১)
উত্তর বিহারের তিরহুত জেলা ও দক্ষিন নেপালের একটা প্রাচীন রাজ্য ছিলো, নাম “বিদেহ”।তার রাজধানী ছিলো “মিথিলা”।সেখানে মৈথেলি ভাষায় কথা বলতো মানুষজন। সে রাজ্যের মহাকবি ছিলেন বিদ্যাপতি, তিনি মৈথেলী কবি কোকিল নামেও সুপরিচিত। তিনি মৈথেলি ভাষা ও সংস্কৃত ভাষার একটা মেলবন্ধনে কবিতা লিখতেন। সে ভাষায় রাধা-কৃষ্ণ, সনাথ-ব্রজমন্ডলের লীলা বিবৃত হতো বলে সে ভাষার নাম দেয়া হলো ব্রজবুলি।

মৈথেলি কবি কোকিল বিদ্যাপতি
ব্রজবুলি ভাষাটা এরপরে আসামী ও বাংলা, দুই ভিত্তিতে গড়ে উঠলো। আসামী ব্রজবুলি ভাষাতে বৈষ্ণব কবি ও নাট্যকারেরা শিল্পচর্চা শুরু করে দিলেন। আসামী ব্রজবুলি’র ভিত রচনায় আরও ছিলো আওয়াধী ভাষা ও ব্রজভাষা। ব্রজভাষা ও ব্রজবুলি ভাষা সম্পুর্ন আলাদা। ব্রজ ভাষা সম্পর্কে একটু পরে বলছি।
আসামী ব্রজবুলি ভাষাতে বৈষ্ণবী নাট্য (অংকীয়-নাট্য) এবং স্তুতিমুলক কবিতা লেখা হতো শুধু। আসামী ভাষায় দেব-দেবীর স্তুতি রচনা করা হতো না এই ভেবে যে, এটি যেহেতু সকল জনসাধারণের ভাষা, দেব-দেবী নাখোশ হতে পারেন। সংস্কৃত ভাষা সাধারণের কাছে সহজবোধ্য না হওয়ায় তারা আসামী ব্রজবুলিতে স্তুতি রচনা শুরু করে দিলেন।
শ্রী কৃষ্ণের পিতামহ ছিলেন শূরসেন। হরিয়ানা রাজ্যের কিছু অংশ, রাজস্থানের কিছু অংশ, মধ্য প্রদেশের গোয়ালিওর, উত্তর প্রদেশের পশ্চিম অংশের পুরোটা এবং কুমায়ুন ও গারহোয়াল নামক অংশ নিয়ে তিনি তৈরী করেন, শূরাসেন প্রদেশ, যার আরেকনাম ব্রজ। শূরাসেন প্রদেশের ভাষা ছিলো মুলতঃ শূরাসেনী প্রাকৃত ভাষা। সেখানেই ব্রজ ভাষার উৎপত্তি, যা তিনটি স্তরের মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করে। অপভ্রংশ স্তর, দিঙ্গল স্তর এবং পিঙ্গল স্তর। ব্রজবুলি ভাষাটি যেখানে একটি আর্টিফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ বলে অভিহিত, ব্রজভাষা সেখানে অনেকটাই প্রাকৃতিক।
বাংলা ভিত্তিতে গড়ে উঠা ব্রজবুলির খোজ পাওয়া যায় ১৩শ থেকে ১৯ শতাব্দীতে। প্রাচীন মৈথিলি ও অবহট্টের উপর ভিত্তি করে বাংলা ব্রজবুলির উদ্ভব।
অবহট্ট সম্পর্কে লিখতে গেলে আলাদা একটা পোষ্ট হয়ে যাবে। সংক্ষেপে বললে, পাচ হাজার বছর আগে ইন্দো – ইউরোপীয় যে ভাষা ছিলো, আর্য ভাষা, সেইটাই চার হাজার বছর আগে ভাগ হয়। ভাগ হয়ে ১০০০ বছর আগে আমাদের এদিকে আসে ভারতীয় আর্য। ভারতীয় আর্যের মেইন শাখা ২টা, সংস্কৃত আর বৈদিক। কাহিনী হইলো, সমগ্র ভারতের মধ্য অংশে অর্থাৎ মধ্য ভারতে (আসাম, উরিষ্যা এইসব জায়গা) এসে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা থেকে আসে মাগধি, উরিয়া, আসামী ভাষা। মাগধির অপভ্রংশের পরের রুপ অবহট্ট, এইটা দুইশ শতক স্থায়ী হয়েছিলো, আর সেইখান থেকে বাংলা।
প্রথম দিকে রাজসভায় ব্রজবুলি (বাংলা) ভাষার চর্চা শুরু হলেও তা পরবর্তীতে জায়গা করে নেয় কবিদের কালিতে। ষোড়শ শতাব্দির শুরু থেকে এটি সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নেয়। বৈষ্ণব কবিতার একজন ভক্ত ছিলেন শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু। তিনি ছিলেন একজন হিন্দু সন্নাসী ও বাঙ্গালী ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগন তাঁকে শ্রী কৃষ্ণের পুর্নাবতার মেনে থাকেন। শ্রী চৈতন্যের ভক্তির কারণে বাংলা সাহিত্যে ক্রমশ শক্ত স্থান করে নেয় ব্রজবুলি ভাষা।
২)
বিদ্যাপতি ছাড়াও কেউ কেউ এই ভাষায় সাহিত্য চর্চা করছেন বলে জানা যায়। যেমন ধরেনঃ প্রাচীন বাংলার প্রথম ব্রজবুলি পদ রচনা করেন যশোরাজ খান। গোবিন্দ দাস, বিদ্যাপতির ব্রজবুলিকে অনুসরন করতেন। গোবিন্দ দাসের কয়েকটি চ্ছত্র দেখি আমরা, অসাধারণ লেখনী !
যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।
তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি॥
যাঁহা যাঁহা অরুণচল চল চলই।
তাঁহা তাঁহা থল-কমল-দল খলই॥
এই অদ্ভুত সুন্দর কথাগুলোর অর্থ এতো সাধারণ ! চিন্তার বাইরে ! তিনি বলেছেন, রাঁধা তার সখিদের সাথে হেঁটে যাচ্ছে, যেখানে তার সৌন্দর্য ছলকে পরছে তার দেহ থেকে, সেখানেই যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যেখানেই রাঁধা আলতা পায়ে পা রাখছে, সেখানেই ঝরে পরছে স্থল লাল পদ্মের পাপড়ি !
ইতিহাসে আরেক সন্তান জন্ম নিয়েছিলেন, বাংলা ভাষাটাকে নিজের মনের মতো করে, আকৃতি প্রদান করেন নিজের মতো। এরপর বীরদর্পে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন, এই দেখো! এইটা হলো বাংলা! পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ভাষা গুলোর একটা ! পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সাহিত্য গুলোও এই ভাষাতেই আছে, দেখে নাও ! সে মানুষটার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শৈশব ও কৈশোরে ভানুসিংহ ছদ্মনামে লিখতেন। ভানুসিংহ নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলির একটা লেখা আছে, “গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে”, এটা লিখে তিনি উনি উনার এক বন্ধুকে দেখিয়ে বলেছিলেন যে, ব্রাহ্ম সমাজের লাইব্রেরী খুজে একটা জীর্ণ শীর্ণ প্রাচীন পুঁথি খুজে পেয়েছি ! একটু দেখ তো! বন্ধু তো সেই খাতা পেয়ে পাগলের মতো খুশি ! সে বললো, এখুনি এই লেখা আমাকে দে ! এই লেখা বিদ্যাপতি-চন্ডিদাশের হাত থেকেও বের হওয়া সম্ভব না ! এই প্রাচীন পুথি অক্ষয়বাবুকে দিবো, ছাপানোর জন্য ! রবী ঠাকুর মজা নিয়ে বললেন, বড্ড সত্য বললা বাপু ! এটা চন্ডী দাশের পক্ষে লেখা আসলেই সম্ভব না, কারণ এইটা আমার লেখা !
ভানুসিংহের প্রথম কবিতা রচনাকালে "ভানুসিংহ" কিশোর রবীন্দ্রনাথ, ১৮৭৭; জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্কেচ অবলম্বনে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত (সুত্রঃ বাংলা উইকি)
তো, ভানুসিংহের পদাবলীগুলো লেখা হয়েছিলো এই ব্রজবুলি ভাষায়। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই শেষবারের মতো এই ভাষায় কাব্যচর্চা করে গিয়েছেন। কাদম্বরী দেবীর অনুরোধে তিনি ব্রজবুলি ভাষায় রচিত তাঁর লেখাগুলো “ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলি” নামে প্রচার করেন। আফসোসের ব্যাপার হলো, কাদম্বরী দেবী তার আগের বছরই পরলোকগমন করেন, পরবর্তীতে গ্রন্থটি তিনি কাদম্বরী দেবীকে উৎসর্গ করেন।

কাদম্বরী দেবী, সুত্রঃ বিচিত্রা; মে ২০১০
রবীন্দ্রনাথের গান মানেই আমার কাছে অন্য কিছু। জীবনবোধ কিংবা আবেগ এসব মাড়াই না, আমি চুপ চাপ পরে থাকি, আমি গানের মাঝে ছবি দেখতে পাই, চলমান ভিডিও দেখতে পাই, চোখের সামনে কতো কী যে ভাসে ! যে মানুষ শ্রবনেন্দ্রীয়কে মন এ গেঁথে দিতে পারেন, দর্শনেন্দ্রীয়কে চট করে চালু করে দিতে পারেন, সে সাধারণ কেউ না। আর, তাঁরই কৈশোর বেলার সেই ভানুসিংহের পদাবলি তো আসলে একেকটা মাস্টারপীস ! যে বেলায় আমাদের ছেলেমেয়েরা টেম্পল রান, ভাইস সিটি নিয়ে ব্যস্ত, কিংবা ব্যস্ত ফোন বাক্যালাপে, সে বয়সে তিনি রচনা করলেন মহাকালের সেরা সাহিত্যগুলোর কিছু অংশ ! ভানুসিংহের পদাবলীর মধ্যে আমার সবচাইতে পছন্দের একটি সবার সাথে একটু শেয়ার করি, এই গানটির জন্য চিরকাল খেয়াপুর (খেয়া মেজবা) কাছে ঋনী !
মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজূট,
রক্তকমলকর, রক্ত‐অধরপুট,
তাপবিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু‐অমৃত করে দান॥
আকুল রাধা‐রিঝ অতি জরজর,
ঝরই নয়নদউ অনুখন ঝরঝর—
তুঁহুঁ মম মাধব, তুঁহুঁ মম দোসর,
তুঁহুঁ মম তাপ ঘুচাও।
মরণ, তু আও রে আও॥
সোর্সঃ
১) বাংলা উইকি
২) উন্মোচন ব্লগ এর লেখক কাফি রশিদ, যিনি হুমায়ুন আজাদকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তাঁর “লাল নীল দীপাবলি” বইটির জন্য।
৩) Encyclopaedia of Indian Literature: A-Devo (page: 578-580)
৪) National Encyclopedia of Bangladesh (বাংলাপিডিয়া)
৫) ব্লগার পার্লিয়া, চতুর্মাত্রিক ব্লগ
ধন্যবাদান্তেঃ
১) সর্বপ্রথম ধন্যবাদ খেয়া মেজবাকে। তিনি আমাকে “মারান রে” গানটা শুনতে দিয়েছিলেন। গানটা এতোই সুন্দর, আমি গানটাতে ডুবে গিয়েছিলাম। উনি আমাকে এই গানটি সেদিন না দিলে আমি হয়তো কখনই ভানুসিংহের পদাবলি, সেখান থেকে ব্রজবুলি আর তারপরে এতো খোজাখুজি করতাম না। খেয়াপুকে ধন্যবাদ।
২) এই লেখাটি লিখবার সময় পাপ্পু দত্ত নামের বোন, নিভৃত নামের এক ভাই এর সাহায্য পেয়েছি। তাদেরকেও ধন্যবাদ।
রাঁধা তার সখিদের সাথে হেঁটে যাচ্ছে, যেখানে তার সৌন্দর্য ছলকে পরছে তার দেহ থেকে, সেখানেই যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যেখানেই রাঁধা আলতা পায়ে পা রাখছে, সেখানেই ঝরে পরছে স্থল লাল পদ্মের পাপড়ি !
দারুন :clappinghands:
বাংলা ভাষার ইতিহাস নিয়ে অনেক কিছুই দেখি জানতাম নাহ ! ভালো লেগেছে তথ্যসম্মৃদ্ধ এই পোস্ট ! 🙂
ভালো লাগলো লেখাটি, বাংলা ভাষার ইতিহাস নিয়ে যদিও তেমন কিছু জানিনা। তবুও আপনার লেখাটি ভালো লাগলো।
ছবিগুলো দেয়াতে ধন্যবাদ।
‘ যে বেলায় আমাদের ছেলেমেয়েরা টেম্পল রান, ভাইস সিটি নিয়ে ব্যস্ত, কিংবা ব্যস্ত ফোন বাক্যালাপে, সে বয়সে তিনি রচনা করলেন মহাকালের সেরা সাহিত্যগুলোর কিছু অংশ ! ‘-সহমত আপনার সাথে।
ব্রজবুলিতে রবীন্দ্র রচনা পড়েছি কিন্তু গোবিন্দ দাসের লেখা এই প্রথম পড়লাম!!
বলা বাহুল্য, মুগ্ধ হয়ে গেলাম!!
পুরো ইতিহাসটা পড়তে চমৎকার লেগেছে!
একটা ছোট্ট সাজেশান ছিলো। ভাষা থেকে ভাষার জন্মের ব্যাপারটা কথায় না লিখে শুধু ফ্লো চার্টে দেখানো গেলে বোধহয় অনেকের বুঝতে আরেকটু বেশি সুবিধা হতো। 🙂
খুব কাটুনির লেখা, পড়েই বোঝা যাচ্ছে!
সেইজন্যে এত্তগুলো ভালোবাসা! :love: