ব্রেনওয়াশিং : মানসিক ধর্ষণ (৩)

প্রথমেই একটা প্রশ্ন করতে চাই। বলুন তো, পুরো পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় কী? অবশ্যই ‘মাইন্ড কন্ট্রোল’! অর্থাৎ ব্রেনওয়াশিং করে মানুষের চিন্তার ধরণ বদলে দেয়া বা মানুষের চিন্তা সীমাবদ্ধ করে দেয়ার মাধ্যমেই তাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আগের দুটো পর্ব পড়ে আপনার মনে হতে পারে আপনি ব্রেনওয়াশিং এর স্বীকার নন, আপনি স্বাধীন চিন্তা ধারার অধিকারি। প্রকৃত সত্য কিন্তু খুবই ভয়াবহ। কারণ ব্রেনওয়াশিং এর মতো জটিল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে খুব কম আলোচনাই করা হয়েছে।

পূর্বে একবার বলেছি, ব্রেনওয়াশিং প্রক্রিয়াটি বহুল ব্যবহৃত হয় রাজনীতি, ধর্ম ও মিডিয়ায়। রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ভাবে জনগণের চিন্তাধারা নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে নিজস্ব প্রয়োজনে তাদের ব্যবহার করে থাকে। একটু খেয়াল করলেই আপনি দেখতে পাবেন পৃথিবীর কোনো দেশের ক্ষমতাসীন দলগুলোই গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে জনগণের মতামত জানতে চায় না। পৃথিবী আজ ১৯৬ টি স্বাধীন দেশে বিভক্ত। কিন্তু আপনার কী মনে হয় দেশগুলো সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন যখন সাধারণ জনগণের নেই চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা, কিংবা সংস্কৃতি ও ধর্মের স্বাধীনতা? পৃথিবীতে ১২৩ টি তথাকথিত গণতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্র থাকা সত্ত্বেও সত্যিকারের গনতন্ত্র কোনো দেশেই প্রতিষ্ঠিত হয় নি, বরং তার আড়ালে চলেছে স্বৈরতন্ত্র এবং একনায়কতন্ত্র- সেটা জানার জন্য বুদ্ধিজীবী হতে হয় না! এই একবিংশ শতাব্দীতেও ‘গনতন্ত্র’ এবং ‘স্বাধীনতা’ শব্দ দুটো সত্য করতে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। মধ্যযুগের মতোই শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর উপর হামলা চালাচ্ছে যখন খুশি তখন। সেসব অবৈধ মিশনকে ‘শান্তি রক্ষা’, ‘সন্ত্রাস দমন’, ‘মানবাধিকার রক্ষা’… এরকম গালভরা নাম দিচ্ছে। টেলিভিশনের সামনে বসে সাজানো কিছু ঘটনা দেখে কিংবা পত্রিকায় আধাখেঁচড়া অস্পষ্ট তথ্য পড়ে আমরা ভাবতে থাকি সবকিছু সম্পর্কে আমরা অবগত। অথচ সত্যিকার অর্থে প্রতিটি দেশের সাধারণ জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত। এদিকে পুরো পৃথিবী নিয়ন্ত্রণে রাখছে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর অল্পসংখ্যক এলিট শ্রেণীর মানুষ! ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার যতো রকম কৌশল আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো জনসাধারণের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করা। খেয়াল করলে দেখবেন, আজ আমরা বিভিন্ন ভাবে বিভক্ত এবং এই বিভক্তি সময়ের সাথে সাথে বাড়ছেই। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতিগত, রাষ্ট্রীয় এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে তৈরি হচ্ছে বিভক্তি, আসলে তৈরি করা হচ্ছে নির্দিষ্ট কিছু স্বার্থ হাসিলের জন্য! ‘ভাগ করো এবং জয় করো’ এটাই বর্তমান রাজনীতি। মূলত এলিটদের জন্যই রাষ্ট্রের সকল সুযোগ সুবিধা। তারা খেটে খাওয়া-মেনে নেওয়া জনতা চায়, স্বাধীন চিন্তা ও মুক্ত বুদ্ধি সম্পন্ন প্রতিবাদী বিপ্লবী নয়! যা ঘটছে বলে আমাদের জানানো হচ্ছে এবং প্রকৃতপক্ষেই যা ঘটছে- তার মধ্যে পার্থক্যটা বিশাল। নিয়ন্ত্রিত কোনো তথ্যই স্বচ্ছ হতে পারে না, সেটা নিঃসন্দেহে অপতথ্য। প্রোপাগান্ডা চালানোর জন্য বহুল ব্যবহৃত অস্ত্রসমূহ আমাদের সবার ঘরেই আছে! বিভিন্ন অপতথ্য বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে টেলিভিশন, ইন্টারনেট, সিনেমা, নিউজ পেপার, পপুলার ফিকশন, ম্যাগাজিন কিংবা মিউজিক… কখনো সরাসরি, কখনো অবচেতনভাবে আমাদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু ধারণা আর বিশ্বাস প্রবেশ করিয়ে দেয়া হচ্ছে।

ব্রেনওয়াশিং করতে ধর্মীয় মতবাদের ব্যবহার অনেক আগে থেকেই হচ্ছে। আপনি খেয়াল করে থাকবেন, সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয় এরকম মানুষের সংখ্যা ইদানিং খুব দ্রুত হারে বাড়ছে। একজন মানুষের নিজস্ব যুক্তি এবং ধর্মীয় বিশ্বাস থাকতেই পারে তাতে কারো কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। সমস্যাটা একটু অন্যরকম। ধর্ম মানেই কিছু নিয়ম কানুন এবং বিধি নিষেধ যা অবশ্যপালনীয়। কোনো ধর্মই অনৈতিক কিছু সমর্থন করে না। অনৈতিক কাজ করলেই ‘ধর্ম’ মানুষের স্বস্তির জায়গাটায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ জীবন থেকে ধর্ম একেবারে বাদ দিয়ে দিলে অস্বস্তি তৈরি হওয়ার সুযোগই থাকবে না, অবাধে যে কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে থাকবে না কোনো ধর্মীয় দায়বদ্ধতা। নৈতিকতা বিসর্জন দিতে বাধবে না, ফলাফল- অন্যায়, অনাচার, দুর্নীতি। একটা দুর্নীতি বিধ্বস্ত মানুষের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা সম্ভব না, সে কখনো দুঃশাসন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে না। দুর্নীতিবাজ মানুষ মানেই মেরুদণ্ড ভাঙা মানুষ, তাদের কাছ থেকে আমরা মুক্ত চিন্তা ও বুদ্ধির কথা কিংবা কাজ আশা করতে পারি না। কেননা ‘One who stands for nothing will fall for anything.’ সমাজের এক শ্রেণীর নির্দিষ্ট কিছু মানুষই সাধারণত মানুষকে দুর্নীতি করতে প্রলুব্ধ এবং উৎসাহিত করে থাকে। ধর্ম প্রসঙ্গে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো ধর্মীয় বিশ্বাস আর অনুভূতি এরকম একটা ব্যাপার যা দিয়ে খুব সহজেই মানুষের পারস্পারিক সৌহার্দকে সংঘর্ষ ও বিভক্তিতে বদলে দেয়া যায়। কিছু মানুষ বিভিন্ন সময় প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলো বিকৃত করে, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে, ব্রেনওয়াশিং করে উসকে দিয়েছে, এভাবে পৃথিবীতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার যুদ্ধ উজ্জীবিত রেখেছে!

বর্তমান সময়ে অধিকাংশ মানুষ বস্তুবাদিতায় বিশ্বাসী। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে অবিশ্বাসের সাথে বস্তুবাদিতায় বিশ্বাসের একটা সূক্ষ্ম সম্পর্ক বিদ্যমান। বস্তুবাদ মানুষকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে বস্তুগত প্রাপ্তির চিন্তায়। সর্বদা প্রাপ্তির চিন্তামগ্ন মানুষকে খুব সহজেই প্রলুব্ধ করে ব্রেনওয়াশ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে একটা রূপক গল্প বলতে চাই : একটি লোক খুব মন খারাপ করে এক বনের ধারে বসেছিলো। তাই দেখে বনের সব পশুরা লোকটির পাশে এসে জড়ো হলো। তারা লোকটিকে বললো, “তোমার মন খারাপ দেখে আমাদের খুব খারাপ লাগছে। বলো কী পেলে তোমার ভালো লাগবে। আমরা তোমাকে তাই দিবো।” লোকটি বললো, “আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি চাই।” শকুন বললো, “তুমি আমার দৃষ্টিশক্তি পাবে।” তখন লোকটি বললো, “আমি শক্তিশালী হতে চাই।” জাগুয়ার বললো, “তুমি আমার মতো শক্তিশালী হবে।” তারপর লোকটি বললো, “আমি পৃথিবীর রহস্য দেখতে চাই।” সাপ বললো, “আমি তোমাকে সেসব দেখাবো।” এভাবে লোকটি একে একে সব প্রাণীর সেরা ক্ষমতাগুলো নিয়ে খুশি মনে বন থেকে চলে গেলো। তখন হরিণ বললো, “লোকটি এখন অনেক জ্ঞানের অধিকারি, সে অনেক সম্ভাবনাময়। তার আর কোনো দুঃখ থাকবে না।” সেটা শুনে পেঁচা বললো, “লোকটির দুঃখ কখনোই কমবে না কারণ আমি তার ভেতর এমন এক ক্ষুধা দেখতে পেয়েছি যা কখনোই নিবৃত্ত হবে না। সে ততোদিন পর্যন্ত চাইতে থাকবে যতোদিন না পৃথিবী বিরক্ত হয়ে বলবে তাকে দেয়ার মতো আর কিছুই পৃথিবীর নেই!” বস্তুবাদিতাও আমাদের এমনভাবে ক্ষুধার্ত করে তোলে বস্তুগত প্রাপ্তির প্রতি যা আর কখনোই নিবৃত্ত হয় না, মানুষ পরিণত হয় পণ্যদাসে।

বর্তমান সময়ে ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে ফ্রি সেক্স তথা যত্রতত্র যথেচ্ছা যৌনতাকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে। আমাদের শেখানো হচ্ছে প্রগতিশীল বোদ্ধা হওয়ার এবং আধুনিকতাকে ধারণ করার মূলমন্ত্র হচ্ছে অবাধ যৌনাচার। তথাকথিত সুপার স্টার এবং জনপ্রিয় সেলিব্রেটিরাও নগ্নতা এবং উন্মুক্ত যৌনতাকে উৎসাহিত করছে। আধুনিকতার সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে নোংরামি এবং অশ্লীলতা। আমাদের সাহিত্যেও প্রবেশ করেছে অপ্রয়োজনীয় অযথা যৌনতা। এমনকি বাচ্চাদের জন্য নির্মিত কার্টুনগুলোও এর আওতা মুক্ত নয়। আমাদের চিন্তা ভাবনা একটা বক্সের মধ্যে আটকে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেই বক্সের নাম- ‘সেক্স’! পর্ণাসক্তি এবং অশ্লীলতা পূর্ণ মিউজিক ভিডিওগুলোর বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা আমাদের চিন্তা ভাবনা সীমাবদ্ধ করে দেয়ার এই পরিকল্পিত প্রচেষ্টার ফলাফল।

আমাদের শরীর এবং মন ভীষণভাবে ব্রেনওয়াশিং এর শিকার। একজন মানুষের মুক্ত চিন্তার গুরুত্ব বুঝতে না পারলে কিছুতেই অনুধাবন করা সম্ভব নয় সাধারণ মানুষদের এভাবে ব্রেনওয়াশিং করার চেষ্টার পেছনে প্রয়োজনীয়তা কী! ব্রেনওয়াশিং প্রক্রিয়া শুধুমাত্র নগন্য কিছু মানুষের ক্ষেত্রে কাজ করে না যারা স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে সক্ষম। খুব কম মানুষই সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে পারে কেননা বিভিন্ন ভাবে প্রতিনিয়ত আমাদের চিন্তাধারা প্রভাবিত হয়, আমাদের বিশ্বাস প্রভাবিত হয় অথবা বলা যায় পরিকল্পিত ভাবে প্রভাবিত করা হয়। সকলের জন্য মুক্তচিন্তার দ্বার উন্মুক্ত হোক, এই সংকটময় সময়ে এটাই হতে পারে একমাত্র সঠিক চাওয়া। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই এই চাওয়াকে পাওয়ায় রূপান্তর করতে পারে।

ফারাহ্‌ মাহমুদ সম্পর্কে

অবিদিত, জানো কি? বুকের মধ্যে জল তরঙ্গ নিয়ে মানুষ হয়ে জন্ম নেয়া পাপ! অবিদিত, জানো কি? অনুরাগ এক প্রকার সুখকর বিভ্রান্তি..
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুপ্রেরণা, ইতিবাচক, উদ্যোগ, চিন্তাভাবনা, সচেতনতা-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

10 Responses to ব্রেনওয়াশিং : মানসিক ধর্ষণ (৩)

  1. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    এই সিরিজটা গণহারে শেয়ার না করা খুবই অন্যায় হবে। অসাধারণ !

  2. রুহশান আহমেদ বলেছেনঃ

    ভালো লেগেছে লেখাটি,
    সাহসী লেখাগুলোর জন্য শুভকামনা থাকলো।

  3. ইকু বলেছেনঃ

    পুরো সিরিজ টাই ভালো লাগলো… খুব ভালো লিখা… শুভেচ্ছা রইলো :guiter:

  4. শারমিন বলেছেনঃ

    ভালো লেগেছে 🙂

  5. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    সিরিজটা চলুক।

    লেখিকা এইটা নিয়ে আমাদের সামনে একটা টক দিলে কেমন হয়? মিষ্টি হয় না ভারি?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।