ভালোবাসার অভিশাপ মুক্তির পন্থা

“ভালোবাসা” …

খুব সম্ভব রবীন্দ্রনাথের কোনো একটি ছোট গল্প কিংবা উপন্যাসে ‘ভালোবাসি’ শব্দটিকে খানিকটা কৌশলের ছলে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল এই ভাবে –
‘ভ-আকার, ল- ও-কার, ব- আকার, দন্ত্য স -হ্রস্বি কার = ভালোবাসি’ !!

ব্যঙ্গ করার যথেষ্ট কারণ ছিলো। কারণ ভালোবাসা ব্যাপারটিই আসলে কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে পড়ছে! শুধুই যেন ‘অ তে ওই অজগর আসছে তেড়ে’ – এর মত মুখস্থ করার মাত্র! বর্তমান প্রেক্ষাপটে, মায়া, মোহ যা-ই থাকে, সব প্রথম সারিতে অবস্থান করে, পেছনের বেঞ্চিতে ছাত্র বেশে বসে থাকা দিনগুলোর দিকে ‘ভালোবাসা’ নামক স্যারের দৃষ্টি দেওয়ার যেন সময়ই নেই!! কিন্তু কেন? ছাত্র তো ছাত্রই, হোক সে পেছনের বেঞ্চের কিংবা হোক সে প্রথম সারির বেঞ্চের, বরঞ্চ দেখা যায়, শেষের বেঞ্চিতে বসে থাকা ছাত্রগুলোরই বেসিক ভালো, শুধু ‘স্যার’ এর একটুখানি ধৈর্য্য আর সুদৃষ্টির অভাব।
ভালোবাসা কখনোই কিছুমাত্র অক্ষরের স্বাধীন বিন্যাস নয়, এটা অন্যকিছু। অনেক বড় রকমের অন্যকিছু। আর এটা কখনোই কারো একার সম্পদ নয়, একাধিকেরও নয় বরং ততোধিকের সম্পদ।
ভালোবাসা ব্যাপারটা আসলেই হয়তো যান্ত্রিক হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। কিন্তু মনে রাখা উচিত, প্রত্যেকটি যন্ত্রই নিজের মত করে জীবিত! সে তৎক্ষণাতের মুখোশ ধারণ করে মাত্র!
প্রশ্ন হলো, ভালোবাসা কেন এতোটা যান্ত্রিক হয়ে পড়ছে?
উত্তরটা হয়তো সঠিক জানা নেই, কিন্তু সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে বেশ কিছু উত্তর দাঁড় করানো যায়। যেমন, মানুষের মাঝে হয়তো আবেগ কমতে শুরু করেছে, তাই ভালোবাসা এমন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। আবার এটাও হতে পারে, ভালোবাসা শব্দটির সঠিক মূল্যায়নই মানুষ ভুলে গেছে কিংবা ভালোবাসা নিয়ে অভিনয় করতে করতে একে বাস্তব জীবনে আর তুলে ধরতে পারছে না! অথবা প্রজন্মই হয়তো ভালোবাসার ভুল সংজ্ঞা শিখছে!
প্রত্যেকটিরই কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্যতা আছে হয়তো, কিন্তু কেন যেন মনে হয়, ভালোবাসাই আসলে এখন অভিনয় করতে শুরু করেছে, নিজে থেকেই ছন্নছাড়া ভাবের আশ্রয় নিয়েছে মানুষের এমন আচরণ দেখে তার প্রতি! হয়তো সে খুব রাগান্বিত এবং তার রাগ থেকেই সে এমনটি করছে আর অভিশাপ দিচ্ছে !!
মানুষ আজ ভালোবাসার অভিশাপে অভিশপ্ত। ‘অভিশপ্ত’ ই, আশীর্বাদে আপ্লুত নয়!
প্রত্যেকটি জিনিসেরই কোনো না কোনো ভিত্তি থাকে, যেটাকে ইংরেজীতে বলে ‘ফাউন্ডেশন’। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যে জিনিসের ভিত্তি যত মজবুত, সেই জিনিসের স্থায়িত্বকাল তুলনামূলক দীর্ঘ। ঠিক তেমনি, ভালোবাসার ভিত্তিটিই হচ্ছে “বিশ্বাস”। কেউ কাউকে ভালো না বাসুক, সমস্যা নেই, কিন্তু বিশ্বাস না করলে কিংবা বিশ্বস্ত না হতে পারলেই যত গোলযোগ বাঁধে। বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়াও শ্রেয়, অবিশ্বাস করে জিতে আসার চেয়ে! কথাটি মুহূর্তের অযৌক্তিক মনে হলেও এর যৌক্তিকতা আছে অন্তর্নিহিতভাবে।
মানুষ বড়ই আজব প্রাণী। তার বৈজ্ঞানিক নাম হোমো সেপিয়েন্স, কিন্তু আচারবিধি করে মাঝেমাঝে হোমো ইরেক্টাসের মত!!
যেমন, যখন আমরা কোথাও যাই কোনো যানবাহনে চড়ে এবং সেই যানবাহনের চালক যদিওবা অচেনা হয়, আমরা অবচেতন মনে একটি বিশ্বাস থেকেই উঠি যে, সে আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু যাদের আমরা খানিকটা হলেও চিনি, তাদেরকে বিশ্বাস করতেই বুক দুরুদুরু করে! বিশ্বাস করা ব্যক্তিগত ব্যাপার, বিশ্বাসের মর্যাদা কিংবা অমর্যাদা করা তৃতীয় ব্যক্তিগত ব্যাপার।
‘বিশ্বাস’ কখনোই মানুষকে ঠকায় না, কেউ তার অমর্যাদা করলেও ঠকায় না, খুব নিরীহ, কিন্তু জেদী!

