তোমাকে চিঠি লেখার আগে অনেকবার ভেবেছি তোমাকে কি বলে সম্বোধন করি। চিন্তার কুল ঠিক করতে না পেরে অবশেষে ছেলেবেলায় স্কুলে শেখা ‘শীতের ছুটিতে বন্ধুকে তোমার বাড়িতে বেড়াতে আসিবার নিমন্ত্রণ জানিয়ে একটি পত্র লিখো’ তার আশ্রয় নিলাম।
আমার মনে পড়ে না কোন কালে, কোন শীতে কোন বন্ধুকে আমার বাড়িতে আসবার নিমন্ত্রণ দিয়েছি বলে। গাঁয়ের ছেলে, সেখানে শীতের ছুটি নামে কোন বিলাসিতা ছিল না, আবার গ্রীষ্মের ছুটি নামেও না। শুধু জানতাম স্কুল বন্ধ থাকবে, অতএব তিন মাইল হাঁটতে হবে না! সেই স্কুল থেকে শেখা একটি পত্র লেখার কায়দা কানুন বড় জোর পরীক্ষাতেই কাজে লাগে। আর সেই সব পরীক্ষায় যেসব বন্ধুর নাম লিখতাম বাস্তবে তার কোন মিল ছিল না। অথচ নামের আগে নিয়ম মত লিখে ফেলতাম প্রিয়! আসলেই, যাকে চিনি না তাকে প্রিয় বলা যায়, কিন্তু যে চোখের সামনে থাকে তাকে কি বলতে হয়? ঢাকা থেকে পাঠানো তোমার উদ্দেশ্যে অজানা ঠিকানায় লেখা চিঠিতে খুঁজে নেব সেই উত্তর।
তোমার মনে আছে আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে কি হয়েছিল? তোমার মনে পড়ছে না তাই তো? কি করে পড়বে বল? আজ তো মহান, জাতীয় কারো মৃত্যুবার্ষিকী নয়। আজ কোন কবির কলম ফুঁড়ে বেরুবে না কাঁদো বাঙালি কাঁদো; আজ কেউ সেই কবরগাহের পাশে যাবার জন্য পায়ে পা ঠেলবে না, হুড়োহুড়ি হবে না। কেন করবে বল? ওখানে গেলে নমিনেশনও পাওয়া যাবে না আর না কোন ধান্দাপাতির জোগাড় হবে। তাই টেলিভিশনের স্ক্রিনে দেখবে না কোন কাল ব্যাজের চিহ্ন, আর রাষ্ট্র কর্তাদের দেখবে কোন শোকবানী অথবা ফাতেহা পাঠ করতে। যা মিডিয়ায় নেই, তাতো সমাজেও নেই আর মানুষের মনেও নেই।
তাই তোমাকে একটু মনে করিয়ে দিতেই হচ্ছে সেই কালো রাতটার কথা। আশা করি দয়া করে কিছু মনে করবে না।
সময়টা কেমন ছিল? খুব যে ভয়ঙ্কর ছিল তা অবশ্য নয়। এই ধরে নাও আগুন লেগেছে, কারখানার ভেতরে কিছু মানুষ কাজ করছিল, ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া হয়েছিল আর ওরা এসে আগুন নিভিয়ে ফেলে যারা মারা গেছে তাদের মৃতদেহ বের করে এনেছিল। আর ক্ষয়ক্ষতির কথা! সে যে কি অবস্থা! এতো বড় একটা কারখানা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। মালিকের হয়েছে পথে বসার অবস্থা। কে জানে সেই মহান উদ্যোক্তা আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবেন কিনা! এই আগুন একেবারে তার কোটি কোটি টাকার সম্পদ পুড়িয়ে ছাই করে দিল। আহারে বেচারা।
এরকম করে আজ জানতে পারছো, আসছে বছর জানতে পারবে সেই ২৪শে নভেম্বর এক গার্মেন্টস মালিকের বিরাট ক্ষতি হয়েছিল। তারপরের বছর হয়ত জানবে ২৪ শে নভেম্বর একটা দিন আর কি। তাই তোমার আজকের জানার বিপরিতে দু একটা লাইন একটু যোগ করে দেব সেখানে কি হয়েছিল। আর তার জন্যই চিঠি লেখা। মাত্র ক’টা লাইন।
‘চারপাশে ছিল আগুনের লেলিহান শিখা, লোহার শিকল আর কংক্রিটের ভেতরে আটকা পড়েছিল কয়েকশ বনি আদম, দরিদ্র। শরীরে মাংস পুড়ে যাচ্ছিল আগুনে, কাচা মাংস পুড়ে যেভাবে বারবি কিউ হয়ে যায়, এক সময় ওদের দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল। যাদের মৃতদেহ চেনা গিয়েছিল সম্ভব হয়েছিল তাদের পরিজনদের কাছে দিয়ে দেয়া। আর যারা কয়লা হয়ে গিয়েছিল তাদের দাফন করা হয়েছিল সরকারি কবরস্থানে’-
তাজরিন- আজ সেই ২৪ নভেম্বর, অন্তত পক্ষে ১২২ জন মানুষ পুড়ে কয়লা হবার দিন।
যে বৃদ্ধা মা সন্তানকে খুঁজে পায়নি, সে এখনও অলি গলি ঘরে, এই তিলোত্তমা নগরীর।
কজন সেই অচেনা কবরগাহের ঘাসফুলের উপর ছিটিয়ে দিয়েছে কিছু হলুদ গাঁদার পাপড়ি, যেই হলুদ গাঁদায় তুমি হেমন্ত উৎসবে শাড়ি পরে খোঁপায় দাও!
ইতি
তমারই [ ‘তোমারই’ কে এইভাবে উচ্চারন করি]
বোকা মানুষ
চোখ ভেঙে জল এলো, জলই এলো!
আমি সামান্য এক নির্লজ্জ মানবী।
তাজরিন কি পৃথিবীর কোন নির্লজ্জ মানবীকে ক্ষমা করতে জানে?
বেশ গভীরে নাড়া দিয়ে গেল আপনার লেখা।
কিছু বলব না, শুধু বলব এই লেখাটা যত বেশি পারা যায় ছড়িয়ে দেয়া উচিত। অন্তত তাতে যদি কারও বিবেক কেঁপে ওঠে।