ইংরেজি মাধ্যমের তৈরি কুয়ো ভাঙার এখনই সময়

[গত ৬ আগস্ট, ২০১৩তে ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত শাফিন ফাত্তাহ্‌-র ‘Time to burst the bubble‘এর অনুবাদ]

বাংলাদেশের শতকরা এক ভাগেরও কম শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে ইংরেজি মাধ্যমে। পুরোপুরি বিদেশি কারিকুলাম মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেয়া এসব প্রতিষ্ঠান অনেকদিন ধরেই নজর কেড়েছে দেশের স্বচ্ছল শ্রেণীর, আর তাই তারা সন্তানদের শিক্ষার জন্য এসব স্কুলকেই বেছে নেন আজকাল। স্কুলগুলোর বেশিরভাগও আবার ঢাকা ও চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকাগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।

দেশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উচ্চবিত্ত শ্রেণীর চোখে মর্যাদার প্রতীক এসব স্কুলগুলোর দুটোতে আমি নিজেও পড়েছি। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ার সৌভাগ্য বলা যেতে পারে একে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত কিছু রূঢ় উপলব্ধির কথাই আজ বলতে চাই।

কুয়োর ভেতরে থাকা ব্যাঙের জীবন যেমন, ইংরেজি মাধ্যমের জীবনকে অনেকটা সে জীবনের সাথে তুলনা করা যায়। স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীরা যাদেরকে সহপাঠী হিসেবে পায় তারাও সবাই সমাজের একই শ্রেণীর ভাগ্যবান সদস্য আর তাই, দিন দিন সমাজে নিজেদের অবস্থান নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠে তারা। আর স্কুলেও এই মিথ্যে অহঙ্কারের বুদবুদে শাণ দেয়া হয় অবিরাম, বিদেশি কারিকুলাম মোতাবেক নিজের দেশকে নিয়ে তাদেরকে কোন তথ্য তো জানানো হয়-ই না, নিজেদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সাথেও চলে না কোন পরিচয়-পর্ব।

কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন, যারা সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেয় তাদের তো অন্তত বাইরের পৃথিবীর সাথে চেনাজানা হয়। কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। ফুটবল টুর্নামেন্ট হোক কি বিতর্ক প্রতিযোগিতা – একই ঘরানার স্কুলগুলোর মধ্যে সবকিছুর আয়োজন হওয়ায় সেখানেও সবাই একই পরিবেশ থেকে আসা মানুষদের দেখা পায়।

এমন অবস্থায় পড়াশোনার পাট চুকানোর পরও চারপাশে নিজের মত যাদেরকে দেখতে পায় শিক্ষার্থীরা, তারা একদিকে ‘ঠিকঠাক’ ইংরেজি বলতে পেরে গর্বে আটখানা, অন্যদিকে নিজের মাতৃভাষাই যে পারে না তা নিয়ে রীতিমত নিশ্চুপ। একই সাথে তারা দেশের বাদবাকি ৯৯% শিক্ষার্থীদের সাথে নিজেদের মানসিক দূরত্বটাও উপলব্ধি করতে শুরু করে।

সমাজের অন্য বাসিন্দাদের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর সংগ্রাম করতে করতে তারা একসময় কাল্পনিক এক শ্রেণী বৈষম্যের ধারণা পুষতে শুরু করে মনে। এতদিন ইংরেজি মাধ্যমের তৈরি কুয়োয় বাস করার ফল হিসেবে মিথ্যে এক আত্মম্ভরিতা জেগে ওঠে তাদের মধ্যে।

ইংরেজি মাধ্যমের গড়পড়তা একজন শিক্ষার্থী এই কুয়ো থেকে বেরিয়েই বাংলা মাধ্যমের সহশিক্ষার্থীদেরকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখতে শুরু করে। ভাবে, ওরা তো আর আমার মত বিশ্বমানে শিক্ষিত না! অথচ ‘বিশ্বমান’ আর ‘বিশ্বস্বীকৃত’ শব্দ দুটোয় যে আকাশ-পাতাল তফাৎ তা তাকে কে বোঝাবে? বাংলা মাধ্যমের কারিকুলামে বিজ্ঞান আর গণিতে বিশেষ নজর দেয়ার পাশাপাশি নিজ দেশ নিয়ে চমৎকার একটা ধারণাও দেয়া হয় – এই সত্য কেউ কেউ হাড়ে হাড়ে টের পায় যখন তারা বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোসহ সেরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যায়।

কিন্তু এই সংখ্যা খুবই সীমিত – ইংরেজি মাধ্যমের খুব কম শিক্ষার্থীই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা দেয়। বাংলা মাধ্যমের কারিকুলাম ছাড়িয়ে তাদের উন্নাসিকতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ারই ফল যেন এটা।

দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর একটা বিশাল অংশ মনে করেন, বিদেশের যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেয়ে উন্নত মানের পড়াশোনা হয়, যেহেতু সেগুলোর র‍্যাঙ্ক থাকে তুলনামূলকভাবে তালিকার ওপরের দিকে! সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান যাচাইয়ে তাদের করা ভুলগুলোর মধ্যে এটাও একটা।

তবে আরেক দল শিক্ষার্থী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে উৎসাহ হারায় অন্য কারণে। তাদের কাছে পরীক্ষার পুরো নিয়মটাকেই ইংরেজি মাধ্যম পড়ুয়াদের জন্য অবান্ধব বলে মনে হয়।

এরকম নানা উপায়ে গড়পড়তা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের গড়পড়তা একজন শিক্ষার্থীর সাথে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের দূরত্ব বাড়ে বৈ কমে না।

আগেও বলেছি, আবারো বলছি – ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের জন্য দেশের চলমান অবস্থার সাথে নিজের ভাবনাচিন্তাকে খাপ খাওয়ানোটা সহজ কিছু নয়। নিজের চেষ্টায় যে যতটুকু জানতে পারে, ব্যস – এছাড়া স্কুলে কখনোই তাদেরকে বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি কিংবা আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জানানোর উদ্যোগ নেয়া হয় না। ইউরোপীয় আর আমেরিকান ইতিহাসের ভালো সমঝদার বনে গেলেও বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান অথবা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের মত ঐতিহাসিক সময়গুলো নিয়ে কিছু শেখে না তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউরো জোন আর যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে জানলেও নিজ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তারা থাকে অন্ধকারে।

ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা এই যে নিজের দেশ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বুঝতে, জানতে, ভালোবাসতে ব্যর্থ হচ্ছে, তার পেছনে মুখ্য ভূমিকা রাখছে স্কুলগুলোর ‘বিশ্বমান’এর কারিকুলাম নিয়ে আদিখ্যেতা আর সেই সাথে স্বদেশ সম্পর্কে জানাতে সদিচ্ছার অভাব।

এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘ব্রেইন ড্রেইন’ নামক মহামারির ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় এখান থেকেই। দেশের জন্য কিছু করার সুযোগ কোথাও দেখতে না পেয়ে তাদের অনেকেই দেশ বা দেশের অবস্থা নিয়ে উদাসীন হয়ে পড়ে। সেই সাথে গড়পড়তা বাংলাদেশির ভাবনাকে বুঝতেও তাদের সংগ্রাম করতে হয়, আর তাই একসময় দেশ ছেড়ে চলে যাওয়াকেই যুক্তিযুক্ত বলে মেনে নেয়।

ইংরেজি মাধ্যমের আরো যে অনেক নেতিবাচক প্রভাব আছে তা নিয়ে আর কথা বাড়াবো না আমি। তার বদলে এখন অন্য একটা প্রশ্নের জবাব দিতে চাই, তা হলো – দেশের মোট শিক্ষার্থীদের এত ক্ষুদ্র অংশ ধারণ করার পরও এই মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমার এত মাথাব্যথা কেন?

অর্থবিত্তের দিক থেকে দেশের জনসংখ্যার সবচেয়ে ওপরের ০.৫ শতাংশের অন্তর্ভুক্ত যারা, সেসব পরিবারে দিনকে দিন বেড়ে চলছে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিতদের হার। এই অংশ একই সাথে জাতীয় সম্পদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের মালিক, আবার বেশিরভাগ বড় ধরনের বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও এদের হাতে।

এক সময় ইংরেজি মাধ্যম নামক কুয়োর বাসিন্দারা এসব ব্যবসার স্বত্ত্বাধিকারী হয়ে উঠবে, বেসরকারি খাতেও তখন তাদের প্রভাব থাকবে সুবিশাল।

এদের খুব সামান্যই যেহেতু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে কিংবা সরকারি চাকরিতে যোগ দিচ্ছে, সরকারি খাতের যে কোন শাখায় খুব অল্পই প্রতিনিধি থাকবে তাদের। তাই এখন ইংরেজি আর বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের যেই দূরত্ব, তা সরকারি ও বেসরকারি খাতের দূরত্বও বাড়াতে থাকবে যা হয়তো দূর ভবিষ্যতে দেশের সার্বিক ভারসাম্যকেই হুমকির মুখে ফেলবে।

অন্যদিকে জনগণও হয়তো অচেনা, দেশের বাস্তবতার সাথে সম্পর্কহীন এসব মানুষকে বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাথা হিসেবে দেখতে চাইবে না, যেহেতু দেশের ভবিষ্যৎ বেসরকারি খাতের উন্নতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলা এই দূরত্বকে সামাল দেয়ার জন্য খুব দ্রুতই ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাকে কুয়োসদৃশ পৃথিবী থেকে বের করে আনার উদ্যোগ নেয়ার সময় এসেছে।

শিক্ষার্থীদেরকে একই সাথে দেশ ও বাংলা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের সাথে সম্পর্কিত করার প্রাথমিক পদক্ষেপ যেহেতু ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোর পক্ষেই নেয়া সম্ভব, সমস্যা সমাধানের মূল চাবিকাঠিও তাই হয়তো তাদের কাছে। জাতীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও আর্থসামাজিক অবস্থাকে কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজি – এ দুই মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একীভূত প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়েই শুরু হতে পারে এই পথচলা।

একই সাথে সরকারকেও এই বিভাজন দূর করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশাসনে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদেরকে আরো বেশি সুযোগ করে দিয়ে।

একটা কথার পুনরাবৃত্তি করাকে জরুরি মনে করছি – ওপরের কথাগুলোর কোনটাই ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদেরকে আক্রমণের লক্ষ্যে বলা হয় নি। সেটা বলা সম্ভবও না, যেহেতু আমি নিজেই এই মাধ্যমেরই ছাত্র ছিলাম।

শেষে আরেকটা কথাও না বললেই নয়: কুয়ো ছেড়ে বেরিয়ে এসে নিজ উদ্যোগে দেশ নিয়ে আরো শেখার, ভাবার, কাজ করার চেষ্টা করছে আর সেই সাথে বিভিন্ন পরিবেশ ও পেশার মানুষের সাথে মিশছে – আমার মতন এমন শিক্ষার্থীও দিন দিন বাড়ছে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে। কিন্তু এই বাড়ার হার একটু বেশিই যেন ধীর।

সামিরা সম্পর্কে

পীচ-গলা তরলে আটকে পা, দুঃস্বপ্ন অন্ধ দুই চোখে/ অসতর্ক হৃদয় পোষ মানে মিথ্যে বলার আফসোসে.../// প্রকাশিত লেখার কপিরাইট সংশ্লিষ্ট লেখক সংরক্ষণ করেন এবং লেখকের অনুমতি ছাড়া লেখা আংশিক বা পূর্ণভাবে কোন মিডিয়ায় পুন:প্রকাশ করা যাবে না।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুবাদ, চিন্তাভাবনা, সচেতনতা-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

16 Responses to ইংরেজি মাধ্যমের তৈরি কুয়ো ভাঙার এখনই সময়

  1. রাইয়্যান বলেছেনঃ

    ভালো লাগেনি। লেখাটায় ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাব্যবস্থার কোন পজিটিভ দিকের ইঙ্গিতও পর্যন্ত নেই, যেন ইংরেজি মাধ্যম রীতিমত ডাস্টবিনের কীট এধরণের একটি টোন লেখায় এসেছে বলে মনে হল।

  2. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    ইংরেজি মাধ্যমকে নতুন করে সাজানো যেমন দরকার, একই সাথে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও একটু ভাবা দরকার। বাংলা মাধ্যমে ইদানীং শিশুদের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি প্রেশার দেয়াতে অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদের ইংরেজী মাধ্যমে পড়াতে আরও বেশি আগ্রহী হচ্ছেন।

  3. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় ! ইংরেজি মাধ্যমের কিছু পোলাপাইন আমার আত্মীয়ের মধ্যে আছে। এদেরকে সবসময়ই কেমন জানি একটা হামবড়া ভাব নিয়ে চলতে দেখতাম। ছোটকালে নিজের মধ্যে এই নিয়ে আমার বেশ ভালো রকমের ইনফিরিওরিটি কম্পলেক্সও তৈরি হয়েছিল। অথচ বড় হতে হতে বুঝলাম, বরং এক ইংলিশে ছোটকাল থেকে ফ্লুয়েন্ট বলতে পারা ছাড়া আরও অনেক কিছুতেই ওরাই ইনফিরিওর অবস্থায় আছে।

    আমি খুবই পজিটিভলি নিলাম লেখা ও অনুবাদ। :love:

  4. জ্ঞানচোর বলেছেনঃ

    বক্তব্য যেহেতু একজন ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষিতের কাছ থেকে এসেছে, সেহেতু তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছেন বলে বোধ করি।

    তবে, এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, কুয়োর ব্যঙ যখন সাগরের পানিতে নামার পর, লবণাক্ততার কষ্ট পেয়েছে, তখন, সে কেবল ঐ কষ্টটুকুই দেখতে পাবে। আমি বরং বলতে চাই, খুঁজতে গেলে আরো অনেক নেতিবাচক পার্থক্য দেখা যাবে।

    আমি যতদূর খোঁজ নিয়েছি, বর্তমান বাংলা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের যে কাজের চাপ, তার থেকে ইংরেজী মাধ্যমে কাজের চাপ অনেক কম। সিলেবাসেরও কমতি আছে বলে শুনেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা না দেবার পেছনে এটা একটা বড় কারণ বলে জানি। তাছাড়া, একাধিক দফায় পরীক্ষা দেবার সুযোগ থেকে শুরু করে, বয়সভিত্তিক বিভিন্নভাবে পেছিয়ে যাবার একটা সূক্ষ প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়।

    এতসব সামনে রাখলে, দুরত্ব তৈরির পরিস্থিতিটা আরো স্পষ্ট হতো।

  5. হৃদয় বলেছেনঃ

    লেখাটার কিছুটা একতরফা ভাবে শুধু ইংলিশ মিডিয়ামের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে না ধরলে, অন্ততপক্ষে এন্ডিংয়ের আগে কিছু পজিটিভ দিক তুলে ধরলে বোধয় লেখাটা আরেকটু পূর্ণতা পেত।
    -যেমন ওদের সিলেবাস কাঠামোটা আমাদের বাংলা মিডিয়ামের চেয়ে অনেক বেশি অ্যাডভান্সড। আমাদের এইচএসসি সিলেবাসের অনেক কিছু সম্বন্ধেই ওরা ক্লাস সেভেন-এইট থেকে জেনে আসে। যেমন ধরুন, ক্যালকুলাস: অনেক গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি সম্পর্কে আমরা প্রথম ধারনা পাই, এইচএসসি অঙ্ক বইয়ে ( শুধু টেক্সটবইয়ের কথা বলছি) যা ওরা শিখে আসে স্ট্যান্ডার্ড- সেভেন কি এইট থেকে। বায়োলজি সহ কেমিস্ট্রির অনেক ইম্পরট্যান্ট টপিকসই ওরা বেশ আগে থেকে জেনে আসে। নাহ, আমি কোন অভিযোগ করছি না। মূলত বলতে চাইছি, ওদের সিস্টেম্যাটিক সিলেবাসের পজিটিভ দিকটা। যদিও বাংলা মিডিয়ামের সিলেবাসের এখন বেশ রদবদল হয়েছে।

    তবে কিছু ইতিবাচক দিকের চাইতে নেতিবাচক দিকের সংখ্যাই বেশি!
    অদ্ভুত হলেও সত্যি, ইংলিশ মিডিয়াম থেকে আগত বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় বর্ষে পড়া শিক্ষার্থী বাংলা বলতে মুখ ভারী হয়ে আসে, কিন্তু তাতে কিছুটা লজ্জাবোধও করে না: এটাই অনেকক্ষেত্রে স্মার্টনেসের ইয়ার্ডস্টিক হয়ে দাঁড়ায় আরও প্রিসাইসলি বললে, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াকে অনেক ধনিক শ্রেণীর মানুষই দেখেন, বিলাসিতার একটা মাপকাঠি হিসেবে!

    এত কিছুর পরও, সরকারী কর্মক্ষেত্রে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়াদের সংখ্যা নেই বললেই চলে। এইচএসসি পরবর্তীতে অনেকেই মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয়ে পাড়ি জমায় বিদেশে, যেটা আমাদের দেশের জন্যও সুখকর নয়।

    ‘জাতীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও আর্থসামাজিক অবস্থাকে কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজি – এ দুই মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একীভূত প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়েই শুরু হতে পারে এই পথচলা।’
    -কথাটার সাথে পুরোপুরি একমত পোষণ করছি। সমস্যা সমাধানে এটা বেশ ইফেকটিভ উপায় হতে পারে।

  6. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেমেয়েদের সাথে যতটুকু মিশেছি, তাতে মনে হয়েছে যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের ভর্তি হবার পেছনে এক ধরনের ভয়, অনীহা এবং বিবমিষা কাজ করে। হয়তো এটা দীর্ঘদিন ধরে একটা বদ্ধ পরিবেশে থাকার নেতিবাচক প্রভাব। কিন্তু আমার মূল প্রশ্ন হলো, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের কতজনের সন্তান বাংলা মাধ্যমে পড়ছে বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে? আমার ডিপার্টমেন্টে কিন্তু সংখ্যাটা শূন্য! যদি দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘ইংরেজি মাধ্যম’ এবং ‘ব্রেইন ড্রেইন’ প্রীতির এই অবস্থা হয়, তবে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের আদতেই কতটুকু দোষ দেয়া যায়?

    অনুবাদ বরাবরের মতই চমৎকার।
    তবে শব্দটা ‘একাত্তুর’ না হয়ে ‘একাত্তর’ হলেই ভালো হতো বলে মনে হচ্ছে।

    • সামিরা বলেছেনঃ

      ইংরেজি মাধ্যমের কিছু দারুণ ভালো ব্যাপার আছে বাংলা মাধ্যমের তুলনায়, এই জন্যই হয়তো সক্ষমরা সেখানে সন্তানদের পড়াতে চায়। যেমন বাংলা মাধ্যমে পড়ে সত্যিই কিছু শেখার বা জানার মানসিকতা তৈরি করার জন্য পরিবারের ওপরেই সব দায়িত্ব বর্তায়, সে দায়িত্ব তারা না পালন করতে পারলে আসলেই বড়সড় ক্ষতি হয়ে যায় – আমার স্বল্প জ্ঞানের ভিত্তিতে এই হলো ব্যক্তিগত মত। তারা সন্তানদের যেখানেই পড়ান, যে কারণটা তাদেরকে বাংলা মাধ্যম কিংবা বাংলাদেশ থেকে বিমুখ করছে সেটা অপসারণে তারা কতটা কাজ বা চিন্তা করেন সেটা মুখ্য।

      আর লেখায় আসলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়াদের কোন দোষ দেয়া হয়েছে বলে আমার মনে হয় নি, স্কুলগুলো যারা চালান তাদের ভুল ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।

      বানান-টানান ভুলে দেখি শেষ! 🙁 ঠিক করে নিচ্ছি।

  7. শাহরিয়ার বলেছেনঃ

    লেখাটা পড়ার সময় মন্তব্য করার জন্য যে কথাগুলো মনে আসছিলো, তা রাইয়্যান ভাইয়া আর হৃদয় মোটামুটি বলেই দিয়েছে! সুতরাং আমি একটু অন্যদিক থেকে বিশ্লেষণ করি।

    হৃদয় ওদের সিলেবাস কাঠামোর পজিটিভ দিক সম্পর্কে বলেছে। প্রথমে আমি একটু যোগ করি এখানে। ওদের যে ক্লাসরুমের পরিবেশ আর পাঠদান পদ্ধতি, তার সাথে আমাদের বাংলা মিডিয়ামের ক্লাসরুমের পরিবেশের আর পাঠদান পদ্ধতির আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে! আমার মনে হয়, টু সাম এক্সটেন্ট অন্তত ছোট ক্লাসগুলোতে (যেমন প্লে গ্রুপ থেকে ওয়ান কিংবা টু) ওদের কিছু কিছু ‘ইউনিক’ বৈশিষ্ট্য সত্যিই অনুসরণ করার মত।

