-মা, আমি একটু বাইরে যাই?
-কেন রে, মা? এতো রাতে?
-একটু দরকার ছিলো।
-তাড়াতাড়ি এসে পড়িস।
-আচ্ছা।
নীতি খুব সুক্ষ্ম সাবধানতার সাথে চোখটা মুছে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। সময় তখন রাত আটটা। শহরটা আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ছে যেন একটু আগেই সে ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। রাস্তার ডিভাইডারের দুপাশে জ্বলতে থাকা বিপরীতমুখী সোডিয়াম বাতিগুলোকে আজ বিবাদপূর্ণ এক এক জোড়া মানুষ মনে হচ্ছে! এতো সুন্দর সোনালী আভায় তার আজ মন ভিজছেন না।
কিন্তু অন্যান্য সময় হলে নীতি এই সোডিয়াম বাতিগুলোর বাসন্তী রঙের আবছা আলোয় স্নান করতো নগ্ন মস্তিষ্কে, কোনো কিছু না ভেবেই দু হাতকে ডানার মত করে ঘুমিয়ে পড়া শহরটার ফাঁকা বুক জুড়ে উড়ে বেড়ানোর চেষ্টায় নিমগ্ন থাকতো!
আজ তাহলে কি হয়েছে?
নীতির বাবা নেই। না নাহ্, মৃত্যু হয়নি তাঁর, বেঁচে আছেন এখনো। তবে নিজে বাঁচতে গিয়ে তিনি দুজনকে হত্যা করেছেন অনেক আগেই, নীতি আর ওর মাকে! মনটাকে জ্যান্ত নিজ হাতে কবর দিয়েছেন তিনি সেদিনই, যেদিন তিনি তাঁর নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া একটি মেয়ে এবং তাঁর স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যান অন্য কোনো সুখের সন্ধানে। এরপর থেকে নীতির মা অনেক সংগ্রাম করেছেন এই প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। নীতিকে ছেড়ে দিয়েছেন স্বাধীনভাবে স্বাধীনতাকে পরখ করে দেখার জন্য , ভুল করার জন্য, শুধরে নেবার জন্য। নীতি সেভাবেই নিজেকে গড়ে তুলেছে। প্রত্যেক মেয়ের জীবনেরই প্রথম হিরো হিসেবে থাকে তার বাবা। নীতির জীবনের নীতিমালার তালিকার প্রথমটিই যখন ভুল প্রমাণিত হলো, তখন সে এই বিপরীত লিঙ্গকে সবসময় এড়িয়ে চলতেই চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই ক্ষিতির নীতিমালা বড়ই রহস্যময়ী!
তার সেই মৃত মনটিকে জীবিত করতে কেউ একজন নিরবে তার মন ছুঁয়ে দিয়েছিলো।
ভালোবাসার জালটা এমনই একটা জাল, যেখানে প্যাঁচানোর আগে মনে হয়, যে মানুষ জালটা পেতেছে, সে আটকে গেছে, তাকে ছুটাতে হবে। কিন্তু ছুটাতে যখন যাওয়া হয়, তখন নিজেই সেই জালে পেঁচিয়ে যায়! ছুটতে পারেও না, চায়ও না!!
নিঃশব্দ আর নীতির মাঝে এই জালটার বীজ বাসা বেঁধেছিল। পরে তারাই সেই জালে নিজেদের ছোট্ট একটি নীড় গড়ে নেয়। তারা কখনোই কেউ কারো কাছে প্রতিজ্ঞা করেনি যে তারা কেউ কখনো কাউকে ছেড়ে যাবে না। কারণ দুজনই জানতো, কেউ কাউকে ছাড়ার নয়, এ কারণে বন্ধনটা হয়তো আরো শক্ত হয়ে গেছে!
