বিদেশে উচ্চশিক্ষা: হিটলারের জার্মানিতে

ক’দিন আগে সদ্য আয়ারল্যান্ড থেকে পড়াশোনা শেষে দিশে ফিরে আসা এক বড় ভাইয়ার সাথে কথা হচ্ছিল বিদেশে উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে। এইচএসসি পরীক্ষার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হতে না পেরে তীব্র হতাশায় প্রায় ভেঙ্গেই পড়েছিলেন। তখন আঙ্কেল অনেকটা জোড় করেই তাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর… গত বারো বছরে দেশে আসবার সুযোগ হয়নি। টাকার অভাবে ১৬ দিনেও দেশে একটা ফোন করে স্বজনদের সাথে কথা বলতে পারেন নি। কিন্তু এখন যখন তিনি দেশে ফিরে এসেছেন, তার নাম উচ্চারণ করবার আগে আরেকটি শব্দ যোগ করে নিতে হয়, ডক্টর! তিনি এখন National University of Ireland এর একজন সহযোগী অধ্যাপক!

আমি নিজেও ইদানীং বিদেশে উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে কিছুটা আগ্রহী হয়ে উঠেছি। সেই জের ধরেই আরো অনেক কথা হল। কথাপ্রসঙ্গে জানা হল অনেক কিছুই। ভাইয়াদের সময়ে দেশে ইন্টারনেটের অবস্থা এখনকার মত ভাল ছিল না মোটেও। অনেক কষ্টে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে তথ্য জোগাড় করতে হত, তার সাথে দালাল/ভুয়া অ্যাজেন্সির দৈরাত্ম তো ছিলই।

ভাইয়ার কথা থেকে বুঝলাম, এখনকার সময়ে আমাদের ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে অনেক, ছেলেপিলে সারাদিনই এখন ইন্টারনেটে ডুবে থাকে। তথ্য যোগাড় করা এখন অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হল, এত এত সুযোগ থাকার পরও প্রয়োজনীয় আর নির্ভুল তথ্য আর প্রয়োজনীয় গাইডেন্সের অভাবটা বড্ড প্রকট! আবার যারা সত্য ব্যাপারগুলো জানেন, জানেন বিদেশে উচ্চশিক্ষার পথে পা বাড়াবার আগে কী কী বিষয়ে সজাগ হওয়া দরকার, তাদের অত সময় কোথায় অন্যদের সামান্য উপকারটুকু করার! সেই প্রেক্ষিতেই এই লেখাটি নিয়ে কিবোর্ডে আমার হাত চালানো…

চেষ্টা করব ধাপে ধাপে উচ্চশিক্ষার জন্যে বিদেশে গমনেচ্ছু বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের পছন্দের দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া এবং শিক্ষার্থীদের FAQ গুলোর উত্তর নিয়ে সাজাতে এবং অবশ্যই কোন গম্ভীর, ভারিক্কি চালের ভাষায় নয়! একটা ব্যাপার এখানে বলে রাখা দরকার, বিদেশে উচ্চশিক্ষা মানে দেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে তারপর আরও উচ্চ কিছুর জন্য বিদেশ যাত্রা। অনেকেই যথাযোগ্য যোগ্যতা না নিয়ে বিদেশ যান, ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসেন দেশে! সেই ক্ষেত্রে এদের অসফলতার দায়ভার তাদের নিজেরই। উচ্চ শিক্ষার জন্যে বিদেশে যাবার উদ্যোগটিকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করতে তাই বাস্তবসম্মত ও নিখুঁত পরিকল্পনা কোনো বিকল্প নেই।

প্রথম পর্বে জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে আলোকপাত করবার চেষ্টা করব আমি…

ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানি, পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধশালী একটি দেশ। শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প, সংস্কৃতি, অর্থনীতি – প্রায় সবদিক থেকে জার্মানি খুবই উন্নত একটি দেশ। প্রকৌশলীদের জন্য তীর্থ স্থান বলা হয় জার্মানিকে! দীর্ঘকাল আগে থেকেই স্বল্প খরচে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। ১৩৮৬ সালে হেডেলবার্গে জার্মানদের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলেও বর্তমানে প্রায় ৩ শতাধিক আধুনিক ও উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে জার্মানিতে। উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে গমনেচ্ছু বাংলাদেশীদের পছন্দের তালিকায় এই দেশটি রয়েছে বেশ উপরের দিকেই। উচ্চ মানসম্পন্ন শিক্ষা, টিউশান ফি না থাকা, পরিপাটি জীবনযাত্রা – এসব কারণেই সম্ভবত আমাদের পছন্দের তালিকায় এই দেশটির এত উচ্চ স্থান। উচ্চশিক্ষার জন্যে যদি কেউ জার্মানিতে যেতে আগ্রহী হন, এটি নিঃসন্দেহে একটি ভাল উদ্যোগ ।  কিন্তু জার্মানিতে স্টুডেন্ট ভিসা পাবার ক্ষেত্রে ভেজাল তথ্যের পরিমাণটা মনে হয় একটু বেশীই বেশী!


শিক্ষাব্যবস্থা:
জার্মানিতে ব্যাচেলার্স, মাস্টার্স, ডক্টোরাল ও পোস্ট-ডক্টোরাল ডিগ্রি দেওয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়া ডিপ্লোমা করারও ব্যবস্থা রয়েছে। জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত বছরে দু’টি সেমিস্টারে ভর্তির সুযোগ থাকে – গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন।

এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রীষ্মকালীন ও অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত শীতকালীন সেমিস্টারে ভর্তি করা হয়।

ব্যাচেলার ডিগ্রির জন্য মেয়াদ চার বছর (কিছু ক্ষেত্রে তিন বছর) ও মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য এক থেকে দুই বছর পড়াশোনা করতে হয়।

জার্মানিতে আপনি যে সাবজেক্টেই পড়াশোনা করুন না কেন, সেটাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে পাঠদান করা হয় – লেকচার, এক্সারসাইজ, সেমিনার ও ল্যাব। এখানে একটা ব্যাপার হল, জার্মানিতে থিওরেটিক্যাল পড়াশোনা অনেক কম হয়। এখানে প্র্যাক্টিক্যাল পড়াশোনার পরিমাণই বেশী। আর একটা ব্যাপার হল, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পড়াশোনার ভাষা সম্পূর্ণ জার্মান ভাষায়।


ভর্তির যোগ্যতা: 
বলে রাখি, জার্মানিতে পড়াশোনার মাধ্যম মূলত জার্মান। তাই জার্মান ভাষায় দক্ষতা এখানে পড়াশোনার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের দেশ থেকে HSC বা সমমানের পরীক্ষায় সকল বিষয়ে কমপক্ষে বি গ্রেড সহ যাদের GPA 3.50 বা তার চাইতে বেশী আছে, তারা জার্মান ভাষায় BSc পড়বার জন্যে প্রাথমিকভাবে যোগ্য বলে ধরে নেয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশের ১২ বছরের শিক্ষাজীবন শেষে HSC বা তার সমমানের একটা সার্টিফিকেটেই যোগ্যতার পরীক্ষা শেষ হয়ে যায় না। জার্মানিতে পড়তে যাবার আগে টেস্ট-ডাফ পরীক্ষা (অথবা সমমানের সার্টিফিকেট পরীক্ষা, যেমন  DSH) এবং   স্টুডেন্টকলিগ  পাস করতে হবে। ইংরেজিতে IELTS বা TOEFL পরীক্ষার মত টেস্ট-ডাফ বা DSH  হল জার্মান ভাষাজ্ঞানের উপর একটা পরীক্ষা। আর স্টুডেন্টকলিগ পরীক্ষাও অনেকাংশে সেরকমই, এখানে  ভাষা শেখার শেষে একটা এসেসমেন্ট টেস্ট দিতে হয়, শুধুমাত্র এই পরীক্ষায় যারা পাশ করবে তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে চূড়ান্তভাবে যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। সাধারণত দেখা যায়, আমাদের শিক্ষার্থীদের স্টুডেন্টকলিগ শেষ করতে একটু বেশী সময় লাগে, অনেকের ক্ষেত্রে ২/৩ বছরও লেগে যায়। আগে থেকেই যারা দেশে জার্মান ভাষার চর্চা করে আসে, তাদের সময় বেশ কম লাগে, ১ বছরের মাঝেই উৎরে যেতে পারেন।

