বাংলার সক্রেটিসের রসনাবিলাসঃরসুইঘর থেকে সরাসরি সম্প্রচার!

একটা কথা খেয়াল রাখন খুব দরকার।যখন নতুন কোন জায়গায় যাইবেন,দুইটা বিষয় পয়লা জানার চেষ্টা করবেন।ঐ জায়গার মানুষ কি খায়।আর পড়ালেখা কি করে।কাঁচাবাজারে যাইবেন,কি খায় এইডা দেখনের লাইগ্যা।আর বইয়ের দোকানে যাইবেন পড়াশোনা কি করে হেইডা জাননের লাইগ্যা।কি খায়,কি পড়ে এই দুইডা জিনিস না জানলে একটা জাতির তেমন কিছু জানন যায় না।

আমার খুব প্রিয় একটা বই ‘যদ্যপি আমার গুরু’ থেকে উপরের লাইন গুলো ধার করা।আমার পড়া বইয়ের লিস্টিটা খুব ছোট হলেও এই বইটা কোন এক অদ্ভুত কারণে অন্তত ১০বার পড়া হয়ে গিয়েছে।এই আকর্ষণ কি আহমদ ছফার লিখনির কারণে নাকি আব্দুর রাজ্জাক নামে এক ঋষিতুল্য জ্ঞানতাপসকে জানতে চাওয়ার কারণে,সেটা ঠিক বলতে পারবো না।তবে দ্বিতীয়টা হওয়ার সম্ভবনাই প্রবল।নইলে যিনি কোন বই লিখে যান নি কিন্তু অনেকগুলো গুণী লোককে মন্ত্রমুগ্ধ করে গেছেন,তাঁর চলে যাওয়ার প্রায় দেড় দশক পরেও কেন তাঁকে জানতে চাই!তাঁর ভক্তদের কাছে তিনি পরিচিত ‘বাংলার সক্রেটিস’ নামে।সক্রেটিস প্রসঙ্গ যখন চলেই এল,তখন সক্রেটিসকে নিয়েও কিছু কথা লিখে যাই।তাহলেই একদম অপরিচিতদের বুঝতে সুবিধা হবে কেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে ‘বাংলার সক্রেটিস’ বলা হয়।দর্শনের ইতিহাসে সক্রেটিসের মত রহস্যময় ব্যক্তিত্ব আর দ্বিতীয়টি নেই।সক্রেটিস ও কিছুই লিখে যাননি।তাঁকে আমরা যতটুকু জানি,সেটা পুরোটাই তাঁর সুযোগ্য ছাত্র প্লেটোর লেখা থেকে।সক্রেটিসের কথোপকথনের একটা বিশেষ কৌশল ছিল।ব্যাপারটা ছিল এমন,তিনি যে লোকজনকে কছু শেখাতে চাইছেন সেটা তাদের বুঝতে দিতেন না।উল্টো,যাদের সঙ্গে তিনি কথা বলতেন তাদের তিনি এমন একটা ধারণা দিতেন যে আসলে তিনি আমাদের কাছ থেকে শিখতে চাইছেন।কাজেই;চিরাচরিত এক স্কুল শিক্ষকের মত লেকচার দেওয়ার বদলে তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় মত্ত হতেন।তিনি শুধু প্রশ্ন করে যেতেন,বিশেষ কোন একটা আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে,যেন তিনি বিষয়টা সম্পর্কে কিছুই জানেন না।আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি তাঁর প্রতিপক্ষকে তার যুক্তির দুর্বলতা বা অসারতা বুঝিয়ে দিতেন আর তখন কোণঠাসা হয়ে পড়া লোকটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হতেন কোনটি ন্যায় আর কোনটি অন্যায়।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের শেখানোর ধরন ছিল ও অনেকটাই এমন।তাঁর কাছে কিছু জানতে আসা মানুষদের হয়ত একটা আলোচনার সূত্র ধরিয়ে দিতেন।সেইসাথে উস্কে দিতেন জানার আগ্রহ।সহায়ক হিসেবে ধরিয়ে দিতেন নিজের বিশাল লাইব্রেরী থেকে কোন বই।অর্থনীতি-রাজনীতি-দর্শন-সমাজতত্ত্ব-ইতিহাস-শিল্প-সাহিত্য এমনকি সঙ্গীত নিয়ে প্রচুর জানাশোনা ছিল তাঁর।কিন্তু ক্লাসরুমে কেন জানি পড়াতে তেমন একটা আগ্রহী ছিলেন না তিনি।বরং ভিন্ন ভিন্ন লোকের সাথে আলাপেই বেশি আগ্রহী ছিলেন।
সারাজীবন ধরে জ্ঞান অনুসন্ধানী এই মানুষ বিয়ে থা করে ঘর সংসারী না হলেও রান্না বান্নার প্রতি তাঁর প্রচুর আগ্রহ ছিল।ঢাকার পুরনো দিনের রান্না বান্না,খাওয়া দাওয়া,আচার আচরণ ধরে রাখার এক বিচিত্র খেয়াল ছিল তাঁর মধ্যে।ঢাকার পুরনো দিনের হারিয়ে যাওয়া অনেক রান্নাবান্নাই তাঁর বাড়িতে নিয়মিত রান্না করা হত।তবে তিনি যে বিদেশী খাবার খেতেন না বা পছন্দ করতেন না তেমনটা না।যখনই বিদেশে গিয়েছেন কমপক্ষে একপদ হলেও ভিনদেশী রান্না শিখে এসেছেন।ল্যাবরেটরিতে যেভাবে কেমিকেল কম্পাউন্ড পরীক্ষা করা হয়,সেরকম নিক্তিমাপা সতর্কতা সহকারে বিদেশী রান্না করা হত তাঁর বাসায়।কিসে স্বাদ ভালো হয় তা নিয়ে সম্ভবত তাঁর বিস্তর গবেষণা ছিল।যেমনঃ

ইলিশ যেদিন কিনবা সেদিনই রান্না করবা;আর চেষ্টা করবা রান্না কইরাই খাইতে দিতে।দুইবার গরম করলে ইলিশের স্বাদ নষ্ট হয়।পদ্মার ইলিশ কিনতে চেষ্টা করবা।মাছওয়ালা আর গোশতওয়ালাদের সঙ্গে সবসময় খাতির রাখবা,ওরা তোমারে ঠকাইব না

অথবা রান্না নিয়ে সভ্যতা-অসভ্যতা নির্ণয়ের এক অদ্ভুত থিওরিও ছিল এই অনাড়ম্বর গুণীজনের।

যে জাতি যত বেশি সভ্য,তাদের রান্নাও তত বেশি সফিস্টিকেটেড।পশ্চিমারা এই তো সেদিন সভ্য হয়েছে,তাই আমাদের রান্নার সঙ্গে ওদের রান্নার কোন তুলনাই হয় না।এই সেদিন ও ওরা কাঁচা মাংস খেত।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রথমবার আমেরিকা থেকে ফিরে সেখানকার বিফ স্টেকের প্রশংসা করতে গিয়ে স্যারকে বলেছিলেন,ওরা এত ভালো করে ক্যাটল রেইজ করে,আমরা পারি না কেন?সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপক রাজ্জাকের উত্তর,মানুষগুলা হইব আপনাগো মত আর গরুগুলা হইব হ্যাগো মত-এমন তো হয় না।

রান্না বান্না নিয়ে তাঁর এই কৌতূহলের কথা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনই বলেছেন। তাঁর কাছ থেকে রান্না শিখেছেন অনেকেই।এমনই একজন ‘রান্নার ছাত্রী’ ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের স্ত্রী সিদ্দিকা জামান।প্রথম আলোর ২০০৭ সালের ঈদ সংখ্যায় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন এক স্মৃতিচারণমূলক লেখা।সেখানে তিনি অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের কাছ থেকে শিখেছেন এমন কিছু রান্নার রেসিপি দিয়েছিলেন।সেই রেসিপি সংকলন থেকেই সরব ব্লগের বন্ধুদের জন্য ‘বিফ রোস্ট’ রেসিপিটা দেওয়া।অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে আমি ইন্টারনেটে বাংলায় বিফ রোষ্টের রেসিপি খুঁজেছিলাম।পেয়েওছিলাম।সেগুলোর সাথে এর মিল নেই।বরং এই রেসিপিটা একটু ভিন্নরকম।এখানেই সম্ভবত অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মুনশিয়ানা!

