[আগের দুটি পর্ব না পড়েও যদি কেউ এই পর্বটি পড়ে থাকে, মোটামুটি বুঝতে পারবে কাহিনী, তেমনভাবেই লিখা হয়েছে এই পর্ব। কিন্তু পরিপূর্ণ স্বাদের জন্য আগের দুটি পর্ব পড়া আবশ্যক। নাহলে পড়ার আনন্দ মোটামুটি অর্ধেকই মাটি হবে। এই পর্ব পড়ার আগে পাঠকের সুবিধার্থেই আগের দুটি পর্ব আগে পড়ে আসার অনুরোধ রইল। নিচের লিঙ্কগুলোতে পাওয়া যাবে এই সিরিজের আগের দুই পর্ব-
২। ইতস্তত বিপ্লবী ২ : উত্তেজক মৃত্যুযাত্রা
]
স্থান- কৃষ্ণপুরা, নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ
সময়কাল- বর্তমান
শীত ততদিনে পড়তে শুরু করেছে, তবু সে রাতটা কেমন যেন অস্বাভাবিক উষ্ণ ছিল। প্রতি রাতের মত আজও পুকুরপাড়ে বসে আছে কাওসারের মা। রাত যখন গভীর হয়, তখন তিনি এখানে এসে বসেন। গত দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি একাজটা করে আসছেন। ঠিক যেদিন কাওসার এই পুকুরে ডুবে মারা যায় সে রাত থেকে তিনি অপেক্ষায় থাকেন, স্রষ্টা তার আকুতি শুনে যেখান থেকে তার ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানেই ফিরিয়ে দিয়ে যাবেন তার কোলে। মৃতদেহটা একনজর দেখার পর জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিনি, তার মনে আছে, চোখগুলো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো কাওসারের। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ছিল, খামচে ধরে রেখেছিল পুকুরের তলার মাটি। “আরে বদ পোলা আমার! কইলাম যাইস না একলা সাঁতার কাততে, তুই পারস না ঠিকমত! শুনলনা আমার মানিক, এহন কই পাই তরে?” বিলাপ রাতের নিস্তব্ধতাই শুধু ভাঙে। সেদিন রাতে স্রষ্টা তার কথা না শুনলেও অন্য কোন একজন তার আকুতি শুনেছিল মনে হয়।
তবে তার ফলাফল ভালো হয়নি।
স্থান- ঢাকা, বাংলাদেশ
সময়কাল- কয়েকমাস আগে
বাংলাদেশের রাজনীতির আগাগোড়া পরিবর্তন হয়েছে কদিন হল। অনেক আইন সংস্কার করা বাকি, ব্যস্ত দিন যাচ্ছে। অবসর সময়ে বন্ধুদের বাসায় ডাকি, আড্ডা জমে… যতক্ষণ না বাসার হ্যামেলিনের বাঁশি বেজে ওঠে। একেকজনের ফোন বাজা শুরু হওয়ার পরপরই বুঝে যাই, কিছুক্ষণ পরেই এরা সবাই হ্যামেলিনের বাচ্চাকাচ্চাদের মত সার বেঁধে বাসার দিকে রওনা হবে, আমার মত একা তো আর কেউ নেই, সংসার সবারই আছে, অদ্ভুত মায়ার সংসার।
সেদিন জনি ছাড়া আর কেউ আসেনি। পুলিশে চাকরি করে সে, কথায় কথায় এক অদ্ভুত প্রসঙ্গ তুলল সে সেদিন।
-আচ্ছা দোস্ত, তুই কই একটা খবর জানিস? বাংলাদেশে শয়তানের উপাসক দিন দিন আশংকাজনক হারে বাড়ছে!
-মজা নিচ্ছিস, তো? এখন বলবি আমি শয়তানের চেলা?
-আরে নাহ! সিরিয়াসলি বলছি আমি! সেদিনও একটা ধরা পড়েছে!
অবাক হলাম আমি।
-ধরা পড়েছে মানে কী? প্রচলিত আইনে শয়তানের উপাসনা করলে গারদে পুরতে হবে এমন তো কোন কথা নাই যতদূর মনে পড়ে।
-ওই কারণে ধরা পড়েনাই। আইনকানুন ঠিকঠাক করা তোদের কাজ। একে ধরা হয়েছে কিডন্যাপের অপরাধে।
-কাকে কিডন্যাপ করেছিল?
-একটা দুই মাসের বাচ্চা…
-মুক্তিপণ?
-নাহ! (চোখ চকচক করে ওঠে জনির, ঘৃণায়ই বোধহয়) বলি দেওয়ার জন্য!
-বলিস কী?! (আঁতকে উঠলাম আমি)
-হ্যাঁ! তবে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার অন্য জায়গায়। একে যেখানে রাখা হয়েছে ওখানে এই নিয়ে পাঁচবার সেন্ট্রি বদলাতে হয়েছে।
-মানে? বদলাতে হয়েছে কেন?
-একরাত ডিউটি করার পরপরই কেন জানি সবাই পরদিন হাত পা ধরে কান্নাকাটি করে অফিসারের, যাতে ওখানে ওকে আর না দেওয়া হয়। কারণ জিজ্ঞেস করলে অদ্ভুত সব কথা বলে, ভূতপ্রেতের। একজন দুইজন হলে পাত্তা দিতাম না, কিন্তু গত পাঁচ রাতে একরাতের বেশি কেউ ওই সেলের বাইরে ডিউটি করেনি।
-আচ্ছা কৌতূহল হচ্ছে অনেক। চল কালকে বিকালে দেখে আসি একসাথে, কোন থানায় আছে?
-রমনা…উফফ!
কথা বলতে বলতে হাতের বেনসনটা যে শেষ হয়ে গিয়েছিল, খেয়ালই ছিলনা জনির, পানি এনে দিলাম ওকে পোড়া জায়গায় দেওয়ার জন্য।
পরদিন বিকালে জনির সাথে গেলাম রমনা থানায়। জানা গেল, ষষ্ঠবারের মত সেন্ট্রি বদলাতে হয়েছে গত রাতে। জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে নিয়ে আসা হল কয়েদীকে। আমি বসলাম তার উল্টোপাশে, জনি বসল আমার পাশে, কয়েদীর দিকে তাকাতে অবাক হলাম আমি, সে সোজাসুজি আমার দিকে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত দৃষ্টিতে, যেন আমি তার বহুদিনের চেনা। শুধু তাই নয়, সে দৃষ্টিতে এক ধরনের আনন্দ ও হিংস্রতা মিশে ছিল, যেটা আমি ধরতে পেরেছিলাম, কিন্তু এর অর্থ আমি বুঝতে পারিনি সেদিন।
জনি কথা শুরু করে- নাম কী তো-? (মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া হয় তাকে)
-আপনি চলে যান।
-কী? (কয়েদীর কাছ থেকে এধরনের কথা সে শুনবে ভাবতেও পারেনি)
-আমি বলেছি আপনি চলে যান, আমি ইনার সাথে কথা বলব।
সামলে নিয়ে বড়সড় ঝাড়ি দিতে যাবে জনি, ওকে থামালাম আমি।
-কী বলার ওর সামনেই বলো।
আমাদের কয়েদীকে এরপর আর কোন কথা বলানো গেল না। সারাক্ষণ একটানা সে আমার দিকে একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, জনি মাঝে হালকা মারধরও করেছে, তাতে তার কোন বিকার হয়নি, সে তাকিয়েই ছিল আমার দিকে, একদৃষ্টিতে।
বের হলাম কক্ষ থেকে আমি আর জনি, হঠাৎ কী মনে হতে আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে কক্ষের ভেতর ঢুকে পড়লাম।
আমার দৃষ্টিতে একই দৃষ্টিতে চেয়ে আছে লোকটা, আমি তার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী বলতে চেয়েছিলে বল। আমাকে চেন নাকি তুমি?”
উত্তর দিতে গিয়ে অসম্ভব ভারী হয়ে গেল লোকটার গলা, “লুসিফার তোকে চেনে, তুই হবি আমার উত্তরসূরি, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তোর নতুন জন্ম হবে!”
