ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলতেই ভীষণ অবাক হয়ে যায় অদিত। সে এখানে কেন? সে মাস্টারমাইন্ড স্কুলের স্ট্যান্ডার্ড ফোরে পড়াশোনা করে, তার বাবা আলতাফ আহমেদ বাংলাদেশের প্রথম সারির কয়েকজন ধনী ব্যক্তিদের একজন। ওরা উত্তরায় থাকে।
গতরাতে আব্বু-আম্মুর সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছিল, যার মূলে ছিল নীল রঙের ব্লু-বার্ড গাড়ী আর গ্যালাক্সির সবচেয়ে লেটেস্ট ভার্সনের হ্যান্ডসেট। অদিত ওর বন্ধু রক্সির মত নিজে গাড়ী চালিয়ে স্কুলে যেতে চায়, আলতাফ আহমেদ খুব ধনাঢ্য ব্যক্তি হলেও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় মোটেই পছন্দ করেন না, স্ট্যান্ডার্ড-ফোরে পড়ুয়া একজন ছেলে নিজে ড্রাইভ করে স্কুলে যাওয়াটাও স্বভাবতই তার কাছে অযৌক্তিক মনে হয়েছে। অনেক বোঝানোর পরও যখন কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না তিনি তখন একরকম বাধ্য হয়েই অদিতকে ধমক দেন। অদিতের চোখ ছলছল করতে থাকে; বাবা ওর সাথে এই প্রথম কঠিন স্বরে কথা বললেন। দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায় অদিত।
অদিত অনেক বড়লোক বাবার উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে নয়। ও যখন ওদের গাড়ীতে করে স্কুলে যায় তখন ওর চোখও আঁটকে যায় মায়ের সাথে পুরনো টিনের থালা হাতে রাস্তায় এলোমেলো পায়ে হাঁটতে থাকা ওর বয়েসী কোন ছেলের মাঝে। টিভিতে সুদানের গৃহযুদ্ধে পীড়িত মানুষ গুলোকে দেখলে ওরও খুব খারাপ লাগে; তখন নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করে। কিন্তু বন্ধুদের সাথে থাকার সময় যে কী হয়! তখন মনে করে, ‘ওসব ভেবে লাভ কি হবে? আমি যদি এখন সব ছেড়ে-ছুড়ে রাস্তায় ঐ ছেলেটার মত একটা ভাঙা থালা নিয়ে বের হই, নিশ্চয়ই তাতে সুদানের সেই মানুষগুলোর কোন উপকার করা হবে না। যেহেতু আমি ওদের নিয়ে অনেক ভাবলে বা মন খারাপ করলেও আমি ওদের জন্য কিছুই করতে পারছি না, তাই আমি আমার মতই থাকবো। বাবা যদি, গাড়ি কিনে না দেয়, তাহলে নানুকে বলব, নানু আমাকে অনেক সময় অনেক গিফটই দিতে চেয়েছেন। কিন্তু বাবা পছন্দ করেন না বলে নানুর কাছে তেমন কিছুই আলাদা করে চাওয়া হয় নি। এবার না’হয় তাই করব। নীল ব্লু-বার্ডে চড়ে এবার স্কুলে যেতেই হবে… …
ভাবতে-ভাবতে ঘুমিয়ে যায় অদিত।
