ফিরবো বলেই যাচ্ছি

 -এই যে, আমার উপর হুট করে রেগে যাও, এটা কী ঠিক?
:করিবে তুমি রাগার মত কাজ,

গোস্বা করিতে থাকিবে কেন লাজ?

 

-উউকথার কী ধাঁচ!

:বড্ড ভুল করেছি, তোমার প্রেমে পড়ে

তুমি হীরা, কাঁচ কিছুই না, সামান্য একখান চাঁচ!

 

-মুখ বাঁকিয়ে স্পর্শ বলে, আমি গেলাম!

:যেতে যে চায়, তাকে রুখবো কেমনে?

যাও, শুনে ব্যাথিত হলাম।

 

-ঠোঁট দিগুণ বাঁকিয়ে, আর কিন্তু ফিরবো না

:কি মিনমিন করছ!

যাচ্ছে না কিছু শোনা

 

-আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করছি… 

:ঐ চাওয়ালাকে ডাকোতো,

মাথা ব্যথায় মরছি।

 

-একবার গেলে আর ফিরবো না কিন্তু!

:চটছো কেন সোনা,

আমি টুনি আর তুমি মন্তু

 

আচ্ছা, আমি মন্তুএবার তুমি ছন্দ মেলানো বন্ধ করে প্লিজ আমার  কথাগুলো একটু শুনবে?

:তোমার সব কথাই মন দিয়ে শুনি, এটা মাথায় রাখবে

অবশ্যই মাথায় রাখবোএখন থেকে যতক্ষণ আমি আছি, নো মোর ছন্দ মেলানো, ওকে?

:আচ্ছা, ঠিক আছে, থামলামএখন বল তোমার ইম্পরট্যান্ট কথা, তবে চা পান করতেকরতে শুনলে ভালো হয়, আমার সত্যিই কেমন জ্বরজ্বর লেগছে

কই দেখি, স্পর্শ হাত রাখে স্নিগ্ধার কপালে কম করে হলেও, একশএক হবে! আজব মেয়ে তুমি! আমি ভেবেছিলাম, ঠাট্টা করছআচ্ছা, বস আমি কফি নিয়ে আসি! ৫ মিনিট লাগবে, আর কিছু খাবে?

:কিচ্ছু লাগবে না, তুমি বসতো আমার পাশে, বলেই হাত টেনে জোর করে বসিয়ে দেয়

আমার পরশু ফ্লাইট, কিছুটা বিমর্ষ দেখায় স্পর্শকে

:জানি, ফ্লাইট ক’টায়?

রাত দেড়টা

:তাহলেতো বোধয়, আমি থাকতে পারবো না!

হুম

:তুমিতো ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পেয়েছ, তাই না?

হুম

:বস!

আমার খুব খারাপ লাগছে স্নিগ্ধা

:আমার খুব আনন্দ লাগছে!

ফান করো না তো, সবসময় ফান ভালো লাগেনা

:কাল-বাদে পরশু চলে যাচ্ছ, কম করে হলেও দুবছর তোমার সাথে ঝগড়া করতে পারবো না, কথার পিঠে ছন্দ জুড়ে দিয়ে তোমায় বিরক্ত করতে পারবো না, মাঝরাতে একের পর এক মিসকল দিয়ে রাগাতে পারবো না, আজ নাহয় একটু বেশিই ফান করলাম।

স্কাইপি আছে, ফেইসবুক আছে, মোবাইল আছেপারবেনা কেন!

:ওয়েব-ক্যামের সামনে বসে তোমার সাথে ঝগড়া করবো!

হুম, শুধু ঝগড়া না চাইলে ওটাও খেতে পারবে, মুচকি হাসে স্পর্শ

:অত শখ নাই বাবা! আচ্ছা, শোনফ্লোরিডার মেয়েরা তো খুব সুন্দর হওয়ার কথা! কারো প্রেমে পড়ার আগে আমাকে ঐ মেয়ের ছবি দেখিয়ে নিও। দ্বিতীয় বিবাহ করার আগে যেমন প্রথম স্ত্রীর পারমিশন নেয়া লাগে, তেমনি দ্বিতীয় প্রেম করার আগেও প্রথম প্রেমিকার পারমিশন নেয়া লাগে। টেনশন নিবা না একদম! আমি মেয়ে ভালো, তোমাকে নিষেধ করব না, বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে স্নিগ্ধা।

-তোমার এই হাঁসির শব্দটাই আমি ভীষণভাবে মিস করবো স্নিগ্ধা।

:তোমার এক কথাটা-ই আমি খুব মিস করবো স্পর্শ, এবার বেশ শব্দ করেই হেঁসে ওঠে স্নিগ্ধা।

-আজ রাতে রাতে একটু গ্রামের বাড়ি যাবো। দাদী-ফুপিদের সাথে দেখা করে আসবো, কাল দুপুরে একটু অ্যাম্বাসিতে যেতে হবে, কিছু কেনাকাটাও আছে। অনেকগুলা কাজ অল্প সময়ে করতে হবে। আর হয়তো দেখা হবে না, একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

:আর দেখা করতে হবে কেন? দাদীকে দেখে আসো, পারলে উনাকে সাথে নিয়ে এসো। তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে দাদী, তোমার বিদায়ের সময়টায় তোমার উচিৎ দাদিকে পাশে রাখা।

-চেষ্টা করবো, সাথে নিয়ে আসতে। দাদির কান্নাকাটিতে দাদু পারিবারিক কবরস্থানে দাফন না দিয়ে, দাফন করতে হয়েছিল আমাদের উঠানের আমগাছের নিচে। দাদুর মৃত্যুর অনেকদিন পর পর্যন্ত দাদী আমাগাছের নিচে দাদার প্রিয় খাবার নারকেলের নারু আর খই-ভাজা প্লেটে সাজিয়ে রেখে দিতেন। মনে  হয় না উনি দাদুকে ফেলে তিনি আসবেন…

:চেষ্টা করো। চল উঠি, রাতের ট্রেনেই তো যাচ্ছ?

-হুম। আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি, হয়তো রাগ করবে।

:রাগ করলেও কর।

-দাদি, দাদাকে যেমনটা ভালোবাসতেন, তুমি কি আমাকে তেমন ভালোবাসো?

:তুমি রাগ করার মত কোন প্রশ্ন করনি, কিন্তু আমার উত্তরটা শুনে বোধয় তুমি রাগ করবে, তাই বলতে চাইছি না

বলতে হবেনা, মিষ্টি করে হাসে স্পর্শ

:ভালো থেকো, আল্লাহ হাফিজ

ভালো থাকবো, তুমিও থাকবে, শেষ বারের মত স্নিগ্ধাকে আলিঙ্গন করে বিদায় নেয় স্পর্শ

………………………………

………………………………

রাত সাড়ে বারোটায় বাবাদাদীকে সাথে নিয়ে এয়ারপোর্টে চলে আসে স্পর্শ। দাদীকে বলতেই তিনি রাজি হয়ে যান, হেসে বলেন, ‘তুই চলে যাওয়ার সময় আমি তোর পাশে থাকবো না! তোর দাদা আমাকে বকবে না? অবশ্যই আমি যাবো তোর সাথে।’

এক ঘণ্টা পরেই বাবা-দাদীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইমিগ্রেশান রুমে ঢুকে যায়। ঢোকার আগে বাধ্য  ছেলের মত বাবার দেয়া উপদেশগুলো মাথা নিচু করে শোনে। স্পর্শের দাদী স্পর্শের কপালে হাত রেখে দোয়া করেন। তার চোখে কোন জল ছিল না; অনেক আগেই তা শুকিয়ে গেছে…

 

সোফায় বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা উলটাচ্ছিল স্পর্শ। ম্যাসেজের শব্দ, ‘তুমি একটু বাইরে আসবে?’ পেছনে ফিরে স্বচ্ছ কাঁচের দরজা দিয়ে বাইরে তাকায় স্পর্শ হালকা নীল রঙের একটা শাড়ী পড়ে স্নিগ্ধা দাঁড়িয়ে ছিল, সাথে ওর সাথে ভাই স্নিগ্ধ।

একবার ইমিগ্রেশান রুমে ঢুকে গেলে বের হওয়া খুব কঠিন। অনেক রিকোয়েস্ট আর কিছুটা জরিমানা গুনে, ২০ মিনিট পর বাইরে আসে স্পর্শ।

সময় যেন হঠাৎ স্থির হয়ে যায়। অনেকক্ষণ এক-অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘আপু তোরা কথা বল আমি ও’দিকটায় গেলাম’ স্নিগ্ধের কথায় ফিরে আসে দু’জন। গভীর মমতায় স্পর্শ, তার দু’হাতে স্পর্শ করে স্নিগ্ধার চিবুক।

-এত রাতে করে কেন আসতে গেলে?

:এমনি, দু ফোঁটা জ্বলে সিক্ত হয় স্পর্শের হাত। প্রচণ্ড আবেগে স্নিগ্ধাকে জড়িয়ে ধরে স্পর্শ।

 এভাবে কতটা সময় কেটে ওরা জানে না, সিকিউরিটির ডাকে ফিরে আসে। আধঘণ্টা পর প্লেন ছাড়বে, এখন ঢুকতেই হবে।

:এই নাও।

-কী এটা?