জনি ভেতরে ঢোকামাত্র লোকটা ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল, নাকমুখ থেকে রক্ত পড়তে লাগল। আমি আর জনি দৌড়ে গেলাম, ঘরটায় কেমন যেন একটা বাজে গন্ধ ছড়াচ্ছে, অনেকটা পচা মাংসের গন্ধের মত বিকট গন্ধ। মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম আমি, জ্ঞান হারানোর আগে টের পেলাম, ওই লোকটা যেন আমার মাথার ভেতর থেকে বলছে, “সামনের ১১ তারিখ। পাহাড়তলি, চট্টগ্রাম, কালো ফেরারি থাকবে স্টেশনে, চুপচাপ চলে যাবি। কেউ যাতে না জানে।”
হাসপাতালে শুয়ে জানতে পারলাম আমি যে লোকটা মারা গিয়েছে ওখানেই, আর আমার নাকি খিঁচুনি হচ্ছিল কেমন জানি। জ্ঞান ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে রিলিজ করে দেয় ওরা। জনি নিয়ে যেতে এসেছে, ওর কথার উত্তরে জানালাম লোকটা আমাকে কী বলেছে, ও এমন হাসা হাসল শুনে, যে ওকে আর আমার জ্ঞান হারানোর আগে শোনা কথাটা বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম আমি। ওর গাড়ি থেকে নামার আগে খোঁচাটাও দিতে থাড়ল না সে, “হয় ওই ব্যাটা ইয়ে ছিল নাহলে ওর লুসিফার! নাইলে এত মানুষ থাকতে, মেয়েমানুষ বাদ দিয়ে তোরে পছন্দ হইল কেন? তুইও ইয়ে নাকি? হেহেহে!” আমার হাতের কিল খেয়ে বিদায় নেয় জনি। ওর গাড়ি চলে যাওয়া মাত্র আবার সেই গন্ধটা টের পাই আমি, মাথা ঘুরতে শুরু করে, কোনরকমে গেটের মাথা ধরে সামলাই নিজেকে, চোখ বন্ধ করামাত্র আবার মাথার ভেতরে সে কণ্ঠস্বরটা শুনতে পাই, সেই একই কথা বলছে।
পরপর তিনদিন একই কাহিনী হওয়ার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, ডাক্তারের কাছে যাব। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে বের হবার সময়ই ঘটনাটা ঘটল। পুরো ঘরে সেই বিকট গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ল, আর আমার নিজেকে ভরশূন্য মনে হতে লাগল। কে যেন আমাকে শূন্যে তুলে নিল, তারপর বিছানায় আছড়ে ফেলল। আর কিছু মনে নেই আমার তখনকার কথা।
জ্ঞান ফেরার পর মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি ১০ তারিখ রাত ১০টা বাজে। সিদ্দান্ত নিয়ে ফেললাম আমি। রাত ১১টার বাস ধরছি চট্টগ্রামের।
১১ তারিখ কালো ফেরারিতে করে গভীর রাতে গন্তব্যে পৌঁছাই আমি। সেইরাতেই আমি দীক্ষা পাই শয়তান উপাসকদের কোভেন্টে। স্রষ্টাকে গালাগাল করার মাধ্যমে শুরু হয় আয়োজন, ভয়ংকর অশুভ কিছু আচ্ছন্ন করে রাখে আমার চেতনা, ওই শক্তির সাথে যুদ্ধ করার ক্ষমতা আমার ছিল না, জীবনের সব অপূর্ণতা চোখের সামনে ভেসে উঠে মনটাকে বিষিয়ে দেয় স্রষ্টার প্রতি। সমস্বরে তাকে ডাকার পর সাত বছর বয়স্ক এক ছেলের ওপর সে রাতে ভর করে লুসিফার। আমরা সবাই শ্রদ্ধায় মাথানত করি। আমি অনুভব করি পৃথিবীতে ভালো আর আলো বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব নেই। শুধু আছে অন্ধকার, আর এর