মিথোলোজির বিভিন্নতাকে একীভুত ককরে বলা হয় সিংক্রেটিজম। দূর্গার সংগায়ন সিংক্রেটিজম বলে অভিমত দেন রাম প্রসাদ চাঁদ। তিনি চমৎকার ব্যাখ্যা দেন। হিমালয় ও বিন্ধ্য পর্বতমালার বাসিন্দারা পর্বত দেবীর উপাসনা করতেন। আভিরা কিংবা আহিরা নামক জাতি প্রকৃতি দেবীর পুজা করতেন। এই দেবী খুব সম্ভবত অরন্যানী যাকে বনবিবি কিংবা বনদুর্গাও বলা হয়ে থাকে, বর্তমানে বনদুর্গা কিংবা অরন্যানীর পুজা হয়না বললেই চলে। এছাড়াও একজন যুদ্ধ-দেবী – এই ত্রয়ের একীভুতকরনই হলেন দূর্গা।
দূর্গার সৃষ্টি সম্পর্কে অনেক মতবাদ রয়েছে। স্কন্দ-পুরাণের মতবাদটা আমার কাছে কিছুটা অন্যরকম লেগেছে, ঐটাই আগে বলি। এক সময় মহাবিশ্বকে ধ্বংস করতে আসে এক অসুর, তার নাম ছিলো দূর্গা। শিব তখন পার্বতীকে অনুরোধ জানান এই অসুরকে বধ করবার জন্য। পার্বতী তখন যুদ্ধ-দেবীর রুপে আবির্ভুত হন এবং সে অসুরকে বধ করেন, সে অসুর তখন ষাঁড়ের রুপ নেয়। তদপরবর্তি সময় হতে পার্বতী দুর্গা বলে পরিচিত হন।
তবে, সবচেয়ে বেশী গৃহীত মতবাদটি হলো, মহিষাসুর এই ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছিলো যে তাকে কোন দেবতা হত্যা করতে পারবে না, কিন্তু একজন মহিলা (দেবী) -ই শুধু পারবে। মহিষাসুর এই ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে প্রচন্ড তেজী হয়ে উঠে, সে একের পর এক দেবতাকে বধ করতে থাকে। তখন সকল দেবতা একত্র হয়ে প্রচন্ড শক্তি ও তীব্র আলোর (তাপ) মাধ্যমে তৈরী করেন দেবী দুর্গাকে। দুর্গার মুখমন্ডল আসে শিবের হতে, তার চুল আসে যম এর থেকে, বাহু আসে বিষ্ণুর থেকে এবং এভাবেই বাকি সব অংশ আসে একেক দেবতার থেকে। প্রত্যেক দেবতা তাকে একটি করে অস্ত্র উপহার দেয়। দূর্গার হাতের ত্রিশুলটি তাকে দেয় শিব। চাকতির ন্যায় অস্ত্রটি তাকে দেন বিষ্ণু। হিমালয়ের দেবতা, হেমাবত তাকে বাহনরূপে সিংহ দেন। সকল দেবতার সম্মিলিত রুপ দূর্গা প্রস্তুত হন মহিষাসুরের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য, তিনি গর্জন করে উঠেন, সে গর্জনে ব্রহ্মান্ড কেঁপে উঠে।
দুর্গা মহিষাসুরের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ন হন। তিনি সহজেই মহিষাসুরের সৈন্যবাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন। মহিষাসুর তখন মহিষের রুপ নিয়ে দুর্গাকে আক্রমন করতে যায়, দুর্গার সিংহ তখন সে মহিষকে আক্রমন করে। সে মহিষ সিংহে রুপ নেয়, দুর্গা সে সিংহের ধর কেটে ফেলেন, সে তখন মানুষের রুপ নেয়। দুর্গা তাকে তীর ছুড়ে মারেন, সে তখন হাতির রুপ নেয়। দুর্গা তার তলোয়ার নিয়ে সে হাতিকে আঘাত করলে সেটি আবার মহিষে রুপ নেয়। এই যুদ্ধে দুর্গা তার প্রয়োজনে একাধিক দেবীর সৃষ্টি করেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলেন দেবী কালী। বলা হয়, দেবী কালী হলেন দুর্গারই আরেকটি রূপ।
