১…
বেশির ভাগ মানুষের ধারণা মফস্বলের মেয়েরা খুব মায়াবতী হয়।দুটো ফিতে ঝোলানো বেনী,বড় বড় চোখ ছুঁয়ে যাওয়া কাজল, মুখ জুড়ে স্নিগ্ধতা। আমি জানি তুমিও আমাকে ঠিক এমনি চেয়েছিলে, হয়তো দেখেছিলেও তাই। তোমার শহুরে দিন যাপনের ফাঁকে কটা দিন হাতে রেখে বাড়ি আসতে তুমি। লুকিয়ে দীঘির পাড়ে, বাড়ির পিছনের বাঁশ ঝাড় কোথায় কোথায় না আমরা দেখা করেছি।টিউশনির টাকা দিয়ে একটা মোবাইল ফোন কিনলে, ফোন দিয়ে আমার চেয়ে বেশি রাতুলের সাথেই কথা বল তুমি।মাঝে সাঝে তোমার কন্ঠ শুনতে পাই, বাবাটার উপর রাগই লাগে, ঘরে নাকি একটার বেশি মোবাইল থাকার কোন মানে নাই। রাত বিরাতে বাসার সামনের এক চিলতে উঠোনে তারা দেখতে দেখতে ভাবি একদিন আমার লাল টুকটুকে একটা ছোট্ট মোবাইল ফোন থাকবে।আমি অনেক কথা বলবো তোমার সাথে। তুমি কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে যাবে, হুট করে বলবে উফ ঘুমোতে দাও তো।আমি ফোনের এপাশে গাল ফুলাবো।আমি আর দশটা মেয়ের মতো লক্ষী টাইপ নই জানো তো। বড় আত্মকেন্দ্রিক। আমার ছোট ঘরের ছোট জানালার মত মনটাও শুধু তোমাকে ঘিরে ছোট হয়ে গিয়েছে। একটা মনের সবটা জুড়ে শুধু তুমি।
আমি শাওলী।আমার মনে মনে কথা সাজাতে ভালো লাগে।একা একা প্রায়ই কথা বলি দেখে মা বিরক্ত হয়ে প্রায়ই বলেন আমার মাথায় গণ্ডগোল আছে।কিছুটা যে আছে তা অস্বীকার করছিনা।পাগল না হলে কোন মেয়ে লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলেনা, আমার বয়স হচ্ছে তো, আমার বিয়ে দিবেনা? সেদিনের কথা আমি আজো ভুলতে পারিনা। মা কেমন বিস্ফোরিত চোখে আমাকে দেখছিলেন!মানুষকে চমকে দিতে আমার ভাল লাগে।আসলে অনুভূতিটা আরো অনেক বেশি অন্যরকম, ইংরেজিটা ভালো শোনায়,বাটারফ্লাইজ ইন মাই টাম্মি! মাথায় একটা টেনশন কাজ করে সে চমকে যাবে তো? আর চমকে যাবার পর কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়,মানুষের বিস্মিত দৃষ্টি আমার ভালো লাগে।মানুষকে চমকে দিতে গিয়েইতো শ্রাবণের সাথে আমার পরিচয়। শুধু কি পরিচয়? শ্রাবণ আর আমি কি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাইনি?সেসব প্রশ্নের উত্তর জানিনা।শ্রাবণ আমার ছোট ভাই রাতুলকে পড়াতো, অনুরোধে ঢেঁকি গেলা যাকে বলে, শহরতলীর ভাল ছাত্র, বাবার হঠাত বদলী হয়ে আসা বন্ধুর ছেলে,ছুটিতে গ্রামে এসেছে। সারাক্ষণ ঘামতে থাকা ফর্সা মুখটায় কালো ভারী ফ্রেমের চশমা। খুব অবাক হলে ডান হাতটা ঘুরিয়ে ঘাড়ের কাছে নিয়ে যেয়ে পেছনের চুল এলোমেলো করে দাঁড়িয়ে থাকে। চশমার আড়ালে গভীর চোখ, উজ্জ্বল কালো তারায় রাজ্যের স্বপ্ন উড়ে। আমি স্বভাবমত তাকে চমকে দিতে চাইলাম।সে তো হতবিহবল হলোই, তার অবাক চোখের তারায় আমিও বন্দী হয়ে গেলাম।সময় যেন সিন্ডারেলার ঘোড়ার গাড়ি হয়ে গেলো, কোন ফাঁকে কেটে গেলো বুঝলামইনা। অ্যাডমিশন টেস্টের ধাক্কা পেরিয়ে এবার আমি শহরমুখি।