কন্যার তরে পিতার শব্দমালা (অনুবাদ)

প্রিয় ছোট্টমনি,

তোমাকে এ চিঠিটা লিখছি আমাদের এলাকার বড় দোকানটার প্রসাধনীসামগ্রীর অংশে বসে। কিছুদিন আগেই আমার এক বন্ধু আমাকে মুঠোফোনে একটি বার্তা পাঠিয়েছিল। সে লিখেছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শোষণকারীদের মধ্যে দোকানের এই প্রসাধনীর অংশগুলো অন্যতম। তার এই কথাটার মর্মার্থ বোঝার আমার বেশ আগ্রহ হল। আর তাই চলে এলাম এখানে। মজার ব্যাপার হল, আমি আমার বন্ধুর সাথে একমত হতে শুরু করেছি। প্রতিটি শব্দের আলাদা শক্তি থাকে, সামনে রাখা এই প্রসাধনের সাজসরঞ্জামের ওপরে লেখা প্রতিটি শব্দের গভীর কিছু অর্থ আমি খুঁজে পাচ্ছি। কিছু কথা এরকম-

সাধ্যসীমায় জাঁকজমক, সংশয়াতীত ও নিখাদ, নিখুঁত শেষ ছোঁয়া, দীপ্তিময় তেজ, তারল্যে শক্তি, নগ্ন হও, বয়সকে করো তুচ্ছ, তাৎক্ষণিক বার্ধক্য থেকে যৌবনে,  বেছে নাও স্বপ্ন, প্রায় নগ্নতা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

যদি তোমার একটা মেয়ে থাকে, তো একটা সময় বুঝতে পারবে সে তোমার বাসার বাকি সবার মতই সামর্থবান। একটা ছেলের মত তার ভেতরেও দেখার মত এক শক্তি আছে; তার মাঝেও আছে স্বপ্নপাগল, উদ্দাম এক আত্মা। কিন্তু যে জায়গাটায় আছি এখানটায় আসলে বোঝা যায়, বেশির ভাগ মানুষই মেয়েটাকে এভাবে বুঝতে চায় না, এভাবে দেখতে পারে না। তারা তাকে একটি সুন্দর মুখ এবং একটি সুন্দর শরীর হিসেবে দেখতেই ভালোবাসে। তারা তাকে বুঝিয়ে চলে নিয়ত, তোমাকে এইভাবে নিজেকে পৃথিবীর কাছে উপস্থাপন করতে হবে, তাতেই তোমার মূল্য, তাতেই সার্থকতা।

কিন্তু আবারও বলি আসলে প্রতিটি শব্দের শক্তি থাকে; আর তাই একজন বাবার মনে আসা কিছু শব্দ প্রসাধনী বা মেইক আপের গায়ে সেঁটে দেয়া পৃথিবীর বাকি মানুষগুলোর শব্দের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে পারে বৈকি। হয়তো একজন বাবার চয়ন করা শব্দগুচ্ছ তার মেয়েটিকে প্রাতিষ্ঠানিক এই লজ্জাজনক শব্দের  আবরণে গভীর এবং দৃঢ় কিছু বোধ এনে দেবে; সে বোধ হবে তার একেবারে আপন করে অনুভব করা সৌন্দর্যের আর স্বমূল্যায়নের।

বাবার শব্দগুলো প্রসাধনীর শব্দগুলো থেকে আলাদা নয়, কিন্তু বাবার চোখে দেখা অর্থগুলো ঠিক যেন অন্য এক মেরুর।

দীপ্তিময় তেজ

তোমার এই তেজ তোমার হাতের নখগুলোতে নয়, বরং হোক তোমার হৃদয়ে। তুমি তোমার অন্তরের গভীরে বুঝে নাও তুমি কে, তবেই তুমি ভয়ডরের মাঝেও দৃঢ়তা দিয়ে পৃথিবীতে বাঁচতে শিখবে।

বেছে নাও স্বপ্ন

তোমার স্বপ্নগুলো দোকানের এই তাকে রাখা প্রসাধনে খুঁজতে এসো না। নিজের ভেতরে প্রশান্তির যে ছোট্ট একটা কোণ আছে তাতে খুঁজে নাও। সত্যিকারের স্বপ্ন ওখানটায়ই বপন করা যায়। আর তারপর খুঁজে নাও এই পৃথিবীতে তুমি কী করতে চাও। যখন তুমি তা জেনে যাবে তখন বিশ্বাস, সততা আর প্রত্যাশার আলো জ্বেলে একনিষ্ঠ হয়ে তাতে আত্মনিয়োগ করবে।

