মধ্যাহ্নে দু’জন

:বলুন তো, এই ছবিটায় মোট কয়টা স্কয়ার আছে?

-আপনি কি আমাকে বলছেন?

:হুম, আপনাকেই। বলুন না?

এবার কিছুটা ভ্রু কুঁচকে স্পর্শকের দিকে তাকায় তাসনীমছেলেটাকে আগে কোথায় দেখেছে কি- না মনে করতে থাকে, কিছুই না পেয়ে জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা, আমি কি আপনাকে আগে দেখেছি কোথাও? আমার যতোটুকু মনে পড়ে, আপনার সাথে আগে কখনো আমার দেখা হয় নি।

:আপনার সাথে আমার আগে দেখা হলেও বোধয় সেটাটোটাল নাম্বার অব স্কয়ারবের করতে কোন সাহায্য করত না আহা, কথা না বাড়িয়ে চেষ্টা করে দেখলেই হয়, এতক্ষণে হয়েই যেত

নানা তা হবে না জানি, তবে

:আপনি এতক্ষণে সলভ করে ফেলতে পারতেন, সামান্য বিরক্তি মাখানো গলায় স্পর্শক বলে

এই দাঁড়ানদাঁড়ান! আপনি কথা বলার অজুহাতে আমাকে এটা সলভ করতে বলছেন নাতো আবার? কথা বলতে ইচ্ছে করলে বলতে পারেন, এসবের দরকার নাই, বলেই মুচকি হাসে তাসনীম

:থাক, আপনাকে সলভ করতে হবে নাআমি যাই, বলেই হাঁটতে শুরু করে স্পর্শক

 

এই যে শুনছেন? আমি এমনিই বলেছি কথাটা দেন দেখি কাগজটা, চেষ্টা করে দেখি, পারি কিনা?

:বাদ দেন, আপনি বসে বসে আকাশ দেখেন

হুম, তা মন্দ বলেন নিআকাশ দেখতে আমার দারুণ ভালো লাগে অযথাই মন খারাপ করছেনআপনি তো আমাকে চেনেনও না! অকারণে বাচ্চাদের মত মুখ গোমড়া করে চলে যাচ্ছেন; আপনি তো আর বাচ্চা না মিষ্টি করে একটু হেসে চলে যান আমি এই ভর দুপুরে এখানটায় এসেছি জারুলের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যালোক গায়ে মাখবো বলে, আকাশ দেখবো বলেটুকটাক কবিতাছড়া লেখার বদ অভ্যাস আছে আমার কাগজকলম নিয়ে এসেছি কবিতা লিখবো বলে।  যদিও ছাদে বসে আকাশ দেখতে এখানকার মত ভালো না লাগলেও খুব একটা মন্দ লাগে না কিন্তু পিচ্চি বোন দুইটার জ্বালায় তার জো কি আছে? আরেহ! আপনি এখনও দাঁড়িয়ে আছেন? মিষ্টি করে হাসতে পারছেন না? আচ্ছা, তেঁতো করেই হাসুন নাহয়? আর ইচ্ছে হলে আমার পাশে বসে আকাশ দেখতে পারেন।

:আপনার পাশে বসে আকাশ দেখতে লজ্জা লাগবে, বলেই হাসার চেষ্টা করে স্পর্শক

বললাম কী আর করলেন কী? হাসলেন এক পিস পানসে হাসিলজ্জা লাগলে কী আর করার, আপনাকে লজ্জা দেয়ার ইচ্ছা নাই, সো, আল্লাহ হাফিজ  

:কে, আল্লাহ হাফিজ, বলে অন্যমনস্ক ভাবে কিছু একটা ভাবতেভাবতে হাঁটতে থাকে স্পর্শক হঠাৎই কী মনে করে আবার ফিরে এসেআচ্ছা, আমি কি আপনার পাশে একটু বসতে পারি?

কিছুমাত্র চিন্তা না করেই মুচকি হেসে তাসনীম বলে, হুম, পারেন

:থ্যাংকস বলেই তাসনীমের পাশের বেঞ্চেটাতে বসে কিছু একটা লিখতে শুরু করে স্পর্শক

আপনি তো আমার পাশে বসবেন বলেছিলেন, পাশের বেঞ্চেতো না! বলেই শব্দ করে হেসে দেয় তাসনীম

:ভুলে গিয়েছিলাম, স্যরি একটু চেপে বসুনতো বলেই তাসনীমের বেঞ্চিতে এসে বসে স্পর্শক- আগের মতই গভীর মনোযোগ দিয়ে লিখতে থাকে।

-আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, এই ভরদুপুরে পার্কে এসে, এত মনোযোগ দিয়ে একজন মানুষ কি লিখতে পারেন- জানা যায়?

:খাতা থেকে মুখ না সরিয়েই- একটু পর বলি? এখন বলতে গেলে, সব তালগোল পাকিয়ে যাবে।

আচ্ছা, লেখা শেষ করেই আমাকে দেখিয়েন। 

 

তারপর কেটে যায় বেশ খানিকটা সময়, তাসনীম আকাশ দেখার ফাঁকে-ফাঁকে স্পর্শককে দেখে…স্পর্শক তখনও লিখছিল, হঠাৎ খাতা থেকে মুখ সরিয়ে- আচ্ছা আপনি কি ‘টাওয়ার অফ হ্যানয়’ প্রবলেমটা জানেন?

-‘টাওয়ার অফ হ্যানয়’? নাহ, এই প্রথম শুনলাম!

:এটা গনিতের খুব বিখ্যাত একটা সমস্যাহ্যানয় হচ্ছে ভিয়েতনামের রাজধানী, কাজেই সমস্যাটার  নাম শুনেই মনে হতে পারে এটা ভিয়েতনাম শহরের কোন বিখ্যাত দালানের ঘটনা। মজার ব্যাপার হল এটি যিনি দিয়েছেন, তিনি ভিয়েতনামের কোন গনিতবিদ নন। তাঁর নাম এডমণ্ড লুকাস১৮৩৩ সালে দেয়া এই ধাঁধাটা গনিত জগতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তবে এক ধরনের ফাঁকিবাজির উপর দাঁড়িয়ে এই সমস্যাটি সলভ করা হয়েছে। আম চেষ্টা করছি, নাম্বার থিউরি দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা উপায়ে এটা সলভ করতে। অনেকটা হয়ে এসেছে। দুপুর দিকে এখানে লোকের তেমন আনাগোনা থাকে না বলে, কলম-খাতা নিয়ে চলে আসা। আচ্ছা, আপনি কি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারেন?

-আমি সাহিত্যের ছাত্রী। অঙ্ক তেমন একটা বুঝি না বললেই চলে। কীভাবে সাহায্য করি বলুন তো?

:সাহিত্য খাটো করে দেখবার জিনিস না, জার্মান সাহিত্যিক গোথিকের মেনসা আইকিউ স্কোর ছিল ১৯৫! আইনস্টাইনের চেয়েও ৩০ বেশি!

-ভাই, গোথিক সাহেব অনেক বড় ব্যাপার, আমি সাধারণ একজন মানুষ। চালিয়ে যান, আপনি নিজেই পারবেন। আমি বরং এখন যাই, কেমন?

:আচ্ছা, ঠিক আছে।

             উঠতে গিয়ে হঠাৎ-ই তাসনীমের চোখ পড়ে যায় স্পর্শকের খাতার দিকে, খাতা উল্টো করে লিখছিল ও! মুহূর্তেই একটা ছোটবেলার স্মৃতি ভেসে ওঠে; স্পর্শকের বাঁ-হাতের কনিষ্ঠার ছোট আরেকটা আঙ্গুলের মত বৃদ্ধি আছে, সেটা চোখে পড়তেই মনে পড়ে গেল সব! চমকে ওঠা গলায়- আপনি মানে তুমি স্পর্শক না? রংপুর ক্যান্ট স্কুলে পড়তে?

:কিছুক্ষণ তাসনীমের দিকে তাকিয়ে থেকেস্কুলে সবাই আমাকেএকসেনট্রিক স্পর্শক’ নামে ডাকতো  বলে নিজের লেখায় মন দেয় ও।

-আমি তাসনীম, আমাকে চিনতে পেরেছ? ঐ যে একদিন অঙ্ক পরীক্ষার আগে আমার খুব খারাপ প্রিপারেশান ছিল; অবশ্য ভালো প্রিপারেশান থাকার কোন কারণ অবশ্য ছিল না, তখন আমি গণিতকে যমের মত ভয় পেতাম। তুমি পরীক্ষার আগের দিন আমার বাসায় এসে সারদিন অঙ্ক করালে, তুমি না থাকলে ১১০% সিউর আমি ঐ অঙ্ক পরীক্ষায় ডাব্বা মারতাম। মনে পড়ছে, ক্লাস সিক্সের থার্ড সেমিস্টারের কথা?

: তুমি তাসনীম? কেমন আছো? আসলে আমার স্মরণশক্তি গোল্ডফিশের চেয়েও নিচু মানের কিনা, তাই কিছুই মনে থাকে না তারোপর এই প্রবলেমটা নিয়ে বেশ চিন্তায় আছি, শেষ না করা আগ পর্যন্ত কিছুই মাথায় ঢুকবে না তবে তুমি যখন বলেছ, তুমি তাসনীম তাহলে তুমি অবশ্যই তাসনীম একটু পর সব মনে পড়বেতুমি বসো, আমি এটা শেষ করেই তোমার সাথে গল্প করব, কেমন? 

আচ্ছা, ঠিক আছে বলে স্পর্শকের পাশেই তখন স্পর্শক ক্যালকুলেটরের বোতাম দ্রুত টিপে যাচ্ছে 

 

আগের মতনই রয়ে গেছে স্পর্শককে স্পর্শক চিনতে পারে নি ভেবে জমে থাকা খারাপ লাগাটাকে  পাত্তা না দিয়ে আকাশের দিকে তাকায় তাসনীম খুব কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছিল ও, বিয়োগাত্মক কিছু না; সুখ মেশানো কোন কবিতাএক মুহূর্ত স্পর্শকের দিকে তাকিয়ে, আকাশের মেঘগুলোকে দেখতে থাকে নিজের অজান্তেই চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দুফোঁটা জল অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, ‘ইশ! কখন যে তোমার লেখা শেষ হবে

অনিমেষ ধ্রুব সম্পর্কে

"You've gotta dance like there's nobody watching, Love like you'll never be hurt, Sing like there's nobody listening, And live like it's heaven on.'' অসম্ভব পছন্দ উইলিয়াম পার্কারের এই কথাগুলো! নিজের মত করেই নিজের পৃথিবীটা কল্পনা করে নিতে ভাল লাগে। ঔদাসিন্য,অলসতা শব্দ দুটি আমার সাথে বনে যায়। গভীর মনোযোগ কিংবা অসম্ভব সিরিয়াস মুড আমার কখনোই আসে না। একা অচেনা রাস্তায় অকারণে হাঁটতে ভালো লাগে, মানুষ দেখতে ভালো লাগে, ভাল লাগে কবিতা লিখতে...তবে স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখি আমার চারপাশে থাকা মানুষগুলোর জন্য কিছু একটা করার, দেশকে কিছু একটা দেয়ার। পারব কি-না জানি না, তবুও স্বপ্ন বুনে চলেছি নিরন্তর... http://www.facebook.com/kamrul.h.hridoy.3
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

4 Responses to মধ্যাহ্নে দু’জন

  1. ইকু বলেছেনঃ

    খুব সুন্দর লাগসে লিখাটি … কিন্তু সব শেষে মেয়ে টার নিজের অজান্তেই চিবুক বেয়ে দু’ফোঁটা জল কেন গড়িয়ে পড়ল বুঝিনি … কিন্তু যাই হউক … খুব ভালো লাগলো :guiter:

    • হৃদয় বলেছেনঃ

      কিন্তু সব শেষে মেয়ে টার নিজের অজান্তেই চিবুক বেয়ে দু’ফোঁটা জল কেন গড়িয়ে পড়ল?
      -সেটা মেয়াটাই জানে 😛 অধিক খুশীতে চোখে জল গড়িয়ে পরে হয়তো সে কারণে 😀

      মন্তব্যের জন্য মিষ্টি জর্দা মেশানো একটা ধন্যবাদ জানুন 😀

  2. রুহশান আহমেদ বলেছেনঃ

    লেখাটা আসলেই ভালো লেগেছে, খুব সুইট…
    লেখার আগে হাতে মধু মেখে নাও নাকি?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।