টিউশনির ফাঁদ

দৃশ্য -০১:

কুমিল্লা বোর্ডের মেধাবী ছাত্র রফিকুল ইসলাম। বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায়  ১ম দিকে স্থান পাওয়া ছাত্র। বেছে নিলেন পছন্দের সেরা বিষয়। তার বাবা নাই। চার বোন এক ভাই ।

ঢাকায় বুয়েটের হলে থেকে নিজের পড়াশুনা এবং  থাকা– খাওয়ার খরচ মেটাতে একটা টিউশনির ব্যবস্থা করে  নিলো। এই পর্যন্ত সব  ঠিকই ছিল।

বিপদ হলো যখন বড় বোনের বিয়ের খবর এল গ্রাম থেকে। কি করবে ভাবতে পারছিলনা রফিক। তখন উপায়  করে দিল হলেরই এক বড় ভাই।

কয়েকটা কোচিং আর টিউশনির ব্যবস্থা করে দিল। বোনের বিয়ে হয়ে গেল বেশ ভাল ভাবেই। কিন্তু রফিকের টিউশনি আর ছাড়া হয়না ।

আজীবন দারিদ্রের সাথে লড়ে  যাওয়া রফিক ভাবল- একটু  স্বচ্ছলতা আসলে আসুক, খারাপ কি?

দৃশ্য -০২:

রন, ঢাকার নামকরা স্কুল এবং কলেজ থেকে বেশ ভাল রেজাল্ট নিয়ে পাশ করে বেশ দাপটের সাথেই বুয়েট এ পড়ার সুযোগ  পায় পছন্দের বিষয়ে। সাথে সাথে ভর্তি কোচিং এর বড় ভাই কোচিং এ ক্লাস ও মম কে বাসায় পড়ানোর জন্য বলেন।

রন ভাবে বুয়েটে যেহেতু ভর্তি হয়েছি একদিন ইঞ্জিনিয়ার হবোই। আর চাকরী তো আমাদের জন্য বসেই আছে। আর ভর্তি কোচিংয়ের বড় ভাইতো আর ভুল বলেনাই-বুয়েট এ আসলে পড়তে হয়না– খালি পাশ করলেই চলে ।

তাহলে এখন নো চিন্তা ডু ফুর্তি। চুটিয়ে টিউশনি আর কোচিং এ ক্লাস নেয় রন। বেশ নগদ নারায়ন মিলতে থাকে রনর হাতে, দেদারছে খরচ ও করে। হাল ফ্যাশনের মোবাইল, জামা আর গার্ল ফ্রেন্ডের  জন্য গিফট  তো আছেই।

দৃশ্য -০৩:

একরামুল হক, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শেষ আশা। নিরক্ষর অথর্ব বাবার ঘাড়ে চেপে বসা এক হত দরিদ্র পরিবারের মেধাবী মুখ। আধ বেলা-এক বেলা খেয়ে, সরকারি স্কুল ও কলেজে অন্যের দান খয়রাতে পড়ে ,আর পাঁচটা দরিদ্র মেধাবির মতই সুযোগ করে নেয় বুয়েট নামক স্বপ্নের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। স্বপ্ন দিকবিজয়ি গবেষক বা প্রকৌশলী হওয়া।

কিন্তু ইকরু নামে পরিচিত এই সদ্য বালক হতে তরুণে পরিনত ছেলেটার  স্বপ্নগুলো  মার খেয়ে যায়। যখন ইকরু দেখে  ফি না দেয়ার কারনে ছোট বোনের স্কুলে যাওয়া প্রায় বন্ধ। দিনের পর দিন বাবার ওষুধ থাকেনা।মাসের পর মাস পড়ার কাপড়ের  অভাবে বাইরে যায়না মা। তখন ইকরু পড়াশুনার খরচ চালানোর জন্য আগের একটা টিউশনির সাথে আর তিন-চারটা জুটিয়ে নেয়। নিজের স্বপ্নের সময়টুকু বিক্রি করে নাম মাত্র মুল্যে অন্যের স্বপ্ন-বীজ বোনার কাজে।

———উপরের তিনটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। ছাত্রজীবনে পড়াশুনার খরচ মেটানোর জন্য দুই-একটা টিউশনি করাটা হয়তো দোষের কিছুনা। কিন্তু বিপদটা হয় যখন এটা মাত্রাতিরিক্ত হয়।

অনেকেই আমার সাথে দ্বিমত করতে পারেন- এই বলে যে অনেক টিউশনি করেওতো অমুক ভাই ভাল রেজাল্ট করতেছেন, ভাল রেজাল্টের জন্য টিউশনি কোন বাধা না।

কিন্তু এই অমুক ভাইয়ের সংখ্যা খুব বেশিনা- এক বা দুইজন। মনে রাখতে হবে ব্যতিক্রম কখনো উদাহরন নয়। আর মাত্রাতিরিক্ত টিউশনি আমাদের পড়াশুনার করার জন্য উৎসাহ ও এনার্জি কমিয়ে দেয় ।

মাত্রাতিরিক্ত টিউশনির প্রভাবটা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিকে বোঝা যায়না। কারন তখন পড়াশুনার চাপ ও লেভেল থাকে প্রাথমিক পর্যায়ে– যা দেশ সেরা মেধাবীরা সহজেই উতরে যায়- বলতে হবে। এর প্রভাব বোঝা যায় শেষ দিকে (৩য়, বিশেষত ৪র্থ বছরে) যখন পড়াশুনায় অতিমাত্রায় মনযোগ ও অধ্যবসায় দরকার।

এখন আসা যাক কেন টিউশনি ও কোচিং ক্লাশের এই ফাঁদে আটকা পরে মেধাবীরা?

ক) পড়াশুনার খরচ মেটানোর জন্য এক-দুইটা টিউশনি করে থাকে অনেকে। যেটা দোষের কিছুনা।

খ) অর্থ-লোভঃ ছাত্রজীবনে একটু বিলাসী ভাবে থাকার জন্য অনেকেই মাত্রাতিরিক্ত টিউশনি করে থাকে।

গ) কোচিং এর প্রভাবঃ বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী ভর্তি কোচিং হয়ে  বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। সে সব কোচিংয়ের বড় ভাইয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়। অনেকেই চায় বড় এই ভাইয়াদের মত হতে।

ঘ) অভিভাবক মহলে বুয়েট ছাত্র হিসেবে ব্যাপক কদর পায়। যে কারনে বুয়েট হয়ে যায় আমাদের অতি সচেতন অভিভাবকদের টিউটর সরবরাহকারী(!)।

ঙ) ভিশন (VISION) না থাকাঃ অনেকের কাছেই বুয়েটে এ ভর্তি হওয়া এবং একটা ভাল চাকরী পাওয়াটাই শেষ স্বপ্ন। এর পরেও যে অনেক কিছু হওয়ার আছে, অনেক কিছু করার আছে এটা না জানা। যতদিনে জানা হয়, ততদিনে আর কিছু করার থাকেনা। তাহলে বুয়েটে তো ভর্তি হয়েছিই, চাকরী হবেই পাশ করলে। তাই এখন জান দিয়া টিউশনি কর আর কোচিংয়ে ক্লাশ লও ।

—-এবার ইকরু আর রফিকুলদের বলি বুয়েটে আসার আগে বারটা বছর সেরা ছাত্র হয়ে এসেছো এখানে। আর কয়েকটা বছর কি কষ্ট করা যায়না। জাতি তোমাদেরকে স্কুল কলেজের গৃহ-শিক্ষক হিসেবে চায়না। কোচিং মালিকের ব্যবসার হাতিয়ার হওয়া- তোমাদের লক্ষ্য নয়। তোমরা আর মাত্র কয়েকটা বছর কষ্ট করলেই নিজেদের স্বপ্নের কাছে চলে যেতে পারবে। জাতি তোমাদের মধ্য থেকে একেকটা  এফ.আর খান চায়, একেকটা সত্যেন বোস, জাফর ইকবাল, হুমায়ুন আহম্মদ চায়। আর তোমরা ভাল করেই জান এদের মত বা তার চেয়েও অধিক বড় হওয়ার সামর্থ্য প্রতিটা বুয়েট ছাত্রের আছে। প্রয়োজন মেটানোর জন্য যতটুকু না করলেই নয়, ঠিক ততটুকু কর-বাকিটা ব্যয় কর নিজেকে গড়ার কাজে। কারন ঠিকভাবে গড়ে উঠা রফিক/ইক্রু– তার পরিবারের জন্য বড় সম্পদ হবে।

—-আর রণদের বলি, ভেবনা বুয়েটে সুযোগ পেয়ে তোমারাই সেরা। অন্যান্য পাবলিক/প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তোমাদের প্রতিযোগি, যারা  টিউশনি না করে চার বছর ধরে  তোমার চেয়ে অনেক বেশি পরাশুনা করে পাশ করবে, চাকরীদাতার কাছে তখন তোমার প্রতিষ্ঠান নয় বরং অধিক জানা ও যোগ্য লোকই  প্রাধান্য পাবে।

কারন দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন গুরুত্তপুর্ন পদে ও কাজে নন-বুয়েটিয়ান্দের সংখ্যা কোন অংশে কমনা। বরং কিছু ক্ষেত্রে বেশিই বলতে হবে।

…সবশেষে টিউশনি আর কোচিং ব্যবস্থার এই ফাঁদ থেকে মুক্তি পাক সকল বুয়েটিয়ান, সর্বোপরি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।

 

ইব্রাহীম

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চিন্তাভাবনা-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

5 Responses to টিউশনির ফাঁদ

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    প্রথমেই বলি :welcome:

  2. হৃদয় বলেছেনঃ

    সরবে স্বাগত :welcome:

    সত্যি কিছু কথা 🙁
    তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সত্যিই, ‘টিউশনি ফাঁদ’ নামক ফাঁদ থেকে বের হওয়া কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে… 🙁

  3. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    ভালো মেসেজ। সরবে স্বাগতম।

    মাত্রাতিরিক্ত টিউশনি বন্ধ হোক।

  4. ইকু বলেছেনঃ

    লিখার ধরন টা ভালো… মেসেজ মুলক লিখা আমার ভালো লাগে। আপনাকে ধন্যবাদ :happy:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।