ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, শিক্ষা জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হচ্ছে ভর্তি যুদ্ধ। ভালো খারাপ কোনো রেজাল্টেরই দাম থাকবে না যদি দেশ সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পারি। ঠিক এরকমটাই আমাকে বলা হয়েছিলো। আমার বন্ধুদেরও এটাই বলা হয়েছিলো আমি নিশ্চিত। আমি ২০১৩-২০১৪ সেশনের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার্থী। আমার নিজের পরীক্ষা নিয়ে বলা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার সামান্য বুদ্ধিতে এবারের ভর্তি পরীক্ষা নামক মহাযুদ্ধের যেসব অসঙ্গতি ধরা পড়েছে তাই আমি লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছি।
শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকারগুলোর একটি। কিন্তু শিক্ষা এখন ব্যবসার অন্যতম একটি ক্ষেত্র। তারুপর উন্নয়নশীল দুর্নীতিগ্রস্থ একটি দেশে আমাদের বাস। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর কাছে বিভিন্ন ভাবে আমরা কোণঠাসা। জাতি হিসেবে আমরা বড় অভাগা। আমাদের জীবনের কোনো মূল্য যেখানে নাই, নিরাপত্তা নাই, সেখানে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা নতুন করে বলার মতো কিছু নয়। আমরা সবাই অসঙ্গতিগুলো জানি, তবু যেন আমাদের কিছুই করার নেই।
আমি বিশ্বাস করতাম শুধু মেধাবী হলেই কেউ দেশ সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হতে পারে না, অনেক পরিশ্রমীও হতে হয়। ‘বিশ্বাস করতাম’ বলছি কারণ এখন আমি জানি, আসলে আমরা অনেকেই জানি, এই দুর্নীতিগ্রস্থ দেশে ক্ষমতা ও অর্থ থাকলে অসদুপায় অবলম্বন করে মেধাবী ও পরিশ্রমী না হয়েও দেশ সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হওয়া যায়! মেনে নিতে কষ্ট হয়। সহ্য করাই যায় না। অন্তত আমি পারি নি, আমার বন্ধুরা পারে নি, তবু হচ্ছে, আরো অনেক দিন ধরেই হবে কারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্নীতি এবং শিক্ষা বাণিজ্য বন্ধ করতে কখনোই কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেয়া হয় নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট ২৫ নভেম্বর দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয় নি। কারণটা বেশ পুরনো। সেটা হচ্ছে- এই দেশের বেশিরভাগ ক্ষমতাবান মানুষগুলোর কোনো নীতি বোধ নাই। তাদের কোনো দায়িত্ব বোধ নাই। তারা শুধু দুইটা জিনিস চেনে- টাকা এবং ক্ষমতা। নিঃসন্দেহে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কেউ না কেউ প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত। কোচিং সেন্টারগুলো আরো একধাপ এগিয়ে। নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ভর্তির গ্যারান্টি দিয়ে তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেয়। এরাও প্রশ্নপত্র ফাঁসে মদদ যোগায়। এছাড়া আমরা দেখেছি এরা কিভাবে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সময় ডিজিটাল জালিয়াতি করতে সাহায্য করে। তবুও শিক্ষা ব্যবস্থা এভাবেই আছে বহাল তবিয়তে। মেনে নিতে যতোই কষ্ট হোক এটাই সত্য যে, প্রতি বছর অনেক শিক্ষার্থীই ক্ষমতা ও অর্থের বিনিময়ে সরকারি মেডিক্যাল এবং নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে সীট কিনছে!
আমরা যারা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী, তাদের একটা অন্যতম কনফিউশন হলো কোন মডেলের ক্যালকুলেটর ব্যবহার করবো পরীক্ষায়! এবার টেক্সটাইলের ভর্তি পরীক্ষায় এই নিয়ে ভালো রকমের ঝামেলা হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী ক্যালকুলেটর ছাড়া পরীক্ষা দিয়েছে কারণ তারা যে মডেলের ক্যালকুলেটর নিয়ে গিয়েছিলো সেটা তাদের ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয় নি। আরো অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাতেও ক্যালকুলেটর সংক্রান্ত ঝামেলা হয়, আমার মনে হয় বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের গণিত বইয়ের শুরুতেই উল্লেখ করে দেয়া উচিত তারা প্রবলেম সল্ভ করতে কোন মডেলের ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে পারবে। অথবা, আরো ভালো হয় যদি ভর্তি পরীক্ষার প্রবেশ পত্রে ক্যালকুলেটরের মডেল নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সি ইউনিটের পরীক্ষায় পাশ করেছে মাত্র ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী! ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী যারা পাশ করতে পারে নি তারাও কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বাণিজ্য বিভাগ থেকে মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করে পাশ করেছে নাহয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারতো না। আমরা সবাই জানি, এই দেশে বোর্ড পরীক্ষাগুলোতে সরকারের ভালো রকম হস্তক্ষেপ থাকে, পাশের হার যেটুকু দেখি সেটা অনেকটাই শুভঙ্করের ফাঁকি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত এবং সরকারের প্রভাব থেকে অল্প হলেও মুক্ত, তাই ভেবে দেখার সময় এসেছে- শিক্ষা ব্যবস্থায় কতো বড় গোলমাল থাকলে উচ্চ মাধ্যমিক সম্মানের সাথে পেরিয়ে আসা ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাশটুকুও করতে সক্ষম হয় না!
আমাদের দেশে প্রশ্নপত্র ফাঁস অনেক পুরনো ঘটনা। আমরা ‘পরীক্ষা’ শব্দটার সাথে পরিচিত হওয়ার পরপরই জানতে পারি পরীক্ষায় সময় পরীক্ষার হলে আমাকে যে প্রশ্নটা দেয়া হবে, সেটার কপি পরীক্ষার আগেই অনেকের হাতে চলে যায় এবং এর নাম ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস’….. সৎ এবং পরিশ্রমী শিক্ষার্থীদের গলার ফাঁস বটে! যাই হোক, বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় এটা ছোটবেলা থেকেই জানতাম। ধীরে ধীরে জানলাম এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়। এবার দেখলাম পিচ্চি বাচ্চাদের পরীক্ষা অর্থাৎ পিএসসি এবং জেএসসি এর প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন শুধু ফাঁস হয় সেটাই না, নামীদামী কোচিং সেন্টারগুলো জনসম্মুখে তার প্রলোভন দেখিয়ে অনেক অর্থও হাতিয়ে নেয়- এবার সেটাও দেখলাম! ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি শিক্ষা লাভের জন্য কোচিং সেন্টারের কোনো প্রয়োজন নেই। বড়োজোর হোম টিউটর রাখা যেতে পারে। যেহেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে এবং তাদেরই কাজ আমাদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা, সেহেতু এই কোচিং সেন্টারগুলো অপ্রয়োজনীয়। এদের উপস্থিতিই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো অলস হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে, শিক্ষাকে বড়সড় বাণিজ্যে পরিণত করেছে। কিন্তু, শিক্ষা আমাদের অধিকার, এটা কোনো বাণিজ্য করার বস্তু নয়।
এবার একটু অন্য দিকে বলবো। বিভিন্ন জেলায় ভর্তি পরীক্ষা দিতে যেতে শিক্ষার্থীদের অনেক অর্থ খরচ করতে হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটগুলো যদি একটি মাত্র পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী বাছাই করে তাহলে সময় ও অর্থ দুটোই বেঁচে যেতো। এছাড়া কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ও একই ভাবে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নিতে পারে, এতে করে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দৌড়াদৌড়ি করে পরীক্ষা দেয়ার ঝামেলা কমে যাবে। চাইলেই এই উদ্যোগটা নেয়া যায়, বাধা একটাই- কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাব।
যোগ্যতার তুলনায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ এদেশে কম। যেটুকু সুযোগ আছে, সেটুকুও দুর্নীতির অভিশাপে অভিশপ্ত। সত্যিকারের পরিশ্রমীদের সম্ভবত সত্যিই দমিয়ে রাখা যায় না। তবু, আমাদের ন্যায্য শিক্ষা ব্যবস্থা যখন শিক্ষা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে, তখন সব জেনে আর চুপ থাকতে পারছি না। আমাদের দেশ, আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। কোনো পরিশ্রমী শিক্ষার্থীই পরীক্ষার পূর্বে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রহসন মেনে নিবে না। একজন শিক্ষার্থীই শুধু এই কষ্টটুকু উপলব্ধি করতে পারে, এটা অনেকটা ব্যর্থ হওয়ার পূর্বেই ব্যর্থতার স্বাদ পেয়ে যাবার কষ্টের মতো। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই কষ্ট থেকে মুক্ত থাকুক, এর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ আমাদেরই নিতে হবে।
আমার এই সাধারণ ছোট্ট লেখাটি উৎসর্গ করছি প্রিয় লেখক এবং শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারকে, যে মানুষটি কখনো কোনো অন্যায়ের সামনে মাথা নত করেন নি।
সময়োপযোগী পোস্ট। লেখা ভালো লেগেছে আপু।
ধন্যবাদ আপু 🙂
দারুণ সত্য কিছু কথা। প্রায় পুরোটার সাথেই একমত।
ক ইউনিটের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে নাকি এবার? জানতাম না তো!
নিজের অবস্থান থেকে যতটা সম্ভব ভালো থাকার চেষ্টা করুন,
হাজার সমস্যা থাকলেও এখান থেকেও কিন্তু অনেকে ভালো করছে।
প্রতিবাদ করাটা খুব জরুরী।
লেখিকার এই পোস্টটি দিয়ে সরবে সরব যাত্রা শুরু করলেন। তাকে স্বাগত জানাতেই আপনারা ভুলে গেলেন- ভাপু, নুহা’পু আর রুহশান ভুলে গেছেন!? 😛
:welcome:
সময়োপযোগী আর সহমত জানানোর মতই একটা পোস্ট এটা! আমিও তাই করছি। পরে বিস্তারিত মন্তব্য করব এটা নিয়ে।
ধন্যবাদ 🙂
https://m.ak.fbcdn.net/photos-g.ak/hphotos-ak-frc1/374530_10151686476007554_55507701_n.jpg
:welcome:
😀
ফারাহ, খুব ভালো লাগলো যে আমার ছাত্রী এত ভালো লেখে। তোমার কয়েক্তা লেখা আমি পড়েছি । লেখা চালিয়ে যাও।
ধন্যবাদ স্যার 😀
বেশ ভালো লিখেছ আপু। প্রথম লেখা হিসেবে অসাধারণ। দেশটা নিয়ে মাঝে মাঝে চূড়ান্ত হতাশ লাগে। নীতিহীন এই লোকগুলোর কাছে আমাদের পুরো দেশটাই বন্দী হয়ে আছে।
সরবে স্বাগতম।
ধন্যবাদ। হুম, সরবে এই প্রথম লেখা। মূলত কবিতা লিখি আমি 🙂