*****গরুর রোস্ট*****

উপকরণঃ
১.গরুর সিনা বা পেছনের রানের মাংস ১ কেজি
২.দই ১২৫ গ্রাম
৩.পেঁয়াজ কুচি ১২৫ গ্রাম,
৪.রসুন বাটা ১ টেবিল চামচ
৫.এলাচ ২ টেবিল চামচ
৬.দারচিনি ২ টুকরা
৭.একটি জায়ফলের চারভাগের এক ভাগ বাটা
৮.জয়ত্রি বাটা ১চা চামচ
৯.আস্ত গোলমরিচ ১চা চামচ
১০.টমেটো কেচাপ ৪ টেবিল চামচ বা টমেটো কুচি ২ টেবিল চামচ
১১.বাটার ওয়েল ১০০ মিলি
১২.সরষের তেল ১০০ মিলি
১৩.চিনি ১ চা চামচ
১৪.লবন পরিমাণমত

পদ্ধতিঃ মাংসের টুকরা ভালো করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে।বাটার ওয়েল ও তেল মিশিয়ে তাতে পেঁয়াজ কুচি ভেজে হালকা বাদামি রঙ হলে উঠিয়ে নিতে হবে।ভাজা পেঁয়াজ কুচি ঠান্ডা করে গুঁড়ো করতে হবে।এরপর হালকা এলাচ,দারচিনি ও আস্ত গোলমরিচ ছাড়া অন্য সব মসলা ও পেঁয়াজ বেরেস্তার গুঁড়ো দিয়ে আস্ত মাংসের টুকরাটিকে ভালো করে মাখিয়ে কাঁটাচামচ দিয়ে ভালোভাবে কেঁচে ঘন্টাতিনেক বাইরে রাখার পর ফ্রিজে তুলে দিতে হবে।রাতে আরেকবার কেঁচে নিতে হবে।(একদিনে রান্না করতে চাইলে চার-পাঁচ ঘণ্টা বাইরে রেখেই রান্না সেরে নেওয়া যায়।তবে একদিন পর পরে রান্না করলে মসলা ভালোভাবে ভেতরে ঢুকে।)এবার মাংস থেকে মসলাগুলো ভালমত আলাদা করে রেখে দিতে হবে।তেল ও বাটার ওয়েল একটি বড় কড়াইয়ে ঢেলে তাতে মাংস বাদামি রঙ করে ভাজতে হবে।ভাজার সময়ে বড় কাঁটা ব্যবহার করতে পারলে সুবিধা হয়।রোস্ট ভাজার তেল ছেঁকে আলাদা করতে হবে।রোষ্টের টুকরা চেয়ে সামান্য বড় একটি সসপ্যানে সে তেল ঢেলে চুলায় দিতে হবে।তেল সামান্য গরম হওয়া মাত্র প্রথমে এলাচ,দারচিনি ও আস্ত গোলমরিচ ছেড়ে তারপর মাংস থেকে কেঁচে রাখা মসলা ঢেলে কষাতে হবে।এরপর তাতে এমনভাবে ফোটানো পানি ঢালতে হবে,যাতে অন্তত অর্ধেক রোস্ট ডুবে যায়।এবার সসপ্যান ঢেকে আঁচ একটু কমিয়ে ১০-১৫ মিনিট রেখে আঁচ বাড়িয়ে দিতে হবে।এর ভেতরে রোস্টটি মাঝেমধ্যে উল্টেপাল্টে দিতে হবে।রোস্ট সেদ্ধ হওয়ার পর অল্প ঝোল থাকতে থাকতে রোস্ট উঠিয়ে নিতে হবে।রোস্ট করার সময়ে যে সবজি পাওয়া যায় ও সিদ্ধ খেতে ভালো লাগে-যেমন বিট বা গাজর-সেসব পছন্দমত কেটে লবণে হালকা সিদ্ধ করে মাখন দিয়ে অল্প আঁচে সামান্য ভেজে রোষ্টের ওপর ও চারপাশে সাজিয়ে পরিবেশন করুন।রোষ্টের গ্রেভি আলাদা পাত্রে পরিবেশন করা যেতে পারে,যাতে রোস্ট কেটে গ্রেভি মাখিয়ে খাওয়া যায়।
মেহমান বেশি হলে রোষ্টের জন্য সিনা বা পেছনের রান থেকে গোলাকৃতি দু-তিন কেজির টুকরা নিলে পরিবেশনের সময় ভালো দেখায়।সে ক্ষেত্রে অন্যান্য উপকরণ অনুপাত অনুযায়ী বাড়িয়ে নিতে হবে।