নগ্নতা

পৃথিবী চায় তুমি তোমার পোশাক খুলে ফেলো। আমার অনুরোধ, তুমি তা করো না। কিন্তু তোমার হাত আবৃত করে রাখা মোজাগুলো খুলে ফেলো, কোন মুষ্টিযুদ্ধে যেও না। হৃদয়ে যা আছে তা বলে ফে্লো। অসাবধান হও, ঝুঁকি নাও। পৃথিবীটাকে ভালোবাসো, যে পৃথিবীটা জানেই না কী করে নিজেকে ভালোবাসতে হয়। নগ্ন হয়ে ভালোবেসো, উদ্দাম হয়ে ভালোবেসো, এর মাঝে কোন বাঁধ রেখো না।

সংশয়হীন

সংশয়াতীতভাবে সবসময় মনে রেখো ‘সংশয়হীনতা’ বলে কিছু নেই। এটা কিছু লোকের তৈরি করা একটা ভ্রম যারা তোমার কাছে থেকে কেবল আর্থিক সুবিধা আদায় করতে চায়। যদি নিখুঁতভাবে, সংশয়হীনভাবে কিছু করতেই চাও তো নিজের ও অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও দয়ার্দ্রতায়ই তার প্রমাণ দিও।

বয়সকে তুচ্ছ করো

একটা সময় তোমার গায়ের চামড়া কুঁচকে যাবে, তোমার উচ্ছল যৌবন হারিয়ে যাবে। কিন্তু জেনো, তোমার আত্মার কোন বার্ধক্য নেই। সেই আত্মা সবসময়েই জানে আমাদের এই নশ্বর জীবনে কী করে হাসতে-খেলতে হয়, উপভোগ করতে হয়, আনন্দ করতে হয়। নিজের ভেতরের এই উচ্ছল সত্তাটাকে কখনও বার্ধক্যে যেতে দিও না।

নিখুঁত শেষ ছোঁয়া

তোমার মুখটা আজ কেমন দেখাচ্ছে এই দিয়ে তোমার খুঁতহীনতা যাচাই হয় না, বরং তোমার জীবনের শেষদিনটা কেমন হবে তার ওপর নির্ভর করে। প্রার্থনা করি, তোমার জীবনের প্রতিটি বছর যেন সেই দিনের জন্য প্রস্তুতি হয়। সহানুভূতি আর দয়ার মাঝেই যেন তুমি বুড়িয়ে যেতে থাকো, জ্ঞানের মাঝে যেন তুমি একটু একটু করে বড় হও, সকল মানুষের জন্য এক বুক সমান ভালোবাসা নিয়ে যেন বেড়ে ওঠো। এভাবেই তোমার শেষদিনটা যেন নিখুঁত আর শান্তিময় হয় যা তোমাকে ওপারের অজানায় পৌঁছে দেবে, একইসাথে তোমার আপন মানুষগুলোর জন্য এক অনন্য উপহার হয়েও থাকবে।

ছোট্ট সোনা,

একটা সময় তুমি হয়তো গোলাপি রং এর সব জিনিস আর জাঁকজমক ভালোবাসবে আর আমি অবশ্যই জানি জীবনের কোন এক সময় তার গুরুত্বও থাকবে। কিন্তু আমি তোমার জন্য তিনটি শব্দের প্রার্থনা করি যার গুরুত্ব আরও একটু বেশি। প্রতিদিন রাতে যে তিনটা শব্দ তুমি বল যখন আমি তোমাকে প্রশ্ন করি, ‘কোথায় তুমি সেরা সুন্দরী ?’ তুমি কি জানো, তোমার বলা তিন শব্দের উত্তর এতটা উজ্জ্বল যে কেউ তার ঔজ্জ্বল্য প্রকাশে বাধা দেয়ার শক্তি রাখে না?

কোথায় তুমি গো সেরা সুন্দরী ?

একদম এই অন্তরটায় !

আমার হৃদয় থেকে তোমার হৃদয়ে,

তোমার বাবা।

(ড: কেলি ফ্লানাগানের ব্লগ থেকে অনূদিত) ((http://drkellyflanagan.com/2014/01/15/words-from-a-father-to-his-daughter-from-the-makeup-aisle/))

মাধবীলতা সম্পর্কে

"অনিমেষ অবাক হয়ে দেখল মাধবীলতাকে । মাধবীলতা কোন রাজনীতি করেনি কখনও, শুধু তাকে ভালবেসে আলোকস্তম্ভের মত একা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে । খরতপ্ত মধ্যাহ্নে যে এক গ্লাস শীতল জলের চেয়ে বেশি কিছু হতে চায় না । বাংলাদেশের এই মেয়ে যে কিনা শুধু ধূপের মত নিজেকে পোড়ায় আগামীকালকে সুন্দর করতে । দেশ গড়ার জন্যে বিপ্লবের নিষ্ফল হতাশায় ডুবে যেতে যেতে অনিমেষ আবিষ্কার করেছিল বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা ।" - সমরেশ মজুমদারের "কালবেলা" উপন্যাসের মুখবন্ধের অংশবিশেষ থেকে উদ্ধৃত এই কথাগুলো আমার খুব বেশি আপন । কোন এক অনিমেষের মাধবীলতা হতে পারাটা আসলেই বড় বেশি সৌভাগ্যের।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুপ্রেরণা, অনুবাদ, ইতিবাচক, সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

13 Responses to কন্যার তরে পিতার শব্দমালা (অনুবাদ)

  1. অক্ষর বলেছেনঃ

    খুবই ভালো লাগলো। অনুবাদটা সাবলীল। ভালো লাগলো। এমনিতেই মনে হয় প্রায়ই নিজের একটা মেয়ে থাকলে ভালো হবে (আমি এখনও বিয়েই করি নাই যদিও O:) ) এই অনুবাদটা পড়ার পর মেয়ে বাবুর প্রতি তো আরও ঝুকে গেলাম। 😛

    :happy:

    • মাধবীলতা বলেছেনঃ

      এই লেখাটা পড়ে মেয়েবাবুর প্রতি ঝুঁকে পড়ার বিষয়টা জেনে একই সাথে বিস্মিত ও আনন্দিত হইলাম ! বিয়ে যখন এক সময় করবাই, মেয়েবাবুও হবে ইনশাআল্লাহ !

  2. তরঙ্গ বলেছেনঃ

    আপু, অনুবাদটা পড়ে খুব ভালো অগলো। কষ্ট করে অনুবাদ করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। 🙂

    • মাধবীলতা বলেছেনঃ

      আপনাকেও ধন্যবাদ ভাইয়া, পড়ার জন্য। বাঙ্গালির ইংরেজি বিকর্ষণের কারণে করতে হইল অনুবাদ আর কী ! অথচ অরিজিনাল লেখাটায় আসল ভাবটা সত্যিকারভাবে অনুভব করা যায়।

  3. শারমিন বলেছেনঃ

    তোমার স্বপ্নগুলো দোকানের এই তাকে রাখা প্রসাধনে খুঁজতে এসো না। নিজের ভেতরে প্রশান্তির যে ছোট্ট একটা কোণ আছে তাতে খুঁজে নাও।

    একটা সময় তোমার গায়ের চামড়া কুঁচকে যাবে, তোমার উচ্ছল যৌবন হারিয়ে যাবে। কিন্তু জেনো, তোমার আত্মার কোন বার্ধক্য নেই।

    অসাধারণ কথাগুলো
    আর অনুবাদ অনেক ভালো হয়েছে আপুনি :love:

  4. তুসিন বলেছেনঃ

    তোমার স্বপ্নগুলো দোকানের এই তাকে রাখা প্রসাধনে খুঁজতে এসো না। নিজের ভেতরে প্রশান্তির যে ছোট্ট একটা কোণ আছে তাতে খুঁজে নাও।
    অসাধারণ 🙂
    ভাল লাগল লেখাটি।

  5. রুহশান আহমেদ বলেছেনঃ

    কথাগুলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে যাক, জীবনের সত্যিকার উপলব্ধি ঘটুক প্রত্যেকের অন্তরে…সেই আশা রাখি।

    চমৎকার লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।

  6. “পৃথিবী চায় তুমি তোমার পোশাক খুলে ফেলো। আমার অনুরোধ, তুমি তা করো না। কিন্তু তোমার হাত আবৃত করে রাখা মোজাগুলো খুলে ফেলো, কোন মুষ্টিযুদ্ধে যেও না। হৃদয়ে যা আছে তা বলে ফেলো। অসাবধান হও, ঝুঁকি নাও। পৃথিবীটাকে ভালোবাসো, যে পৃথিবীটা জানেই না কী করে নিজেকে ভালোবাসতে হয়। নগ্ন হয়ে ভালোবেসো, উদ্দাম হয়ে ভালোবেসো, এর মাঝে কোন বাঁধ রেখো না।”

    দারুণ 🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।