ঘুম ভাঙে এক রুগ্ন শিশুর চিৎকারে! শিশুটি জীর্ণ পা দু’টি ছুঁড়ছে সর্বশিক্তি দিয়ে। হয়তো খুব ক্ষুধা লেগেছে ওর। অদিত অবাক যায় সেই শিশুটির মাকে দেখে। খুব বেশি বয়স হবে না, পনের কি আঠার হবে কিন্তু এতো লিকলিকে শরীর যেন নিমেষেই সবগুলো হাড় গুণে ফেলা যায়। শিশুর ক্রমাগত চিৎকারে মা তার স্তনে গুঁযে দেয় শিশুটির মুখে। কিন্তু অর্থহীন সে চেষ্টা; নিরন্তর চুষেও একফোঁটা দুধের হদিস মেলে না শিশুটার। কিশোরী মাও যেন কেমন নির্বিকার ভঙ্গীতে শিশুর পণ্ডশ্রম দেখে যাচ্ছেন। এটাই যেন স্বাভাবিক! তিনি নিজেও গত এক সপ্তাহ ধরে কয়েকটা বিস্কুট আর পানি ছাড়া কিছুই খেতে পান নি, দুধ মিলবেই বা কোথা থেকে? কিছুক্ষণের মধ্যে শিশুটিও বোধ হয় তা বুঝে যায়। ঘুমের মাঝে ক্ষুধা ভুলে থাকার কৌশল জন্ম থেকেই শিখে এসেছে সে। নির্বিকার মায়ের নির্লিপ্ত মুখ এই প্রথম যেন কিছুটা বিবর্ণ হতে শুরু করে। তিনি কাঁদছিলেন না, চোখের জলও বোধয় শুকিয়ে গেছে। ক্ষুধার্ত সন্তানকে খেতে দিতে না পরার অপরাধবোধ থেকেও বের হতে পারছেন না। কিশোরী হলেও তো সে মা। বিধাতা তাকে মাতৃত্বের স্বাদ দিয়েছেন, মাতৃত্বের দাবী পূরণের সাধ্য দেননি! না, আর সহ্য করতে পারছিল না অদিত। তার বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। এত কষ্ট মানুষের? কতোটা খারাপ থাকলে এমন হয়? মুহূর্তেই দৌড়ে ওখান থেকে চলে যায় অদিত।
আরেকটু সামনে যেতেই একটা আট-দশজনের জটলা দেখে থামে অদিত। কৌতূহলী চোখে সামনে এগিয়ে যায়। দেখে, বার-তের বছরের একটা ছেলে তার ছোট বোনকে মারছিল। সেই মেয়েটার বয়স অদিতের সমান অথবা ছোট হবে। এক হাতে ছোট্ট বোনের চুলের মুঠো ধরে অন্য হাতে অন্ধের মত মারছিল। এত মারের মাঝেও যেন কিছু একটা চিবুচ্ছিল মেয়েটা। পরে জানতে পারে, কোত্থেকে যেন একটা রুটি নিয়ে আসে ছেলেটা। রুটিটা মাঝারী সাইজের। একজনেরও পেট ভরবে না। ওদের পরিবারের সবাই গত তিন দিন ধরে অভুক্ত। ভাইয়ের হাতে রুটি দেখে ক্ষুধার্ত ছোট বোনটি আর লোভ সামলাতে পারি নি। দৌড়ে ভাইয়ের হাত থেকে শুকনো রুটিটা মুখে নিয়ে কামড় দেয়… এখন মেয়েটার অচেতন দেহ মাটিতে পড়ে আছে। রুটির অবশিষ্ট অংশটা ডান হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। ভাইটা সেই অবশিষ্টাংশ হাতে তুলে নির্বিকারে খেতে থাকে। মাটিতে অচেতন বোনের দিকে তার নজর নেই। এই মুহূর্তে তার সব মনোযোগ নিবন্ধিত অবশিষ্ট রুটি শেষ করায়। মা তার মেয়ের পাশে বসে গগনবিদারী চিৎকারে ছেলেকে অভিসম্পাত দিয়ে যাচ্ছেন ছেলেকে কিন্তু মায়ের চিৎকার, অভিশাপ কোন কিছুই যেন ওর কানে পৌছায় না।
আর দেখা সম্ভব নয়, ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসে। প্রচণ্ড দারিদ্র্য মানুষগুলোকে অমানুষ করে দিচ্ছে! একটা রুটির জন্য ভাই নিজের বোনকে এমনভাবে মারতে পারে! এত কষ্টে আছে এরা! আল্লাহ কেন এতো কষ্ট এদের দিচ্ছেন?
চিন্তাগুলো অদিতের ছোট্ট হৃদয়টা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছিল।
যাবার আগে আবার ভিড়ের দিকটায় উঁকি দেয় অদিত। ভাইকে কিছু প্রশ্ন করবে সে কিন্তু সেখানে গিয়ে যা দেখছিল তাঁর জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না অদিত। মেঝেতে অচেতন বোনের ডান হাতটা নিজের দু’হাতে চেপে নিঃশব্দে কাঁদছিল ছেলেটা। হয়তো নিজের ভুল বুঝে অনুতপ্ত সে। হায়রে অভাব…
আযানের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় অদিতের। ওর সারা শরীর ঘামে ভিঝে গিয়েছিল। বিশ্বাসই করতে পারছিল না, এটা স্বপ্ন ছিল। ওর মনে হচ্ছে, কোন এক ম্যাজিশিয়ান হয়তো তাকে ঘুমের মধ্যে অন্যএকটা দেশে নিয়ে গেছে গিয়েছিল। কিন্তু কে সে ম্যাজিশিয়ান? ছোট্ট অদিতের আর কিছু ভাবতে পারছিল না কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, ম্যাজিকটা তার মধ্যে কিছু একটা করেছে, হয়তো বড় কন পরিবর্তন এনে দিয়েছে।
‘তোমার ব্লু-বার্ড কখন চাই? কালকে হলে চলবে? তবে তুমি নিজে ড্রাইভ করে স্কুলে যেতে পারবে না, আমি একজন ড্রাইভার রেখে দিচ্ছি। ড্রাইভার প্রসঙ্গে আমি তোমার কোন মতামত শুনব, না, তোমার সেইফটি আমাকেই দেখতে হবে। আর হ্যান্ডসেট আজ বিকেল নাগাদ পেয়ে যাবে, ঠিকআছে?’ ব্রেকফাস্টে ডাইনিং টেবিলে বসে অদিতকেএ কথাগুলোই বলছিলেন আলতাফ মাহমুদ।
– ঠিক নেই
– ঠিক নেই কেন? তুমি যা চেয়েছ সবই দিচ্ছি। শুধু তোমাকে ড্রাইভ করার পারমিশান দিতে পারছি না। কারণ সাইকেল চালানো আর মোটর কার চালানো এক না; সেটা তুমিও জানো। তুমি ড্রাইভিং শেখ আগে, তখন তোমাকে পারমিশিন দেয়া হবে। তুমি কি আর কিছুচাও?
– চাই। আমি সামনে বছর থেকে বাংলা মিডিয়াম কোন একটা স্কুলে ভর্তি হতে চাই। অদিতের আব্বু-আম্মু দু’জনই অবাক চোখে তাকায় অদিতের দিকে।
– আব্বু-আম্মু তোমরা হয়তো ভাবছো, আমি রাগ করে এই কথাগুলো বলছি। কিন্তু কথাগুলো সত্যি ছিল। মাস্টারমাইন্ডে আমার পেছনে তোমরা যে মান্থলি খরচ কর, তাতে করে অনায়েসে বাংলা মিডিয়ামের কোন স্কুলে, মানে সাধারণ কোন স্কুলে দশ-পনের জনকে পড়ানো সম্ভব। অনর্থক এতগুলো টাকা খরচের কোন মানে নেই। আমার ব্লু-বার্ড বা হ্যান্ডসেটের কোন দরকার নেই আব্বু। আমাদের ড্রাইভার আঙ্কেলের আমার বয়েসি অটিস্টিক একটা ছেলে আছে না, আতিক নাম! আঙ্কেলের তো তেমন টাকা নেই, তাই ছেলেটার চিকিৎসা করাতে পারে নি। আমি আমাদের ক্লাসের মিসের কাছে শুনেছি, অল্প বয়সেই অটিস্টিক বাচ্চাদের উন্নত চিকিৎসা করালে ওরা সুস্থ হয়ে উঠে। আব্বু, তুমি কি ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিতে পারো না? কথাগুলো বলার সময় ছোট্ট অদিতের চোখদুটো ছলছল করছিল।
অদিতের আব্বু-আম্মু তখনও ঠিক বুঝতে পারছিলেন না, অদিতের কী হয়েছে। মাত্র এক রাতের ব্যবধানে অদিতের এত বড় পরিবর্তনটা যেন তারা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। এ যেন নতুন এক অদিত। ব্রেকফাস্ট শেষে অদিত স্কুলে চলে যায়।
অদিতের মা চিন্তিতমুখে বলেন, ‘আমার কাছে সব কেমন যেন স্বপ্নের মত লাগছে। এটা কেমন করে সম্ভব, আমাদের অদিত… আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না, এতো ম্যাজিক!’
