নিতু, তোমাকে…


নিতু নামটা শুনলেই কেমন একটা শান্তশিষ্ট মায়া মায়া চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।আমার অফিসের পিওন যখন আমার টেবিলে খামটা রেখে গেলো খামের উপরে বাংলা দুই অক্ষরের নিতু শব্দটার দিকে তাকিয়েছিলাম অনেকটা সময়। খামের ভেতরে মেয়েটার ছবি আছে। কেন যেন খামটা খুলতে আমার ভয় ভয় লাগছে, হাল্কা টেনশন ও হচ্ছে। ছবির মেয়েটাকে যদি নামের মত পছন্দ না হয়।আমি নানা কিছু ভাবতে ভাবতে খামটা উলটে পালটে দেখতে লাগলাম, আমার ভাব দেখে আমার নিজেরই মনে হচ্ছে এই খামের সাথেই মনে হয় আমার বিয়ে হবে। এতো আগ্রহ নিয়ে কে কবে খাম দেখেছে! রশিদ মিয়া যখন টেবিলে চায়ের কাপ রেখে গেলো সাদা খামটা তখন আমার কোলের উপর রাখা।খামের কোনায় নীল জেলপেন দিয়ে লেখা গোটা গোটা অক্ষরে নিতু নামটা জ্বলজ্বল করছে। চায়ের কাপ হাতে নিতে কিছুটা মেজাজ বিগড়ে গেলো।ঠান্ডা চা আমি একদম পছন্দ করিনা।চায়ের উপরে সর ভাসছে, সরের সাথে দুই তিনটা পিঁপড়েও ভাসছে।রশিদ মিয়াকে বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেছি কিন্তু তার স্বভাব শুধরালোনা। বিয়ের পর যে মেয়েটা চায়ের কাপ নিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গাতে আসবে সে মেয়েটা নিতু হলে কি খুব মন্দ হয়? নিতুর হাত ভর্তি কাচের চুড়ি থাকবে, একটা ফর্সা হাত, লম্বাটে আঙ্গুল, টকটকে লাল কাচের চুড়ি, কাপ্টার রঙ কালোই নাহয় হলো, নিতুর হাতে ভালো মানাবে। মেয়েটার চুড়ির টুং টাং আওয়াজে আমার ঘুম ভাংবে। গরম চায়ের কাপে ঘুমন্ত আমার এক আঙ্গুল চুবিয়ে দিবে, আমি ধরমর করে লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠবো, নিতু হাসবে, কাঁচ ভাঙ্গা হাসি…

স্যার আসবো?

আমি চমকে উঠি, চায়ের কাপ ছলকে চা আমার কোলে রাখা খামের উপর গিয়ে পড়ে। রশিদ মিয়া এসেছে, পানির গ্লাস নিয়ে। এই ছেলে সবসময় আগে চা দিয়ে পরে পানি দিবে।অসংখবার নিষেধ করা স্বত্তেও তার এই স্বভাব পরিবর্তন হয়নি। রশিদ মিয়া পানি রেখে চলে গেলো, আমি খাম মুছতে লেগে গেলাম। চা পড়ে খাম ভিজে গিয়েছে, মোছার চেষ্টা করতে ছিড়েই গেলো।ছেড়া টুকু দিয়ে ছবির একটুখানি অংশ দেখা যাচ্ছে। নীল নীল একটা অংশ। নিতু মেয়েটা সম্ভবত নীল জামা পড়েছে। তাও আমি ছবিটা দেখলাম না। বাসায় যেয়ে দেখবো। খামটা আমার বুক পকেটে রাখি। নিজেকে আজ কেমন বড়লোক বড়লোক লাগতে থাকে।কেন যেন মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াবতী মেয়েটাকে বুকে নিয়ে ঘুরছি। এরকম কেন মনে হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছিনা।নিজেকে কেমন সেকেলেও লাগতে থাকে। সেকেলে কিন্তু সুখী।


আজকালের দিনে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ কয়জনের হয়? আমাদের মেয়ে সোনার টুকরা বলেই এরকম হচ্ছে… নিতুর মামি বকবক করেই যাচ্ছেন।নিতু খুব বিরক্ত হয়ে জুতার দোকানে ঘুরছে।এখনকার দিনে কেউ ছেলে দেখতে জুতার দোকানে আসেনা।নিতু কে আসতে হয়েছে।কারণ নিতু প্রেম করে বিয়ে করতে চায়নি।নিতুর কথা হচ্ছে যে বাবা মা এতো কষ্ট করে এতো বড় করলেন, বিয়ের মত এতো বড় সিদ্ধান্তটাও তাদেরই হওয়া উচিৎ। আমিও নিতুর সাথে এতোকাল একমত ই ছিলাম, কিন্তু গতকাল রাত থেকে ঝামেলা লেগে গেছে। আমি সাব্বির, নিতু আমার লতায়পাতায় আত্মীয় খালার মেয়ে।কোন এক বিচিত্র কারনে নিতুদের বাসার যাবতীয় কাজে তাদের আমাকে দরকার হয়।আগে পরে আমিও ছুটে এসেছি।কেন আসতাম সেই রহস্য গতকাল রাতে আমি উদ্ধার করেছি।আগে কখনো বুঝি নাই। কাল রাতে বুঝতে পারার পর থেকে নিজেকে কেমন বেকুব বেকুব মনে হচ্ছে। নিতু নামের এই ছোট খাটো মেয়েটাকে আমি ভালবাসি। কি ভয়ঙ্কর। ছোট মরিচে ঝাল বেশি  হয়। ছোটখাটো মেয়েমানুষে ঝাল এর চেয়েও বেশি হয়। নিতু যখন কথার তুবড়ী ছোটায় তখন আমাকে রীতিমত হিমশিম খেয়ে যেতে হয় এই মেয়েকে আমি কেমন করে ভালবাসলাম? অথচ কাল রাত থেকে আমার মনে হচ্ছে সারাজীবন এই মেয়ের খোঁচা মেরে কথা বলা শুনতে না পারলে আমার জীবন বৃথা। আমি মনে প্রাণে দোয়া পড়ে যাচ্ছি , ওই ছেলে যেন নিতু কে পছন্দ না করে। ছেলে কে নিতুদের বাসার সবার খুব পছন্দ। কেনই বা হবেনা ইঞ্জিনিয়ার পাত্র কে আর হাত ছাড়া করে? তাছাড়া সবার মুখে শুনছি ছেলে দেখতে নাকি রাজপুত্র।ড্রাইভার কালাম ভাই এর ভাষায় সালমান খান। শুনেই মনটা তেতো হয়ে গিয়েছে। নিতুকে ছেলে দেখাতে নিয়ে এসে সমানে দোয়া পড়ে যাচ্ছি নিতুকে যেন ছেলে কোনভাবেই পছন্দ না করে। এতো খাটো মেয়েকে পছন্দ করা কি দরকার?


আজ আমার বিয়ে। আমার বিয়ে হচ্ছে একটা গবেট টাইপ লোকের সাথে। আমার পরিবারের পছন্দ এই লেভেলের জানলে আমি অবশ্যই অতীতে একটা প্রেম করে ফেলতাম।কিন্তু পরিবারের লক্ষ্মী মেয়ে হতে যেয়ে বিরাট ভুল হয়ে গিয়েছে। মানুষ খাল কেটে কুমির আনে, আমি খাল কেটে তিমি মাছ নিয়ে এসেছি। শুধু তিমি মাছ না একেবারে নীল তিমি নিয়ে এসেছি। সবচেয়ে বড় সাইজের তিমিটা। আমার এখন ইচ্ছে করছে পালিয়ে যেতে। এই ব্যাটা ফোন দিয়ে এতো মিনমিন করে কথা বলে দেখে আমার ছোটবোন তার নাম দিয়ে দিয়েছে মিনমিন কুমার। সারা জীবন এইরকম একটা গবেট টাইপ লোকের সাথে আমি কিভাবে কাটাবো? গবেটের নাম অপু। গতরাতে মেহেদি দিতে যেয়ে আমার ছোটবোন মেহেদির এক কোণায় ছোট করে ইংরেজি অক্ষর A লিখে দিয়েছে। সে নাকি মিনমিন কুমার কে এটা খুঁজে বের করতে দিবে, বের করতে পারলে মিনমিন কুমার তার দিদিকে অনেক ভালবাসে। ইচ্ছে করছিলো ফাজিলটার কান বরাবর একটা লাগাই। হিন্দি সিরিয়াল দেখে দেখে পেকে ঝুনা নারিকেল হয়ে গিয়েছে। বদ পোলাপান। মেহেদির লতাপাতার মধ্যে A টা কেমন জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। যেই মেহেদির রং দেখতে আসে সেই কেমন কেমন করে আমার দিকে তাকায় আর মিচকে হাসি দেয়। আর বলে বাহ খুব রঙ হয়েছে তো। জামাই তাহলে অনেক ভালবাসবে।লজ্জায় ইচ্ছে করছে মাটি ফুঁড়ে ঢুকে পড়ি। বিয়ে করা এমন একটা এম্বেরেসিং ব্যাপার জানলে কে বিয়ে করতো? গবেট কুমার ফোন দিয়েছে। এই লোকের মাথা ফাটিয়ে দিয়ে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারলে ভালো হতো। দুনিয়ার সব কিছু এতো অসহ্যকর কেন? তবে সত্যি কথা বলতে কি মেহেদির রঙ আসলেই খুব সুন্দর হয়েছে, জুলজুল করে তাকিয়ে থাকা A টাকে দেখতেও খারাপ লাগছেনা, কিন্তু সে কথা আমি কাউকে বলতে যাবো কেন? নিজের অজান্তেই হাতের দিকে চলে যাচ্ছে আমার, ওই বোকা বোকা লোকটা সত্যিই কি আমাকে অনেক ভালোবাসবে?


সেদিন বাসায় এসে নিতুর ছবি দেখার পরে আমি বুঝে গিয়েছিলাম এই মেয়েকে ছাড়া আমার চলবেনা। ঘাড় বেয়ে নীচে নেমে যাওয়া ঘন কালো চুল, আয়ত চোখের গাঢ় নীল জামা পড়া মিষ্টি হাসির এই মেয়েকে ছাড়া কিছুতেই আমার চলবেনা।কিন্তু এই কথা বাসায় বলতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছিলো।সবার সামনে শুধু বলেছিলাম তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে অন্য জায়গায়। সেদিন মিলি মানিব্যাগ থেকে টাকা নেয়ার সময় মানিব্যাগে নিতুর ছবি দেখে ফেলেছে। থ্রি আর সাইজের ছবিটা খুব কসরতে করে কেটে সাইজে এনেছিলাম। মিলিকে মানিব্যাগ থেকে টাকা নিতে বলাটাই ভুল হয়েছে। সেদিন সকাল থেকে আমাকে দেখলেই মিলি কেমন ফ্যাঁকফ্যাঁক করে হাসছে, আজকালকার ছেলে মেয়ে গুলো যেন কেমন, বড় ভাইকে শ্রদ্ধা সম্মান করার জায়গায় ফাজলামি করে বেড়ায়।আমি মাঝে মাঝে নিতুকে ফোন দেই, বলার থাকে অনেক কিছুই, তবে সব কথা কেমন আছেন ভালো আছিতেই ফুরিয়ে যায়।মেয়েটার সাথে কথা বলার সময় আমার কেমন যেন লাগতে থাকে।নিতু আমাকে এখন ও আপনি আপনি করে বলে, আমার খুব ইচ্ছে করে নিতুকে তুমি করে বলি, সাহসে এখন ও কুলিয়ে ওঠেনি। কিছুদিন আগেই নিতুর জন্মদিন গেলো, আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো কিছু টক্টকে লাল গোলাপ নিয়ে ওর সাথে একটু দেখা করি, নিতুর ছোটবোনটা খুবই হেল্পফুল, ভাগ্যিস আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলো নিতুর ফুলে এলার্জি আছে। নিতুর জন্য কেক কিনেছিলাম কিন্তু ওর বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসার সাহস হয়নি, কে কি ভাববে কে জানে। নিতুকে আমার খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়… নিতু মনে হয় আমাকে ঠিক পছন্দ করে না, কি জানি আমার ভাবনার ভুল ও হতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে নিতু আজ আমার ঘরে আসছে, আমার মনে হচ্ছে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ, মনে হচ্ছে এইদিনটার জন্যই আমি অপেক্ষা করেছিলাম সারা বছর।কিছুটা নার্ভাস ও লাগছে অবশ্য, লাগারই কথা জীবনে প্রথম বিয়ে করতে যাচ্ছি তো।


নিতুর সাথে অপু সাহেবের বিয়েটা হয়নি।ওদের বিয়ের দিনই অপু সাহেবের বাবা হার্ট এটাকে মারা যান। যতদূর শুনেছি বরযাত্রী মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো রওনা হতে, তার কিছুক্ষন বাদেই অপু সাহেবের বাবার ভীষণ বুকে ব্যাথা ওঠে।হসপিটালে নিতে নিতেই সব শেষ। ওদের পরিবার থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো এরকম অপয়া মেয়ের সাথে কোনরকম যোগাযোগ রাখতে তারা চায়না। ঝর্ণার মত চঞ্চল নিতুকে সেদিন আমি চোখের সামনে পাথর হয়ে যেতে দেখলাম। পৃথিবি কতটা কঠিন হয়ে যেতে পারে আমার জানা ছিলোনা। বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার শোকে নিতু কাঁদলোনা। কমিউনিটি সেন্টারের রানীর মত বসে থাকা আমাদের পরিচিত মেয়েটি কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের সবার অপরিচিত হয়ে গেলো। আমি নিতুর কাছে গিয়েছিলাম ওকে কিছু বলতে, আমি কিছু বলার আগে ওই আমাকে বললো সাব্বির ভাই, আমাকে একটু পানি খাওয়াতে পারেন?

নিতুর সাথে তার পরের সপ্তাহে আমার বিয়ে হয়ে গেলো।আমি খুশি ছিলাম, সুখীও ছিলাম কিন্তু নিতু সুখী ছিলোনা।কোন এক বিচিত্র কারণে নিতু আমাকে সহ্য করতে পারতোনা।তার বদ্ধমূল ধারণা ছিলো আমি তাকে করুনা করেছি।নিতু কঠোর হয়ে গিয়েছিলো। একই ছাদের নিচে তো আমরা থাকছি তবু যেন আমরা অনেকদূরে। আমি সব ঠিকঠাক করে ফেলার অনেক চেষ্টা নিয়েছিলাম, কিন্তু ফলাফল শূণ্য হয়েছিলো সবসময়। নিতুর নিজের একটা দুনিয়া ছিলো, সেখানে আমার প্রবেশের অধিকার ছিলো না। ঘরের বউ হিসেবে নিতু চমৎকার, সকলের সাথেই তার অনেক খাতির, আমার বাসা নিতুকে ছাড়া অচল, স্ত্রীর দায়িত্বও সে পালন করে যাচ্ছে, শুধু নিতুর মনের বাড়ি থেকে আমি অনেক দূরে ছিলাম, আমি তবু দরজায় কড়াঘাত করে গিয়েছি, নিতু যদি কোনদিন সাড়া দেয়। অবশেষে একদিন নিতু দরজা খুলে দিলো।


বাবাকে যখন তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে নেয়া হলো, আমি তখন ঘোরের মধ্যে ছিলাম।হাসপাতালে সারি দেয়া চেয়ার গুলোর একটায় যখন বসেছিলাম আমার গায়ে তখন ও বিয়ের শেরওয়ানী।অনেকেই অদ্ভূতভাবে তাকাচ্ছিলো আমার দিকে। ডাক্তার যখন বললেন উই আর স্যরি , তখনো আসলে আমার মাথায় কিছু ঢুকছিলোনা। একটা সময় বাবার ডেথ সার্টিফিকেট আমার হাতেই দেয়া হলো। কাগজে বড় বড় করে লেখা মৃত্যুর প্রমাণ পত্র, তার নিচে বাবার নাম লেখা। লোকটা এই কিছুক্ষণ আগেও বেঁচে ছিলো। আমার মনে হচ্ছিলো কান পাতলেই বাবার আওয়াজ শুনতে পাবো। বাবা আমাকে সবসময় আব্বা বলে ডাকতেন, কোনদিন নাম ধরে ডেকেছেন বলে আমার মনে পড়েনা। ঘরে বউমা আসবে নিজের ভারিক্কি কথার আড়ালে আনন্দ লুকাতে পারছিলেন না কিছুতেই। আমি কাঁদতে জানিনা। অথচ আমার চারপাশে কান্নার রোল পড়ে গিয়েছিল। বাবা কান্নাকাটি একদম পছন্দ করতেন না, সবাই একথাটা কি করে ভুলে গেলো জানিনা।

বাবাকে মাটির ঘরে রেখে আসার পর দেখলাম নিতু এ বাসায় অপয়া হয়ে গিয়েছে। নিতুর পরিবার থেকে অনেকেই ছুটে এসেছিলো।তাদের সাথে নূন্যতম ভাল ব্যবহার করার কেউ প্রয়োজন দেখলোনা। নিতুর মত অপয়া মেয়ের জন্য এমনটা ঘটেছে সেটা শুনিয়ে দিতেও ছাড়লোনা কেউ কেউ।নিতুর পরিবারের সবাইকে মাথা নিচু করে চলে যেতে দেখলাম আমি।


সাব্বির ভাইএর সাথে যখন আমার বাসা থেকে বিয়ের কথা চালাচ্ছিলো আমি না করিনি।শুধু বিয়েতে কবুল বলার আগে হাতের মেহেদীতে লেখা A অক্ষরটার কথা খুব মনে পড়ছিলো। অপুর বাবা কি আসলেই অপয়া আমার জন্যই পৃথিবী ছেড়েছিলেন কিনা প্রায়ই ভেবেছি। ভাবনার কূল কিনারা পাইনি খুঁজে। সাব্বির কে কেন যেন আমি ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম। আমার মনে হতো ও আমাকে করূনা করেছে। এই পৃথিবীতে করূনার মত নগণ্য অন্য কিছু হতে পারে বলে আমার জানা ছিলোনা। অনেকদিন পাশে থেকেও আমরা ছিলাম দূরে, আমার কারনেই। ভুলটা আমার কখনোই ভাংতোনা যদিনা ওর পুরোনো ডায়রী পড়ে ফেলতাম। বাদামী মলাটের ডায়রীর পাতার পর পাতা জুড়ে যখন আমাকেই দেখলাম, সাব্বিরকে তখন নতুন করে আবিষ্কারের পালা আমার। ডায়রীতে ছোট ছোট চিঠি পড়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, ছেলেটা আমাকে এতো ভালবাসে, অথচ কখনো মুখ ফুটে বলেনি! কী আশ্চর্য! চারপাশে সবার কাছে যখন আমি অপয়া বলে স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছি সাব্বিরের পরিবার আমাকে নতুক করে বাঁচিয়ে তুলেছিলো। আমি এই পরিবারের জন্য কিছু করতে চাইতাম অথচ এই পরিবারে আমার সবচেয়ে আপন যে তাকে আমি ভুল বুঝে এসেছিলাম। সাব্বির আমাকে ভালবাসে জানার পর থেকে আমি সুখি ছিলাম  তবে মাঝে মাঝেই হাতের তালুতে অপুর A আদ্যক্ষরটা খুঁজে বেড়াতাম, প্রথম ভালোবাসা ভুলে যাওয়াটা তো সহজ কাজ না।

সাব্বিরের পরিবারের সাথে আমার অসাধারণ সময় কাটতে শুরু করেছিলো তবে সবচেয়ে খুশীটা আমি সেদিন হয়েছি যেদিন জানতে পেরেছি সাব্বিরের একটা অংশ আমি আমার মাঝে বড় করে তুলছি।আরো একজন ও খুশি হয়েছিলেন সেটা ছিলো অপু সাহেব। মাঝে মাঝেই তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতেন, আমি বিনয়ের সাথে এড়িয়ে গিয়েছি প্রত্যেকবারই। ডাক্তারের রিপোর্ট আনতে সেদিন আমি একাই গিয়েছিলাম। অপু সাহেবের চট করেই দেখা হয়ে গিয়েছিলো।  তিনিই এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ভালো আছো নিতু? কারো কারো মুখে নিজের নামটা শুনতে এতো ভালো কেন যে লাগে! রিপোর্ট জেনে খুশি হলেন খুব, শুভ কামনা জানালেন। আমি তীক্ষন চোখে তাকে দেখছিলাম।তাতে কোন অভিনয় ছিলোনা।


জীবনে খুশির উপলক্ষ তো অনেক আসে, কিন্তু যখন আপনি জানতে পারবেন আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন সে অনুভুতিটা আসলে কি রকম? আমি নিজেও কখনো বুঝিনি এতোটা আনন্দিত হবো। নিতুকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো সে সময়টা খুব কঠিন ছিলো। আমার খালি মনে হচ্ছিলো আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা। নিতুর অবস্থা ক্রিটিকাল ছিলো যথেষ্ট, ডাক্তার জানালেন ব্লাড লাগবে। নিতুর ব্লাড গ্রুপ খুব রেয়ার, এবি নেগেটিভ।রক্তের জন্য একে তাকে ফোন দিয়ে বেড়াচ্ছিলাম, কোন ব্লাড ব্যাঙ্কেও রক্ত পাওয়া যাচ্ছিলোনা।অবশেষে একজন ডোনার পাওয়া গিয়েছিলো। ডোনার যখন হসপিটালে আসেন, আমি চমকে উঠেছিলাম। ডোনার আর কেউ না, ছিলেন অপু সাহেব। ভদ্রলোক হাসপাতালে ছিলেন যতক্ষন না নিতুর অপারেশন শেষ হয়। রাত প্রায় দশটার দিকে নিতুর কোল আলো করে আসে আমাদের ছেলে। সাদা কাপড়ে জড়িয়ে আনা সদ্য চাঁদের টুকরাকে যখন আমাকে দেখানো হল, আমার মনে হয়েছিলো আমার এই পৃথিবীতে মনে চাওয়ার আর কিছু নাই। ছেলেকে কোলে নিয়ে আমি অপু সাহেবের দিকে তাকালাম। অবাক হয়ে দেখলাম তার চোখে পানি। তিনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন, আমি ছেলেকে তার কোলে তুলে দিলাম। অবাক হয়ে দেখলাম ভদ্রলোকের চোখে পানি।


নিতুর ছেলেকে কোল নেয়ার পর অনেকদিন পরে আমার চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো। আমার ভাবতেই ভাল লাগছিলো আমার নিতু আজ থেকে মা হয়ে গিয়েছে। হলেও হতে পারতাম আমি এই ছেলেটির বাবা। নিতুর যখন চরম দঃসময় আমি তখন নিতুর হাত ধরতে পারিনি, এই ছেলেটির বাবা পেরেছেন তাকে আমি সবসময়ই অন্য চোখে দেখি, শ্রদ্ধা করি, তার থেকে বেশি যেটা করি তাহল হিংসা। তিনি নিঃসন্দেহে অসম্ভব ভাগ্যবান নিতুকে এই জীবনে তিনি পাশে পেয়েছেন।দ্বিতীয়বার জন্ম নেয়ার সুযোগ পেলে নিতুকেই আমি পাশে চাইতাম। সেদিন সারাদিন আমি হাসপাতালে কাটিয়ে দিয়েছিলাম, সন্ধ্যায় নিতুকে যখন বেডে দেয়া হলো, ছেলে কোলে নিতুকে দেখে আমার চোখ ভরে গেলো, চোখের পানি আবার গড়ালো, হলেও হতে পারতো এই পরিবারের একজন সদস্য আমি। আমার এতোটা দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থাকাটা সাব্বির সাহেবের পরিবার পছন্দ করলেন না। না করারই কথা। তাদের তীব্র দৃষ্টি আমি গায়ে মাখলাম না। সন্ধ্যায় চলে আসার আগে নিতুকে খুব সৌভাগ্যক্রমে একা পেয়ে গিয়েছিলাম। সারাজীবনের ভিতূ আমার উপর কোত্থেকে এতো সাহস ভর করলো জানিনা, নিতুর হাত ধরে বলে ফেললাম, আমার একটা কথা রাখবে? নিতু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। নিতুকে আমি বলি ছেলের নাম অপু রাখবে প্লিজ? নিতু মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে, কিছু বলেনা। আমি রুম থেকে চুপচাপ বেড়িয়ে আসি।

পরিশিষ্টঃ

নিতু আর সাব্বিরের একমাত্র ছেলে অনিন্দ্যের বয়স এখন পাঁচ। অনিন্দ্য সেদিন প্রথম স্কুলে যাবে। অফিসের প্রচন্ড চাপ থাকায় সাব্বির নিতু আর অনিন্দ্যের সাথে স্কুল পর্যন্ত আসতে পারেনি।অনিন্দ্য স্কুলের গেট পর্যন্ত চলেই গিয়েছিলো, নিতু তাকে ডেকে বলে,
অপু মামণিকে আদর করে গেলেনা?
চটপটে অনিন্দ্য নিতুকে বলে,  মা, আমার এই নামটা একদম ভাল্লাগেনাহ, তুমি আমাকে মাঝে মাঝে অপু কেন ডাকো?

নূহা চৌধুরী সম্পর্কে

এক বাক্যে - আমড়া কাঠের ঢেঁকি !!! এক কথায় - অপদার্থ !!! X( ভালবাসতে ভালবাসি ... :) From every depth of good and ill The mistry which binds me still From the torent or the fountain From the redclif of the mountain My heart 2 joy at the same tone.... And all I loved, I Loved Alone...
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, সাহিত্য-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

13 Responses to নিতু, তোমাকে…

  1. সামিরা বলেছেনঃ

    খুব নতুন গল্প এমন না, খুব বাস্তবও না, কিন্তু দারুণ সুপাঠ্য! এত মসৃণ যাদের গল্প লেখার হাত তাদেরকে আমার খুব হিংসা হয়।

  2. ইকু বলেছেনঃ

    গল্প টি বেশ ভালো লেগেছে … আপনার লিখার হাত খুব ভালো… 8)

  3. শারমিন বলেছেনঃ

    ভালো লেগেছে 🙂

  4. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    চমৎকার লাগছে। 😀

  5. রুহশান আহমেদ বলেছেনঃ

    ভালো লাগলো গল্পটা,
    পরীক্ষার স্ট্রেস নেমে গেল সুখপাঠ্য লেখাটি পড়ে।

  6. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    পাকা গল্পকার দেখি ! বেশ ভালো লেখনী। তবে হুমায়ুনের ছায়া পেলাম অনেক জায়গায়।
    আর একটা ব্যাপার, ছেলেরা সবসময় একটা ফর্সা হাতের মেয়েই চিন্তা করে ব্যাপারটা ঠিক হজম হয় না। হয়তো এটাই স্বাভাবিক। 🙂

  7. নিয়ন খান বলেছেনঃ

    লেখনীর ধরনটা হুমায়ুন সাহেবের মত হয়েছে। কপি করেন নাই তারপরও পড়ে মনে হচ্ছে কপি করেছেন হুমায়ুন সাহেবের গল্প।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।