    এবার লেখার টোনের ব্যাপারে আসি। আচ্ছা, এই লেখার টার্গেট অডিয়েন্স আসলে কারা? আই মীন, শুধু আমরা কিংবা নীতিনির্ধারকরা, নাকি ইংলিশ মিডিয়ামের কারেন্ট স্টুডেন্টরাও? ভাল দিকগুলো এখানে প্রাসঙ্গিক নয় বটে, অভিযোগগুলোও প্রায় শতভাগ ঠিক; কিন্তু যে ভাষায় ঢালাওভাবে সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়েছে, তা কি তাদের মাঝে সচেতনতা তৈরিতে সক্ষম হবার মত হয়েছে? আমি ভাবছিলাম, লেখাটা পড়ে ইংলিশ মিডিয়াম ব্যাকগ্রাউন্ডের কয়েকজনকে পার্সোনালি পড়তে দিব। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে, এতে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনাই বেশি! কারণ, সমালোচনাগুলো যতই সত্য হোক, নিজেদেরকে এভাবে ‘কুয়োর ব্যাঙ’, কিংবা ‘ডাস্টবীনের কীট’ হিসেবে আবিষ্কার করার পর তারা তাদের ভাবনার জগতে নাড়া অনুভব করবে, আর নিজেদেরকে সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবে – এমন সম্ভাবনা খুব কম!

    পরিশেষে, একটা খবর জানিয়ে শেষ করি, যা কিঞ্চিৎ আশার আলো দেখাতে পারে। সম্প্রতি সারাদেশের স্কুল লেভেলের ৬৪টা দল নিয়ে একটা সাধারণ জ্ঞান কুইজ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে, শুধু “বাংলাদেশ বিষয়াবলী”র উপর। একটা বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সেটা এখন নিয়মিত সম্প্রচার করা হচ্ছে। সেখানে বাংলা মিডিয়ামের বাঘা বাঘা স্কুলগুলোর সাথে পাল্লা দিয়েছে বেশ কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলও! আর এর মধ্যে একটি স্কুল সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়ে শুধু একটা প্রশ্নের নম্বরের ব্যবধানে ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে (সম্প্রচার হবার আগেই তথ্যটা ফাঁস করা উচিৎ হল কি না জানি না 😛 ) ! এছাড়া আজকাল আরও কিছু স্কুল বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশ বিষয়াবলী নিয়ে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরণের প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে। সুতরাং, যদিও চেষ্টা ও উদ্যোগগুলো এখনও যথেষ্ট মাত্রায় পৌঁছে নি, কিন্তু তারা যে উদাসীনতা কাটিয়ে উঠে ব্যাপারগুলো নিয়ে এখন চিন্তা করছে, তা বেশ বুঝা যায়। অতএব ‘কুয়ো’ থেকে তারা অচিরেই বেরিয়ে আসছে, এই স্বপ্নটা আমরা এখন দেখতেই পারি। 🙂

    • সামিরা বলেছেনঃ

      কুয়োর ব্যাঙ ব্যাপারটা মূল লেখায় ছিল না, ছিল বাব্‌ল ফেটে বেরিয়ে আসার কথা। বাংলায় আক্ষরিক অনুবাদ করাটা যুতসই মনে হয় নি।

      লেখার মূল পয়েন্ট, উদ্দেশ্য একেবারে শেষে এসেছে, যেটা নিয়ে কেউ কিছু বললো না দেখে একটু হতাশ হয়েছি। বাংলা আর ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের বেড়ে চলা দূরত্ব দেশে সামনের দিনগুলোতে কেমন উদ্ভট সমস্যার জন্ম দিতে পারে তা নিয়েই লেখাটা।

      টার্গেট অডিয়েন্স আমার কাছে মনে হয়েছে নীতিনির্ধারকদেরকেই, দেশের আর ইংরেজি মাধ্যমের। শিক্ষার্থীদের এখানে করণীয় তেমন কিছু আছে বলে আমার মনে হচ্ছে না।

      আর বাংলা মাধ্যমের চাইতে ইংরেজি মাধ্যমের প্রায় সব কিছুই হয়তো ভালো, এই লেখায় উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়া – তাই সেটার উল্লেখ আমার কাছে তেমন প্রাসঙ্গিক মনে হয় নি।

      প্রতিযোগিতার কথা জেনে খুবই ভালো লাগলো। এরকমটা মাঝে-মধ্যেই হয়, কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ তেমন থাকে না। তাদেরকে উৎসাহী আর অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়!

      আমার অনুবাদের টোনেই কি লেখার মূল পয়েন্ট থেকে পাঠকদের দৃষ্টি কিছুটা সরে গেলো কিনা ভাবছি। :thinking: আর আমিই বা কেন আরেকজনের লেখাকে এত ডিফেন্ড করার চেষ্টা করছি! 😛

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।