সবার ঈদ ভালো কাটুক।ঈদুল আযহা যে মর্ম ও তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়,তা যেন আমরা ঠিকভাবে ধারণ করতে পারি,সেই প্রার্থনাই করি।সবাইকে ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা।ঈদ মোবারক

পুনশ্চঃআমরা অনেকেই নায়করাজ রাজ্জাক,স্পিনার আব্দুর রাজ্জাক এমনকি পাকিস্তানের অলরাউন্ডার আব্দুর রাজ্জাককে চিনলেও চিনি না এই নিভৃতচারী জ্ঞানতাপসকে।জাতি হিসেবে এর চাইতে লজ্জার কিছু হয়না।তাঁকে নিয়ে জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ তৈরি হলেও তিনটি বই পড়ার অনুরোধ রইল।এই লেখাটা এই বইগুলোর সাহায্য নিয়েই লেখা
১.যদ্যপি আমার গুরু-আহমদ ছফা।
২.ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজঃঅধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের এর আলাপচারিতা-সরদার ফজলুল করিম
৩.জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক স্মারক গ্রন্থ
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হলেও নিজে কিছু লিখে যাননি।তাঁর কেবল একটা ভাষণ Bangladesh:State of The Nation এর লিখিত রূপ প্রবন্ধ হিসেবে পাওয়া যায়।
সক্রেটিসকে নিয়ে জানতে চাইলে পড়তে পারেন ইয়েস্তেন গার্ডারের ‘সোফির জগত’ ও প্লেটোর ‘সক্রেটিসের জবানবন্দি ও মৃত্যুদণ্ড’।এই বইটির বাংলা অনুবাদ করেছেন ডঃ সফিউদ্দিন আহমদ কিংবা বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘পাশ্চত্য দর্শনের ইতিহাস’।এটার বাংলা অনুবাদ করেছেন ডঃ প্রদীপ রায়।

আবদুল্লাহ সম্পর্কে

পড়তে বেশ পছন্দ করি।পছন্দের কিছু লেখকের লেখা পড়ে লিখতে চেষ্টা করি।লেখা শেষে দেখি সেগুলো আসলে শব্দের খিচুড়ির চাইতে বেশি কিছু না!তাই নিজের লেখা নিজেই পড়ি।বিশ্বাস করি Malcolm X এর সেই অমর বাণীতে "I'm for truth, no matter who tells it. I'm for justice, no matter who it's for or against." [www.rdbangla.blogspot.com]
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

2 Responses to বাংলার সক্রেটিসের রসনাবিলাসঃরসুইঘর থেকে সরাসরি সম্প্রচার!

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    এত আগেই ঈদ মোবারক!

    সরব এ একজন আছেন যিনি বলেন রাজ্জাক আর ছফা না পড়লে বাংলাদেশ বোঝা যাবে না!

    ফাহাম আবদুস সালাম রাজ্জাকের জনপ্রিয়তা নিয়ে একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, সারাংশ অনেকটা এই রকম “তরুণতর ছাত্রদের তিনি স্নেহ করতেন, কাছে নিয়ে বসে গল্প করতেন। পরবর্তীতে তারা অনেক বিখ্যাত হয়ে গিয়ে সেই স্নেহ/ গল্প গুলা নিয়ে বলেছেন লিখেছেন… সেটা থেকে মিথ হয়ে গেছে!”

  2. আবদুল্লাহ বলেছেনঃ

    haha ঈদের আগে আর কোন পোস্ট লেখার সম্ভাবনা নাই বিধায় অগ্রিম শুভেচ্ছা!অবশ্য ঈদের আছেই আর চার-পাঁচ দিন।
    ফাহাম ভাইয় বেশ ভালো একটা কার্যকরণই বের করেছেন।এমন হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল।অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্মারক গ্রন্থ পড়লে এই ধারণা আরও পোক্ত হবে।তবে উনার জীবনী পড়ে আমি বেশ বড় রকমের শিক্ষা পেয়েছি।জ্ঞানী মানুষদের কিছু না লেখলেও চলে।কেবল বিনয়ী আর সদালাপী হলেই চলে!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।