দেবী ভগবত পুরাণে পাওয়া যায় যে, মহিষাসুর দেবী দুর্গাকে বলেছিলো, একজন মহিলা (দেবী) হিসেবে তার পক্ষে যুদ্ধ করাটা খুবি ঔদ্ধত্বপুর্ন এবং তার সৌন্দর্য ভালোবাসা-বাসির জন্য যথেষ্ট, এছাড়া কিছুই নয় এবং তাকে অবশ্যই অন্তত একজন পুরুষের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পন করতেই হবে। মহিষাসুরের মতে, যেহেতু দেবী দুর্গার পাশে কোন পুরুষ রক্ষক ছিলেন না, তার মানে দেবী দুর্গা ছিলেন অসহায়।
কিন্তু একসময় দুর্গা অসুরকে তার দশ হাত দিয়ে ভু-পাতিত করেন এবং তার ত্রিশুল দিয়ে গেঁথে দেন। তার হাতের তলোয়ার দিয়ে অসুরের কল্লা কেটে ফেলে। এভাবেই অসুরের বধ হয়।

৯ম শতাব্দীতে ইন্দোনেশিয়ার জাভাতে প্রাপ্ত প্রাম্বনন নামক হিন্দু মন্দিরে প্রাপ্ত দেবী দুর্গার প্রতিমা। ছবি কৃতজ্ঞতাঃ উইকিপিডিয়া
দুর্গার ইতিহাস পরলে দেখা যায়, প্রকৃতির প্রয়োজনেই নারী তথা দেবীর আগমন ঘটেছিলো। আরও দেখা যায় যে, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়োজনে দুর্গা আরও দেবীর সৃষ্টি করেন, কিন্তু কোন দেব (পুরুষ) এর সাহায্য নেন না। যদিও সে দেবতাদের সমন্বয়েই তৈরী কিন্তু সে কখনওই দেবতাদের সাহায্যের মুখাপেক্ষী নন, উলটো তার প্রতিপক্ষ হলো পুরুষ অসুর। এবং বলাই বাহুল্য, সকল অসুরকেই তিনি বধ করতে সক্ষম। খেয়াল করলে একটা ব্যাপার বুঝবার কথা, দুর্গা তার সমস্ত শক্তি কিন্তু দেবতাদের থেকে নিয়েছে, বলা যায় পরিস্থিতির প্রয়োজনে ছিনিয়েই নিয়েছে।
আমার কাছে একজন দুর্গা একজন দেবী, কিন্তু তার থেকে অনেক অনেক বেশী একজন মহাশক্তিধর নারী। প্রচন্ড ব্যক্তিত্ত্ববান একজন নারী। যে কি না, নিজের শক্তিতে কাউকে তোয়াক্কা না করে সকল যুদ্ধে জয় ছিনিয়ে আনতে জানে। পুরুষতান্ত্রিকতাময় জগতে নিজের অস্তিত্বকে জানান দিয়ে গর্জন করে উঠতে জানে।
দুর্গার বহু প্রতিদ্বন্দ্বী তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, দুর্গা তাদের শর্ত দিয়েছিলেন, যদি তাকে যুদ্ধে হারাতে পারে, তবে তাকে বিয়ে করবে দুর্গা। দুর্গার জীবনি থেকে আরও দেখা যায়, যে অসুর দূর্গাকে উনজ্ঞান করেছিলো, দুর্গা তাকে পিষে পিষে মেরেছিলেন। শেখার আছে, অনেক কিছু শেখার আছে।
দুর্গার কথা মনে পরলেই আমার ব্লগার অগ্নিলার ( Maksuda Aziz ) লেখা “দেবী” নামে একটা ব্লগপোস্টের কথা সাথে সাথে মাথায় ক্লিক করে। ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে সেই লেখাটি ছিলো অতীব শক্তিশালী, সে লেখায় তিনি বলেছিলেন, “আমার বন্ধু মাত্রই জানে নারী চরিত্র হিসাবে আমি দূর্গার দৃঢ়তকে কি পরিমানে পছন্দ করি। আমার কাছে সে শুধু দেবী না একজন আদর্শনীয় চরিত্র“, ব্যাপারটা আসলেই তাই !
