ভ্রম

সুটকেসটা গোছানো শেষ হতেই লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো দিশা। উদাস দৃষ্টিতে জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রাখলো সে। কোনো পিছুটান থাকার কথা নয়। তবু খারাপ লাগছে। নিজের অজান্তেই এই বাসাটার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছে কি? যদিও এরকম কিছু মনে পড়ে না তবু আজ মায়া মায়া লাগছে। মায়া মায়া নাকি মন খারাপ? আজকাল মনের মধ্যে সারাক্ষণ কথা চলতে থাকে। অসংখ্য কথা। কথারও যে শাখা প্রশাখা আছে আগে সে জানতো না। আজ জানে কথারও শেকড় থাকে, আর থাকে শাখা। জানলার বাইরে সেই একচিলতে আকাশ। আকাশ দেখতে কখনো একঘেয়ে লাগে না এটা সে আগেও খেয়াল করেছে। সন্ধ্যার হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে আকাশটা মন খারাপ করা সুন্দর রূপ নেয়। বেশি সুন্দর প্রকৃতি কোনো এক অজানা কারণে মনটা খারাপ করে দেয় সবসময়। তাই দিশা এই অনুভূতির নাম দিয়েছে মন খারাপ করা সুন্দর। গত পাঁচটা মাস এই জানলার পাশে বসে আনমনে আকাশ দেখেই যেন কেটে গেলো। এরকম মনে হচ্ছে আজকে। অথচ কথাটা সত্যি নয়। গত পাঁচ মাসে তার জীবনে একটা বড়োসড়ো ঝড় বয়ে গেছে। সেই ঝড়ে তছনছ হয়ে গেছে সবকিছু। ঝড় শেষে নিঃশেষিত দিশা থেকে গেছে এমনি চুপচাপ, ভেতরে ভেতরে সে পুরোপুরি উলটপালট হয়ে গেছে সেটা কেউ জানে না।

এই বাসাটায় সে আছে সাত মাস ধরে। প্রথম দিন থেকেই বাসাটা তার একটুও ভালো লাগে নি। অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে এই বাসাটাকে এখন তো তার অশুভ বলেই মনে হয়। তার জীবনে যা হয়ে গেলো তার জন্য বাসাটাকেও দোষ দিতে ইচ্ছে করে। মানুষ বোধয় কারণ খুঁজে না পেলে অথবা নির্মম সত্যটা মেনে নিতে না চাইলে এরকম করে। অশুভ মনে হওয়া সত্ত্বেও আজ এই বাসাটার দেয়ালগুলো পর্যন্ত অদ্ভুত মায়া নিয়ে যেন তার দিকে চেয়ে আছে। দিশা হঠাৎ চোখ বন্ধ করে ফেললো। এই পাঁচটা মাস ধরে রোজ বেশ কয়েকবার সে এই কাজটা করে আসছে। চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে চোখ খোলা মাত্রই দেখবে সব আগের মতো হয়ে গেছে। সে আর সাজ্জাদ আগের মতোই সুখে আছে। খুব ভালো আছে একসাথে এমনকি এই অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে বাসাটাতেও। কিন্তু চোখ খুললে সেসব কিছুই হয় না। কিচ্ছু না। চোখ খুললেই একের পর এক ছবি ভাসতে থাকে চোখের মধ্যে। সুখের ছবি, দুঃখের ছবি। এই তো সেদিনের কথা, মাত্র পাঁচ বছর আগে সাজ্জাদের সাথে তার বিয়ে হয়। পরিচয় হয়েছিলো ফেইসবুকে, তারপর ঘনিষ্ঠ হতে বেশি সময় লাগে নি। পরিচয়ের ছয় মাসের মাথায় সাজ্জাদ যখন তাকে ভালোবাসার কথা জানায় তখন সায় দেয়া ছাড়া আর অন্য কথা ভাবতে পারে নি সে। সাজ্জাদের কণ্ঠে ‘ভালোবাসি’ কথাটা শোনার সাথে সাথে কানের মধ্যে গরম একটা অনুভূতি হচ্ছিলো, বুক ধুকধুক করছিলো দিশার। এখনো যে কোনো সময় চোখ বন্ধ করে সেই অনুভূতিটা ভাবার চেষ্টা করলেই সেটা আরেকবার যাপন করার সুযোগ পেয়ে যায় সে। খুব সাদাসিধে মেয়ে দিশা। চোখে ছিলো ছোট্ট একটা সংসারের স্বপ্ন, ছিমছাম আর সুখি। খুব বেশি দেরি করে নি সে। মাত্র দুবছরের মাথায় সাজ্জাদকে বিয়ে করে সংসারি হয়ে গেলো। প্রেম করে বিয়ে। দিশা কিংবা সাজ্জাদের পরিবার প্রথমে ব্যাপারটা সহজভাবে না নিলেও খুব দ্রুত পরিস্থিতি সহজ হয়ে আসে। বিয়ের পরের দুবছর সুখের ভেলায় ভেসে ভেসে কেটে গেছে দিশার। জীবন এতো সুন্দর হয়! সংসার করার স্বপ্ন এমনভাবে জেঁকে বসে তার ভেতর যে সে আর অন্য কিছু ভাবতে পারে না। মাস্টার্স শেষ হলে চাকরিও খুঁজতে যায় নি সে বরং সংসারে মনোযোগী হয়, সাজ্জাদও এটাই চাইছিলো। আজও অধিকাংশ বাঙালি ছেলে চায় না ঘরের বউ বাইরে কাজ করুক। দিশা অবশ্য এখন মনে প্রাণে চায় তার একটা চাকরি হোক। যে কোনো একটা চাকরি, আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার মতো একটা কাজ।

মানুষ কতো দ্রুতই না পাল্টে যায়। একটা মানুষের কয়টা রূপ হয়? কয়টা? আজকাল কোনো কিছুই সহজভাবে ভাবতে পারে না দিশা। সাজ্জাদ এতো দ্রুত পাল্টে গেলো… এই মানুষটা তাকে কী ভীষণ ভালোই না বাসতো! বিয়ের তিন বছরের মাথায় দিশা জানতে পারে সে কখনো মা হতে পারবে না। সেই থেকে সাজ্জাদ একটু একটু করে বদলে গেলো। কোনো ডাক্তার দেখিয়ে যখন কাজ হলো না তখন দিশা একটা বাচ্চা দত্তক নিতে চেয়েছিলো। সাজ্জাদ রাজি হয় নি। সে নিজের একটা বাচ্চা চায়। কথাটা শুনে দিশা একদম চুপ করে গেছে। নিজেকে খুব অপরাধি মনে হয় তার। এখন অবশ্য অপরাধি নয়, অসহায় মনে হয়। পাঁচ মাস আগেই সাজ্জাদ জানিয়েছে সে আরেকটা বিয়ে করতে যাচ্ছে। দিশা তখনো চুপ ছিলো। কী বলতে পারতো সে! সেও চায় সাজ্জাদ ভালো থাকুক। তার বুকটা ভেঙে গেছিলো সবসময় পাশে থাকার প্রতিজ্ঞার কথা ভেবে। কতো রাত জেগে কাটিয়েছে ওরা… কতো ভালো সময় কাটিয়েছে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে। ভালোবাসার কথাগুলো সব মিথ্যে হয়ে গেলো। সাজ্জাদ সবসময় দিশাকে বলতো ‘আমি তোমাকে সবচাইতে বেশি ভালোবাসি’। শুনে দিশা আনন্দে মুখ বাঁকাতো আর বলতো ‘উঁহু, আমি’!

কোনো ঝামেলা করে নি দিশা। চুপচাপ সরে যাচ্ছে সাজ্জাদের জীবন থেকে। গত রাতে ডিভোর্স পেপারেও সাইন করেছে চুপচাপ। দ্বিধান্বিত মুখে কাগজগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো সাজ্জাদ। দিশা একটা কথাও বলে নি। বলে নি বলেই সাজ্জাদের ভেতরের অস্বস্তি বাড়ছিলো। সে মাথা নিচু করে বললো ‘আমাকে ক্ষমা করো দিশা’। দিশা কিছু বলে নি, কোনো রকমে মাথাটা নেড়েছিলো শুধু। সাজ্জাদকে মুখ নিচু করে বসে থাকতে দেখতে তার একটুও ভালো লাগে না। কিন্তু ক্ষমা সে করতে পারবে না। সাজ্জাদ কি তাকে ভালোবেসে একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে না তার সাথে? এসব কি শুধুই গল্প উপন্যাসে হয়? নাহ, সে কখনো সাজ্জাদকে ক্ষমা করবে না। কিন্তু মুখ ফুটে কথাটা বললো না দিশা। কথা বললেই ভেতরের দমিয়ে রাখা কান্নাটাও মুক্তি পেতে চাইতো। এই মানুষটার সামনে সে আর কাঁদতে চায় না। হাসিমুখে তার জীবন থেকে সরে যাবে। মানুষটা ভালো থাকুক। দিশাও খারাপ থাকবে না তার একাকিত্ব আর কষ্টগুলো নিয়ে।

গুছিয়ে রাখা সুটকেসটার দিকে চেয়ে দিশা ভাবতে থাকে সবকিছু গোছানো হলো কিনা। পরদিন সকালে সে তার ভাইয়ের বাসায় চলে যাবে। একটা চাকরি পেলেই নিজের মতো করে অন্য কোথাও থাকবে। ভাই-ভাবির সাথে থাকেন বৃদ্ধা মা। মা প্রায়ই বলেন ‘বোঝা হয়ে আছি’। কেনো বলেন আজ বুঝতে পারছে দিশা। ভাইয়ের বাসায় কতোদিন থাকতে হতে পারে সে জানে না। চাকরি পাওয়া অনেক মুশকিল হয়ে উঠেছে। তারুপর ছয় বছর আগে পড়ালেখার সাথে তার সমস্ত সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। অনেক কিছুই মনে নেই। কেমন একটা জড়তা তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে ভালো হয় কোনো একটা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেলে। চাকরিও করা হবে, বাচ্চাদের কাছাকাছিও থাকা হবে। ভাবতে ভাবতে চোখের কোণে কখন জল জমেছে সে নিজেও টের পায় নি। এর মধ্যেই আত্মীয় স্বজনরা নানান কথা বলতে শুরু করেছে জেনে-না জেনে। সেসব দিশা এড়িয়ে গেলেও সমবেদনা মেশানো খোঁচাগুলো কিছুতেই সহ্য হতে চায় না তার। ডিভোর্সি একটা মেয়েকে সমাজ কখনোই ভালো চোখে দেখে না। কিন্তু নিজের জীবনটাই হঠাৎ এরকম হয়ে যাবে এমনটা কখনো দুঃস্বপ্নেও ভাবে নি সে। আমরা সমাজ তৈরি করেছিলাম কোনো এক সময়। এখন সমাজ আমাদের তৈরি করছে। ভাবতেই দিশা চমকে উঠে। সে কি দার্শনিক হয়ে যাচ্ছে? নাকি পাগল হয়ে যাচ্ছে? নাহয় এরকম কথা কেনো আসে তার মাথায়!

সাজ্জাদ তাকে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলো। নেয় নি দিশা। সাজ্জাদকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে তাকে নিয়ে চিন্তা না করতে, তার ব্যবস্থা সে নিজে করে নিবে। কথাটা জোরগলায় বললেও ভেতরে ভেতরে দিশেহারা সে। জীবন যে হঠাৎ এইভাবে মোড় নিলো, সে কি পারবে সামলে নিতে? পরক্ষনেই ভেতর থেকে কেউ বলে ওঠে ‘পারবেই’! জানলা দিকে বাইরে তাকায় দিশা। রাত হয়ে গেছে। ইদানিং রাত হলেই বড্ড একলা লাগে। ভীষণ একা যেন সে, ভীষণ ক্ষুদ্র এই বিশাল পৃথিবীতে! আবারও চোখ বন্ধ করে ফেলে দিশা। ইস, চোখ খুললেই যদি সব ভ্রম হয়ে যেতো!

ফারাহ্‌ মাহমুদ সম্পর্কে

অবিদিত, জানো কি? বুকের মধ্যে জল তরঙ্গ নিয়ে মানুষ হয়ে জন্ম নেয়া পাপ! অবিদিত, জানো কি? অনুরাগ এক প্রকার সুখকর বিভ্রান্তি..
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, সাহিত্য-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

4 Responses to ভ্রম

  1. ইকু বলেছেনঃ

    বাস্তব জীবন টা কেমন জানি !! ঠিক বুঝে ওঠা যায়না … 🙁
    খুব ভালো লাগলো গল্প টা, ঠিক তার সাথে সাথে মন টাও অনেক খারাপ হয়ে গেলো।

    আমার বাবার এক বন্ধু আছেন আমাদের বাড়ির তিন তলায় থাকেন।স্বামী-স্ত্রী দুইজন একদম একা একা থাকেন। এই গল্প টির মতই উনার ওয়াইফ এর সন্তান হবেনা জানার পরেও এক জীবন ভালবেসে কি সুন্দর কাটিয়ে দিলেন। এই দুই জন কে দেখলে আমার খুবি ভালো লাগে। ভালোবাসা আসলে এমন নিঃস্বার্থ ই হওয়া উচিৎ।

    কিন্তু উচিৎ কাজ টা আমাদের সমাজে চরম বাস্তবতা কে সামনে রেখে আমরা কয়জন ই বা ভালো ভাবে করতে পারি। 🙁

  2. তুসিন বলেছেনঃ

    মন খারাপ করা গল্প। 🙁
    তবে ভাল লেগেছে। আমাদের চারপাশের বাস্তবতা েএমনই হয়ে থাকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।