন্তাশীল মানুষের নানারকম দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ উপমহাদেশে তিনটি রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি বিজ্ঞানসম্মত রাষ্ট্র – যদিও ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। বাংলাদেশের অভ্যুদয় এ অঞ্চলের একটি সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী ঘটনা। সময়ের পরিবর্তনের কথাটি যদি ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়, আমরা দেখতে পাই পলাশীর যুদ্ধ ইতিহাসের একটি বিশেষ পর্যায়ের উপনিবেশ স্থাপনের একটি বীজ-কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম আর একটি সুদূরপ্রসারী ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। পলাশীর যুদ্ধের মতো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এ অঞ্চলের একটি বিরাট প্রভাব বহনকারী ঘটনা, সে-জিনিসটি আমাদের যথার্থভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন।
বাঙালী জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র
(২০০১)
কষ্ট করে টাইপ করার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া। ভালো লেগেছে। কিন্তু এই মুক্তিযুদ্ধকে নিয়েই এখন ব্যবসা চলছে, দুঃখ এখানেই।
ইতিহাস নিয়ে এই ধরনের লিখা আমার বরাবর ই ভালো লাগে , ধন্যবাদ 🙂