হিন্দুদের উপর রাজনৈতিক কারণে ‘ধর্মীয়’ হামলা এবং “সুজন” এর সাবধানতা সত্ত্বেও সরকার ও আমাদের হামলা ঠেকাতে ব্যর্থতা

দিল্লীতে প্রথম যাই ২০১১ তে। দেশের বাইরে আমার প্রথম সফর।

অফিসের কাজে। শুক্রবার অফিস থাকে, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তাই।
জুমার নামাজ পড়তে গেলাম অফিসের গাড়িতে।

মসজিদ দেখে অবাক! বাংলাদেশের এসি-মোজাইক-টাইলস ওয়ালা মসজিদে অভ্যস্ত চোখ দেখল – বেশ দরিদ্র মসজিদ!! বস্তির মধ্যে ছিল অবস্থান। যারা নামাজে গিয়েছিল তাদের ৯০% এর অবস্থাও ভালো না। দরিদ্র পরিবারের কিশোর তরুণ।

দিল্লী এবং আশেপাশে অন্তত ৫ টি মসজিদে গিয়েছিলাম। প্রতিটা মসজিদ ছিল বস্তির মধ্যে।

ভারতে মুসলিমদের অবস্থা আসলেই ভাল না মনে হচ্ছিল।

এই প্রথম নিজেকে সংখ্যালঘু মনে হলো। এর পর আমি আরও ৪ টি দেশ ঘুরেছি। ১ টি বাদে সব সময় সংখ্যালঘু ছিলাম।

খাবার দাবার এ গিয়ে হালাল জিজ্ঞেস করতে হত। যেই জিনিস নিয়ে কখনও ভাবতে হয় নাই সেটা নিয়ে ভাবতে হত! Taken for granted জিনিসগুলা রিথিঙ্ক করতে হয়েছিল কিছু সময়ের জন্য হলেও!

নিজে সংখ্যালঘু না হলে কি অন্যের কষ্ট বোঝা যায়?

হয়ত পুরোটা যায় না।

কিন্তু যাওয়া কি উচিত না? আজ আপনার আমার জন্ম যদি সংখ্যালঘু হয়ে হত?

“আমি কে তুমি কে? বাঙালি বাঙালি” বলার সময় অবাঙালির খারাপ লাগে। সেটা হয়ত অবাঙালি না হলে বোঝা যাবে না।

মাদ্রাসার ছাত্রদের যখন উচ্চশিক্ষায় হয়রানি করা হয় তখন হয়ত আমরা বুঝতে পারি না যারা আমাদের থেকে আলাদা তাঁদের কষ্ট!

গত ৪০ বছরে কত জন হিন্দু দেশ ছেড়েছেন?
অত্যাচারিত হয়েছেন?
মালাউন গালি শুনেছেন? [একটু ভাবুন তো চাকমা শব্দটাকে যখন আমরা হাসাহাসির জন্য ব্যবহার করি একজন রিয়েল চাকমার কেমন লাগে? মুসলিমদের যখন দাঁড়ির জন্য সন্ত্রাসী/ টেরোরিস্ট  বলে তখন কেমন লাগে? ]

হিন্দুদের পরিমাণ যে আমাদের দেশে কমে গেছে এটা জানেন তো?
কতটুকু জানি আমরা?
কতটা খোঁজ রাখি?

কেন কমে যাচ্ছে? তাঁরা কি স্বেচ্ছায় চলে যাচ্ছেন/ ছেড়ে যাচ্ছেন নিজের জন্মস্থান?

একটা জায়গায় কিছুদিন থাকলেই কেমন মায়া পড়ে যায় – সেই জায়গায় নিজের জন্মস্থান যদি ছেড়ে যেতে হয় তাহলে কেমন লাগবে?

একবার ভাবুন তো?

আপনার জন্মস্থান ছাড়তে হবে কেবল মাত্র আপনার ধর্মের জন্য! কেমন লাগবে আপনার?

একবার ভাবুন তো। আজ আপনি যদি এখানে থাকতেন?

 

২।

গত ১০ বছরে বহুবার সংখ্যালঘুদের উপর হামলার খবর শুনেছি। কিন্তু কয়বার বিচার হয়েছে? কেন হচ্ছে না বিচার? শুধু হামলা হবার পরই কেন আমরা চিৎকার চেঁচামেচি করি? 
রাজনৈতিক কারণে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা হয় মূলত* (এই বিষয়ে খুব চমৎকার একটা বই আছে The Myth of Religious Violence নামে)। বিএনপি জামাত এর পাশাপাশি যেমন ছাত্রলীগও নাকি হামলা করেছে হিন্দুদের উপর! এবারেও তেমনটা হতে পারে, বিশেষজ্ঞরা বললেও আমরা শুনি নি! কেন?

সংখ্যালঘু নিয়ে সুজন এর ১৫ ডিসেম্বর ২০১৩ এর সাবধানবাণী

সুজন এর ওয়েবসাইট থেকেঃ

নির্বাচন এলেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। এই আতঙ্কের বড় কারন অতীত নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতায় জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি না করা। এই আতঙ্ক বৃদ্ধি পাওয়ার আর একটি বড় কারন হচ্ছে সামপ্রতিককালে পাবনার সাঁথিয়া, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম ও মহেন্দ্রনগর এবং বরিশালের চর কাউয়ার কালা গ্রামে বিভিন্ন অজুহাতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা।
অথচ সংখ্যালঘুসহ নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সাংবিধানিক দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আইনগত বাধ্যবাদকতা রয়েছে জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষার। সকল মানুষকে রক্ষা করার জন্য জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলসমূহের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে। সামাজিক নেতৃবৃন্দ তথা সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের রয়েছে এ সংক্রান্ত সামাজিক দায়বদ্ধতা। কিন্তু আমরা ব্যর্থ হচ্ছি সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে।  

আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কিছু ভ্রান্ত ধারণা আছে। যেমন, হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভোট মানেই একটা বিশেষ জনগোষ্ঠীর ভোট, এরকম একটা ধারণা আছে। এ ধারণার উপর ভিত্তি করে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার জনগোষ্ঠী নির্বাচনের সময় অহেতুক হুমকি-ধামকির সম্মুখিন হয়। তাদের ভোট পাওয়া যাবে না বলে ধারণা করে তাদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা প্রদান করা হয়। যাদের ভোট পাওয়া যাবে না বলে ধারনা করা হয় তাদের বল প্রয়োগ করে ভোট কেন্দ্র থেকে বিতাড়ন করা হয়। ভোটে হেরে গেলে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এ অপরাজনীতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের।
মানুষের এই নিরাপত্তাহীনতার অবসানে সচেতন নাগরিকদেরকে সংঘবদ্ধভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। প্রতিরোধ করতে হবে। প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে দুস্কৃতিকারীদের প্রতিরোধ করতে হবে। রাজনৈতিক দলসহ সাধারন নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এ সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে।

আমরা বড্ড বেশি reactionary চিন্তা করি। মানুষের উপর হামলা করে রাজনৈতিক ফায়দা অনেকেই লুটতে চায় – ইতিহাস এর স্বাক্ষী।

আসুন proactive হই। এই জাতীয় বিষয় ঘটার আগে থেকেই কাজ করার চেষ্টা করি। প্রতিটা হামলার দোষীকে বের করার জন্য সরব হই। আজ থেকেই এখন থেকেই। তাহলেই আগামীতে আর এমন ঘটনা ঘটবে না।

আসুন সহানুভূতির দুনিয়া গড়ে তুলি। কারণ আমরা সবাই কানেক্টেড এই পৃথিবীতে

 

বোহেমিয়ান সম্পর্কে

পেশায় প্রকৌশলী, নেশায় মুভিখোর আর বইপড়ুয়া। নিজেকে খুঁজে পাবার জন্য হাঁটতে থাকি। স্বপ্নের সাথে হাঁটা, স্বপ্নের জন্য হাঁটা। https://www.facebook.com/ibappy
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

4 Responses to হিন্দুদের উপর রাজনৈতিক কারণে ‘ধর্মীয়’ হামলা এবং “সুজন” এর সাবধানতা সত্ত্বেও সরকার ও আমাদের হামলা ঠেকাতে ব্যর্থতা

  1. নূহা চৌধুরী বলেছেনঃ

    সংখ্যালঘু শব্দটা ঘিরেই আমার আপত্তি। অসাম্প্রদায়িকতার বাংলাদেশে যখন এরকম পরিস্থিতি দেখতে হয়, হতাশ লাগে, নিজেকে খুব হতাশ লাগে।

  2. শাণিতা বলেছেনঃ

    “আসুন সহানুভূতির দুনিয়া গড়ে তুলি। কারণ আমরা সবাই কানেক্টেড এই পৃথিবীতে।”

    ভালো বলেছেন ভাইয়া

  3. ইকু বলেছেনঃ

    লিখা ভালো ছিল … কিন্তু দেশটার একি হাল হইল ? 🙁
    তাছাড়া সংখ্যালঘু শব্দটিতে আমার ও আপত্তি । শুভেচ্ছা রইলো । ভালো থাকবেন 🙂

  4. তুসিন বলেছেনঃ

    তথ্যবহুল লেখা।আসলে তাই।:( লেখা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।