:চিঠি। এখন না, প্লেনে উঠে পড়বে। ভালো থেকো…

  -ভালো থাকবো। তুমিও থেক, স্নিগ্ধার কপালে আলতো করে ঠোঁট স্পর্শ করে, দ্রুত ইমিগ্রেশান রুমে ঢুকে যায় স্পর্শ। নাহ, একটিবারের জন্য ও আর পেছনে তাকায় নি স্পর্শ, পেছনে ফেরার সাধ্য নেই ওর…

 

রাত পৌনে-দু’টায় প্লেন ছাড়ে। সিটে বসে পকেট থেকে কাগজটা বের করে স্পর্শ।

স্পর্শ,

তুমি যখন আমার চিঠিটা পড়ছ, তখন তোমার অবস্থান মাটি থেকে অনেক উপরে, যেখান থেকে আকাশের মেঘগুলোকে স্পর্শ করা যায়। তুমি জানালার দিকে তাকাচ্ছ  কেন? রাত দু’টায় সাদা মেঘ দেখবে কীভাবে! তুমি সেদিন আমায় একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলে, দাদীকে-দাদা যতটা ভালোবাসেন ততোটা ভালো আমি তোমাকে বাসি কি-না? নাহ, ততোটা ভালো হয়তো বাসি না, বাসতে পারবোও না। তুমি না থাকেলেও, আমি কবিতা লিখে যাবো। লেমন ইয়েলোর সাথে লাইট ইনডিগো মিশিয়ে, আকশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের ছবি আঁকবো। পহেলা বৈশাখে বন্ধুদের সাথ দল বেঁধে কাজ করব…

তুমি খুব ভালো ছাত্র আমি জানি, আকাশ ছোঁয়ার যে স্বপ্নটা তুমি ছোটবেলা থেকেই দেখছ, তা তুমি পারবে। তবে মনে রেখ, আকাশ ছোঁয়ার পরও পা-টা যেন শক্তভাবে মাটিকে জড়িয়ে থাকে । অবশ্যই পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরে আসবে; শুধু আমার জন্য না, দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য।

আমি তোমাকে কতোটা ভালবাসি, সেটা বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব না। তবে একটা কথাই বলছি, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।

 

-স্যার, আপনার কিছু লাগবে, মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে এয়ারহোস্টেস।

-নাহ, কিছু লাগবে না।

-স্যার, আপনার কী খুব বেশি মন খারাপ আপনি কাঁদছেন?  

-আমি কাঁদছি না, আমার অপটিক গ্লুকোমার প্রবলেম আছে। আপনি যদি পারেন, আমাকে একটা টিস্যু দিন, হাসার চেষ্টা করে স্নিগ্ধ।

-দিচ্ছি স্যার, একটা টিস্যু দিয়ে সামনে চলে যায়  ’হোস্টেস

 

জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় স্পর্শ। জানালার স্বচ্ছ কাঁচে নিজের আর জ্বলতে থাকা বাতির প্রতিচ্ছবি দেখে তাতে চোখের জল দেখা যাচ্ছেনা, দেখা যাচ্ছে একটা প্রশান্ত, হাসিমাখা স্নিগ্ধ মুখ যা বলছে- আমি ফিরে আসবো

অনিমেষ ধ্রুব সম্পর্কে

"You've gotta dance like there's nobody watching, Love like you'll never be hurt, Sing like there's nobody listening, And live like it's heaven on.'' অসম্ভব পছন্দ উইলিয়াম পার্কারের এই কথাগুলো! নিজের মত করেই নিজের পৃথিবীটা কল্পনা করে নিতে ভাল লাগে। ঔদাসিন্য,অলসতা শব্দ দুটি আমার সাথে বনে যায়। গভীর মনোযোগ কিংবা অসম্ভব সিরিয়াস মুড আমার কখনোই আসে না। একা অচেনা রাস্তায় অকারণে হাঁটতে ভালো লাগে, মানুষ দেখতে ভালো লাগে, ভাল লাগে কবিতা লিখতে...তবে স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখি আমার চারপাশে থাকা মানুষগুলোর জন্য কিছু একটা করার, দেশকে কিছু একটা দেয়ার। পারব কি-না জানি না, তবুও স্বপ্ন বুনে চলেছি নিরন্তর... http://www.facebook.com/kamrul.h.hridoy.3
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

9 Responses to ফিরবো বলেই যাচ্ছি

  1. তালপাতার সেনাপতি বলেছেনঃ

    এরকম লেখা পড়ার সুযোগ হঠাৎ ই হয় আমার।

    অসাধারন। ধন্যবাদ, কিছু সুন্দর সময় ব্য্ইয় করার সু্যোগ দেয়ার জন্যে

  2. শারমিন বলেছেনঃ

    অনেক ভালো লেগেছে 😀

  3. হাসান বলেছেনঃ

    হৃদয়, প্রথমে তো ভাবছিলাম কবিতা পড়ছি,
    পরে বুঝলাম- না এটা গল্প !!

    অনেক ভালো লিখছো। তোমার কাছে প্রত্যাশা ক্রমবর্ধমান … :love:

  4. হৃদয় বলেছেনঃ

    চেষ্টা থাকবে, অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া :love:
    অনেকদিন পর লগ-ইন করলেন মনে হয়, তাই না? 😛

  5. সামিরা বলেছেনঃ

    স্পর্শ শেষে এসে স্নিগ্ধ হয়ে গেল যে? 😛

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।