কিন্তু সেদিন নিঃশব্দের হঠাৎ কি যেন হলো! নীতিকে একটি নদীর ধারে ডাকলো, যেখানে প্রথম নিঃশব্দ তার নীতিকে তার জীবনের বৈঠা হিসেবে চেয়েছিলো, আর নীতিও লক্ষী মেয়ের মত দায়িত্বটি মনে বেঁধে নিয়েছিল! নিঃশব্দ সেখানেই তার নীতির গায়ে উষ্ণতার নীল চাদর জড়িয়ে দিয়েছিলো প্রথমবারের মত! প্রথমবারের মত সেই এলোমেলো চুলের বালকটির উষ্ণ নরম ঠোঁট সেই নীল চাদর গায়ে জড়ানো মেয়েটির কপাল স্পর্শ করেছিলো।
সেদিন আবার সেই একই জায়গায় ডেকে নিয়ে নিঃশব্দ তার নীতির হাতে ঠিক ১৪টি কাঁচের চুড়ি পড়িয়ে দিয়েছিলো নীল রঙের আর হাতে একটি চিঠি দিয়ে বলেছিলো, “বাসায় গিয়ে খুলো। খানিকটা সময়টা আমাকে দাও।”
“ঠিক আছে, বাবুটা,” নীতি জবাব দিলো।
সেদিন তারা অনেকক্ষণ বসে গল্প করলো, রাত আটটা নাগাদ পর্যন্ত। কিন্তু নিঃশব্দ সেদিন আসলেই কেমন যেন নিঃশব্দতা প্রকাশ করছিল, যদিও বুঝতে দিচ্ছিলো না নীতিকে। তবুও নীতি খেয়াল করেছে, সে তো তারই আয়না! সে ভেবেছিল হয়তো ছেলেটি আজকে ক্লান্ত, তাই এমন চুপচাপ হয়ে আছে। তাই আর কিছু বলেনি। সেই রাতের আটটা সময়টার কথা নীতি কক্ষণো ভুলবে না!
ছেলেটা হঠাৎ করেই কিছু না বলেই নীতিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো! খুব বেশি শক্ত করে!! মনে হচ্ছিলো যেন, ‘এই বুঝি ফসকে গেলো!’ ! আর হুঁ হুঁ করে কেমন নিথরভাবে আর্তনাদ করে নোনতা পানিতে নীতির পিঠ ভিজিয়ে দিলো!! নীতি তখনও কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। কি হচ্ছে এসব? আপাতত প্রশ্নটিকে অবজ্ঞা করে সেও নিঃশব্দকে খুব নিজের করে জড়িয়ে নেয়। জিজ্ঞেস করলো সে, “কি হয়েছে তোমার হঠাৎ? কাঁদছো কেন?” নিঃশব্দ নিঃশব্দই থাকে, কোনো জবাব দেয় না। খানিকক্ষণ পর ছেড়ে দেয় নীতিকে, হাতটিও ছেড়ে দেয়! এরপর হেঁটে চলে যায় কিচ্ছুটি না বলে …
বাসায় এসে নীতি চিঠিটি খোলে খুব ভয়ে ভয়ে। চিঠির লেখাগুলো এমন ঃ
“প্রিয় নীতি,
চিঠিটি যখন লিখছি তখন চোখের পর্দায় রাস্তায় জ্বলতে থাকা সোডিয়াম বাতির আলো এসে পড়ছে। আমার এই পিচ্চি খুকিটার তো সোডিয়াম বাতির আলো খুব পছন্দের, তাই না? তাই আজ সোডিয়াম বাতির আলোয় সিক্ত হওয়া একটি কাগজে তোমাকে লিখছি ঠিক ডিভাইডারের মাঝখানটিতে বসে! তুমি যদি এখন সামনে থাকতে, তাহলে হয়তো বলতে, “এই পুচকে পাগল,তুমি ডিভাইডারে দাঁড়িয়ে কি করো? জানো না, ওটা আমার কাছে দুই রাস্তার মিলনপথের বাঁধা দানকারী ভিলেন মনে হয়? নেমে আসো! ”
হয়তো, উপরের কয়েকটি লাইন পড়ে মুচকি করে হেসে দিচ্ছো। ইশশ্!! যদি আর একটাবার সেই দু তিলের ঠোঁটের হাসিটা দেখতে পারতাম!
আজ তোমার নিঃশব্দের সাথে তোমার জীবনের অতিক্রান্ত হওয়া চৌদ্দতম মাসের শেষ দিন। তাই তোমায় চৌদ্দটি চুড়ি দেওয়া। চুড়িগুলো তোমার হাতে খুব মানাবে।
জানো নীতি, তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, সেদিন মনে হয়েছিল তুমি খুব অহংকারী হয়তো, তাই কারো সাথে অতোটা মেশো না, কিন্তু পরে ধারণাটি পুরোপুরি পাল্টে গেলো যেদিন তুমি প্রথম আমার সাথে কথা বলেছিলে। মনে হয়েছিল, তুমিই সেই মেয়েটি যে কিনা আমার এলোমেলো চুল আঁচড়ে দিবে, আমার চশমার কাঁচ মুছে দিবে, দুপুরে খেতে দেরি করলে অভিমান করে থাকবে আর মিষ্টি করে বকে দিবে! তাই তোমাকে আমার জীবনের হাল ধরতে তোমার হাত ভিক্ষা করেছিলাম আর তুমিও আমাকে নিরাশ করোনি। এই মেয়ে, তুমি সেদিন আমাকে নিষেধ করলে না কেন? কেন বললে না যে, ‘আর কক্ষণো আমার সামনে আসবে না’ ? তাহলে হয়তো অনেক কিছুর শুরুও হতো না আর আজ সেই অনেক কিছুরই শেষও হতো না!!
হুমম্, তুমি ঠিকই পড়ছো! তবে “শেষ” বলে কি আসলেই কিছু আছে, মণি?
আমার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে, বেশিদিন আর সার্ভাইভ করছি না হয়তো। তাই বাবা মায়ের কাছে আজ রাত দশটার ফ্লাইটেই অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি।
জানো, আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে, সোনা! খুব ইচ্ছে করে, তোমার ভালোবাসায় সিক্ত হতে , ইচ্ছে করে সোডিয়াম বাতির আলোয় একসাথে স্নান করতে , ডিভাইডারে দাঁড়িয়ে তোমার বকা শুনতে , একসাথে বৃষ্টিতে ভিজতে খুব করে ইচ্ছে করে, নদীর ধারে তোমার গায়ে নীল চাদর জড়িয়ে দিয়ে চোখজোড়াকে শান্ত করতে ইচ্ছে করে ….
কিন্তু আমি জানি, আমি আর পারবো না। কখনোই পারবো না।
আমি জানি, তুমি আমাকে কতোটা ভালোবাসো, তাই কষ্ট পাবে ভেবেই কিছু জানাইনি তোমাকে। আমাকে ক্ষমা করে দিও, প্লিজ। আর, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, নীতি … অন্নেক ভালোবাসি।
ভালো থেকো সবসময়।
ইতি –
তোমার পুঁচকে পাগল ”
এরপর নীতি একটাবার ফোনও দিয়ে দেখেনি নিঃশব্দকে। নিঃশব্দের নিঃশব্দতা তার মনটাকে ঘিরে ফেলেছিলো চতুর্দিক থেকে।
একটু আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে একটা ফোন এসেছিলো । নিঃশব্দের মামা ফোন করেছে। একটু আগেই ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন!!
নীতির মনে অদ্ভুত একটা অনুভূতি অনুভূত হচ্ছিল। হৃদয়টা আগেই ভেঙে গিয়েছিল। তবুও আজ আবারো ভাঙলো, কিন্তু নিঃশব্দে!! কোনো আওয়াজ নেই। শব্দটির মাত্রা বোধ করি পৃথিবীর এক কোণে থাকা এক জোড়া কবুতর ছাড়া অন্য কারো শ্রাব্যতার সীমার নিচে ছিলো।
নীতির তখন মনে হচ্ছিলো, নিঃশব্দ সেই সোডিয়াম বাতির নিচেই বসে আছে এখনো! ডেথ সার্টিফিকেট পেয়েই সে তার নীতির কাছে ফিরে এসেছে!!
নীতি এখনো সেই ডিভাইডারে দাঁড়িয়ে আছে আর ভাবছে,
“ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না। শেষ বলতে কিছু নেই আসলেই। সময়টাই যা বেঈমানী করে মাঝেমাঝে! “
ভাল লিখেছিস! :love:
চালিয়ে যা!
“এতো নিষ্ঠুরভাবে সত্যি কথা বলতে নেই রে, পাগল …” :love:
😳
ভালো লিখা … ভালো লাগলো :guiter:
🙂
তোমার এই গল্পটা আমি কয়েকদিন আগেই পড়েছি। মন্তব্য করিনি, কেননা কিছুটা সময় নিয়ে মন্তব্য করবো ভেবে রেখেছিলাম…
একজন লেখক মাত্রই তাঁর লেখায় নিজের চিন্তাগুলোকে বিভিন্ন উপমায় রাঙিয়ে তোলার চেষ্টা করে থাকেন। উপমার গাঢ়ত্ব/অন্তরালের কথা লেখকের কল্পনাশক্তির প্রগাঢ়তার পরিচায়কও বটে। উপমায় স্বাতন্ত্র্যের ছাপও থাকে।
তমার এই গল্পেই এমন কিছু অংশ আছে—
”শহরটা আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ছে যেন একটু আগেই সে ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। রাস্তার ডিভাইডারের দুপাশে জ্বলতে থাকা বিপরীতমুখী সোডিয়াম বাতিগুলোকে আজ বিবাদপূর্ণ এক এক জোড়া মানুষ মনে হচ্ছে! এতো সুন্দর সোনালী আভায় তার আজ মন ভিজছেন না।”
”ভালোবাসার জালটা এমনই একটা জাল, যেখানে প্যাঁচানোর আগে মনে হয়, যে মানুষ জালটা পেতেছে, সে আটকে গেছে, তাকে ছুটাতে হবে। কিন্তু ছুটাতে যখন যাওয়া হয়, তখন নিজেই সেই জালে পেঁচিয়ে যায়! ছুটতে পারেও না, চায়ও না!!”
”এই পুচকে পাগল,তুমি ডিভাইডারে দাঁড়িয়ে কি করো? জানো না, ওটা আমার কাছে দুই রাস্তার মিলনপথের বাঁধা দানকারী ভিলেন মনে হয়?”
সরবে প্রকাশিত হয়েছে এমন তোমার প্রায় সবগুলো লেখাই পড়েছি।
এক শব্দে অসাধারণ লেখাগুলো। প্রায় প্রত্যেকটা লেখাতেই গভীর জীবনবোধের ছাপ আছে। কিছু-কিছু লেখাতো এতটাই রূপকাশ্রয়ী ছিল যে তার পেছনের কথাগুলো ধরতে বেশ বেদ পেতে হয়েছিল।
গল্প/কবিতার নামকরণ আমার কাছে কঠিনতম কাজের একটা মনে হয়। ব্যাপারটা এমন, যে গল্প/কবিতা লেখার চেয়ে তার একটা পারফেক্ট নাম দাঁড় করানো আরও বেশি কঠিন!
এই নেমিংয়ের কাজটাও তোমার বেশ ভাল হয়। আর এই সবকিছুই বলে, তোমার মধ্যে চমৎকার একজন লেখক বাস করে। আমি তোমাকে উপদেশমূলক কথা বলব না। তার প্রয়োজনও দেখি না। আমার মনে হয়, প্রকৃতি ট্যালেন্টগুলোকে রক্ষা করার, চালিয়ে নেয়ার দায়িত্ব নিজের হাতেই রেখেছে। মাঝে-মাঝে কিছুটা অন্যরকম মনে হয়, তবে তা কিন্তু নিয়মের ব্যত্তয় না। তোমার গল্পের শেষ লাইনটার মত- ”শেষ বলতে কিছু নেই আসলেই। সময়টাই যা বেঈমানী করে মাঝেমাঝে!”
মন থেকে দু’আ করি আপু, অনেক বড় হও 🙂
বাকরুদ্ধ আমি আপনার মন্তব্য পড়ে!!
এতোটা ভালো লাগবে আমার লেখা কারো কাছে কিংবা কেউ সেই লেখা পড়ে এতোটা উৎসাহিত করবে, ভাবতেই পারিনি!!
কেমন যেন হলেও ব্যাপারটা সত্য, কাগজে কলমে আমার লেখালেখির ব্যাপারটি ঠিক আসে না! কিন্তু যখনই আমি এই যান্ত্রিক শব্দগুলো দেখি কাঁচের আড়ালে, তখনই কেমন যেন হাতের আঙুলগুলো এদিক সেদিক দিগ্বিদিক দৌড়াতে থাকে আর সে থেকেই কি কি যেন লিখে ফেলি!
আসলেই অনেক বেশি ভালো লেগেছে আপনার কথাগুলো।
অসংখ্য সাধুবাদ … 🙂