আই থিঙ্ক, আই লাভ হার!

ওরা বলে আমি নাকি স্কিজোফ্রেনিক! আমার যা করতে ভালো লাগে আমি তা করি। তবে কারো ক্ষতি হয়, এমন কিছু করি না। আমি ছোটবেলা থেকেই তো এমন। আমার আম্মু সেটা  জানে। আমি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন একবার খুব কাছ থেকে প্লেন দেখতে ইচ্ছে হয়। আমার বাসা থেকে এয়ারপোর্ট বেশি দূরে ছিল না আবার খুব যে কাছে ছিল তাও বলা বোধয় পুরোপুরি ঠিক হবে না। আমি একাই এয়ারপোর্ট গিয়ে প্লেন দেখতে যাওয়ার কথা আম্মুকে বলি। আম্মু তখন হেসে কথাটা উড়িয়ে দিয়েছিল। ভেবেছিল, আমি ঠাট্টা করেছি। আমি বিকেলে খেলতে না গিয়ে, এয়ারপোর্ট চলে যাই। এখনও মনে পড়ে, মাঝরাস্তায় জুতার ফিতে ছিঁড়ে গিয়েছিল, আমি তখন জুতা ফেলে খালি পায়েই হাঁটা শুরু করেছিলাম, এক ট্র্যাফিক সার্জেন্ট আমাকে রাস্তা পার করে দিয়েছিল। আমি যখন এয়ারপোর্টে পৌছি তখন প্রায় সন্ধ্যা  হয়ে এসেছিল। আম্মুকে ছাড়া আমি কখনো সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বের হইনি কিন্তু আমার একটুও ভয় লাগছিল না। একটা করে বিমান ল্যান্ড করে, আমি চিৎকার করে উঠি। আবার যখন উড়ে যায়, তখন লাফ দিয়ে উঠি। আমি সব মিলিয়ে উনিশটা প্লেন দেখেছিলাম। ২০ তম প্লেন দেখার আগেই আমার কানে আম্মুর তর্জনী আর বুড়োআঙুলের চাপ অনুভব করি। আম্মুর সবচেয়ে বাজে অভ্যাস ছিল ঐ একটাই, যখন-তখন, যেখানে-সেখানে কানমলা দেয়া! তবে এরপর থেকে মজার যেটা হয়েছিল, তা হল- আমার কথা আর কেউ খুব হালকাভাবে নিত না। যেখানে যেতে চাইতাম নিয়ে যেত। আম্মু এখন আর আমাকে কানমলা দেয় না, ছোটবেলার মত আমাকে ভাত খাইয়ে দেয়। পার্থক্য একটাই- আগে খাইয়ে দেয়ার সময় মা গল্প করত, গাল ভরে হাসত এখন চোখ জুড়ে থাকে বিষণ্ণতা, মনে হয়ে কেঁদে ফেলবে!

আপন মনে বিড়- বিড় করা, একদৃষ্টিতে কোন কিছুর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকা, মাঝে-মাঝে ডানহাতের সাথে কথা বলা- এগুলো খুব সম্ভবত বড় ধরণের কোন সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারের লক্ষণ। আমাকে কেউ সরাসরি পাগল বলে না, তবে আমি বুঝতে পারি, সবাই তাই মনে করে। তবে আমি ওসব নিয়ে ভাবি না। ছোটবেলা থেকেই আমাকে নিয়ে কে কি ভাবছে সেগুলো নিয়ে আমি তেমন চিন্তা করি না।  অন্যের ভাবাভাবিতে তো আমার কোন হাত নেই, তাই যে যা ভাবার ভেবে নিক। আমি কিছুটা স্বল্পভাষী স্বভাবেরও ছিলাম, প্রয়োজন না হলে কথা বলতাম না। কম কথা বলতাম বলে স্কুলেও আমার তেমন বন্ধু তৈরি হয় নি। আমার কল্পনা করতে ভালো লাগতো। আমার নিজস্ব একটা কল্পনার জগত ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়েছিল। লর্ড অব দ্যা রিংস পড়ার সময় নিজেকে স্মেগেলের অবস্থানে চিন্তা করতাম, নিজেকে প্রশ্ন করতাম- ‘আমি স্মেগেল হলে কি করতাম?’ অথবা যদি গ্রিফিনডোরের সিকার থাকতাম! আমি কি পারতাম, হ্যারির মত ‘গোল্ডেন স্নিচ’ টা গিলে গ্রিফিনডোরকে জিতিয়ে দিতে? অথবা ‘ক্রনিকেলস অব নারিনার’ সেই হোয়াইট উইচকে মারতে পারতাম?  এখন আমার সব কল্পনা জুড়ে শুধু একজনই- ত্রিনা।

ত্রিনার সাথে আমার পরিচয়টা একটু অন্যরকমই বলা যায়। আমার ফিজিক্স পড়তে ভালো লাগতো, এবং সৌভাগ্যক্রমে ঢাবিতে আমার ফিজিক্স নিয়ে পড়ার সুযোগ হয়। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, ক্লাস শেষ হওয়ার পরপরই অন্য অনেকের মত ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে ভার্সিটির বাস ধরতাম না। আমি শেষ বাসে যেতাম। পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়াতাম। মাঝে মাঝে দুপুরে হাকিম চত্বরে  খিচুড়ি খেতাম। কলাভবন ক্যাফেটেরিয়ার উল্টা পাশে মাঝ-বয়েসি একজন প্যাঁরা সন্দেশ বিক্রি করত। অল্প দামে এত মজার সন্দেশ আগে কোথাও খাই নি। কতদিন কিনে খেয়েছি। মাঝে মাঝে সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর টেবিলে দুপুরে গল্পের বই পড়তে-পড়তে ঘুমিয়ে যেতাম। কি মজারই না ছিল সেদিন গুলো! কিছুদিন পরই ত্রিনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল।

হুট করে একদিন মিডটার্ম  পরীক্ষার রুটিন  দিয়ে দেয়। রাজ্যের পড়া জমে থাকায় তখনই  প্রথম পণ করেছিলাম গল্পের বই অথবা ঘুম দুটোকেই শেকলবন্দী করে লাইব্রেরীতে থাকার পুরো সময়টা পড়াশুনা করব। যেই চিন্তা সেই কাজ। ক্লাস শেষে সেদিন সায়েন্স লাইব্রেরীতে পড়তে গিয়েছিলাম। বিকেলে আম্মুকে ফোন করব বলে পকেটে হাত দিতেই দেখি, পকেটে মোবাইল নেই! আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, ওটা আমার খুব পছন্দের ছিল। আমার হাতে গোনা যে কয়জন খুব বেশি পছন্দের মানুষ আছে, ছোটমামা তাদের মধ্যে একজন। আমি ঢাবিতে চান্স পাওয়ার পর, মামা মোবাইলটা গিফট করেন। আমি কিছুতেই মনে করতে পাড়ছিলাম না, মোবাইলটা কোথায় রেখেছিলাম। যদিও আমার স্পষ্ট মনে ছিল, আমি ক্লাস শেষে আম্মুর সাথে কথা বলেছিলাম। আমি জানতাম, মোবাইল হারিয়ে ফেলেছি শুনলেও আমাকে কেউ কিছু বলবে না কিন্তু ভীষণ মন খারাপ হল। পড়াশুনার বালাই না করে সেদিন বাসায় চলে আসি। বাসে থাকা অবস্থার পুরোটা সময় মনে করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোথায় ভুলে মোবাইলটা রেখেছিলাম মনে পরেনি। বাসায় ঢুকতেই আম্মু আমাকে দেখে মুচকি হেসে বলেন, ‘এত ভুলোমনে হলে কি করে হবে?’
আমার মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। মোবাইল হারিয়েছি এটাতো আম্মুর জানার কথা নয়!

-ত্রিনাকে চেন?
-না, ত্রিনা নামের কাউকে আমি চিনি না। কেন?
-মাইক্রোবায়োলজিতে পড়ে, তোমার ব্যাচমেট। ওর কাছেই তোমার মোবাইল। কাল ওর ক্লাসে গিয়ে নিয়ে এসো।
মোবাইলটা ফিরে পাবো ভাবতেই আমার এত ভালো লেগেছিল, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ত্রিনা নামের সেই মেয়েটির কথা- যে কিনা কাততালীয়ভাবে আমার সেই অসম্ভব ভালোলাগা সৃষ্টির উৎস ছিল।

পরদিন ইউনিভার্সিটি গিয়ে আমি আবার আমার চিরচেনা ‘ভুলোমনা’ গুনটি সহজেই ফিরে  পাই। ক্লাস শেষে করে যখন বেরিয়ে আসি তখন ত্রিনাকে প্রথম দেখি। যদিও খানিকটা সময় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকেলও কথা হয় নি কেননা তখনও আমরা কেউ কাউকে চিনিই না।   ত্রিনা যখন আম্মুকে ফোন করে আমার কথা জিজ্ঞস করছিল, তখন আমার সব মনে পড়ে যায়। সামনে গিয়ে বলি, ‘আমি রাহাত, আপনি বোধয় ত্রিনা, তাই না?’ আমি ভেবেছিলাম, ত্রিনা বোধয় আমার উপর বিরক্ত হবে; বিরক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু হয়নি, প্রত্যুতরে কেবল মিষ্টি করে হেসেছিল। সে হাসিতে কিছু একটা ছিল…আমি জানি, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসি হচ্ছে আমার আম্মুর হাসি, ত্রিনার অবস্থান ঠিক তার পরে। ত্রিনা আমাকে মোবাইল দিয়ে চলে গিয়েছিল। কোন কথা বলেনি। আমি কিছুটা অবাক হয়েছিলাম কিন্তু সেটা প্রকাশ করি নি। রাতে যখন বাসায় ফিরি, আম্মু ত্রিনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। ত্রিনার সাথে আমার কথা হয়নি শুনে খুব অবাক হয়েছিল আম্মু।

তারপরের কয়েকদিন ত্রিনার সাথে আমার আর দেখে হয়নি। আমার পরীক্ষাও তখন শুরু হয়ে গিয়েছিল। পড়াশুনা নিয়ে মোটামুটি ব্যস্ত সময় কাটছিল, ভুলেই গিয়েছিলাম সব। একদিন দুপুরে আবার সায়েন্স লাইব্রেরীতেই ওর সাথে আবার দেখা। আমি আইডি-কার্ড দিয়ে ব্যাগ জমা রাখছিলাম, পাশেই ওকে দেখি। স্বভাবসুলভ সেই মিষ্টি করে হাসা। না, সেদিন আর চুপ   ছিল না। বলে, ‘আজ আবার ভুলে ব্যাগ রাখার টেবিলটায় মোবাইল ফেলে যাবেন না যেন!’
আমি অবাক হয়ে বলি, ‘আমার মোবাইল টেবিলের উপরে পেয়েছিলেন আপনি?

-হুম।
-অসংখ্য ধন্যবাদ।
-তাও ভালো। এক সপ্তাহ পরে হলেও, থাঙ্কস তো বললেন।
-সরি। সেদিন ভুলে গিয়েছিলাম।
-না, ঠিক আছে। আজ তাহলে যাই?
-আচ্ছা, ঠিক আছে। পরে কথা হবে।

ত্রিনার সাথে প্রথম কথা বলার মুহূর্তটা মাত্র দু’মিনিট ধরে চলেছিল। তারপর থেকে শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়া। আমি ত্রিনার ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম। চোখে-চোখ পড়তেই আবার সেই জগত-ভুলানো হাসি! ত্রিনার হাসিটাকে ঠিক প্রাণ-খোলা হাসি হয়তো বলা যেত না কারণ ওর হাসি ছিল শব্দহীন। কিন্তু সবেচেয়ে অসাধারণ যেটা ছিল, তা হল- হাসলে খুব আলতো করে একফোঁটা জল ওর চোখের কোণায় জমত। খুব অল্প সংখ্যক মানুষেরই ঠোঁট আর চোখ একসাথে হাসে। ত্রিনার হাসিতে চমৎকারভাবে তা মিশে যেত।

ত্রিনা খুব ইসলামিক-মাইন্ডেড ছিল। তবে মোটেই গোঁড়া স্বভাবের ছিল না। ওর ধারনাগুলো স্বচ্ছ ছিল, চিন্তাগুলো যৌক্তিক বিশ্লেষণে সাজানো ছিল। আমি ধর্ম নিয়ে আলাদা করে খুব বেশি ভাবতাম না। যদিও আমি নিজে একজন পুরোপুরি আস্তিক মানুষ। আমার কাছে স্রষ্টা অথবা ধর্মের ব্যাপারটাকে একটা অবলম্বনের মত মনে হত, যেটায় বিশ্বাস মানসিক শান্তি এবং তুষ্টির জায়গাটিকে আরো দৃঢ় করে। যার যেমন থাকতে, যা বিশ্বাস করতে ভালো লাগবে সে তেমনটা  করবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা অন্যের বিশ্বাসে কোনরুপ অসম্মান প্রদর্শন করে। ত্রিনা আমাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতো, এ বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশুনা করতে ইন্সপায়ার্ড করত। কিন্তু কখনোই কোন কিছুতে জোর করত না। আমার মধ্যে যে খুব সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটছিল, আমি সেটা বুঝতে পারছিলাম। এটা শুধু ধর্ম-স্রষ্টা নিয়ে আমার চিন্তা অথবা দর্শনে না বরং সবকিছুতেই। আস্তে-আস্তে আমি অনুভব করছিলাম, ত্রিনার প্রতি আমার আলাদারকমের একটা অনুভূতি কাজ করে।

একদিন ক্রিস রক অভিনীত আমেরিকান রোম্যান্টিক-কমেডি ফিল্ম ‘  ‘আই থিঙ্ক আই লাভ মাই ওয়াইফ’ মুভিটা দেখেছিলাম। মুভির নায়ক তার স্ত্রীকে ভালোবাসেন কিন্তু স্ত্রীর সামনে কখনো  সেটা প্রকাশ করতে পারত না। তাই তাদের জীবন খুব সুখের ছিল না। একসময় নায়কের জীবনে আরেকজনের নারীর অনুপ্রবেশ ঘটে। কিন্তু রক তাকে ভালবাসতে পারে নি কারণ রক  তার স্ত্রীকে প্রচণ্ড ভালবাসত, তার সবসময় মনে হত, ‘আই থিঙ্ক আই লাভ মাই ওয়াইফ’। শেষে স্ত্রীকে সেটা প্রকাশ করার মাধ্যমে মুভির ইতি টানা হয়। অসাধারণ কোন মুভি বলা যায় না, প্লটও সাধারণ। রেটিং ছয়ের কাছাকাছি। কিন্তু সেই সাধারণ মুভিটা আমার জীবনে কিছু অন্যরকম পরিবর্তন এনে দিল যেটা মুভির সাথে সেভাবে মিলে না।

আমার নিজস্ব কল্পনার জগত, যেটাকে আমি খুব যত্নে লালন করি। সেই জগতাটারও অনেকটা জুড়ে ছিল ত্রিনা। যেকোনো সমস্যায় ও আমাকে সাজেশান দিত, আমার সাথে বেড়াত, ওর স্বপ্নগুলো আমাকে বলত, আবার মাঝে-মাঝে আম্মুর মতন শাসনও করার চেষ্টা করত। আমি প্রচণ্ড আশাবাদী মানুষ ছিলাম। জীবনের প্রতি ক্ষোভ, হতাশা, না-পাওয়া,  জীবনকে অর্থহীন ভাবা, এ ব্যাপারগুলো আমাকে কখনোই খুব একটা ভাবাতো না। এর কারণটা হয়তো জীবন সেভাবে তার অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে কখনও আমার দিকে তাকায় নি। যা চেয়েছিলাম   তার প্রায় সবকিছুই আমাকে সে মুক্ত হস্তে দিয়েছিল। তবে জীবনের নিগূঢ় অর্থ, তাৎপর্য, গুরুত্ব আমি প্রথম বুঝতে শিখি ত্রিনার কাছ থেকে। ও নিজে ওর এলাকায় বস্তিতে থাকা কয়েকজন গরীব ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা স্কুল করেছিল। স্কুল বলতে ওদের বাসার পাশের একটা আধাপাকা বাড়ির একটা রুম ভাড়া নিয়ে প্রতিদিন বিকেলে, মাঝেমাঝে রাতে ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াতো। জন্মদিনের টাকায় পার্টি না করে ওদের সবাইকে নিয়ে আনন্দ করত। মাঝেমাঝে ওদের এটা-সেটা কিনে দিত। আমি যখন প্রথম ওদের বাসায় যাই, তখন কিছুটা সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। আমাকে যখন ওর স্কুলে নিয়ে গেল, ত্রিনা রুমে ঢুকতেই সবগুলো ছেলেমেয়ে একসাথে চিৎকার করে বলেছিল- ‘ম্যাডাম আসছে, ম্যাডাম আসছে’… আমি  অবাক হয়ে সেদিন বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর চোখে যে আনন্দের ঝিলিক দেখেছিলাম, কার সাধ্য সেটা  অর্থের পাল্লায় মাপবে। অর্থের বিনিময়ে সেই অপার্থিব সৌন্দর্য এ পার্থিব জগতে কেনা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র নিখাঁদ ভালোবাসাই পারে তার জন্ম দিতে। আমার ঠোঁটে হাসি ছিল  কিন্তু খেয়াল করি করি নি কখন যেন চোখের কোণায় দু’ফোঁটা জল জমেছিল। ত্রিনা আমাকে অবচেতনমনেই ওর হাসিটা শিখিয়ে দিয়েছিল; হাসির উৎস চিনিয়ে দিয়েছিল। আমি অস্ফুটস্বরে বলেছিলাম, ‘আই থিঙ্ক, আই লাভ হার।’

আমার জীবনে ত্রিনার প্রভাব কতোটা বেশি সেটা বুঝেছিলাম আমার মোটামুটি কাছের এক বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে গিয়ে। পার্টি হয়েছিল ছাদে। ছাদের এককোনায় বার সাজনো হয়েছিল।  সবাই ঠিক  করে, খাওয়ার পার্ট চুকে গেলে একসাথে ড্রিংকস করবে। আমার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু সবাই মিলে এমন জোর করছিল, আমাকে রাজি হয়ে যেতে হয়েছিল। কিন্তু আমি গ্লাসে চুমুক দিতে পারি নি, কোন এক অদৃশ্য শক্তি যা আমাকে সায় দিচ্ছিল না, আমার মাথায় শুধু ঐ একটা লাইনই ঘুরছিল, ‘আই থিঙ্ক, আই লাভ হার’। আমার বন্ধুরা সেদিন অনেক অবাক হয়েছিল, আমিও হয়েছিলাম, আমার নিজের উপর! অকেশনালি একটু ড্রিংকস করা খুব বেশি খারাপ কাজের মধ্যে পড়ে না কিন্তু আমি সেটা পারি নি, সেখান থেকে চলে আসি। আমি ভাবতে থাকি, ঐ একটা লাইন আমার মাথায়  সারাজীবনের জন্যই তার অবস্থান পোক্ত করে নিয়েছে এবং কোন খারাপ কাজ করার সাহস আমাকে তা দেবে না। আমি পারিও নি। এক অদৃশ্য শেকলে আমার প্রতিটি কোষ বাঁধা পড়েছিল। আমার চির স্বাধীন, খেয়ালী সত্ত্বার মুক্তি ঘটেছিল সেই অদৃশ্য শেকলে বাঁধা পরে।

অনার্স পরীক্ষার পর আজকের দিনটিতে ত্রিনার সাথে আমার বিয়ে হয়। সে রাতের পুরোটা সময় জুড়েই আমরা গল্প করে কাটিয়েছিলাম। স্বল্পভাষী ত্রিনার মনে যে এত কথা জমা ছিল, আমি জানতাম না। ও কথা বলছিল, আমি গভীর আগ্রহে ওর কথাগুলো শুনছিলাম। কথা বলেছিল, ওর স্কুল নিয়ে, সেটা নিয়ে ওর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আরও অনেক কিছু নিয়ে। একনাগাড়ে অনেক কথা বলার পর ও যখন আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমাকে সাপোর্ট করবে তো? আমার পাশে থাকবো তো?’
আমি কিছু বলিনি, হয়তো অন্যজগতে ছিলাম। এবার একটু জোরেই ঐ লাইনটা বের হয়ে আসে মুখে থেকে, ‘আই থিঙ্ক, আই লাভ ইউ ত্রিনা।’ বলে আমি নিজেই একটু অস্বস্তি বোধ করছিলাম।
ত্রিনা মুখ টিপে হাসছিল, তারপর বলেছিল, ‘আমি সেটা জানি, এখন আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।’
-‘অবশ্যই পাশে থাকব’, বলেই ওর ডান হাত আমার দু হাতে শক্ত করে ধরেছিলাম।

শেষ সময়টায় ত্রিনা রাতে একদম ঘুমাতে পারতো না। সারারাত টেবিল ল্যাম্পের সামনে বসে কাটাতো। চোখে কাজল পড়লে ত্রিনাকে খুব সুন্দর লাগতো। তখন ত্রিনাকে চোখে আর কাজল পড়তে হত না, কাজল ওর চোখের নিচে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছিল। পার্থক্য একটাই ছিল, আগে সেটা ত্রিনার মায়াকাড়া চোখটা ফুটিয়ে তুলত আর তখন সে চোখ জুরে ছিল চাপা  বিষণ্ণতা। বিয়ের একমাস পড়ই ত্রিনার এই সমস্যাটা শুরু হয়। আস্তে-আস্তে সেটা বাড়তে থাকে। ঘুম ছাড়া কি একজন মানুষ বাঁচতে পারে? ত্রিনার ওর জীবনের শেষ সময়টায় কাউকেই চিনতে পারতো না। নিজের মনে বির-বির করতো। মাঝে-মাঝে কেবল আমাকে চিনতে পারত। রহাত বলে ডাকত। দেশে, দেশের বাইরে অনেক সাইক্রিয়াটিস্ট, নিউরোলোজিস্ট দেখিয়েছিলাম কিন্তু কেউই নিশ্চিতভাবে ওর রোগ প্রসঙ্গে কিছু বলতে পারে  নি। তারা বলেছিল রোগের লক্ষণগুলো নাকি এত বেশি বিরল যে তার সাথে নিশ্চিতভাবে  কোন রোগের মিল খুঁজে পান নি।

জীবনের শেষ কিছুদিন আমি ওকে নিয়ে একটু দূরে চলে গিয়েছিলাম। যেখানে মানুষের ভিড় নেই, পাখির ডাক শোনা যায়, বারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা যায় এমন একটা  জায়গায়। বিকেলে আমি ওর হাত ধরে হাঁটতাম। ও কিছুই চিনত না, পাখি-ফুল, চাঁদ-সূর্য কিছুই ওর মনে ছিল না। মাঝেমাঝে কেবল একটা শব্দ উচ্চারণ করত- ‘রাহাত।’