– সামিয়া, আমারা যে বেঁচে আছি, এটাই তো সবচেয়ে বিস্ময়কর এক ম্যাজিক। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যাজিশিয়ানের কাছে এ তো কিছুই না। তোমাকে ম্যাজিক বিশ্বাস করতেই হবে; ইউ মাস্ট বিলিভ ইন ম্যাজিক।
‘আমি তোমার সব কথাই রাখবো বাবা।’ জানালা দিয়ে বাইরে তাকান আলতাফ আহমেদ।
ছবি কৃতিত্ব, এডিটিং: সাঈদ আনওয়ার অনুজ 😀
আমার অনেক লেখারই নাম দিয়ে দেয় এই ছেলেটা। ম্যাজিশিয়ান নামটাও তার দেয়া 😀
এমন একজন ছোট ভাই থাকলে আর কি লাগে! :love: 😀
১. আমার নাম সাঈদ আনোয়ার অনুজ। :crying:
২. এটা বলার দরকার ছিলো না। ছবিটা খুবই বাজে ধরণের হয়েছে। 🙁
প্রায় দুই বছর আগের করা এটা। কীভাবে জানি একটু মিল দেখলাম, তাই দিয়েছিলাম। 🙂 আপনি এইখানেও দিয়ে দিছেন এইটা!!
৩. আমি এডিটিং এর কী কাজটা করলাম?? :thinking:
৪. নাম কিন্তু এইটা আপনার মাথাতেও ছিলো… আমি আরও কঠিন কঠিন নামের কথা বলে প্যাঁচ লাগাচ্ছিলাম!
৫. লেখা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নাই। 😛
হুম, এডিট করিস নাই, তাইতো দেখছি কিন্তু তখন কেমন একটা এডিটিইং-এডিটিং গন্ধ পাচ্ছিলাম! :thinking:
আত্ম-বিপক্ষ সমর্থন তো ভালোই শিখেগেছিস 😐
যাহোক, দুই দিনের এই জিন্দেগী 🙁
পিচ্চি ভাইয়ের হেল্প ছাড়া কেমনে কি? :penguindance: 😛
ঐ দু-একটা শব্দ আর বানান আর কি… এইটাকে এডিট বলা যায় না! 😛
কার ছোট ভাই দেখা লাগবে না! 8)
কেও মেও চেও! 😐
চিন্তার বিস্তৃতি লক্ষ্য করে বরাবরের মতই মুগ্ধ,
লেখালেখি চলুক নিয়মিত।
সত্যিই মুগ্ধ! আমি তোমার মুগ্ধ চেহেরা খানা দেখতে চাই রুহশান 😛
কার্জনে আসার আগে ফোন দিতে ভুল হয় না যেন। ওকে? 😀
অ-সাধারণ!! অনেক বেশি বেশি ভালো লাগল, এরকম গল্পগুলোই ভালো লাগে, যেগুলো দিন বদলের কথা বলে, মানবতার কথা বলে, মানুষ হবার কথা বলে ! গল্পের গাঁথুনী আর লেখনী সবটাই ভাল্লাগছে !! :love:
ধন্যবাদ আপু 🙂
প্রায় সব লেখাতেই আপনার মন্তব্য পাই, এটাও চমৎকার :love:
হাহাহ, চেষ্টা করি ব্লগে রেগুলার কমেন্ট করতে। 🙂
হুম, তাইতো দেখছি। 😀
মন্তব্যের দুর্মূল্যের বাজারে আপনি মুক্ত হস্তে ‘কমেন্ট’ নামক প্লাটিনামের হরিণ যে সাবলীলতায় দিয়ে যাচ্ছেন তা অনাগত মহিলা হাতিম তায়ী’র জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে 😛 😛
সুন্দর লিখা 🙂
😀 :love: