আকাশের বিন্দু থেকে মেঘ এনে দিতাম তোমার ডানায়”
কখনো কি ব্যস্ত শহরের টেবিলে চাপা পড়া জানালাটিকে খুলে দেখা হয়! প্রতিদিন সূর্যের সাথে সাথে জেগে উঠে প্রকৃতি। তারপর পড়ন্ত বিকেলে ভারি কাঁচের ওপার দিয়ে অভিমান নিয়ে চুপটি করে চলে যায়। কম্পিউটার স্ক্রীনে লেমিনেটিং হয়ে গেছে আমাদের চোখ। অনুভূতিগুলো বাক্সে বন্দি হয়ে ড্রইংরুমে সাজানো। তাই উত্তাল হাওয়ায় আমাদের ভেসে যাওয়া হয় না।
কিন্তু আত্মার দাবিকে কতক্ষণ উপেক্ষা করা যায়? অলস দুপুরে ক্লান্ত বইয়ের পাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে যখন পলক বুঁজে আসে, ঘুমন্ত দুপুরের অসাড়তাকে বিদীর্ণ করে উড়ে যাওয়া কাকের চিৎকার কি চকিতে ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দিয়ে যায় না? চোখের ঘুম না, জেগে জেগে ঘুমানো ঘুম। কৃত্তিমতার নেশায় ডুবে থাকা ঘুম।পর্দা দিয়ে ঘিরে রাখা মোহটা ভেঙে যায়।বয়ে চলা স্রোত থেকে টেনে তুলে নিয়ে আসে শিকড়ের দাবি। অনেক মাটি, ময়লা আবর্জনা হয়ত জমেছে তার উপর কিন্তু শিকড় রয়ে যায় তবু। শিকড়ের দাবি বদলায় না। আত্মার দাবি তাদের শিকড়ের সব গুলো শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে মনের ভিতর আঁকড়ে বাসা বাঁধে। জোর করে আর চোখ বুঁজে থাকা যায় না তখন।শিকড়ের টান,অস্তিত্বের আবেদন, সেই অস্তিত্বের প্রতি ভালোবাসা আর উপেক্ষা করা যায় না। চুপি চুপি মনের কথাটি কানের কাছে এসে গুনগুনিয়ে যায়।
“ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো– তোমার
মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো– তোমার
চরণমঞ্জীরে॥”
পাখিদের তাই আমার খুব হিংসে হয়, দুই দিকে ডানা ঝাপটে চোখ বন্ধ করে আকাশে ভাসতে কেমন লাগে আমার খুব জানার ইচ্ছে। আকাশটার উপর তখন থাকবে আমার মনের মত অধিকার, যখন তখন থাকবে আমার আনাগোনা। আর ছাদে উঠার প্রতীক্ষায় থাকতে হবে না। বুভুক্ষের মত কিছুক্ষণের জন্য গলা বাড়িয়ে আকাশের পানে চেয়ে থাকতে হবে না। মুক্ত বিহঙ্গের জীবন চাই, শুধু প্রকৃতির কাছে থাকার জন্য, আকাশটা ছোঁয়ার জন্য, গাছের ডালে বসার জন্য, রংধনুর রঙে খেলা করার জন্য……
ভাবতেই কেমন লাগে- মেঘগুলো স্পর্শ করে থাকবে আমার ডানা! কেমন হবে সেই অনুভূতি? আমার খুব জানার ইচ্ছে। আর তখন যদি বৃষ্টি হয়? মেঘের ভাঁজে লুকিয়ে থাকলে কি গায়ে বৃষ্টি পড়বে? বৃষ্টিকে কত কাছ থেকে ছোঁয়া যাবে তখন!
লম্বা একটা শ্বাস নিতে ইচ্ছা করে, তাতে যদি আকাশ আর আমার অস্তিত্বটা মিলেমিশে এক হয়ে যেত……
যখনই খুব মন খারাপ থাকে, বিশাল আকাশ দেখি। বিশালতায়, বিশুদ্ধতায় হারিয়ে যাই।
তুলোর মতো মেঘগুলো যখন দেখি তখন শুভ্রতা ছুঁয়ে যায়। মনে হয় যেন বুক ভর্তি করে সতেজ বাতাস নিলাম। মনটা তখন অস্থির হয়ে যায়। মেঘ ছুঁয়ে যাওয়া বাতাস মনে পাগল করে দেয়। ইচ্ছা করে ছুটে যেয়ে মেঘের উপর একটা বাড়ি করি। মেঘের সাথে বসবাস করি, মেঘের বাড়িতে থাকবে আমার নিমন্ত্রণ, আমার বাড়িতে মেঘের! মেঘের দিকে কত ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থেকে পার করে দিলাম তার সীমা ওই মেঘের মতোই অস্পৃশ্য। হাঁটতে হাঁটতে যখন মেঘের দিকে তাকাই, এক পরম প্রশান্তি মন ছুঁয়ে যায়, এ যেন প্রিয়তম কোনো বন্ধুর হাত ধরে পথ চলা।
আকাশ নাকি ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। কই আমার তো এমন মনে হয় না। সারাক্ষণ যে আকাশটা মনকে দোলা দিয়ে যায়। এ যেন জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক……
আকাশ আর পাহাড়ের সীমাটা কোথায়? খুব ছুঁয়ে যেতে ইচ্ছা করে পাহাড়ের ঘাড়ে আকাশের নিঃশ্বাস, দেখতে ইচ্ছা করে আকাশে মোড়ানো পাহাড়টা।
ওই ছোট্ট ঝোপে যদি জীবনটা কাটিয়ে দেয়া যেত! পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট একটা দ্বীপ-আজন্ম লালিত সাধ।
মাথার উপর আকাশ, জমাট জমাট সাদা মেঘ, হঠাৎ এক পশলা নীল, পা ছুঁয়ে যাওয়া পানির স্রোত, চোখের সামনে নির্মল প্রকৃতি- এ যেন আমারই সত্ত্বা , পানিতে সবুজের প্রতিফলন- যেন আমারই অস্তিত্ব দর্পণ হয়ে আমার মনে পদার্পণ।
হতো নাহয় নৌকায় আমার বাড়ি, ওপারেতে যেতাম বন্ধুর বাড়ি, নৌকার পাটাতনে বসে ছবি আঁকতাম আর পা দোলাতাম। চোখ খুলে সবুজ দেখা, আঁজলা ভরে পানি নিয়ে মুখে ঝাপটা দেয়া, নৌকার গলুইতে শুয়ে রাতে মাথার উপর লম্বালম্বি আকাশে তারা দেখতে দেখতে ঘুম দিতাম আর ভোরে উঠে এই দৃশ্য দেখতাম। সত্যি বলছি- চশমাটা তখনই খুলে পানিতে ফেলে দিতাম। এখানেই আমার পৃথিবী শুরু, এখানেই শেষ! আমার সামনে শুধু সবুজ থেকে যাক, স্পর্শে আমার থাক সবুজ বাতাস। মুঠো ভর্তি করে যদি সব সবুজ নিয়ে নিয়ে নিতে পারতাম! যখন তখন গালে স্পর্শ বুলাতাম, প্রকৃতির সাথে মিশে যেতাম মাটির ভেজা ঘ্রাণ নিয়ে।
নিজের কাছ থেকে কতক্ষণ দূরে সরে থাকা যায়? এই ছায়াশীতল আশ্রয় থেকে কত দূরে থাকা যায় যেখানে পড়ে থাকে নিজের মন, যার অভাবে অন্তঃসার শূন্য হয়ে শুকাতে থাকে।
যেখানে অস্তিত্বের অস্তিত্ব থাকে-সেখানেই তো নিজের সত্ত্বাকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করা—-
তুমি যদি বলো এখনি করিব বিষয় -বাসনা বিসর্জন।
দিব শ্রীচরণে বিষয়–
দিব অকাতরে বিষয়–
দিব তোমার লাগি বিষয় -বাসনা বিসর্জন।
কিন্তু বিসর্জন দেয়া হয় না। দিন শেষে একটু বেশিই ভয়ে কুঁচকে যাই চাকচিক্য কমে যাবার। পাছে পিছিয়ে পড়ি সেই আশংকায় দৌড়ে যাই সবাইকে টপকে যেতে। দামি আসবাবপত্র নষ্ট হবার দুশ্চিন্তায় জানালার কাঁচ আরেকবার টেনে দেই আর আরেকবার বৃষ্টির মৃত্যু হয়…… শহরে তো প্রাচুর্যের কোনো অভাব নেই,বরং একটু বেশি মাত্রায়ই থাকে। রঙগুলো বড় বেশি রঙিন, সাদা মাটা ‘সাদা’ না। বাতাসে ভেসে বেড়ায় চিকেন-ফ্রাই আর ফ্রাইড রাইসের সুবাস,শুধু থাকে না মাটির সোদা ঘ্রাণ। দামি পারফিউমের মন মাতাল করা সৌরভ থাকে, তাই ঘামের দুর্গন্ধ দুর্গন্ধই থেকে যায়। উচ্চ শব্দে মিউসিক প্লেয়ারের অনাচারের রাজত্বে পাখির ডাক চুরি হয়ে যাচ্ছে, কারো মনে তা হা-হুতাসও তৈরি করে না……
মাঝে মাঝে নিজের নিঃশ্বাসে নিজেই চমকে উঠি! কি ভয়াবহ বিষাক্ত নিঃশ্বাস। এই বাতাস নিজের ভেতরে রেখে কীভাবে দিনের পর দিন বেঁচে থাকছি? তবুও তো বেঁচে আছি। ড্রইংরুমের আরেকটা শো-পিস বাড়ানোর জন্য, যান্ত্রিক ভাবমূর্তিটিকে আরো একটু চৌকষ করার জন্য, নিজেকে দিয়ে নিজের চতুর্দিকে দেয়াল গড়ার জন্য। সেই অতি উচ্চ প্রাচীর ভেদ করে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না, গাছের ডাল মাথা দোলায় না, মেঘের কোলে রৌদ্রছায়া লুকোচুরি খেলে না। আকুলি বিকুলি করা দূষিত বাতাসটাকে তাই মাঝে মাঝে ছুটি দেয়া উচিৎ। তাতে সবুজ একটু হাঁফ ছাড়তে পারবে, দিতে পারবে বিশুদ্ধ বাতাস, চোখ বুঁজে নিব সিক্ত বাতাস, প্রাণপাখিকে দিব মনের মত ডানা মেলতে………
আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর ॥
মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগনমাঝে,
বিশ্বজগত মণিভূষণ বেষ্টিত চরণে ॥
welcome back!
লিখতে থাকো।
ধন্যবাদ… 🙂
প্রকৃতি খুব সুন্দরভাবে উঠে আসে। কিন্ত, বৈরাগী বলেই হয়তো, কোন পরিচয় পায় না, কিংবা পরিচয় দিতে চায় না।
শেষ যেভাবে হোক, পাখিদের হিংসার বিষয়টি বড় বেশী কষ্টদায়ক। কত চাকুরে মানুষ, দুপুরের আলসে ভাবটা ছাপিয়ে দৌড়াতে হয় ভীড়ের মাঝে। প্রকৃতি পড়ে থাক অলস ঘুমে।
হাজার হোক, সাপ্তাহিক চলছে, লেখাটাও তাই আয়েশের কথা বলছে।
🙂
“আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর॥
মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগনমাঝে,
বিশ্বজগত মণিভূষণ বেষ্টিত চরণে॥”
খুব শান্তি শান্তি লাগলো। লেখাটাও, ছবিগুলিও।
খুব সুন্দর। এরকম লেখা নিয়মিত পড়তে না দেয়ার জন্য শাস্তি হওয়া উচিত তোমার।
আমরা সবাই আজকাল এত হিসেবি, এত যুক্তির কথা বলি, এত কারণ দর্শাই, এত আবেগশূন্য, এত অমানুষিক – ফাঁকেঝোঁকে কেউ যখন একটু মানুষের মত কথা বলে তখন কী যে ভালো লাগে! 🙂
ওহ্ বলতে ভুলে গেছি। শেষের দিকে ফরম্যাটিং-এ সমস্যা দেখতে পাচ্ছি, ঠিক করে নিয়ো।
আমিও দেখছি, লেখার সময়ই দেখতেছিলাম বর্ডার এর মাঝে চলে যাচ্ছে, কেন এমন হচ্ছে বুঝি নাই, ঠিক করার চেস্টা করেছিলাম, আচ্ছা আরেকবার চেস্টা করব।
আর আমি তো এতোওওও দিন পর লেখা দিসি যে ছবিই ইনসার্ট করতে অনেকক্ষণ পারতেসিলাম না 🙁
তুমি এডিট পেইজের উপরে বামের দ্বিতীয় সারির প্রথম অপশনে সম্ভবত পাবা ফরম্যাট ঠিক করার অপশন, ‘প্যারাগ্রাফ’ সিলেক্ট করে দিও।
:beshikhushi: :beshikhushi: :beshikhushi:
ধন্যবাদ ধন্যবাদ 🙂
ভালো লেগেছে 😀
ওয়েলকাম ব্যাক 😀
আর ছবিগুলো সুন্দর 😀
আরও লিখা চাই
🙂 চেস্টা করব…
কেমন মন উতলা করা একটা লেখা পড়লাম কত্তদিইইইইন পর! সাথে শান্ত শান্ত ছবি! কেন লিখিস না এমন? মুক্তগদ্য আমার যে কী ভীষণ পছন্দের! আর যার লেখার হাত এতো ভালো, তার লেখা অনেকদন পর পর পড়াটা নিশ্চুপ শাস্তি পাওয়ার মত!
চুপি চুপি একটা কথা বলি? আকাশ কিছু আমার প্রথম আর শেষ প্রেমিক! আমি যে ওর সাথে কত রাত জেগে কত কথা বলতাম! যেদিন বাসার সামনে চোখের পলকে একটা বাড়ি উঠে গেলো, আমার আকাশটাকে যেদিন ওরা গ্রাস করলো, সেদিন থেকে আমি কত কত দিন যে কেঁদেছি আমার একলা আকাশের কথা ভেবে!
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালবেসে!
😯 আকাশের মত লেখে যে তার আবার কিসের শাস্তি……!!!
আর তার মন্তব্যটাও আকাশের মতই হয়েছে……
এই লেখাটা মনে হচ্ছে একটু দেরিতেই পড়ে ফেললাম। মোটামুটি পুরো লেখার প্রতিটি শব্দই যেন আমার কথা…এমনই মনে হল !
কতদিন মনমেজাজ খারাপ থাকাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মেঘ ভেসে বেড়ানো আকাশ, নীল ঝকঝকে আকাশ, কিংবা মেঘ কালো করে আসা আকাশ দেখেছি আর দেখি তার ইয়ত্তা নেই। আর আমার বাসার পেছনটায় একটা ছোটখাট পাহাড়সারি আছে, লাল-নীল-সবুজ মেশানো কেমন একটা রঙ বলে বোঝানো যায় না, সেই পাহাড় ছুঁয়ে থাকা আকাশ আর তাতে বুনোহাঁসেদের উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে এত বেশি পাগলপারা লাগে মাঝে মাঝে যে কী বলব…স্রষ্টার যতন করে রাখা এই প্রকৃতির কী এক অদ্ভূত মহিমা !
এই লেখাটাও দেখছি প্রিয়স্বরে নিতে হবে। :love:
এটা আমার অনেক আগের একটা লেখা। কেন যেন মনে হত তেমন ভালো হয় নাই, আগের লেখা গুলোর মতই মুক্তগদ্য, কোনো চেঞ্জ নাই, একই রকম,ফলে খানিকটা বোরিং, তাই দেয়া হত না।আর ভিন্ন ধারার কিছু লিখতে পারতাম না বলে লেখার আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছিলাম,তাই সরব থেকেও বিছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম… সেদিন হঠাৎ করে মনে হল লিখব, কিন্তু অনেক দিনের চর্চার অভাবে নিজের কাছে মনে হয়-আমি আর লিখাতে পারি না। তাই পুরাতন লেখাটাই দিলাম। ভেবেছিলাম আমাকে দিয়ে আর লেখা হবে না, কিন্তু এই অসাধারণ মন্তব্য গুলো ভবিষ্যৎ লেখার প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। আর লেখাটা প্রকাশের পর আবিষ্কার করলাম-ভালো থাকার জন্য আমাকে লিখতে হবে। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
যদি পারতাম তাহলে মন্তব্য গুলোও প্রিয়স্বরে নিতাম। :love: