কাগজে কাগজে ভালোবাসা – বইজীবন

[অনেক আগের কথা এগুলো, বই নিয়ে একটা ইবুকের জন্য লিখতে বসে আর শেষ করা হয় নি। চিন্তার সুতো একবার ছিঁড়ে গেলে জোড়াতালি দেয়া কষ্ট, ঐ কষ্ট আর করতে গেলাম না। অসম্পূর্ণ লেখার গল্প আমার বইজীবন, বইয়েরা মিলে তিল তিল করে যে আমাকে গড়ে তুলেছে তার জীবনের গল্প।]

একটা মানুষ – সে নাকি আবার কেঁচোসুদ্ধ মাটি চিবিয়ে খায়। তার ওপর আবার যে মাটি মাড়িয়ে হেঁটে গেছে তার প্রাণেশ্বর – সেই মাটি। আরেক মানুষের পেট থেকে নাকি বের হয় ইগুয়ানার বাচ্চা – গিরগিটির মত যে ইগুয়ানা। এসব কোন কথা?

এসব কথা মুখে বলা নিষেধ, তাই থাকে কাগজে কাগজে। স্পেনদেশের কোন এক মানুষ রাতঘুমে যে স্বপ্ন দেখেন, জেগে উঠে তাই লিখতে বসেন বইয়ের পাতায়। সে বই একসময় জায়গা করে নেয় সর্বকালের শ্রেষ্টতম বইগুলোর তালিকায়। যাকে বলে চিরায়ত সাহিত্য।

ছোটদের জগৎ নাকি নিষ্পাপ – যতসব বানোয়াট কথা। এই পৃথিবী যে বড়দের কথামত চলে সে তো সবাই জানে, আর ধুরন্ধর বড়রা কোনদিন বুঝি জানতে দেবে তারা ছোটবেলায় কোন্‌ পাপ করেছে? তাই আর জানা হয় না কারো। কেবল জানা হয় – ‘আইরিশ রূপকথা’ পড়ে, ওখানকার দুর্বল দৈত্যের দেখাদেখি কে কবে ছানার বল চেপে দুধ বের করে এই ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিল যে বলটা আসলে পাথরের, সেই গল্প।

আরেকটু বয়স বাড়লে রঙিন মোড়কে হাজির হবে মানবপ্রেমের আশ্চর্য অদ্ভুত সব গল্প। মনে প্রশ্ন জাগিয়ে যাবে – ঐ জগৎ কি ওরা যেমন বলে ঠিক অতটাই রহস্যময়, নাকি অতিজৈবিক? সেই প্রশ্ন খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যাবে কারটনকে, কোনদিনও না-পাওয়া ভালোবাসার মানুষটির জন্য কেমন টুপ করে প্রাণটা দিয়ে দিলো সে। গিলোটিনে তেইশতম মাথার যোগান দিয়ে শিখিয়ে গেলো – সর্বস্ব উজার করে কেমন করে ভালোবাসতে হয়।

কিন্তু সেখানে ‘কিন্তু’ নিয়ে হাজির হন হুগো, বলে যান প্রেমে অন্ধ হয়ে কেমন করে প্রাণপ্রিয় বাবার কথা ভুলে যায় কোজেত। সারাজীবন দুঃখ-পাওয়া মানুষটাকে কেমন আরো আরো দুঃখ দিয়ে যায়। ঠিক আমাদের মত, তাই না? আমাদের এই অ-কাগুজে, রক্তমাংসের পৃথিবীতেও বাঁধনছেড়া নাড়ি শুকিয়ে পচে রাস্তার পাশের ধুলোয় গড়াগড়ি খায়, চোখ বন্ধ করে যখন ছুটে যাই আমরা অচেনা-অজানা আবেগের দড়ি গলায় পরে। তবু সব বন্ধনই ভাঙে, ভাঙে না কেবল ঐ ধুলোমাখা নাড়ির বাঁধন। সব কষ্ট সয়েও ও অপেক্ষা করে থাকে অনন্তকাল ধরে। তাই তো হওয়ার কথা! যে ভালোবাসার কথা আমরা জোরেশোরে জানান দেই, গল্পে-গানে-কাব্যে যার কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে ফেলি, তার জোর তো কমই হবার কথা। গভীরতম প্রেমের কথোপকথন চলবে নিঃশব্দে, সেখানে এত শোরগোল কিসের?

শুধু নাড়ির বাঁধন ছিড়বে তুমি তা-ই নয়, স্রষ্টা আর তোমার মাঝেও একদিন এসে দাঁড়াবে অন্য কোন মানুষ। নিরাকারকে আর সেদিন গ্রাহ্য করবে না তুমি, তাকে দেখবে না স্বপ্নে, শুনবে না তার কথা। এসব কথা তোমাকে যে জানিয়ে যাবে নাম তার জেন, কারণ ওর সাথেও তো এমনটাই হয়েছিল! স্বাধীন মেয়ে জেনের ছোটবেলার দুখমাখা অবহেলার গল্প শুনে কেউ তাকে ভাববে নিজের মিতা, অন্য কেউ ঠিক বড়বেলার জেনের মত ভালোবাসা পেতে চাইবে কারো। অসুন্দর জেনকে অসুন্দর এডওয়ার্ড যখন পৃথিবীর সবচাইতে আবেগমাখা কথাগুলো বলবে, তুমি তখন জেন হতে চাইবে। প্রেমে অন্ধ এডওয়ার্ডের চোখও যেদিন অন্ধ হয়ে যাবে, সেদিনও তুমি মনে মনে চাইবে জেন হতে। স্বাধীন জেন, বুদ্ধিমতী জেন, অসুন্দর জেন, এডওয়ার্ডের ‘পরী’ জেন – তার অন্ধকার জগৎ আলো করা ‘ছোট্ট’ জেন হতে চাইবে তুমি।

কবিতা-অপ্রিয় তোমার গদ্যে-ভরা পৃথিবীকে কবিতায় ভরে দিতে আসবে স্বাতী। গল্পের শব্দে শব্দে কেমন কবিতারা ঝরে পড়ে ঠিক যেন শিউলি ফুলের মত – তাই দেখাবে তোমাকে সে। শরীরের নয় দরজা দিয়ে কবিতারা ঢুকে পড়বে ইন্দ্রজালের এক একটা সুতো হয়ে, আটটা কুঠুরিতে জড়সড় হয়ে বসে পাতবে গানের আসর। তোমার শরীর ফেটে গান বের হবে তখন, ট্রেনে যেতে স্বাতীর মত তোমাকেও কে যেন গান শোনাবে পুরোটা আকাশ জুড়ে। আর শোনাবে কবিতার মতন যত গল্প। তারপর হঠাৎ একদিন ঘরের ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে কোথায় যে হারিয়ে যাবে, কোনদিন আর তাকে খুঁজেও পাবে না তুমি।

অ্যানা, অ্যানা, প্রিয়তমা অ্যানা! গান শুনতে শুনতে যেই ট্রেনে চেপে রওনা হলে তুমি, তার নিচেই ওর আত্মাহুতি হলো – সুন্দরী অ্যানা, বিদূষী অ্যানা, তোমার মতই পাপ-পুণ্যের জ্ঞানে টনটনে অ্যানা মরে গেলো। মনে পড়ে, তুমিও যে বলেছিলে একদিন – “এই guilty conscienceটুকুই আমি, এটুকুও যেদিন থাকবে না সেদিন আমি আর আমি থাকবো না, অন্য কেউ হবো ঠিক ঠিক”?

সামিরা সম্পর্কে

পীচ-গলা তরলে আটকে পা, দুঃস্বপ্ন অন্ধ দুই চোখে/ অসতর্ক হৃদয় পোষ মানে মিথ্যে বলার আফসোসে.../// প্রকাশিত লেখার কপিরাইট সংশ্লিষ্ট লেখক সংরক্ষণ করেন এবং লেখকের অনুমতি ছাড়া লেখা আংশিক বা পূর্ণভাবে কোন মিডিয়ায় পুন:প্রকাশ করা যাবে না।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে হাবিজাবি-এ এবং ট্যাগ হয়েছে স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

7 Responses to কাগজে কাগজে ভালোবাসা – বইজীবন

  1. হৃদয় বলেছেনঃ

    ‘গিলোটিনে তেইশতম মাথার যোগান দিয়ে শিখিয়ে গেলো’
    ভা’পু, আমি লাইনটার মানে বুঝি নাই। এটা কি কোন প্রবাদ বাক্য?
    [আগে শুনেছি, শুনেছি লাগে কিন্তু মনে করতে পারছি না :/ ]

  2. রুহশান আহমেদ বলেছেনঃ

    কঠিন লেখা, তবে সুখপাঠ্যও বটে

  3. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    লেখা ভালো লেগেছে সবসময়ের মতন, কিন্তু স্পয়লার হয়ে গেল না ? আমি সবগুলা বই পড়ি নাই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।