দেড় বছর পর ত্রিনা মারা যায়। ত্রিনা মারা যাবার পর জন হপকিন্স মেডিকেল স্কুলের একজন নিউরোসায়েন্টিস্ট গবেষণার জন্য ত্রিনার ব্রেইন নিয়ে যায়। আমি ত্রিনাকে নিয়ে আমেরিকায় থাকার সময়ই ওদের সাথে এ নিয়ে কথা হয়েছিল। আমি বারণ করি নি। বিজ্ঞানকে তার নিজস্ব স্রোতে চলতে দিতে হয়। আমি চাইনা ত্রিনার মত এমন পরিণতি আর কারো জীবনে নেমে আসুক। কাউকে যেন এতোটা বর্ণনাতীত কষ্ট সহ্য যাতে মারা যেতে না হয়। তিনমাস পর আমার কাছে একটা চিঠি আসে, সেখানে লেখা ছিল, ত্রিনার অতি বিরল এফএমআই  ডিজিজ হয়েছিল। ফেটাল ফেমিলাল ইনসমনিয়া মূলত জিনঘটিত বংশগত রোগ। সারা পৃথিবীতে মাত্র এরকম পঞ্চাশটি কেইস খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ত্রিনার এফএমআই নাকি বংশগত ছিল না কারণ ত্রিনার পরিবারে কারোর-ই ইনসমনিয়া ছিল না। ত্রিনার পৃথিবীর  প্রথম ব্যাক্তি যে আকস্মিকভাবে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ত্রিনার মস্তিষ্কের প্রায় ৭০ ভাগ  নিউরন নাকি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সে কারণেই সব ভুলে যেত। কিন্তু আমার নাম ত্রিনার মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মনে ছিল। হয়তো আমার মাথায় যেভাবে সেই লাইনটা জায়গা করে  নিয়েছিল, ত্রিনার নিউরনেও আমার নামটা খুব যত্নে জমা ছিল। কেন ছিল? তার উত্তরটা বিজ্ঞানীরা জানেন না।

ত্রিনার মৃত্যু আমি স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিলাম। এত কষ্ট করে ও বেঁচে থাকবে, আমি সেটা সহ্য করতে পারছিলাম না। ওর মৃত্যুর পর আমি কাঁদি নি। কেন কাঁদবো, ত্রিনা তো আমার সাথেই আছে। আমি যখন খুশি, ‘কল্পনায় ওর সাথে কথা বলতে পারি।’ চিৎকার করে বলতে পারি, ‘আই থিঙ্ক, আই লাভ ইউ ত্রিনা’ ত্রিনা শুনবে না, তাই চিৎকার করে বলতেও কোন সমস্যা নেই।

আমি জানি, আমার মৃত্যুর পর কোন একদিন হলেও আমার এই ডায়েরিটা কেউ একজন পড়বে। এবং সেই মানুষটা হয়তো আমার আম্মু।
‘আম্মু তুমি আমাকে মাফ করে দাও। ত্রিনার চাইতেও আমি অনেকবেশি তোমাকে ভালোবাসি…’

গভীর রাতে, ডায়েরীটা বুকে নিয়ে এক মা নিঃশব্দে কাঁদছেন। রাহাত মারা গিয়েছে দশ বছর হল। অনেকদিন পর আজ রহাতের গলা শুনলেন, মা ডাক শুনলেন।

অনিমেষ ধ্রুব সম্পর্কে

"You've gotta dance like there's nobody watching, Love like you'll never be hurt, Sing like there's nobody listening, And live like it's heaven on.'' অসম্ভব পছন্দ উইলিয়াম পার্কারের এই কথাগুলো! নিজের মত করেই নিজের পৃথিবীটা কল্পনা করে নিতে ভাল লাগে। ঔদাসিন্য,অলসতা শব্দ দুটি আমার সাথে বনে যায়। গভীর মনোযোগ কিংবা অসম্ভব সিরিয়াস মুড আমার কখনোই আসে না। একা অচেনা রাস্তায় অকারণে হাঁটতে ভালো লাগে, মানুষ দেখতে ভালো লাগে, ভাল লাগে কবিতা লিখতে...তবে স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখি আমার চারপাশে থাকা মানুষগুলোর জন্য কিছু একটা করার, দেশকে কিছু একটা দেয়ার। পারব কি-না জানি না, তবুও স্বপ্ন বুনে চলেছি নিরন্তর... http://www.facebook.com/kamrul.h.hridoy.3
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, সাহিত্য-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

5 Responses to আই থিঙ্ক, আই লাভ হার!

  1. রুহশান আহমেদ বলেছেনঃ

    স্যালুট বস! আরেকটি চমৎকার লেখা উপহার দেয়ার জন্য।

    কেমন একটু তরিঘরি ভাব এসে গিয়েছিল মনে হল, মাঝের দিকে…

    শুভকামনা সবসময়।

  2. শারমিন বলেছেনঃ

    লিখাটা সুন্দর 🙂
    কিন্তু মন খারাপ করা গল্প ভালো লাগে না
    শেষটা বেশি মন খারাপ করা 🙁

  3. অনুজ বলেছেনঃ

    ইহা একটি কেও মেও চেও রচনা।
    😛

  4. মুনীরা মারদিয়া বলেছেনঃ

    সুন্দর লেখা, কিন্তু এন্ডিং ভালো লাগে নাই ! আচ্ছা, ত্রিনা যদি জানতে পারতো, রাহাত সুইসাইড করছে, ওর কেমন লাগত ? 🙁

  5. হৃদয় বলেছেনঃ

    ইচ্ছে ছিল ছোট গল্প লিখার, হয়তো হয়েছে। তবে রাহাত সুইসাইড করেনি…আবার হয়তো করেছে, সেটা পাঠকের হাতেই থাকুক- এখন আমার নিজস্ব চিন্তা আর পাঠকের চিন্তার মধ্যে সংজ্ঞাগত কোন পার্থক্য নেই, কারণ এখন আমি নিজেও এই গল্পটার একজন পাঠকই! 🙂

    আপু, তবে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। ত্রিনার মৃত্যুর পর রাহাত যদি ত্রিনার স্কুলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিত, ত্রিনার অসম্পূর্ণ ইচ্ছাগুলো সম্পূর্ণ করায় চেষ্টা করত উপর থেকে ত্রিনা তা দেখে হয়তো শান্তি পেত আবার এও হতে পারে-
    গল্পে ত্রিনা আর রাহাতের সহজাত ভালোমানুষীতার দিকটি ফুটে উঠেছে। স্রষ্টা হয়তো তাদের পুনর্মিলনকে ইচ্ছে করেই আর দীর্ঘায়িত করেন নি। স্বর্গেই তাদের মিলন হোক। কীভাবে এতোটা নিশ্চিতভাবে বললাম, ওদের জান্নেতেই ঠাঁই মিলবে। ভালোমানুষ হতে পারাটা একই সাথে যেমন কঠিন এবং সৌভাগ্যেরও বটে। আল্লাহ অল্প কিছু মানুষের মাঝেই তার সহজাত বিকাশ ঘটান। আটটা জান্নাতের মাঝে যদি তারা না থাকে তাহলে থাকবে কারা? 🙂

    আমার ধর্মবিষয়ক জানাবোঝা-পড়াশুনা খুব কম। আমার নিজের ভাবানাগুলোর কিছুটা বললাম। ভুলও হতে পারে…

    আপু, কেন যেন হঠাৎ করেই নিজের লেখার মন্তব্য করায় অনীহা শুরু হয়েছিল। আজ অনেকদিন পর নিজের কোন লেখায় মন্তব্য করলাম; থ্যাংকস আপু 🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।