আজকে মহাদশমী। তুমুল আনন্দ-উৎসবের শারদীয়া দুর্গা উৎসবের শেষ। আনন্দের মাঝেও আমার বোনেরা দুর্গার থেকে শিক্ষা নিবে, কিভাবে সৃষ্টিকর্তার দেয়া অসাধারণ দুইটি পায়ে খুব দৃঢ়ভাবে শক্ত অবস্থান নিয়ে দাঁড়ানো যায়, তারা যুক্তি, আবেগ, সাহসিকতা আর মাতৃত্বের অসাধারণ মিশেল এর শিক্ষা নেবে। সবার জন্য শুভ কামনা রইলো।
তথ্যসুত্রঃ
১) ইংরেজি ও বাংলা উইকি
২) Tales of God’s Friends: Islamic Hagiography in Translation, chapter: Bonbibi, protectress of the forest by Sufia Mendez Uddin
৩) Hindu Goddesses: Visions of the Divine Feminine in the Hindu Religious Tradition, chapter: Durga, By David Kinsley
সবশেষে একটা তথ্য জানিয়ে যাই। দেবী দূর্গার ১০৮টি নাম আছে।
(লেখাটি যেহেতু সনাতন ধর্ম সম্পর্কিত, এবং আমি যেহেতু সনাতন ধর্মাবলম্বী না, তাই লেখায় ভুল থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে জানাবার জন্য অনুরোধ রইলো। সনাতন ধর্মের মিথোলোজিতে আমার আগ্রহের কারণেই এই লেখার জন্ম।)
শেখার আছে, অনেক কিছু শেখার আছে।
একমত।
দারুণ লাগল।
দুর্গা নিশ্চিত ফেমিনিজম এর বিষয় আশয় আছে? সেটা নিয়ে কেউ কি লিখবেন? 😀
“দারুন লাগল” মন্তব্য পড়ে আমারও “দারুন লাগলো” :happy:
কাউকে গছায় দেন, লিখুক ! 8)
নিশমিশ দা’র উপর গছাই দেয়াই ভালো হবেক… ইদানিং উনি ব্যাপক খাটাখাটনি করে লিখালিখি করতেছেন!
মাথা নষ্ট ম্যাআআআআআআন !!!!!! 8)
:love:
দূর্গার দৃঢ়তার ব্যাখ্যান ভালোই লাগলো। 🙂
মিথের নারী চরিত্রগুলোকে আমার বরাবরই তুলনামূলকভাবে বেশি আকর্ষণীয় লাগে। 🙂
ব্যাখ্যা যথাসম্ভব সহজ বাংলায় রাখার চেষ্টা করেছিলাম, যদিও দুর্গার ব্যাখ্যায়নে সংস্কৃত কিংবা পুরাণের কিছু শব্দ চলে আসছিলো। মিথোলজির নারী চরিত্রগুলো কিছু ক্ষেত্রে খুবি আকর্ষনীয় কিছু ক্ষেত্রে শুধুই শারীরিক যন্ত্র, আনন্দ দেবার।
দুইবার পড়লাম। হিন্দু মিথোলজি নিয়ে পড়া হয় নাই তেমন একটা, তোমার লেখা পড়তে ভালোই লাগলো। মেয়েদের স্বাবলম্বনকে খুবই জরুরি বলে মনে করি, সেই সাথে নারী স্বাধীনতার মানে যে পুরুষ বিদ্বেষ না বরং পুরুষের সাহায্য ছাড়াই চলতে পারার ক্ষমতা সেটাও মাথায় রাখা দরকার।
টিআইবি’র একটা লিফলেটে এরকম একটা লেখা পড়েছিলাম, অনুবাদ যে “নারীর ক্ষমতায়ন এর অর্থ পুরুষ বিদ্বেষ নয় এবং একজন পুরুষও নারীবাদি হতে পারে”, খুব চমৎকার একটা লেখা ছিলো, খুজে পাচ্ছি না।
পড়বার জন্য ধন্যবাদ সামিরাবি/সামিরাপু 😛
হিন্দু মিথোলজি নিয়ে লেখা মোটামুটি ভালোই পড়েছি 😀 ভালোই লাগে পড়তে 😀
বেশ ভালো লেগেছে 😀
একটু ঝামেলায় থাকার কারণে সরবে নিয়মিত ছিলাম না, এতো পরে লেখাটা পড়লাম বলে খারাপ লাগছে। যাই হোক, গ্রিক পুরান কিছু পড়া হলেও হিন্দুমিথোলজি সম্পর্কে তেমন পড়ি নাই, সর্বময়ী এই দেবী রুপ কিংবা বলা যায় নারীর এই সর্বশক্তিমান রূপটা বেশ নাড়া দেয়, “কাহানি” মুভির শেষ দৃশ্যে অমিতাভজির কথাগুলো আমার দারুণ লেগেছিল, সেদিন প্রথম ফিল করেছিলাম, প্রতিটা ধর্ম, বিশ্বাসের গোড়াতেই বিশাল একটা শেকড় আছে, যার সন্ধান কজনেই বা পায়, আমরা শুধু উপরের মহীরুহটাকেই দেখি।
লেখাটা ভালো লেগেছে, নিয়মিত হলে ভালো লাগবে। :love: