মেরী কুরি, জন বারডীন, লিনাস পলিং এবং ফ্রেডরিক স্যাঙ্গার। চারজন বিজ্ঞানি, নিজ নিজ ক্ষেত্রে অতুলনীয়। তবে তাদের মধ্যে একটা মিল হল, এই চারজনই দুই বার নোবেল পুরষ্কার অর্জনের বিরল সম্মানের অধিকারি। তবে এই লেখাটি শুধুই ফ্রেডরিক স্যাঙ্গারকে নিয়ে।
সম্পুর্ন কর্মজীবন নিরলস ভাবে কাজ করে গেছেন এই বিজ্ঞানী। বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহনের সময় আসার আগ পর্যন্ত নিজের কাজ ব্যাতীত অন্য কিছুতেই তার আকর্ষন ছিলোনা। প্রোটিন এবং ডিএনএ সিকোয়েন্সিং এ তার অবদান বৈপ্লবিক। আধুনিক প্রোটিওমিকস এবং জিনোমিকসের সবচেয়ে বড় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে তার হাত ধরেই।
তার এই সাফল্যের রহস্য কি? তার আত্নজীবনিতে একটি মূল্যবান সূত্র পাওয়া যায়, যেখানে তিনি বলেছেনঃ
“বৈজ্ঞানিক গবেষনার সাথে জড়িত তিনটি বিষয়- চিন্তা, কথা এবং কাজের মধ্যে শেষটিকেই প্রাধান্য দেই এবং আমি এটাতেই পারদর্শী। চিন্তাভাবনা কিছুটা করতে পারলেও, কথা বলায় আমি মোটেই ভালো না”
এই গুনই তাকে একই সাথে মেধাবি, স্বল্পভাষী এবং বিনয়ী একজন বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। স্যাঙ্গার তার সহকর্মীদের মাঝে যতটা জনপ্রিয় ছিলেন, সাধারনের কাছে ঠিক ততটাই অচেনা। কাজের ক্ষেত্রে যতটা দক্ষতা ছিল, ঠিক ততটাই ছিল প্রচারবিমুখতা। ১৯৫০ সালে যখন প্রোটিনের গঠন সম্পর্কে কারোই স্পষ্ট ধারনা নেই, তখন তিনি একটি রাসায়নিক পদ্ধতি প্রস্তাব করেন যার মাধ্যমে প্রোটিনের প্রতিটা এমিনো এসিড আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব। ইনসুলিন হল সেই প্রথম প্রোটিন, যার এমিনো এসিড সিকোয়েন্স তিনি উন্মোচন করেন। প্রোটিনের গঠন উদ্ঘাটনের উপর লিনাস পলিং এর কাজের সাথে নিজের কাজের সমন্বয় করে তিনি মূলত ‘প্রোটিন বিজ্ঞান’এর ভিত্তি রচনা করে দেন।
ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেবার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট ছিল। খ্যাতির মোহে আবিষ্ট না হয়ে তিনি কাজ করে যান। ১৯৭০ সালে, যখন জেনেটিক্সের বিস্তারিত নিয়ে প্রচুর কাজ হয় এবং জেনেটিক্স বেশ গোছানো পর্যায়ে চলে আসে। তখন স্যাঙ্গার আরেকবার চমক দেখান ডিএনএ সিকোয়েন্স করার চমৎকার এক পদ্ধতি আবিষ্কার করে। তার পদ্ধতির একটি সুন্দর এনিমেশন দেখা যাবে এই ঠিকানায়।
পরবর্তী ২৫ বছর যাবত, হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট সহ প্রতিটা সিকোয়েন্সিং প্রচেষ্টার ভিত্তি হয়ে দ্বারায় স্যাঙ্গারের প্রতিষ্টিত পদ্ধতি। যদিও বর্তমানে ‘Next-Gen method’ স্যঙ্গার মেথডকে প্রতিস্থাপন করেছে। তবে এটা পরিষ্কার যে স্যঙ্গারের অবদান ব্যাতীত পূর্ববর্তী কোন সাফল্যেরই অস্তিত্ব থাকতোনা। জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিকের সাথে স্যাঙ্গারকেও জিনোমিক্সের জনকের সম্মান দেয়া হয়।
দারুন কারিগরি দক্ষতা ধারনের পাশাপাশি স্যাঙ্গার ছিলেন যথেষ্ট শান্ত, বিনয়ী এবং নিবেদিত এক ব্যাক্তিত্ব- যা তার অর্জনের পেছনে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ন অবদান রেখেছে। তিনি যখন স্নাতক অধ্যয়নরত, তখন তার বাবা-মা কে হারান। এই ঘটনা অবশ্যই বৈজ্ঞানিক সত্য অন্বেষনে তার সাধনার পেছনে প্রভাব রেখেছে। গবেষনা, শিক্ষকতা, ব্যাবস্থাপনা প্রতিটা ক্ষেত্রে তিনি যেন ছিলেন বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী। বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই যখন কর্মজীবনের নির্দিষ্ট পর্যায়ের পর ছাত্রদের পেশায় নির্দেশনা দিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন, তিনি প্রতিটা দিন নিজ হাতে কাজ করে গেছেন। সৃষ্টিশীল অথবা অর্থহীন, কোন কাজকেই তিনি ছোট করে দেখেননি। কাজের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি নাইটহুড বর্জন করেছিলেন। তার আশংকা ছিল এই উপাধি হয়তো তার কাজে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