ভালোবাসার সংজ্ঞাটি হওয়া উচিৎ এমন,
“বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে কষ্টের সমান ব্যাসার্ধ নিয়ে গঠিত বৃত্তচাপই ভালোবাসা যার শেষবিন্দু সুখেই সমাপ্ত। ”
এই সংজ্ঞাটি অবশ্যই দুজন বিপরীত লিঙ্গের আকর্ষণ বহির্ভূত সম্পর্কের মাঝেও গ্রহণযোগ্য এবং বিস্তৃত।
কেউ যখন কাউকে ভালোবাসে, তখন তার হ-য-ব-র-ল লেখার মাঝে কিংবা বুলির মাঝেও সে ভালোবাসা খুঁজে নিতে ভালোবেসে ভালোবাসে। হতে পারে তা একটি মায়ের আর তিন মাসের শিশু সন্তানটির ভালোবাসা, হতে পারে তা বাকপ্রতিবন্ধী আর বধিরের ভালোবাসা, হতে পারে তা অন্ধ প্রেমিক প্রেমিকার ভালোবাসা, হতে পারে তা সাবালক বন্ধুটির নাবালক ভালোবাসা, হতে পারে তা লাল টিপে নীল শাড়িতে সজ্জিত প্রেয়সী আর সাদা পাঞ্জাবির কবির ভালোবাসা কিংবা হতে পারে তা নিজের প্রতি স্বত্তার ভালোবাসা!
অনেকেই বলে থাকেন, ভালোবাসা অসংজ্ঞায়িত। ধারণাটি সত্যিই ভুল, কেননা ভালোবাসা অসংজ্ঞায়িত নয়, ভালোবাসার কারণটি অসংজ্ঞায়িত! ভালোবাসার কারণ হলো এমন একটি প্রশ্ন, যার উত্তর খুঁজে পাওয়ার পরই মানুষ প্রশ্নটি খুঁজে পায় কিন্তু তখনই আর উত্তর খুঁজে পায় না!!

ভালোবাসার সংজ্ঞাটি জেনে যদি পরীক্ষার খাতায় ইচ্ছে করে ভুল উত্তর দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করা যায়, তবেই হয়তো ভালোবাসা তার অভিশাপ থেকে মানুষকে মুক্তি দিবে!

মিষ্টি ডানা সম্পর্কে

অসংজ্ঞায়িত!!
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে সচেতনতা-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

6 Responses to ভালোবাসার অভিশাপ মুক্তির পন্থা

  1. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    ভালো লাগল ভালোবাসার ব্যবচ্ছেদ ! 😀

  2. অনুজ বলেছেনঃ

    চমৎকার!!

    ভালবাসার সবটাই উপলব্ধির বিষয়, অনুভবের বিষয়!
    ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশটাও তাই আমার কাছে তেমনি, যেখানে ভেজা জলের রেখা দেখে ভালোবাসার সমুদ্রসম গভীরতা ভেবে ভ্রম হয়, সেখানেই শূন্য হাতে ছুটে যাওয়া নয়। ভালোবাসা হইলো কমলালেবুর মত। একটু একটু করে নিলে মিষ্টি ঘ্রাণ ও চমৎকার স্বাদ থাকে। কিন্তু বেশি চিপাচিপি করলে তেঁতো যায়।
    ফিনিক্স পাখির ভাষায় একটা কথা বলি –
    ‘আমি চাই, কখনো ভালোবাসার খোঁজ পেলে কেউ যেন আমায় না বলে, ‘বাহ, দুজনকেই পাশাপাশি বেশ মানিয়েছে তো’।
    বরং যেন বলে, ‘বাহ, দুজনকেই একসাথে সুখী লাগছে তো খুব’
    [[অনলাইনে নয়, বাস্তবে]]।

  3. ইকু বলেছেনঃ

    হুম… ভালবাসা … ভাবনার বিষয় :thinking:
    ভালো লাগলো লিখাটি :guiter:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।