যে অসুখে মানুষ অল্প বয়েসে বুড়িয়ে যায়: প্রোজেরিয়া!

অমিতাভ বাচ্চন ও অভিষেক বাচ্চন অভিনীত পা (paa) মুভিটি দেখলে প্রোজেরিয়া নামটির  সাথে পরিচয় থাকার কথা। প্রোজেরিয়া সম্পর্কে প্রথম ধরণা দেয়া দুই বিজ্ঞানী জনাথন হাচিনসন এবং হ্যাস্টিং গিলফোর্ডের নাম অনুসারে একে হাচিনসন-গিলফোর্ড প্রোজেরিয়া সিনড্রোমও (Hutchinson–Gilford Progeria Syndrome) বলা হয়ে থাকে। প্রোজেরিয়া শব্দের উৎপত্তি হয়েছে দুটি গ্রিক শব্দের সমন্বয়ে: গ্রিক শব্দ প্রো(Pro) যার মানে আগে (Premature) এবং জেরাস (Gēras) যার মানে বার্ধক্য(Old age)। লেখার শিরোনামের সাথে যা একেবারে  মিলে যায়— যে অসুখে মানুষ অল্প বয়েসে বুড়িয়ে যায়।

প্রোজেরিয়া একধরণের বিরল জিনঘটিত রোগ (Rare Genetic Disorder) যার ফলে আক্রান্ত শিশু অল্প বয়সেই বুড়ো হয়ে যায়। রোগটি এতোই বিরল যে গড়ে প্রতি আট মিলিয়েন শিশুর  মাঝে মাত্র একজন প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত শিশু খুঁজে পাওয়া যায়। প্রোজেরিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশন (Progeria Research Foundation) মতে, এখন পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে প্রোজেরিয়া সংক্রান্ত মাত্র ৩৫০ টি কেইস খুঁজে পাওয়া গিয়েছে!

প্রজেরিয়ার কথা বললে ‘প্রিম্যাচিউর এজিং’ শব্দ দুটি চলে আসে। অন্যান্য শিশুর মত স্বাভাবিকভাবে জন্ম নিলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে লক্ষণগুলো দৃষ্টিগোচর হয়। শুরুর দিকে  যে লক্ষণটি দেখা যায় সেটি হল- আক্রান্ত শিশুর ওজন বৃদ্ধির মন্থর গতি। যেটাকে ফেইলুর টু থ্রিভ (Failure to thrive) বলে হয়ে থকে। ১৮ থেকে ২৪ মাস বয়েসে অন্যান্য লক্ষণগুলো আস্তে-আস্তে প্রকাশিত হতে থাকে। আক্রান্ত শিশুর চেহারায় বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায়, যেমনঃ বড় চোখ (Prominent eyes), সরু নাক, ছোট চিবুক, শীর্ণ ঠোঁট ইত্যাদি। তাছাড়াও আক্রান্ত শিশুর চুল পড়ে যায় যেটিকে আমরা টাক(Alopecia) বলে থাকি। তবে ‘প্রিম্যাচিউর এজিং’ টার্মটির সাথে যে লক্ষণটি সবেচেয়ে জড়িত তা হল- চামড়ায় ভাঁজ পড়া। প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত ৫ বছরের শিশুর ত্বকে ৭০ বছরের বৃদ্ধের মতই ভাঁজ পড়ে যায়।


এতো গেল বাহ্যিক লক্ষণের কথা। আক্রান্ত শিশু পরবর্তীতে আর্টেরিওস্ক্লেরোসিস (Arteriosclerosis), কার্ডিওভাস্কুলার প্রবলেম (Cardiovascular problem), দৃষ্টিহীনতা (Loss of  eyesight), স্ক্লেরোডার্মা (Scleroderma) ইত্যাদিতে ভুগে থাকে।

প্রথমেই বলেছিলাম, এটি এক ধরণের জিনগঠিত রোগ (Genetic disorder) যেটা মূলত হয়ে থাকে একটি পয়েন্ট মিউটেশনের (Point mutation) জন্য। মিউটেশন (Mutation) শব্দের আভিধানিক অর্থ পরিব্যাপ্তি অথবা পরিবর্তন। জেনেটিক মিউটেশন ঘটে থাকে জিনে। সংক্ষেপে বললে, আমাদের ডিএনএ যে নিউক্লিউটাইড সিকুয়েন্স নিয়ে ঘটিত, তাতে ক্ষুদ্র কোন পরিবর্তন। ২০০৩ সালে আবিষ্কৃত হয়, LMNA  জিনের নিউক্লিউটাইড সিকুয়েন্সের ১৮২৪ নাম্বার পজিশনে একটি পয়েন্ট মিউটেশনের কারণে প্রোজেরিয়া হয়ে থাকে। যার ফলে আক্রান্ত শিশুর দেহে Lamin-A  নামক প্রোটিনের অস্বাভাবিক রূপ(Abnormal version) দেখা যায়, যেটিকে প্রোজেরিন প্রোটিন (Progerin-protein) বলা হয়। যার ফলে কোষের নিউক্লিয়াসের পর্দার(Nuclear envelope) গঠন দুর্বল হয়ে যায় ফলশ্রুতিতে নিউক্লিয়াসের ক্ষতিসাধিত হয়, কোষের বিভাজন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং গড় আয়ুর অনেক আগেই কোষ মারা যায় (Premature cell death)

প্রোজেরিয়ার ক্ষেত্রে কোন চিকিৎসাই তেমন ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয় নি। স্থায়ী কোন চিকিৎসা নেই, তবে কার্ডিওভাস্কুলার সমস্যাকে ফোকাসে রেখে বেশ কিছু ট্রিটমেন্ট দেয়া রয়েছে যেমনঃ করোনারি আর্টেরি বাইপাস সার্জারি, লো ডোজ অ্যাসপিরিন প্রয়োগ ইত্যাদি।
তাছাড়া গ্রোথ হরমোন ট্রিটমেন্ট (Growth hormone treatment), প্রোভ্যাস্টিন (Provastin), রাপামাইসিন (Rapamycin), ফার্নেসাইল ট্রান্সফারেজ ইনহিভিটর (Farnesyl Transferase Inhibitor) সহ কিছু ড্রাগ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তবে এগুলো কেবল কিছু সমস্যার সাময়িক সমাধানই দিয়ে থাকে। একজন প্রোজেরিয়া আক্রান্ত শিশুর গড় আয়ু মাত্র ১৩ বছর!

শেষ করব স্যাম বার্ন নামের একজন অসাধারণ কিশোর নিয়ে কিছু কথা বলে। বাবা স্কট  বার্নস এবং মা লেসলি গর্ডন দুজনই পেশায় দু’জনই ডাক্তার। মাত্র দু’বছর বয়সে স্যামের প্রোজেরিয়া সনাক্ত হলে স্যামের মা-বাবা দুজনই প্রোজেরিয়া নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। গড়ে তোলেন প্রোজেরিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশন(Progeria Research Foundation) নামের প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৩ সালে লেসলি গর্ডনের নেতৃত্বে এই প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রোজেরিয়ার জিন আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু বাবা-মা, প্রোজেরিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশনের বিজ্ঞানীদের সুদীর্ঘ চৌদ্দ বছেরের নিরলস গবেষণাও বাঁচাতে পারে নি স্যামকে। চলতি বছরের চৌদ্দই জানুয়ারি সতের বছর বয়েসে মারা যায় স্যাম। গত বছর টেড কনফারেন্সে (Ted Conference) স্যামের দেয়া স্পিচের কিছু কথা নিচে তুলে দিলাম-

No matter what problems we are facing, There is always room for happiness in life. I didn’t put myself in front of you to have you feel bad for me. You don’t need to feel bad for me because it is my life…
For me there is three aspects of happy life-

1) Be OK with what you ultimately can’t do, because there is so much you CAN do.
2) Surround yourself with people you want to be surround.

3) Keep moving forward if you can help it.” 

টেড কনফারেন্সে দেয়া স্পীচের ভিডিও লিঙ্ক- এখানে

বিরল জিনঘটিত প্রোজেরিয়া স্যামকে শারীরিকভাবে বুড়িয়ে দিলেও কিশোর, সজীব মনটিতে তার এতটুকু আঁচ লাগাতে পারে নি। স্যামের বাবা-মা, প্রোজেরিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সেদিন হয়তো খুব বেশি দূরে নয় যেদিন প্রোজেরিয়াকে মানুষ জয় করতে পারবে। আর কোন স্যামকে অকালে চলে যেতে হবে না। মারা গেলেও স্যাম প্রোজেরিয়াকে জয় করতে পেরেছিল; জীবনের অর্থটা ঠিকই স্যাম বুঝেছিল।

বাবা স্কট বার্নস এবং মা লেসলি গর্ডনের সাথে স্যাম

অনিমেষ ধ্রুব সম্পর্কে

"You've gotta dance like there's nobody watching, Love like you'll never be hurt, Sing like there's nobody listening, And live like it's heaven on.'' অসম্ভব পছন্দ উইলিয়াম পার্কারের এই কথাগুলো! নিজের মত করেই নিজের পৃথিবীটা কল্পনা করে নিতে ভাল লাগে। ঔদাসিন্য,অলসতা শব্দ দুটি আমার সাথে বনে যায়। গভীর মনোযোগ কিংবা অসম্ভব সিরিয়াস মুড আমার কখনোই আসে না। একা অচেনা রাস্তায় অকারণে হাঁটতে ভালো লাগে, মানুষ দেখতে ভালো লাগে, ভাল লাগে কবিতা লিখতে...তবে স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখি আমার চারপাশে থাকা মানুষগুলোর জন্য কিছু একটা করার, দেশকে কিছু একটা দেয়ার। পারব কি-না জানি না, তবুও স্বপ্ন বুনে চলেছি নিরন্তর... http://www.facebook.com/kamrul.h.hridoy.3
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুপ্রেরণা, ইতিবাচক, সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

5 Responses to যে অসুখে মানুষ অল্প বয়েসে বুড়িয়ে যায়: প্রোজেরিয়া!

  1. সামিরা বলেছেনঃ

    হৃদয়ের লেখা ভালো হচ্ছে দিনকে দিন! অনেক কিছু জানলাম পড়ে। চালিয়ে যাও!

    টাইপো:
    *জিনঘটিত

    স্পীচের ইংরেজি অংশটা বাংলায় পড়তে একটু কষ্ট হলো। ইংরেজিতে তুলে দিলে বা বাংলায় অনুবাদ করে দিলে দারুণ হত কিন্তু! 😀

  2. শারমিন বলেছেনঃ

    ”বি ওকে হোয়াট ইউ আলটিমেটলি কান্ট ডু বিকজ দেয়ার ইজ সো মাচ ইউ ক্যান ডু।
    সারাউন্ড ইউরসেলফ উইথ পিপল ইউ ওয়ান্ট টু বি অ্যারাউন্ড।
    কিপ মুভিং ফরওয়ার্ড ইফ ইউ ক্যান হেল্প ইট।’

    কথাগুলো সুন্দর
    স্যাম হয়ত জীবনের অর্থ সত্যি বুঝতে পেরেছিল

    ইনফরমেটিভ এবং সুন্দর লিখা 🙂

  3. অক্ষর বলেছেনঃ

    মারাত্মক সুন্দর লেখা হৃদয় ভাই। অনেক ইনফরমেটিভ আর সাবলীল লেখা। :love:

    চালিয়ে যা :happy:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।