প্রচণ্ড ক্ষমতা। ওই ছেলের মুখ দিয়ে লুসিফার আমাদের জানায় যে সে ভয়াবহ ক্ষমতা নিয়ে এরপরেরবার আসবে, আর আমাদের মধ্য থেকে একজনকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে টেনে এনে তার বাহন করবে। ওই কয়েদীর কথা মনে পড়ে যায় আমার। অজানা আশংকায় আর ভয়ে কেঁপে উঠি আমি। লুসিফার চলে যাওয়ার পর জানতে পারি ছেলেটি মারা গিয়েছে। লুসিফার যার ওপর ভর করে সে কোনদিন বেঁচে থাকতে পারেনা বেশিক্ষণ। কথাটা এখন আমি বিশ্বাস করি, চোখের সামনেই দুবার দেখা হয়ে গিয়েছে একয়দিনে।
সে রাতের পর অনেকদিন তার সাথে আমার দেখা হয়নি। ঠিক যখন সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে চলে আসতে গেলাম ৫৪টা ঘুমের ওষুধ খেয়ে, বিছানায় যাওয়ার পরপরই টের পেলাম কিছু একটা ঠিক নেই। সেই বিকট গন্ধটা আবার অনুভব করলাম আমি বহুদিন পর। চারদিকে শূন্যতা নেমে আসল আগের মত, আর ভয়াবহ অন্ধকার। আমার মাথাটা দপদপ করছিল, শুনতে পেলাম সেই ভয়ানক কণ্ঠস্বর আবার, “তুইই হবি আমার প্রথম মৃত্যুঞ্জয়ী বাহন!হাহাহা!” বিকট হাসির তীক্ষ্ণ শব্দে, কিংবা সেই পচা গন্ধে, কিংবা ওষুধের ক্রিয়ায়, যেভাবেই হোক, আমি অচল হয়ে গেলাম। এটাকে কী মৃত্যু বলে কিনা আমার জানা নেই, কিন্তু এ অভিজ্ঞতা যেন পরম শত্রুরও না হয়। ভয়াবহ যন্ত্রণার পাশাপাশি সে গন্ধটা আমার পিছু ছাড়ছিল না। তারপরই আমি তাকে দেখলাম, একটা পশুর মুখ, কোন নাক নেই, বিশাল এক লাল জিহ্বা, আর চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে, সাথে ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর সমস্ত অশুভ, আর অন্ধকার, আনন্দে বিচিত্র শব্দ করছে প্রাণীটি, আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগল শয়তানের ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন যুদ্ধে মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ, গড়াতে থাকা দেহবিহীন রক্তমাখা চোখ, সেই পাহাড়তলির কোভেন্ট, বলি দেওয়া অসংখ্য মানবশিশুর রক্তশূন্য দেহ, আগুন আর আগুন, আগুনের সমুদ্র… এভাবে চলতে থাকল অনন্তকাল, হয়ত আমাকে নিয়ে মৃত্যু আর শয়তানের মধ্যে টানাহ্যাঁচড়া চলছিল… তারপর একসময় আমি আবার তাকে শুনতে পেলাম, পরিষ্কার কণ্ঠে সে আমাকে নির্দেশনা দিচ্ছিল, “তোকে নবজন্ম দিলাম আমি, তোকে দিয়ে আমি এবার সব কাজ করাব। হিংসা, পাপ আর ধ্বংস চলবে সমানতালে। শুরু হবে তোর আপনজনদের দিয়ে, তোর সবচেয়ে ভালোবাসার জায়গাগুলো জ্বালানোর মাধ্যমেই শুরু হবে, বাচ্চাকাল থেকেই শুরু করবি চল!”
আমি ঠিক তখনই জানতাম কোথায় চলেছি আমি।
স্থান- কৃষ্ণপুরা, নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ
সময়কাল- বর্তমান
