শাহবাগ থেকে টি এস সি হয়ে ক্লাসে হেঁটে যায় মেয়েটি। হাঁটতে ভালোই লাগে তার। কখনো পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢুঁ মারে কোন বইমেলা হচ্ছে কি না, খোঁজ খবর নেয় কোন বই কত ডিস্কাউন্টে পাওয়া যাবে। খুব গরমে টি এস সি তে এক গ্লাস লেবুর শরবত অথবা বিকেলের দিকে চারুকলার সামনের চিকেন ফ্রাই। চারুকলার সামনে রাস্তার ধারে বইগুলো উলটে পালটে দেখছিলো মেয়েটি…
দূর থেকে বৃদ্ধ লোকটি মেয়েটিকে দেখতে পায়। পরনে জিনস-ফতুয়া, কাঁধে ব্যাকপ্যাক, হাতে ব্রান্ডেড ঘড়ি। রাস্তার ধারে একটি বই হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখছিলো। পছন্দ হয়নি হয়তো, হাতের বইটা রেখে দিলো। আরেকটি বই তুলে নিলো হাতে। মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায় লোকটি।
-আপা, কয়টা ট্যাকা দিবেন? ভাত খামু।
লোকটির দিকে একঝলক তাকিয়ে দেখে নেয় মেয়েটি। পরনে একটি তালি দেয়া ফুল শার্ট আর লুঙ্গি। মাথার চুল আর মুখের দাড়ি উষ্কখুষ্ক। চোখ দুটো ভেজা, হাত বাড়িয়ে টাকা চাইছে তার কাছে। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এই ধরণের ভাসমান লোকদের ছুতার অভাব হয় না। আজকাল কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। এসে টাকা চাইবে তারপর কে জানে কোথায় কোন মাদকের আড্ডায় গিয়ে পড়ে থাকবে। ভেবে নেয় মেয়েটি। খুব একটা পাত্তা দেয় না। হাতের বই এর দিকে মনোযোগ দেয় আবার।
এবার লোকটি বার বার টাকা চাইতে থাকে। বিরক্ত হয়ে লোকটির দিকে ঘুরে তাকায় মেয়েটি।
-আপনি খাবেন? আচ্ছা ঠিক আছে। ঐ সামনের দোকানে রুটি আর কলা আছে দেখা যাচ্ছে। আপনি খেয়ে নেন আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি।
-আপা, বিশ্বাস করেন তিন দিন ধইরা ভাত খাই না। আমি ভাত খামু। রুটি আর কলা খামু না।
মেয়েটির সন্দেহ আরো বাড়ে। বিরক্ত ভঙ্গিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে বলে,
-আপনার জন্য ভাত কোথায় পাবো এখন? ঐ সামনের দোকান থেকে রুটি আর কলা খেয়ে নেন। আর নইলে আপনাকে আমি টাকা দিচ্ছি না।
লোকটিকে খানিক বেপরোয়া দেখায়।
-আপা, আইচ্ছা ঠিক আছে। ঐ দোকানে ভাত পাওয়া যায়। আপনে তাইলে আমার সাথে ঐখানে চলেন।
রাস্তার ওপাশে ছবির হাটের পাশেই একটা ঝুপড়ি দোকান দেখা যায়। টেবিলের উপর বিশাল সাইজের হাঁড়ি, সামনে এক মধ্যবয়স্কা মহিলা ও একটি ছেলে দাঁড়িতে আছে। কখনো ভাল করে খেয়াল করে দেখেনি মেয়েটি। লোকটির দিকে তাকিয়ে বলে,
-আচ্ছা চলেন।
লোকটিকে নিয়ে রাস্তা পার হয় মেয়েটি। ওপারে গিয়ে বলে,
-এই যে খালা, ওনার জন্য ভাত দেন তো!
-আপা, ভাত তো শেষ হয়ে গেছে। এতক্ষণ কি আর ভাত থাকে?
-কী বলেন খালা? ভাত শেষ? একটু দেখেন না! অল্প একটু হলেও চলবে।
-না, আপা। একটুও নাই। বিশ্বাস না হইলে দেখেন…
ঢাকনা খুলে দেখায় মহিলা। আসলেই ভাত শেষ। ঘড়ির দিকে তাকায় মেয়েটি। চারটা বাজে প্রায়। দুপুর শেষ হয়ে এলো। এতক্ষণ ভাত থাকার কথা নয়। লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখে লোকটিকে আরও বেপরোয়া দেখাচ্ছে।
-আপা, ওইখানে আরও দোকান আছে। চলেন আপা, ওইদিকে চলেন।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের সামনেই একটি বেঞ্চে কয়েকজন লোক বসে আছে। তাদের কাছে গিয়ে ভাত চায় ওরা।
-আপা, ভাত তো শেষ। ঐ যে দেখেন সব গুছায়ে ফেলছি।
লোকটির দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলে,
-চাচা, ভাত তো শেষ। আপনার কপাল খারাপ। আজকে তাহলে আর হচ্ছে না।
আরো বেপরোয়া দেখায় লোকটিকে। উদভ্রান্তের মত মেয়েটিকে বলে,
-আপা, ভিত্রে আরো কতগুলি আছে।
ভেতরে হাঁটতে শুরু করে লোকটি। ঘড়ি দেখে নেয় একবার মেয়েটি। ক্লাস শুরুর সময় হয়ে যাচ্ছে।
-আচ্ছা, চলেন। ভিতরে আর কোথায় আছে দেখি।
চলতে থাকে তাদের ভাত খোঁজার পালা। আশেপাশের যে কয়টি ভাতের দোকান আছে সব জায়গায় ভাত শেষ। একটু খারাপ লাগতে থাকে মেয়েটির। লোকটির চেহারাও বিপর্যস্ত দেখায়।
-চাচা, ভাত তো শেষ হয়ে গেছে। কিছু করার নাই। আপনাকে বললাম রুটি আর কলা খেয়ে নিতে। তখন তো শুনলেন না।
-আপা, ওইখানে একটু খুঁজে দেখি পাই কি না। ঐখানে মাঝে মইধ্যে থাকে। চলেন আপা একটু দেখি।
লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখে খানিক। মায়া হয় মেয়েটির।
-আচ্ছা, চলেন গিয়ে দেখি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে একটি গাছের নিচে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে গিয়ে ভাত চায় ওরা।
-হ’ হ’ ভাত আছে। ভাত, মাছ আর মিষ্টি কুমড়া।
ওদের গাছের নিচে নিয়ে যায় মহিলা। ছোট সাইজের কয়েকটা পাতিল রাখা সামনে। আর কোন দিকে তাকায় না লোকটি। ছেঁড়া শার্টের হাতা গুটিয়ে খেতে বসে পড়ে। এভাবেও যে ভাত বিক্রি হয় জানা ছিলো না মেয়েটির। যত্ন করে প্লেটে ভাত বেড়ে দেয়। আরেকটা পাতিল থেকে পাঙ্গাশ মাছ আর মিষ্টি কুমড়া। বুভুক্ষের মত খেতে থাকে লোকটি। তাকিয়ে খানিকক্ষণ দেখে মেয়েটি। মহিলাটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-খালা, উনাকে ভালো করে খাইয়ে দেন। আর আপনাকে কত দিবো?
-তিরিশ ট্যাকা দেন আপা।
ব্যাকপ্যাক খুলে ওয়ালেট বের করে। ত্রিশটা টাকা হাতে ধরিয়ে দেয় মহিলার। ঘুরে হাঁটতে শুরু করে তার গন্তব্যের দিকে। মেয়েটির মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। বৃদ্ধ লোকটি বা মধ্যবয়স্কা মহিলা দেখতে পায় না সেটা…
:welcome:
চমৎকার লিখা
পড়ে একটু হাসিও ফুটে উঠল আবার মনটাও কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল 🙂
কারো মুখে হাসি ফুটানোটা অনেক বড় একটা বিষয়
লিখতে থাকো আপুনি :love: :love:
থ্যাঙ্কুশ পিচ্চি 🙂 🙂
বাই দি ওয়ে, তুই তাহলে তিন শব্দের চেয়েও বড় কমেন্ট পারিস!! 😛
তুমি এখনো ওই কথা মনে রেখেছ??
হু পারি দেখেলেই তো 8)
আপু, শাবানা অভিনীত বাংলা ছবি ‘ভাত দে’ দেখেছিলেন। অনেক আগের ছবি, এইতো, পঁচাশি থেকে নব্বইয়ের দশকের মধ্যাকার অনেক আলোচিত ছবির মধ্যে একটা। ভাত কি জিনিস এই ছবিটা দেখলে বোঝা যায়! এ প্রসঙ্গে ছোটবেলায় দেখা ‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবির কথাও বলতে হয়।
একইভাবে হুমায়ূন আহমেদ রচিত ‘খাদক’ গল্পটির কথাও বলা যায়।
সহজ সাবলীল কিছু শব্দের প্রয়োগ করে, স্বল্প পরিসরের মধ্যে চমৎকার একটি লেখা হয়েছে বলা। নামকরণটাও সুন্দর ছিল। শুরুটা যেহেতু এরকম চমৎকার একটি ম্যাসেজ সম্বলিত লেখা দিয়ে হয়েছে তাই এরকম লেখা/ এর চেয়েও ভালো লিখা সামনে আরো অনেক পাবো এমন প্রত্যাশা তো করাই যায় 😀
এত কিছু বলার মাঝে আসল জিনিসই ভুলে গেলাম :welcome:
হৃদয়, ‘ভাত দে’ কিংবা ‘খাদক’ একটাও দেখা হয় নি। এই মন্তব্যের পর দেখার ইচ্ছা হচ্ছে 🙂
মন্তব্য আর শুভকামনার জন্য অনেক ধন্যবাদ… 🙂 🙂
নাম দেখে ভেবেছিলাম লেখাটা অন্যরকম হবে।
তবে খারাপ লাগেনি গল্পটি।
শুভকামনা সবসময়।
অনেক ধন্যবাদ 🙂
সরব এ স্বাগতম আফা।
একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করলে কেমন হইত। শেষটায়?
মেয়েটা ওদের হাসি দেখে কী ভাবত?
ধন্যবাদ ভাইয়া…
স্টোরিটায় আসলে মেয়েটি আর বৃদ্ধ দুই জনকেই ফোকাস করা হয়েছে ভাইয়া। দুই পক্ষই লাভবান। বৃদ্ধ লোকটি লাভবান একবেলা ভাত খেতে পেয়ে। আর মেয়েটি লাভবান লোকটির হাসি দেখতে পেয়ে… টাইটেলটা পড়লেই বুঝতে পারবেন ভাইয়া।
আমাদের ইয়ুথ কিমিউনিটি যেমন হয় আসলে। বই পড়ে, মুভি দেখে হয়তো অনেক কিছু জানে। তারপরেও জগতের অনেক কিছুই তার কাছে অদেখা থেকে যেতে পারে
অনেক ভালো লাগল। এভাবেই যেন সবাই এগিয়ে আসে যার যার সামর্থের মধ্যে।
:welcome:
ধন্যবাদ আপনাকেও 🙂