ভাগ্যই বিরুপ বলতে হবে, শ্রাবণের ইটকাঠের ঢাকায় চান্স হলোনা, পাড়ি জমালাম চিটাগং। একটা মোবাইল ফোন হয়েছে আমার ততোদিনে।কিন্তু শ্রাবণের ফোন করতে কেন যেন আর ইচ্ছে হতোনা।বরাবরের খামখেয়ালী আমি শ্রাবণের নাম্বারটা বের করে বসে থাকতাম ঠিকই ডায়াল কীতে আর আঙ্গুল পৌঁছুত না। তবু আমাদের উদ্দাম প্রেম চললো, সারারাত ফোনে দুই টাকার প্যাকেজে না, নীল খামের চিঠিতে। সানমারের টপফ্লোরে বসে কপোতকপতী গুনতে গুনতে ভাবতাম, আমরাও চাইলে এমন হতে পারতাম, ক্ষতি ছিলোনা, কিন্তু এমন হতে চাইনি আসলে আমিই। বছরের হুটহাট দেখার মুগ্ধতা আমাকে বেশি টানতো। শ্রাবণ ও কখনো আপত্তি করেনি।
শ্রাবনের বাবা রিটায়ার্ডমেন্টের পরে পাড়ি জমালেন ঢাকায়। বছরে দু একবার দেখা হবার মৌসুম হারিয়ে গেলো। ঝটকাটা ভালোই ছিল আমার জন্য যখন জানতে পারি।তবে অন্য কিছুও অপেক্ষা করছিলো , সে আরো পরের ব্যাপার। তুমি আশ্বাস দিলে ছুটিতে প্রয়োজনে চিটাগং আসবে। আমি প্ল্যান করি তোমাকে নিয়ে কোথায় ঘুরবো।আমার নেভাল ভালো লাগে।যদিও বিকেলে খুব ভীড় বাট্টা হয় তবুও।নেভালের ঝাউবন আমাকে টানে, খুব টানে।আবার ওয়ার সিমেট্রিও যাওয়া যায়। ঠিক করে ফেলি আমি পতেঙ্গা যাবোনা কিছুতেই, বাজার হয়ে গিয়েছে ওটা। তুমি বন্ধে ঠিকই এলে, আমাদের ঘুরাঘুরি হলো জিইসি মোড়ের টং দোকান আর খুলশী মার্ট এর পাশে থাকা ফাস্টফুডে বসে আড্ডা দেয়া পর্যন্তই।তাতেই আমরা খুশি ছিলাম।আমি আর শ্রাবণ। দুদিনের ছুটি কাটিয়ে শ্রাবণ চলে গেলো ঢাকায়।আমি পড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ক’দিন পরেই পরীক্ষা।শ্রাবণের পড়ার পাট চুকিয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। তারপর একটা চাকরী। তারপর সব সুখী গল্পের শেষটা যেরকম হয় তাই হবে।
দেশের অবস্থা কিছুদিন ধরেই ভালোনা। প্রধান দুটি দল তাদের স্বভাবমত যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে। একদম হরদম হরতাল দিয়ে যাচ্ছে আরেকদল নিজেদের মত নিয়ে গো ধরে বসে আছে। আমার ইচ্ছে করে এই দুই দলের মানুষদের আচ্ছা করে চমকে দেই। পরীক্ষা শেষ, বাড়ি যেতে পারছিনা, কোন মানে হয়।ইচ্ছে আছে এবার বাড়ি যেয়ে মাকে সব জানাবো। শ্রাবণ কে তো তাদেরও কম পছন্দ নয়। মা বাবা অবশ্যই মেনে নিবে, আমি জানতাম।
২…
ট্রেনে বসে আছি। জরুরী তলবে বাড়ি যেতে হচ্ছে।বাবার নাকি শরীর ভালোনা।সব প্রেমের গল্পেই এমন থাকে তাইনা? বাবা কিংবা শরীর খারাপের নাম করে মেয়েকে বাড়ি ফিরিয়ে আনেন তারপর জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়া।আমার ক্ষেত্রে ঘটনা তা ছিলোনা। আসলেই বাবার শরীর খুব একটা ভালোনা। শ্রাবণদেরও খবর দেয়া হয়েছে। আমাদের কিছু বলতে হয়নি বাসা থেকেই সব ঠিক করেছে, ভালোই হলো বলে আমার ধারণা। এইচ এস স্যার পর পর নিজ মুখে একবার মাকে বলেছিলাম বিয়ে দেবেনা?চমকে দিতেই হোক আর যাই হোক বলেছিলাম তো! সত্যিকার বেলায় এসে কেন যেন আর বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিলো পড়াটা শেষ করি তারপর সব হোক।কিন্তু বাবার শরীরটা বড় অবাধ্য হয়ে রয়েছে।এদিকে হরতাল অব্রোধ চলছেই।কাল ও বাস পুড়িয়েছে হরতাল সমর্থকেরা। আজ একদিন হরতাল ছাড়া পাওয়া গেলো, বাসের টিকিটের আকাশ ছোঁয়া দাম, তাছাড়া পাওয়াও যাচ্ছেনা।এক বন্ধু ব্ল্যাকে ট্রেনের টিকিট জোগার করে দেয়ায় রক্ষা।
বন্ধুদের কাউকে বলে যাচ্ছিনা কোন উদ্দেশ্যে বাড়ি যাচ্ছি। এসে সবাইকে চমকে দিবো।ভাবতেই ভালো লাগছে।বাটারফ্লাইজ ইন মাই টাম্মি।
৩…
আজ আমার বিয়ে।ঘুম থেকে ওঠার পর নিজেকে কেমন অনুভুতি শূন্য মনে হচ্ছে।মাথাটা কেওম্ন হাল্কা।বিয়ের দিন সব মেয়ের এমন হয় বুঝি।লাল পেড়ে একটা বাসন্তী শাড়ি পড়ে আছি।ডান হাতে সোনালী রাখিটা চিকচিক করছে, গতকাল রাতুল আর চাচাতো মামাতো ভাই বোন মিলে হলুদ এর আয়োজন করেছিলো। মেহেদীও লাগিয়েছে। আমি মুগ্ধ হয়ে রঙ দেখছি।হিজিবিজি নকশীর মাঝে ছোট্ট করে ইংরেজি অক্ষর ‘এস’ লুকিয়ে আছে।শ্রাবণ যদি খুঁজে বের করতে পারে তাহলে সে নাকি আমাকে সত্যি ভালবাসে, অহনা কাল মেহেদী আঁকতে আঁকতে বলছিলো।সকালে চাচী মেহেদীর রঙ দেখে বললেন শ্রাবণ আমাকে খুব ভালবাসবে। টকটকে হয়েছে রংটা। লজ্জা পাওয়ার ভান করে হাসি আমি। আমি তো জানিই শ্রাবণ আমাকে কতটা ভালবাসে।ভালবাসা পেতে আমার মেহেদী লাল হবার কোন প্রয়োজন পড়বেনা।মেহেদীতে রঙ না ধরলেও শ্রাবণ আমাকে অনেক ভালবাসবে তা আমি জানি।
কথা ছিলো শ্রাবণরা বিয়ের আগেরদিন এসে আমাদের বাড়িতে উঠবে, কেন যেন শেষ মুহুররতে প্ল্যান বদলে গেলো। ওরা একেবারে বর যাত্রীই আসবে। ভালোই হয়েছে। একই বাড়িতে থেকে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছিলোনা। কিছুক্ষণ পর আমাকে তৈরী করতে সবাই আসবে।ইচ্ছে করছে শ্রাবণ কে একবার ফোন দেই।কিন্তু আমরা কথা দিয়েছিলাম বিয়ের আগে কেউ কাউকে আর ফোন দিবোনা। এটাও আমার পাগ্লামী ছিলো।বিরহ কে কতদূর সহ্য করতে পারে দেখার ইচ্ছে। একটু পরেই সবাই চলে আসবে। আমি দরজা ভেজিয়ে দিলাম। গান শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে-
“ বধূ কোন আলো লাগলো চোখে
বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে”
ঘরে সবাই এসে পড়েছে। আমি শ্রাবণের জন্য তৈরী হতে লাগলাম, আমার মনের উপর, জীবনের উপর যার অধিকার সবচেয়ে বেশি, সেই শ্রাবণের জন্য। কোন এক অদ্ভুত কারণে আমার দু চোখ ছাপিয়ে জল পড়তে লাগলো।
শ্রাবণদের গাড়িতে আগুন যখন দেয়া হয় আমি তখন তৈরী হচ্ছিলাম।বাড়ির ড্রইং রুমে তখন বড়দের আড্ডা চলছে। কোন রাজনীতিবিদ কি কি ভাবে দেশটাকে খেলো তা নিয়ে।উত্তেজনা ভরা কন্ঠে শুনতে পাচ্ছিলাম কোন এক বিরোধী দলীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কর্মীরা মাঠে নেমে গিয়েছে। গাড়ি পোড়াচ্ছে, ভাঙছে। আগামী ৫দিন অবরোধ। ঘরের পাড়াতো বোনেরা হাসতে লাগলো আমার সৌভাগ্যে, কতদিন বন্ধে জামাই নিয়ে পড়ে থাকবো।সব ছাপিয়ে আমার মাথায় রবিবাবুর গান বেজে চলেছে। ঢাকা থেকে বেশ খানিকটা দূরে চলে আসার পর উদ্দাম ক্ষোভে ফেটে পড়া কর্মীরা শ্রাবণদের গাড়িতে আগুন দিয়েছিলো। শ্রাবণের চাচা স্পট ডেড, শ্রাবণের শরীরের পঞ্চাশ শতাংশ পুড়ে গিয়েছে। টিভিতে একটু পর পর ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে।শ্রাবণের বাবা কোনমতে গাড়ি থেকে বের হতে পেরেছিলেন, আমার বাবা পাগলের মত কার কার নাম্বার ডায়াল করে যাচ্ছেন। সন্ধ্যার লালিমা তখন দিগন্ত ছুঁয়েছে। একটা সময় আমার মায়ের চিৎকার শুনতে পেলাম আল্লাহ রে…
আমার কানে তখনো বেজে চলেছে –
ছিল মন তোমারি প্রতীক্ষা করি
যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি,
ছিল মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে-
জন্ম-জনম গেল বিরহশোকে…
বধূ কোন আলো লাগলো চোখে
বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে…
কিছু-কিছু মানুষ জোর করে অন্যের বাস্তবতাটাকে অসহনীয় কঠিন আর বিবর্ণ করে তোলে! 🙁 🙁
🙁
ভালো লাগলো লিখাটা 🙂 ধন্যবাদ
ধন্যবাদ 😀
অনেকদিন ব্লগে সময় দেয়া হয় না, আজকে কী মনে করে এলাম, তারপর এই লিখাটার নাম দেখেই কেন জানি না পড়তে এলাম…
শেষটুকুর জন্য আসলে প্রস্তুত ছিলাম না, কিংবা ইচ্ছে করছিলো না এমন ভাবতে…
এমন কত গল্প আমরা না জেনে বেঁচে থাকি রোজ রোজ…
ভালো লেগেছে লিখাটা বলবো না, বরং মন খারাপ হয়েছে…
মন খারাপ করিয়ে দেয়ার দায়ভারটুকু মাথা পেতে নিলাম 🙁
If you are the at the phase when are in the deepest thurst for a moment…
of silence…..
of unending continuation———–
of a melody————
Please consider leaving this story
Cause
Words reflected in the lines
are simple in tone, deep in meaning and tough to absorb for little soul like me…
So, the honorable writer
You are cursed with the gift of telling
that moves everything, everything-
Thank you for your comment.. 🙂
মন খারাপ করা একটি বাস্তব গল্প।এই অবরোধে আর মত মানুষ মারবে।এই পর্যন্ত ৬০+ মারা গেছে।প্রতিদিন অবরোধের মধ্যে আমাকে বের হতে হয়।বাসে উঠার সময় মনের মধ্যে নানা চিন্তা আসে ।আমি ঠিক এরকম একটা চিন্তা একদিন বাসে বসে বসে করেছিলাম।গল্পটা যেন আমার চিন্তার মত মিলে গেছে।
চমৎকার লিখা।পড়ে খুব ভাল লাগেছে যদিও মন খারাপ হয়েছে তবে ভাল লাগল। 🙂
শুভ কামনা।
ধন্যবাদ। 🙂
কী চমৎকার গল্প লেখার হাত! হিংসা করলাম।
আমি ভেবেছিলাম শ্রাবণ মারা যাবে। যাক, মারা তো যায় নি।
আমাদের রাজনীতিবিদরা দেশপ্রেমের কথা বলে, দেশ বদলের কথা বলে। কিন্তু তারা কোন ত্যাগ স্বীকার করে না, সব সইতে হয় সাধারণ মানুষদের।
‘জেন আয়ার’ পড়েছেন? সেখানে জেন আগুনে পুড়ে অন্ধ হয়ে যাওয়া ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করে। দারুণ সংসার হয় তাদের।
হ্যাঁ আপু জেন আয়ার পড়েছি, মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। :love: