বইয়ের ভুবন ও লেখককুঞ্জ(৫): তানবীরা তালুকদার

বই পড়তে ভালোবাসেন এমন কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, একটি উৎসবের নাম বলুন, যেটা গোটা বাঙ্গালী জাতিকে এক সুতোয় গাঁথে? এক শব্দের যে উত্তরটি শোনা যাবে নিঃসন্দেহে সেটা অনুমান করা খুব কঠিন কিছু নয়। বাঙ্গালীর প্রাণের মেলা, নিজের ভেতরকার ‘আমি’ কে খুঁজে পাওয়ার মেলা,  বাঙ্গালিয়ানার মেলা- অমর একুশে বইমেলা।

বইমেলার চিন্তাটি প্রথম যার মাথায় আসে তিনি হলেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদদীন। ষাটের দশকে তিনি যখন বাংলা একাডেমিতে পরিচালক পদে ছিলেন, তখন বাংলা একাডেমি প্রচুর  বিদেশি বই সংগ্রহ করত। তিনি ‘Wonderful World of Books’ পড়তে গিয়ে ‘Book’ এবং ‘Fair’ শব্দ দুটি দেখে বেশ পুলকিত বোধ করেন। বইয়েরও যে মেলা হতে পারে, সেই চিন্তার শুরু সেখান থেকেই। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর নিচতলায় শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। ধারণা করা হয়ে থাকে, এটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বই মেলা। তারপর ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে সরদার জয়েনউদদীন বাংলা একডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজন করেন। তারপর থেকেই বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে বই মেলার যাত্রা শুরু। (তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ৩১শে জানুয়ারি, ২০১৪)

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে চলা এ উৎসবে  লেখক- পাঠক- সমালোচক সবাই মিলে-মিশে একাকার হয়ে যান। পৃথিবীতে আর কোনো বইমেলাই এত দিন ধরে চলে না। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে এটি পৃথিবীর দীর্ঘদিনব্যাপী আয়োজিত একটি বইমেলা। তবে এবারই প্রথম বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গন ছাড়াও সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে হচ্ছে বই মেলা। প্রতিবছর বইমেলায় লেখক পরিচিতিতে পুরাতন লেখকদের পাশাপাশি দেখা যায় অনেক নতুন ও তরুণ মুখকে। লেখালেখি জীবনে ব্লগ থেকে বইতে পা রেখেছেন যারা, তাদের ভাবনার জগত পাঠকদের সামনে উপস্থাপনের প্রয়াসে গত বছরের মত এবছরও সরব ব্লগে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, ‘বইয়ের ভুবন ও লেখককুঞ্জ’।

অপেক্ষায় থাকুন নতুন বইয়ের, অপেক্ষায় থাকুন নতুন সাহিত্যিকের…

বইমেলা হোক সরব, প্রাণের উৎসবে!

১) নিজের সম্পর্কে কিছু বলবেন?

খুব সাধারণ একজন মানুষ আমি। নিজের সম্পর্কে বলার মতো আসলে তেমন বিশেষ কিছু নেই। ছোটখাটো একটা কাজ করি। মেয়ের সাথে খুনসুটি করি। বই পড়তে, গান শুনতে, সিনেমা দেখতে, ঘোরাঘুরি আর আলসেমী করতে ভাল লাগে। রান্নাবান্না খুবই অপছন্দের কাজ কিন্তু রোজই প্রায় করতে হয়।

 

২) লেখালেখির সাথে সম্পর্কের শুরু হলো কী করে?

খুব ছোটবেলায় যখন কিন্ডারগার্টেনে ক খ টাইপ কিছু প্র্যাক্টিস করতাম, তখন বড় ক্লাশের বাচ্চারা স্কুল অ্যানুয়েল ফাংশানের জন্যে বের করা স্মরণিকাতে রঙীন ছবি এঁকে, কবিতা, গল্প লিখে স্কুলের সব গার্জেনদের মন জয় করে নিলো। আমি অংশগ্রহণ করতে না পেরে কিছুমাত্র মনক্ষুন্ন না হয়ে, উৎসাহিত হয়ে তাদের অনুকরণে ছড়া রচনা করলাম,

এই কাক তুই কালো,
তোকে দেখতে লালে ভাল।

এই টাইপ কিছু, এরপর থেমে থেমে ছড়া, গল্প লিখেছি আবার কিছুকাল শীতনিদ্রায় গেছি, অনেকদিন কিছু লিখিনি আবার হয়তো লিখেছি কিংবা লিখছি

 

৩) কেন লিখেন? লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

মন খারাপ থাকলে কখনো লিখি আবার মজা করেও লিখি কখনো কিছু। মন ভাল থাকলেও কখনো সখনো লিখি। কেন লিখি আসলেই জানি না। ইচ্ছে হয় তাই হয়তো কিংবা লিখতে ভাল লাগে তাও হতে পারে। ভেবে দেখিনি কেন লিখি। তবে অনেক বছর আগে চারপাশে ঘটে যাওয়া অসংগতি থেকে অনেক ক্ষোভ থেকেও লিখেছি।

শখের বশেই শখ নিয়ে মানে লেখা নিয়ে নাড়াচাড়া করি। তেমন কিছু এখনো ভাবিনি ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে। ভবিষ্যতই বলে দিবে গন্তব্য কোথায়

 

৪) লেখালেখির ক্ষেত্রে কোন অনুপ্রেরণা আছে কি? কাউকে কি অনুসরণ করেন?

আশাপূর্না দেবী, বানী বসু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, ঝুম্পা লাহিড়ী আমাকে অনেক টানেন। অনেক সহজ ভাষায় তারা জীবনের গল্প বলে যান। কাউকে অনুসরণ করে লিখি না নিজের মতোই লিখি। তবে গল্প তৈরী করার চেয়ে যা ঘটেছে তাই লিখতে ভালবাসি।

 

৫) অনেকের ধারনা এখন অধিকাংশ লেখকের লেখা একই প্যাটার্নের হয়ে থাকে, নতুনত্ব খুব কম পাওয়া যায় – আপনি কি এর সাথে একমত?

না, আমি এ ধারনার সাথে একমত নই। প্রত্যেকেই আলাদা বিষয় নিয়ে লিখেন, আলাদা প্ল্যাটফর্মে কাজ করেন, জীবন নিয়ে প্রত্যেকেই আলাদা দৃষ্টিভঙ্গী রাখেন। একই সময়কে উপস্থাপন করতে গিয়ে হয়তো কিছু কিছু ব্যাপার কমন আসতে পারে কিন্তু তাকে ঢালাওভাবে আমি বৈচিত্র্যহীন বলতে দ্বিমত পোষন করছি।

 

৬) নতুন লেখকদের বিষয়ে পাঠকদের মনোভাব কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

উচিত কিংবা অনুচিত শব্দগুলো অন্যের ব্যাপারে ব্যাবহার আমি দ্বিধা বোধ করি। কে কী করবে, পড়বে, ভাববে সেটা ঠিক করে দেয়ারতো আমি কেউ না। নতুন লেখক পুরাতন লেখক বলেও আসলে তেমন কিছু নেই। এটা একটা মার্কেট, এখানে বই একটা পন্য আর পাঠক একজন উপভোগকারী। বানিজ্যিক নিয়মের ব্যতায় হওয়ার তেমন কোন কারণ নেই আসলে। রুচিতে না মিললে আমি নতুন লিখছি বলেই একজন আমার বই সহৃদয় মনোভাব নিয়ে পড়বেন, আমি এটা ঠিক আশা করি না। বরং লেখকদেরই দায় বেশী এখানে, গুছিয়ে না লিখে সাত তাড়াতাড়ি বই ছাপানো নিয়ে ব্যস্ত না হওয়াই বরং ভালো।

 

৭) আপনি তো ব্লগে লিখেছেন এখনও লিখছেন। বই লেখা তো বেশ বড় পরিসরের ব্যাপার। একটি বই লেখার ক্ষেত্রে ব্লগে লেখার অভিজ্ঞতা কতোটুকু সহায়ক বলে আপনি মনে করেন?

আমি আসলে বই লেখার উদ্দেশ্য নিয়ে বই লিখিনি। প্রথম বইটিও বিভিন্ন সময়ে ব্লগে লেখা আমার বিভিন্ন গল্পের সংকলন। এই বইটিও প্রায় তাই। ব্লগের ধারাবাহিককে ঘষেমেজে বইয়ে রুপান্তর করা হয়েছে। আমার জীবনে ব্লগের প্রভাব অসামান্য। পাঠকদের আর বন্ধুদের তাৎক্ষণিক পাঠ প্রতিক্রিয়া, উৎসাহ, তাগাদা আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়।

 

৮) একজন ব্লগারের কি তার প্রতি কোন দায়বদ্ধতা আছে? থাকলে কতটুকু? বাংলা ব্লগে দায়বদ্ধতার কী রকম ছাপ দেখতে পান?

একটা মানুষের তার প্রতিটি কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকা দরকার। রান্না করা হোক কিংবা ব্লগ লেখা। কি লিখছি, কেন লিখছি, পাবলিক ফোরামে এটার কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে সম্পর্কে নিজের একটি পরিষ্কার ধারনা থাকা জরুরী। সমাজে দায়বদ্ধ মানুষরা যেমন আছেন দায়িত্বহীন মানুষও অনেক আছেন। আর ব্লগতো সমাজেরই একটি অঙ্গ।

 

৯) ব্লগ আসার পর মানুষ খুব বেশি ওয়েব-নির্ভর হয়ে গেছে, আগের মত বই কিনে পড়ে না – এ নিয়ে আপনার কী মতামত?

চিরকালের ব্যাপার বলে আসলে পৃথিবীতে কিছু নেই। সময়ের সাথে সব বদলায়। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা আর মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা মানুষকে অনেক বেশী ডিভাইস নির্ভর করে ফেলেছে। বই কিনে পড়ার ব্যাপারটাও পরিবর্তনের ধারার সাথেই কোথাও মিলে আবার নতুন কোন ফর্মে ফিরবে হয়তো।

 

১০) লেখার মধ্যমে নিজের চিন্তাগুলোকে আপনি পাঠকদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এই ব্যাপারটাকে আপনি ঠিক কীভাবে দেখেন?

আমি নিজেকে তেমন ইউনিক কিছু ভাবি না। আসলে সেভাবে নিজের চিন্তা ভাবনা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার মতো কিছু লিখিও না। ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা সবার সাথে সাদামাটা ভাষায় ভাগ করে নেই মাত্র। তাতে কেউ কাঁদেন, কেউ আবার রেগে যান আবার কারো মনে হয়, হয়তো কথাটা সত্যি। আমার নিজের অনুভূতি বলতে গেলে একটি গানের লাইন মনে আসে, আমিতো আমার গল্প বলেছি – ‘তুমি কেন কাঁদলে?’

 

১১) আপনার লেখা দ্বিতীয় বই এটি। প্রথম বই প্রকাশের পর পাঠকদের কেমন সাড়া পেয়েছিলেন?

আমার প্রথম বইটি প্রকাশ আর গনজাগরণ মঞ্চের জন্ম প্রায় একই সময়। সবাই আমরা এতো বেশী জাতীয় ইস্যুতে ব্যস্ত ছিলাম যে সেভাবে সেবার বইমেলা আর জমেনি। তবে আমার পরিচিত অনেকেই নিজের আগ্রহ থেকে বইটি সংগ্রহ করেছিলেন। সাংবাদিক বন্ধু শেরিফ আল সায়ার বইটির রিভিউ লিখে রকমারী ডট কম থেকে সেরা রিভিউ লেখার পুরস্কার জিতেছিলেন, যেটা আমাকে খুব আনন্দ দিয়েছিলো।

 

১২) আপনার নতুন প্রকাশিত বই সম্পর্কে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন? আপনার নতুন প্রকাশিত বই সম্পর্কে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?

নতুন প্রকাশিত বইটি আসলে বহুদিনের লেখা একটি ব্লগের সংকলন। উপন্যাস হিসেবে দাঁড় করাতে গিয়ে অবশ্য অনেকটাই পরিবর্তন পরিবর্ধন পরিমার্জন করা হয়েছে। এটা আসলে একটা মেয়ের নারী হয়ে ওঠার রোজ দিনের গল্প। যদিও গল্পটি বিদেশের পটভূমিতে লেখা, কিন্তু মেয়েদের এ সংগ্রাম চিরন্তন, দেশ কাল নির্বিশেষে। তবে প্রফেশন্যাল নয় নিজের আটপৌরে ভাষায় বই নিয়ে বলতে পারি, খুব সাধারণ একটা মেয়ের গল্প “দ্যা গার্ল নেক্সট ডোর।” এই গল্পে গল্প সুলভ কোন গল্প নেই, টুইষ্ট নেই, ক্ল্যাইমেক্স নেই, নেই কোন পরিণতি। সিনেমার নায়িকার মত কোন নায়িকাও নেই যার কোন অচেনা যুবকের সাথে দেখা হয়ে যাবে আর সব সমস্যা, দুঃখ একটা গানে অন্যদিকে পালটে বা ঘুচে যায়। তাহলে কী আছে?  আছে রোজ দিনের যুদ্ধ, টানা-পোড়ন, কষ্ট, কান্না, অভিমান যেমন সাধারণ মানুষের জীবনে থাকে।


বই: একদিন অহনার অভিবাসন
ধরন: উপন্যাস
লেখিকা: তানবীরা তালুকদার
প্রচ্ছদ: সব্যাসচী হাজরা
প্রকাশনী: শুদ্ধস্বর
স্টল নং: ৩৯, ৪০, ৪১
মূল্য: ২৮০ টাকা।

সাহিত্যস্বর সম্পর্কে

সরব বাংলাদেশে বই জনপ্রিয়করণের লক্ষ্যে কাজ করতে চায়। এই লক্ষ্যে আমরা নানান ধরনের কাজ করতে চাচ্ছি। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে একুশে বইমেলা ২০১২তে বিভিন্ন ব্লগারদের বই আমরা প্রোমোট করতে চাইছি। প্রতিদিন একজন করে ব্লগার/লেখক এর ইন্টারভিউ আমরা ছাপানোর পরিকল্পনা নিয়েছি।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বইপড়ুয়া, সাহিত্য-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

1 Response to বইয়ের ভুবন ও লেখককুঞ্জ(৫): তানবীরা তালুকদার

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    অভিনন্দন আপু।

    আমার জীবনে ব্লগের প্রভাব অসামান্য।
    শুনে ভালো লাগল! 😛

    নতুন লেখকদের প্রতি আলাদা কেয়ার/ যত্ন না নিলে কি আমাদের বর্তমান সিস্টেমে আসলে নতুনরা দাঁড়াতে পারবেন?
    রয়ালিটি পান না নতুনরা। তাঁদের বই এর বিজ্ঞাপন যায় না।
    এই দিকে বাংলাদেশের পাঠকরাও অনেক কম বই পড়েন।

    কেমনে কী?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।