তার সাফল্যের আরেকটি কারন হতে পারে যে, তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মোলিকুলার বায়োলজি ল্যাবরেটরিতে কাজ করেছেন। MRC ল্যাবরেটরি অব মোলিকুলার বায়োলজি থেকে পরবর্তীতে আরো ৮ জন নোবেল লরিয়েট বেরিয়েছেন। এরকম এক নোবেল লরিয়েট, তার পোস্টডক থাকার সময়কালীন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেনঃ তিনি একদিন রাসায়নিক তরলের একটি পাত্র ভূল করে ফেলে দেন। এরপর তিনি ভয় পেয়ে যান এবং আশেপাশে খুজতে থাকেন, কে এটা পরিষ্কার করে দিতে পারবে। যখন তিনি ফিরে আসেন, তিনি দেখলেন স্যাঙ্গার নিজেই সেটা সযত্নে পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। যদিও স্যাঙ্গার ছিলেন বেশ গম্ভীর স্বভাবের, কিন্তু ইন্সটিটিউটের অন্যান তরুন বিজ্ঞানীদের সাথে ছিলেন যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ন। রোদ বৃষ্টি যাই থাকুক, রোজ সাইকেল চালিয়ে কাজে আসতেন। তরুনদের কথার চেয়ে কাজের মাধ্যমে উৎসাহিত করতেন। তার নামে প্রতিষ্ঠিত স্যাঙ্গার ইন্সটিটিউট জিন সিকোয়েন্সিং এর অগ্রদূত হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে এবং হিউম্যান জিনোমের প্রাথমিক খসড়া তৈরিতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। প্রতিষ্ঠানটি নামকরনের মাধ্যমেই এই বিজ্ঞানীর প্রতি সপ্রশংস শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে।
তিনি গবেষনার ক্ষেত্রে যেই নীতি মেনে চলতেন, সেই নীতি মেনেই অবসর গ্রহন করেন। তার অবসর গ্রহনের দিনের শেষ এক্সপেরিমেন্টটি করার পর আর কোনদিন ল্যাবে কাজ করেননি এবং বাগান করার পেছনে মনোনিবেশ করেন। কর্মজীবনের প্রতিটা দিন কায়মনোবাক্যে কাজ করে দুই বার নোবেল পুরষ্কার অর্জন, মোলিকুলার বায়োলজি এবং জিনোমিক্সে বিপ্লব সৃষ্টি এবং ভালোবেসে গোলাপের যত্ন নেয়া; একদিনের ঘাটাঘাটিতে এই হল একজন ফ্রেড স্যাঙ্গার। যিনি ১৯, নভেম্বর ২০১৩ চলে গেছেন না ফেরার দেশে। এখন আমাদের সময়, তার উদাহরন অনুসরন করে বেশি বেশি কাজ করা এবং কম কম কথা বলা।
সায়েন্টিফিক আমেরিকান ব্লগে প্রকাশিত Ashutosh Jogalekar এর Winning two Nobel Prizes, turning down knighthoods: The legacy of Fred Sanger (1918-2013) থেকে অনুপ্রাণিত
খুবই সাবলীল ভাষায় এক মহান বিজ্ঞানীর জীবনতাত্ত্বিক ব্যবচ্ছেদ করলেন।
আর লেখাটা পড়তে পড়তে শেষ লাইনে এসে কষ্টটা দিয়ে দিলেন, যে তিনি চলে গেছেন। এবং একেবারে এই ক’দিন আগে। অথচ, আমাদের পত্রিকাগুলোতে খুব বেশী কিছু চোখে পড়লো না। অথবা হয়তো আমিই সেভাবে দেখি নি।
চিন্তা,কথা আর কাজ, তিনটা সরল বিভক্তিতে সবচেয়ে কঠিনটাই তিনি করতেন। সেই আহবানে আমাদের সবার সাড়া দেয়া প্রয়োজন।
আমার মনে হয় মাদাম কুরীর মতোই মানুষের উন্নতিতে নোবেল পাওয়ার পরও, সমানভাবে কাজ করে গিয়েছেন বলেই তাঁর এই দুইবার নোবেল প্রাপ্তি।
৯৫ বছর বয়সটা কেন জানি মনে হয়, এ ধরনের মানুষের জন্য বয়সটা অকালই বলা যায়।
আপনার সাথে একমত, আমারও কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল ব্যাতীত আর তেমন কিছু চোখে পড়েনি।
আর আমার মনে হয়, ওনাদের মত মানুষ পুরষ্কারের মোহের উর্ধে।
অনেক ধন্যবাদ চমৎকার কমেন্টের জন্য।
সুন্দর লিখা 🙂
অনেক কিছু জানতে পারলুম 🙂
ধন্যবাদ আপনাকে 🙂
এই ধরনের মানুষগুলোকে খুবই ভালো পাই যারা খ্যাতির মোহে না ঘুরে এমন নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন। উনার জন্য শ্রদ্ধা থাকল। আর পরিচিত করে দেয়ার জন্যও অনেক ধন্যবাদ।
শেষ প্যারাটা বেশ জরুরি, বিশেষ করে এই কথাটা…”এখন আমাদের সময়, তার উদাহরন অনুসরন করে বেশি বেশি কাজ করা এবং কম কম কথা বলা”
অনেক ধন্যবাদ আপনার কমেন্টের জন্য।
ওনাদের মত মানুষকেই যুগে যুগে দরকার।
শেষকথা গুলো তো জন্ম থেকেই শুনে আসছি, কতটা আর কাজে লাগাতে পারলাম…