মনে পড়ে যাচ্ছে দেড় যুগ আগের কথা আমার। এই রাস্তার মাথায়ই কাওসার আমাকে বিদায় দিয়েছিল, প্রাইমারী স্কুলে আমার প্রিয়তম বন্ধু ছিল সে, ফাইভ পাস করার পর আমরা ঢাকায় চলে আসি। যাওয়ার আগে ওর বাসায় একদিন কাটিয়ে গিয়েছিলাম। বিদায় দেওয়ার সময় ও বলেছিল, “আরে টেনশন করিস না, হাইস্কুলটা নাহয় ভিন্ন জায়গায়ই পড়লাম, ম্যাট্রিকের পর আমিও ঢাকায় আসব, তখন আমরা দুজন একসাথে নটরডেমে পড়ব।”
এই ঘটনার কয়দিন পর কাওসার ওদের বাড়ির পুকুরে ডুবে মারা যায়। কোন এক অদ্ভুত কারণে আমি একটাবারও আসিনি ওর কবর দেখতে। যতদিন মানুষ হয়ে বেঁচে ছিলাম এই জিনিসটা আমাকে পুড়িয়েছে অনেক। আজ এই অপরাধবোধের সমাপ্তি ঘটবে।
বিলাপরত মহিলাটা আমাকে দেখতে পায়নি, নিঃশব্দে তার পেছনে এসে দাঁড়ালাম, নিজের মধ্যে অন্ধকারের অপরিসীম শক্তি অনুভব করতে পারছি, আমার উপস্থিতিতে শীতের রাত উষ্ণ হয়ে গিয়েছে, সব রাতজাগা পাখি চুপ হয়ে গিয়েছে। আমার আঙুলের ইশারায় এই মুহূর্তে মহিলার হৃৎপিণ্ড হাতে চলে আসতে পারে আমার, কিন্তু আমার ভেতরে কে যেন বলে উঠল, সেটা যথেষ্ট বিনোদনমূলক হবেনা। ছুঁড়ে ফেললাম আমার বাল্যবন্ধুর মাকে সেই পুকুরেই, তার বিলাপের প্রতিধ্বনি এখনও মিলিয়ে যায়নি। তার আগেই তিনি পুকুরের তলদেশে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, তার ছেলের দিকেই।
প্রাথমিক কাজ শেষ করে আসল কাজে মনযোগ দিলাম আমি। এই এলাকাটার টিকে থাকার কোন প্রয়োজন অনুভব করছিনা। প্রচণ্ড ক্রোধে আমি কাঁপছি, শয়তান কাঁপছে, প্রলয় আসন্ন তবে!
শেষ রাতের ব্রেকিং নিউজ সব চ্যানেলে- স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নারায়ণগঞ্জের কৃষ্ণপুরা এলাকা পুরোটাই ভস্মীভূত।
স্থান- ঢাকা, বাংলাদেশ
সময়কাল- কৃষ্ণপুরা ঘটনার কয়েকদিন পর
জনি বাসায় যাচ্ছিল গভীর রাতে নিজের গাড়ি চালিয়ে, এয়ারপোর্ট থেকে খিলক্ষেত যাওয়ার এই রাস্তাটায় ড্রাইভ করা সবসময়ই আনন্দের, স্পীড আরো বাড়িয়ে দিল সে, মনটা ভালো নেই, দেশের বিভিন্ন যায়গায় অদ্ভুত সব ধ্বংসযজ্ঞ হচ্ছে একয়দিন। আজ সবগুলো ঘটনা মিলিয়ে দেখে অদ্ভুত এক অস্বস্তি ঢুকেছে তার মনে। তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটির জীবনের সাথে কোন না কোনভাবে এই এলাকাগুলো জড়িয়ে আছে বলে সে টের পেয়েছে, কিছু একটা মিস করে সে অবশ্যই গিয়েছে। কিন্তু কী সেটা, ধরতে পারছে না। তার সেই বন্ধুটি আসলে আমি, যে আরো কয়েকদিন আগে নিউইয়র্কে আত্মহত্যা করেছে বলে সবাই জানে। রাত ২টার সময় জনশূন্য মহাসড়কে তার সেই বন্ধুকে তার গাড়ির সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখলে তার ঠিক থাকার কথাও না, সে থাকতে পারলও না। হার্ডব্রেক করল, ঠিকমত করতে পারল না, গাড়িটা উলটে গিয়ে আছাড় খেল বাজেভাবে কয়েকবার। আমার ইশারায় গাড়ির জানালা ভেঙে তার রক্তাক্ত দেহ শূন্যে ঝুলতে লাগল।
আমার গলা দিয়ে পৈশাচিক শব্দ বের হল, “আমাদের নিয়ে ব্যঙ্গ করেছিলি না একদিন? অনেক মজা লাগছে না এখন?”
