আপনি একটা জিনিশ খেয়াল করবেন- যখন বন্ধু বান্ধবেরা সবাই আড্ডা মশগুলে মত্ত, বিয়ে বাড়িতে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে সবাই কুশল বিনিময়ে ব্যস্ত,তখন কয়েকজন আছেন যারা আড্ডায় থেকেও এক কোনায় সবার থেকে আলাদা হয়ে চুপ হয়ে বসে আছে, কোন কথা বলছে না, তারকথায় কেউ পাত্তা দিচ্ছে না, বা তাকে উদ্দেশ্য করে কেউ মজা করলে সে উত্তর দিচ্ছে না,কিংবা বিয়ে বাড়িতে সব গণ্ডগোলের মধ্যে কয়েকজন আলাদা হয়ে চুপ হয়ে নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে রাখছে।এরাই হচ্ছে তথাকথিত আত্মকেন্দ্রিক। তবে হ্যাঁ, এই একা থাকাটা একজন স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে ও হঠাত একদিনের জন্য হতে পারে।কিন্তু তাকে আত্মকেন্দ্রিক বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না।আমি বলতে চাচ্ছি যারা সবসময় একটা সামাজিক পরিবেশে নিজেকে ইচ্ছা করে গুটিয়ে রাখেন,সবার থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখেন তারাই আত্মকেন্দ্রিক।আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন,কেন??
কেনও তারা এমনটা করেন? তারা তো ইচ্ছে করলেই সবার সাথে মিশতে পারেন? তাদেরকে তো কেউ আটকিয়ে রাখেন নি।তো কেন?
উত্তরটা হল তারা এমনটা করেন কারণ তারা এমনই। তারা আত্মকেন্দ্রিক। কারণ তারা আত্মকেন্দ্রিক।
এখন বলি মানুষ কেনও আত্মকেন্দ্রিক হয়?আপনি খেয়াল করে দেখবেন আত্মকেন্দ্রিক মানুষ সমাজে খুব কম। কারণ তারা সবসময় একটা বিশেষ দিকে খুব অসাধারন হয়। যেমন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা হয় মেধাবী।কিন্তু একটা কথা ঠিক, ঈশ্বর যখন কাউকে একটা জিনিশ খুব বেশি দেন প্রয়োজনের তুলনায়। তিনি বাকি জিনিসগুলো তার কাছ থেকে কেড়ে নেন।
এই তো গেল তত্ত্বীয় কথা।এখন একটি বাস্তব রূপরেখা দিচ্ছি ।যেমন ধরুন, ছাত্রজীবনের শুরুতেই যখন একটি ছেলে খুব ভাল ফলাফল করে, তখন তার গায়ে মেধাবী তকমাটা লেগে যায় ।ওকে তখন সবাই গুরুত্ব দেয়। আলাদা একটা দৃষ্টিতে দেখে।এরপর প্রতিবার যখন সে প্রথম হয়,সবাই বলে ও তো মেধাবী। ও তো ভাল করবেই! এতে অবাক হবার কিছু নেই। এতে ওর মর্যাদা বাড়ে না, আগের মতই থাকে ।ক্লাস এর যেই ছেলেগুলো ওর মত রেসাল্ট করে নি সেই ছেলেগুলোর সাথে ফলাফলের জন্য তার সাথে একটা অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হয় ।কেউ কেউ তাকে হিংসা করাও আরম্ভ করে।
কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন ক্লাস এর সেরা ছাত্রটি অনিচ্ছাকৃত কোন কারণে ২য়,৩য় হয়ে যায়। তখন ই সমালোচনা শুরু হয় চারদিকে। শিক্ষক , অভিভাবক, সবাই বলতে থাকে ছেলেটি আর পড়ছে না আগের মত।( ব্যাপারটা অনেকটা ফুটবলের গোল কিপারের মত। হাজারটা দুর্দান্ত সেভ করলে কেউ মনে রাখে না। একটা মিস করলেই সর্বকালের ভিলেন।)
যাই হোক, সেই মেধাবী ছেলেটার এই কথাটা গায়ে লাগে ।সে তখন হারানো সম্মান ফিরে পাবার আসায় পড়াশোনা করে ভয়ঙ্কর ভাবে। একসময় হয়ত সে তার হারানো আসন ফিরে পায়।কিন্তু সে কখনই জানে না এই মূল্যহীন ১ম বয় খেতাবের জন্য সে কি বিসর্জন দিয়ে এল?এরপর যতই সে বড় ততই সে ভয়ে থাকে তার এই “মেধাবী” খেতাব যেনকখনই হাতছাড়া না হয়।তাই সে খেয়াল করে না, “ছেলেটা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে” এই কথা না শোনার জন্য সে পড়াশোনাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে সে তার সহপাঠীদের সাথে বন্ধুত্ব এর আনন্দের সময়টুকু হারিয়ে ফেলেছে সময়ের গহব্বরে।সে নিজেই নিজেকে দূরে রেখেছে এসব থেকে। কেউ যখন বলেছে “ দোস্ত, চল আজ সারাদিন ঘুরে বেড়াই, সে বলেছে “ না আমার পড়তে হবে”এইভাবে নিজের সহপাঠীদের সাথে দূরত্ব তৈরি হয় তার।সে কেবল মাত্র কতিপয় ২য়, ৩য় দের ছাড়া আর কারো সাথে তেমন একটা মেশে না।আর কারও সাথে বন্ধুত্ব হয় না তার, কারণ সে পড়াশোনার সাহায্য তার কাছ থেকে পাবে না।যেমন তা পাবে ২য় ৩য় বয়দের কাছ থেকে।আর সাধারন ছাত্ররাও ওর সাথে কথা বলে না।কারন তাদের চোখে সে একটা দেবতা, নয়ত আঁতেল,ওর সাথে কথা বলতে গেলেই পড়াশোনার প্রসঙ্গ নিয়ে আসে।
এই যে একটা অদৃশ্য দূরত্ব একটা অর্থহীন বিষয় নিয়ে, এইটা কোন পক্ষই বুঝতে পারে না।এতে ক্ষতি যা হবার হয়, সেই তথাকথিত ১ম বয়টির। সে আর বন্ধু পায় না ।স্কুল কলেজের গন্ডী পেরিয়ে সেই ১ম বয়টি যখন তার মেধার বদৌলতে ভাল জায়গায় সুযোগ পায়, তখন সে তার পুরনো সহপাঠীদের থেকে অনেক দুরে।বেসির ভাগ ই তার মতও ভাল জায়গায় সুযোগ পায়নি। এমনকি তার গুটিকয়েকসহপাঠী( (২য়, ৩য়) রাও হারিয়ে গেছে তার জীবন থেকে।
এরপর যখন সেই ছেলেটি ভার্সিটি গিয়ে দেখে, এখানে সবাই তার মত ১ম বয় ছিল,“ছেলেটা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে এই কথা বলার কেউ নেই”- সে তখন তার মেধাবী তকমাটা খুলে সবার সাথে মিশতে চায়।কিন্তু হায়! অনেক দেরি হয়ে গেছে। সেই ১ম বয় খেতাবের লোভ তাকে অদৃশ্য ভাবে ঘিরে ধরেছে।এর থেকে তার মুক্তি নেই। সে না চাইলেও তার অবচেতন মন তাকে বলে “ পড়তে বয়”যখন কারো সাথে ঘুরতে যাওয়ার যাওয়ার যাওয়ার প্ল্যান করে,তখন তার সেই অবচেতন মন বলে-”পড়তে বয়।“ সে তখন তার পুরনো আমিকে আর অবহেলা করতে পারে না। পড়তে বসে। ।এইভাবে নতুন বন্ধুদেরও হারিয়ে ফেলে সে।আর স্কুলের বন্ধুরা!!!সেই ২য়, ৩য় বয়!!!তাদের সাথে আর যোগাযোগ নেই আজ তার। কারণ একেকজন দেশের একেক জায়গায়।
কিন্তু সে তার পড়াশোনা নিয়ে তার সিরিয়াস্ নেস ছাড়তে পারে না। সে জানে না ভার্সিটি লাইফে সবাই করে গ্রুপ স্টাডি, পড়াশোনা এখানে হয় তলে তলে। সামনা সামনি পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করাটা এখানে আপত্তিকর অবস্থায় ফেলে দিতে পারে তাকে। তাই সে অনেকের কাছে হয়ে যায় আতেল।যেই পড়াশোনার জন্য সে আজ এই জায়গায় এসেছে, সেই পড়াশোনা তাকে আজ অপমানিত অবস্থায় ফেলছে। এর ফলে সে আর বন্ধু খুঁজে পায় না সেই অপমান কারিদের মধ্যে থেকে।তাই সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এদিকে বেশি পড়াশোনা করতে গিয়ে সে মানুষের সাথে খুব একটা মেশে নি। তাই একদম অপরিচিতদের মধ্য থেকে সে নতুন বন্ধু খুঁজে পায় না।
এই ঘটনা সব ১ম ,২য় বয় দের ক্ষেত্রে হতে পারে। তবে যে কেবল মেধাবিরাই আত্মকেন্দ্রিক হবে কথাটা ঠিক নয়। একজন রক্ষণ শীল পরিবারের ছেলেও এ অবস্থায় পড়তে পারে।মা বাবার খুব বাধ্য ছেলে, মা বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে।মার ওপর সব কাজে নির্ভরশীল। ঘর থেকে বের হয় না খুব একটা, এভাবে সে মানুষের সাথে মেশে কম,মানুষের সাথে মেশার ক্ষমতা
হারিয়ে ফেলে। সারাক্ষণ মাথা নিচু করে হাঁটে। এভাবে দেখা যায় ভার্সিটি লাইফেও তার বন্ধু হয় খুব কম।
এই ধরনের আত্মকেন্দ্রিক সমস্যা সমাজে খুব কম, কারণ খুব কম সংখ্যক মানুশই এর শিকার। তাই ে নিয়ে লেখা লেখিও কম হয় বিভিন্নজায়গায়।তবে তাই বলে আমাদের এই সমস্যার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া ঠিক নয়।
এই সমস্যা দূর করার একটাই উপায়, তা হল অভিভাবকদের উচিত, ছেলে মেয়েদের বেশি পড়াশোনার প্রতি সিরিয়াস না করা।সবার সাথে মিশতে দেয়া উচিত,শুধু পড়াশোনায় ভাল করাটাই জীবনে সাফল্য বয়ে আনে না, এই কথাটা আমাদের সিরিয়াস অভিভাবকরা বুঝতে চান না, তারা ভাবেন ছেলে পড়াশোনায় খারাপ করছে, মানে জীবন অন্ধকার। জীবনটা অনেক বড়, এটাকে ব্যর্থ করা খুব কঠিন। আর অভিভাবকদের এই অন্ধ সিরিয়াসনেস এর প্রতিযোগিতায় যদি তার সন্তান যদিও পড়াশোনায় খুব ভাল করে, তবুও সে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়তে পারে।আর আত্মকেন্দ্রিকতা নামক রোগের কোন ট্যাবলেট বা ইনজেকশন নেই,আর এটা থেকে বের হয়ে আশা খুব কঠিন।
তাই বাইরে থেকে দেখা যায় একজন মানুষ জীবনে উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে যে কি যন্ত্রণায় পুরে মরছে, তা অকল্পনীয়।
দেশে এখন পি এস সি,জে এস সি নামক আরও ২ টা বোর্ড পরীক্ষা চালু করার ফলে কম্পিটিশন আরও বেড়ে গেছে। আর ভাল ফল করার জন্য ছাত্র ছাত্রীদের প্রতি অভিভাবকদের চাপ ও আরও বেড়ে গেছে। কিন্তু আদতে এই পরীক্ষা গুলো আসলে মূল্যহীন। কারণ পরবর্তী জীবনে এসব সার্টিফিকেট কোন কাজে লাগে না।কিন্তু অভিভাবক রা টা বুঝছে কোথায়? এজন্যই রেসাল্ট বের হবার পর আত্মহত্যার অনেক খবর আমরা পেপার ে দেখি।
আত্মকেন্দ্রিকতার জন্য মানুষ একটা সময়ে গিয়ে খুব একা হয়ে পড়ে।কারণ তখন আর নিজের দুঃখ কষ্ট গুলো আর শেয়ার করার কেউ থাকে না। বিদেশে এজন্য সুইসাইড এর হার অনেক বেশি। বাংলাদেশ ও যে এদিকে ধাবিত হচ্ছে না , তার গ্যারান্টি কি?
নিদারুণ সত্য কথা। এইরকমের মানুষগুলোর জন্য আসলে কষ্টই হয়। কেন যে সবাই পচানো কালচার থেকে বের হয়ে আসে না, আশেপাশের মানুষের একটু সহানুভূতি ও উৎসাহ কিন্তু ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। তবে আরেকটা ব্যাপার, সবসময় চুপচাপ বাচ্চা মানেই যে আত্মকেন্দ্রিক তা না, আরও কিছু কারণ এতে প্রভাব রাখে।
:welcome:
কয়েকটি পয়েন্টে একমত, কয়েকটিতে একমত নই।
আমার নিজের কথাই বলি। আমি একই সাথে এক্সট্রোভার্ট এবং ইন্ট্রোভার্ট! একটু উদাহরণ দিই। যেকোন নতুন মানুষের সাথে আমি নিমেষে মিশতে পারি, বিভিন্ন টপিকে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে গল্প জুড়ে দিতে পারি, মানুষ বুঝে কথা বলতে পারার কারণে ইগো/চিন্তাভাবনার অমিল কাটিয়ে আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর একটা কমন গ্রাউন্ড খুঁজে নিতে পারি। পাবলিক স্পিকিং এর উপর ওয়ার্কশপ নিয়েছি, জড়তা ছাড়া কমিউনিকেট (সেটা ব্লগ হোক, আর প্রেজেন্টেশন হোক) করতে পারার উপর সেশন নিয়েছি। অথচ ক্যাম্পাসে আমাকে বেশিরভাগ সময় একা ঘুরতে দেখবি, বিয়েবাড়িতে একা ঘুরতে দেখবি, এমনকি ঠাটারিবাজার স্টারে কোন উপলক্ষ্যে ক্লাসমেটদের সাথে খেতে গেলেও দেখবি আমি চুপচাপ বসে আছি! অতি এক্সট্রোভার্ট আমি তখন একেবারেই ইন্ট্রোভার্ট।
আমার এই ব্যক্তিত্ব বদলের সাথে ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়া বা সোশ্যালাইজিং স্কিলের সম্পর্ক খুব কম, অন্তত আমার ক্ষেত্রে। বরং ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, আমার একা ঘুরতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য, তাই আমি সেটাই *বেছে* নিয়েছি! আড্ডার মধ্যমণি হওয়া আমাকে টানে না, তাই পেটে অনেক গল্প থাকলেও বলার পরিবর্তে কেবল শুনে যাই!
বিশ্বাস করবি কিনা জানি না, তিন বছর ভার্সিটিতে কাটালাম, এই তিন বছরে অ্যাকচুয়ালি আড্ডা দেয়ার পরিমাণ এখনও এক ঘন্টা পুরো হয়নি। ক্লাসে যাই, ক্লাস শেষে ছুটে বেড়াই নিজের কো কারিকুলারে, নিজের প্যাশন শিকারে, নিজের মনমত বই পড়ায়! সবাই বলবে আঁতেল, আমি বলব, এটাই আমাকে টানে!
দিনশেষে, আমি প্রচণ্ড বোরিং একজন মানুষ, এবং আমার ক্ষেত্রে এটা অতি যত্ন করে তৈরি করে নেয়া একটা ইমেজ ছাড়া আর কিছু না!
নিজের কথা তো বললাম। জেনারেল সেন্সেও আমার ব্যক্তিগত ধারণা আত্মকেন্দ্রিকতার শত কারণের মাঝে অতি পড়াশোনা কেবলই একটিমাত্র কারণ! জীবনটা নিজেই একটা রেস। পড়াশোনাটা জীবনের প্রথম কোয়ার্টারের রেস (তাও সবার জন্য নয়), জীবনের বাকি কোয়ার্টারগুলোতে চাকুরী, ব্যবসা বা অন্য পেশাগত রেস চলে আসবে। পারিবারিক জীবনের রেস চলে আসবে। এক রেস ফুরাবে, আরেক রেস আরম্ভ হবে! আত্মকেন্দ্রিক মানুষ আত্মকেন্দ্রিকই থাকবে! যে ফার্স্ট হত সেও থাকবে, যে চিরকাল হীনম্মন্যতায় ভুগেছে সেও থাকবে। একটি দিনশেষে একটি মনস্তাত্ত্বিক বিশেষণ মাত্র, বেড়ে উঠার পুরো প্রক্রিয়ার সাথেই সম্পর্কযুক্ত, কেবলই পড়াশোনা কিংবা প্রতিযোগিতা নয় 🙂
ভালো একটা টপিক নিয়ে লিখেছেন,
চালিয়ে যান…
thanks