কেঁপে উঠল জনির দেহ। আমি ওর চিন্তাধারা পড়তে পাচ্ছি, ও সেটা জানে না। ও আমাকে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছে অনেক কিছু, আমি বেঁচে আছি এটা সে বিশ্বাস করতে পারছে না। তারচেয়ে বড় কথা সে কিছু একটা লুকাতে চাচ্ছে। বোকা মানুষ! শয়তানের কাছে কিছুই গোপন থাকে না। তবে খবরটা আমাকে অবাক করল কিছুটা। সাথে সাথে আমার পরবর্তী গন্তব্যস্থল সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেলাম।
জনির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম, ওর রক্তাক্ত দেহ চারখণ্ড হয়ে রাজপথে ছড়িয়ে পড়ল।
যত আপনজন ছিল আমার এ দুনিয়ায় সবাইকে মারা শেষ আমার। একজন বাদে। ফ্লোরিডা ডাকছে আমাকে।
স্থান- দক্ষিণ ফ্লোরিডার কোন এক হাসপাতাল, আমেরিকা
সময়কাল- জনি হত্যার কয়েকদিন পর
সেই অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্নটা ভেঙে চেতনা ফিরে আসে আয়েশার। মৃত্যুর আগে নাকি মানুষ জীবনের সুখের স্মৃতিগুলো চোখের সামনে দেখতে পায়, আয়েশাও দেখছিল, কিন্তু মরা হয়নি আর তার। কোমায় পড়ে গেছে সে। ভাগ্য ভাল, শকটা অত ভয়াবহ ছিল না, মোটামুটি দুই সপ্তাহ পর সেরে উঠল সে, কোমা থেকে উঠতে পারল। কিন্তু ডাক্তাররা শরীর ঠিক হওয়ার আগে ছাড়বে না তাকে, সুতরাং থাকতেই হচ্ছে তাকে হাসপাতালে। কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে কথা বলার শক্তিটা সম্ভবত চিরতরে হারিয়েছে সে।
ভোররাতের দিকে হাসপাতালে প্রবেশ করি আমি, কর্মরত গার্ড, ডাক্তার এবং নার্সদের সবকটাকে দম বন্ধ করে মৃত্যুর স্বাদ উপহার দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর সব অশুভকে নিয়ে আমার একসময়ের সবচেয়ে শুভ মানুষটির কক্ষে প্রবেশ করি আমি।
শয়তান আমার আত্মাকে অধিকার করার পর এপর্যন্ত কোন কাজে আমি ইতস্তত করিনি, কোন অশুভ কাজে থমকে যাইনি আমি, কিন্তু কোমায় পড়ে থাকা আয়েশাকে দেখে সে জোয়ারে যেন খানিকটা ভাটা পড়ল।
লুসিফারের নির্দেশ আমি যাতে সবচেয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করি আয়েশাকে, কিন্তু আমি আমার মধ্যের পরিবর্তনটা টের পেয়েছি এই ঘরে ঢোকার পর, ওই মায়াবী মুখ আমার শক্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে, শয়তানের সেটা ভালো লাগেনি।
কোন এক কারণে ঘুম ভেঙে গেল আয়েশার। চোখ খোলার আগেই সে নাক চেপে ধরল, ভয়াবহ দুর্গন্ধ! আর চারদিক এত অন্ধকার কেন? এত চুপচাপ কেন সব?
এই কথাটা মনের মধ্যে আসামাত্র ঘর আলোয় আলোকিত হয়ে গেল। চোখ মিটমিট করে তাকাল সে চারদিকে, তারপর ভয়াবহভাবে চমকে উঠল আমাকে দেখে।
তারপর হঠাৎ করেই দুম করে নিভে গেল সমস্ত আলো। চারদিকে আবার নেমে এল সেই শ্মশানের নীরবতা। এগিয়ে গিয়ে আয়েশার গলা চেপে ধরলাম আমি, ওকে নিজ হাতের স্পর্শে শেষ করতে হবে। ওর চোখের তারায় পরিষ্কার বিস্ময়, আস্তে আস্তে সেটা এক প্রবল দুঃখবোধের ছায়ায় রূপ নিল, আর সেই মুহূর্তুটাই সব এলোমেলো করে দিল। আমার ভেতরের মানুষ সত্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল প্রবলভাবে, হাত পিছলে গেল আমার, আমি কীভাবে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষকে হত্যা করতে পারি?
আমার ভেতরে তখন ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে, শয়তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে উঠেছে আমার সত্তা, কিছুতেই এটা হতে দেবে না, কিন্তু সেই ভয়াবহ অশুভ শক্তির সাথে আমি পেরে উঠছি না, বারবার সে হাত নিয়ে যাচ্ছে ওর গলার কাছে, আমি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি, আয়েশার চোখের দিকে সরাসরি তাকালাম। আমার শক্তির উৎস ওই একজোড়া চোখ, যেখানে এখন আকুতি দেখতে পাচ্ছি।
শয়তানকে অভিশাপ দিলাম আমি, দূর হয়ে যেতে বললাম, ওকে আমার নিয়ন্ত্রণ আর রাখতে দিচ্ছি না আমি, জয় হতে চলেছে আমাদের।
কিন্তু প্রত্যেক বিজয়ের পেছনে কিছু ক্ষয়ক্ষতি থাকে।
যাওয়ার আগে প্রচণ্ড ক্রোধে আমার চোখ দুটো তুলে নিল লুসিফার, সাথে আমার চেহারা প্রচণ্ড উত্তাপে গলিয়ে দিল, যাতে সারাজীবন কষ্টে থাকি আমি, মৃত্যুর চেয়ে বড় শাস্তি আমাকে দিতে চায় সে। সারাজীবন অপরের মুখাপেক্ষি করে রাখতে চায়, আয়েশার ওই চোখ জোড়া আর কখনও দেখতে দেবে না সে আমাকে, যদিও আয়েশা ঠিক পাশেও থাকে আমার। প্রচণ্ড ব্যথায় মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাম আমি।
স্থান- ঢাকা, বাংলাদেশ
সময়কাল- পাঁচ বছর পর
“বাবা, বাবা, ওই বিড়ালটা না আবার কান্নাকাটি করছে” ছোট্ট পূর্ণতার গল্প শুনছি আমি। রোজ রাতে আমাদের পারিবারিক বৈঠক বসে, আমি আর পূর্ণতা তার বক্তা। আয়েশা বৈঠকের নেতা এবং শ্রোতা। চোখে না দেখলেও আমি ঠিক বুঝতে পারি আয়েশা ঠিক আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর নিঃশব্দে বলছে, “মেয়েটা ঠিক তোমার মতই হয়েছে।”
শয়তান ভুল করেছিল, যত কষ্টই হোক, বেঁচে থাকা কখনও কোন শাস্তি নয়। সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।
খাইছে!! পুরাই ভুতুড়ে কাহিনী, আবার শেষে এসে জীবনের গল্প!! ফিউশনটা ভালো লেগেছে! :beshikhushi:
বাই দ্য ওয়ে, পোস্টের ট্যাগগুলো দেখে বিশাল মজা পেলুম! পিশাচ কাহিনী’র সাথে রোমান্টিসিজম!! ওয়াহ ওয়াহ!! 😛
:love:
মিশাইতে মজা লাগসে আমারও! 😀
কিন্তু তমারে না গভীর রাতে পড়তে বলসিলাম??
আগে পরোলা কেন? :crying:
*পড়লা
শেষটা সত্যিই সুন্দর। আর লেখার ঢং-টা তো আগে থেকেই ভালো লাগে আমার। 🙂
পড়তে পড়তে একবার সরব মাশুদুল হকের লেখাকে মনে পড়ে গেছিল।
🙂
কোন সময়টাতে ঠিক?
আর আপনার এই ভালো লাগাটা আমার সবসময়ের অনুপ্রেরণা! :happy:
ঠিক কোথায় জানি না, উনার ‘ভেন্ট্রিলোকুইস্ট’ লেখাটার কথা মনে পড়ে গেছে। মনে হয় দুটার genre একই হওয়ায় প্লাস লেখনীতেও মিল আছে। 🙂
‘ভেন্ট্রিলোকুইস্ট’ পড়া হয়নি, সরবে পেলামও তো না 🙁
আরে …… দারুন লিখা তো !! বেশ ভালো লাগলো :guiter:
:happy:
পড়ার জন্য ধন্যবাদ!!
খুবই ভালো লাগল। টানটান উত্তেজনাময় গল্প। ঠিক যেন তিন গোয়েন্দা পড়ার দিনগুলোয় ফিরে গিয়েছিলাম। গাঁথুনি, ভাষা সবদিক থেকেই অনেক পরিণত। এইরকম থ্রিলার গল্প আরও চাই ভাইয়া। 😀
শুভকামনা !
:happy:
ভালো লেগেছে বুঝলাম, তাই বলে আমার প্রিয় সিরিজটার সাথে তুলনা? অনুপ্রেরণাটা একটু বেশিই হল, আপু! চেষ্টা থাকবে!