ইংরেজিতে ব্যাচেলর করতে চাইলে DSH পরীক্ষা দিতে হবে না,  শুধু স্টুডেন্টকলিগ পাশ করতে হবে। আর অল্পকিছু যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে পড়ানো হয়, সেখানে IELTS বা TOEFL স্কোর দেখাতে হয়। TOEFL স্কোর ২১৩ বা  ৮১ (IBT) এবং IELTS স্কোর ৬..০ (প্রতিটি ব্যান্ডে ৫.৫ এর চাইতে বেশী) থাকতে হয়।

মাস্টার্সের জন্যে কমপক্ষে ১ বছর জার্মান ভাষাচর্চা ও ন্যূনতম ১৫ বছরের সফল শিক্ষা জীবনের প্রমাণপত্র থাকতে হবে। এদের জন্যেও টেস্ট-ডাফ বা DSH পরীক্ষা দিতে হবে। তবে গোথি ইন্সটিটিউট ভাষাচর্চায় থেকে সি১ লেভেল পর্যন্ত কমপ্লিট হলে, এই পরীক্ষা দিতে হবে না। মাস্টার্স আর পিএইচডি’র জন্যে ভাষা দক্ষতার যোগ্যতা সমান। তবে মাস্টার্স না করেও অনার্সে ভাল পারফরমেন্স থাকলে সরাসরি পিএইচডি শুরু করা যায়। স্ট্যাডি গ্যাপ কোন সমস্যা নয়। এই ব্যাপারে এই লিঙ্কটা সাহায্য করবে বলে আশা করি।

বেশীরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাওয়া যোগ্যতা মোটামুটি একই হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকে। অনেক সময় ভর্তির জন্য কিছু কিছু বিশেষ যোগ্যতার প্রয়োজন হয় চায়, সেটা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে  দেখে নেয়া যেতে পারে।


ভাষাগত দক্ষতা:
জার্মানিতে সফল হবার পেছনে মূল চাবিকাঠি হল জার্মান ভাষায় দক্ষতা আর দীর্ঘ সময় ধরে নিজের মোটিভেশন ধরে রাখা। জার্মান ভাষা না জানলে জার্মানিতে গিয়ে প্রতি পদে পদে হোঁচট খেতে হবে। অনেকেই ডাডে পছন্দের বিষয় খুঁজে পান না, এই সমস্যার মূল কারণ, শুধুমাত্র ইংরেজিতে কোর্স খোঁজা। সহজ করে বলি, ডাড সাইটে একটু ঘাটাঘাটি করলে দেখা যাবে, জার্মানিতে সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে মোট ১৬,৪০৮ টি কোর্স অফার করে। এর মাঝে কেবল ৯২২টি কোর্স ইংরেজিতে অফার করা হয়, যার অধিকাংশই শুধুমাত্র মাস্টার্স লেভেলে। অর্থাৎ, কেবল জার্মান ভাষা না শেখার কারণে প্রায় ৯৫ ভাগ কোর্সই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ভাষা শিক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্যে গোথি ইন্সটিটিউটে যোগযোগ করতে পারেন।


কোর্স খোঁজা:
বাইরের একটা দেশে উচ্চশিক্ষার জন্যে পা বাড়াবার আগে কোন ইন্সটিটিউটে কোন কোর্সটি নিয়ে পড়তে যাচ্ছেন, সে সম্বন্ধে ভালভাবে জানা-বোঝাটা খুব দরকার। এখানে ইন্সটিটিউট সম্পর্কে বলতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং নিয়ে মাথা ঘামানোর তেমন কোন প্রয়োজন নেই। প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ই স্টেটের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং এদের মান খুব কাছাকাছি। আর জার্মানরা প্রার্থীর নিজস্ব যোগ্যতা বিচার করে, সে কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কেমন করে এসেছে, সেটা মাথা ঘামায় না।

কোর্স বাছাইয়ের সময় নিজেকে প্রশ্ন করুন –  কোর্সটি সত্যিই আপনার পছন্দের কিনা, আপনার আগ্রহ আছে কিনা এই কোর্সটিতে। প্রশ্ন করুন নিজেকে, আপনি এই কোর্সটি করবার যোগ্য কিনা। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের  প্রতিটি কোর্সের পাশেই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়কের ইমেইল বা অন্য যোগাযোগের মাধ্যম উল্লেখ করা থাকে, প্রয়োজনে তার সাথেও যোগাযোগ করতে পারেন। শুধু জার্মানি বা বিদেশের কোন কোর্স নির্বাচনের ক্ষেত্রে নয়, দেশেও কোর্স নির্বাচনের ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব সাবধান হওয়া উচিত। জার্মানিতে কোর্স বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এই সাইটটা  বেশ কাজের।

শিক্ষাবৃত্তি:
জার্মানিতে পড়াশোনার জন্যে বেশ ভালো বৃত্তির সুযোগও পাওয়া যায়। জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তির বিষয়ে সকল তথ্য পাওয়া যাবে এই  লিঙ্কে


আবেদন ও ভিসা:
ভর্তির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইটগুলোতে ভর্তির আবেদন ফরম পাওয়া যায়। যে বিভাগে ভর্তি হতে চান, সেই বিভাগে ঢুকে আবেদন করতে পারেন। এখানে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের কথা উল্লেখ থাকে। এছাড়া সরাসরি জার্মান দূতাবাস/গোথি ইন্সটিটিউট/ডাড বাংলাদেশে  যোগাযোগ করতে পারেন। তবে ভর্তির জন্য নম্বরপত্রসহ শিক্ষাগত যোগ্যতা, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র, জার্মান বা ইংরেজি ভাষার টেস্ট স্কোর, কমপক্ষে ৬ মাসের মেয়াদসহ পাসপোর্টের ফটোকপি দরকার হবে। জার্মানিতে উচ্চ শিক্ষার ভিসার জন্য প্রথম বছরের জন্য ৭৬০০ ইউরো ফান্ড ও শিক্ষাকালীন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দেখাতে হবে।


টিউশন ফি ও অন্যান্য খরচ:    
জার্মানির মোট ১৬ টি স্টেটের মধ্যে ১৫ টি স্টেটেই সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোন প্রকার টিউশন ফি দিতে হয় না। কেবল মাত্র নিডার সাক্সেন স্টেটে প্রতি সেমিস্টারে প্রায় ৫০০ ইউরোর মত খরচ হয়। এছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেমিস্টার প্রতি ৫০০ থেকে ৫৫০ ইউরোর মত প্রয়োজন হয়।

জার্মানিতে উচ্চশিক্ষাঃ পড়াশোনার খরচ

টিউশান ফি জার্মানিতে থেকে পড়াশোনার ক্ষেত্রে খুব বড় বাঁধা নয়। যা মাথা ব্যথার কারণ, তা হল থাকা খাওয়ার খরচ। এখানেও বলা যায়, অন্যান্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশের চেয়ে জার্মানির খরচ তুলনামূলক ভাবে বেশী নয় মোটেও, বিশেষ করে স্ক্যান্ডিন্যাভিয়ান দেশগুলোর সাথে তুলনা করলে বেশ কম খরচ এখানে। তবে সত্যি বলতে, জীবনযাত্রার খরচ মূলত নির্ভর করে লাইফ স্টাইলের উপর নির্ভর করে, তারপরও মোটামুটি একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করছি –

বাসা ভাড়াঃ স্টুডেন্ট হোস্টেলে ১৮০ থেকে ৩৪০ ইউরো পর্যন্ত খরচ হতে পারে মাসে। এটা মূলত নির্ভর করে শিক্ষার্থী কোন শহরে বসবাস করছেন, তার উপর। আর বাসা শেয়ার করে থাকলে (অনেকটা মেসের মত) মাসিক ২০০-৩০০ ইউরো খরচ হয়। আলাদা ফ্ল্যাটে থাকতে গেলে ৩০০ থেকে ৭০০ ইউরোর মত খরচ হতে পারে।
হেলথ ইনস্যুরেন্স: জার্মানির পড়াশোনা করছে, এমন প্রতিটি শিক্ষার্থীর হেলথ ইনস্যুরেন্স করতে হয়। এতে প্রায় ৮০ ইউরো খরচ হয় মাসে।
খাবার খরচ: খাবার খরচ মাসে ৭০ থেকে ১৫০ ইউরো পর্যন্ত লাগতে পারে। তবে রিচ ফুডের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ থাকলে সেটা ৫০০ ইউরোতেও গিয়ে ঠেকলেও অবাক হবার কিছু নেই!
এডমেনিস্ট্রেটিভ ফি: প্রতি সেমিস্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫০ থেকে ২৫০ ইউরো হারে একটি এডমিনিস্ট্রেটিভ ফি দিতে হয়। এই ফির মধ্যে লোকাল বাস-ট্রাম বা ট্রেনের টিকেট কাভার করে। এই
অন্যান্য: টেলিফোন, কাপড়চোপড় ইত্যাদি অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিশের জন্য মাসে ৫০-১০০ ইউরো পর্যন্ত খরচ হতে পারে।

একটু মিতব্যয়ী হলে মোটামুটি ৫০০ থেকে ৭০০ ইউরোতেই একজন শিক্ষার্থী এক মাসের সব খরচ চালাতে পারে। মিউনিখ, স্টুটগার্ট, ফ্রাঙ্কফুর্ট বা হামবুর্গের মতন শহরে জীবন যাত্রার খরচ বেশি হলেও এসব শহরে আবার স্টুডেন্ট জব পাবার সম্ভাবনা অন্যান্য শহরের তুলনায় একটু বেশি। তবে এই খরচের বাইরে জরুরী প্রয়োজনের জন্যে কিছু টাকা সবসময় সাথে রাখা উচিত। বলা তো যায় না, অজানা দেশ, কখন কী দরকার হয়!


প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ:
আমাদের দেশ ও সংস্কৃতির সাথে জার্মানির সংস্কৃতির তফাতটা বড্ড বেশী। বলা চলে, আমাদের দেশে একটা ছেলে বা মেয়ে ঠিক যে দৃশ্যপটগুলো দেখে বেড়ে ওঠে, জার্মানিতে দৃশ্যপটগুলো যেন ঠিক তার উল্টো। এই পার্থক্যের সবটুকুই যে ‘খারাপ’ তা যেমন নয়, তেমনি সব যে ‘ভাল’ তাও নয়। সমস্যাটা বাঁধে যখন ‘ভাল’ আর ‘খারাপ’র মাঝের দাঁগটা অস্পষ্ট হয়ে যায়। জার্মানিতে এসে প্রথমে সবাই এক বড় ধরণের অনিশ্চয়তায় ভুগে, এই অনিশ্চয়তার মূল কারণ শুধুমাত্র এই দেশের সংস্কৃতি, আচার-আচরণ আর জীবন যাপনের পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞতা। তাই, জার্মানিতে যাবার ইচ্ছে থাকলে আগে ভাগেই ওদেশের কৃষ্টি কালচার সম্পর্কে একটু আধটু জানার চেষ্টা করা উচিত, ইন্টারনেটে ওদের সম্পর্কে তথ্যের কোন অভাব নাই। আর এরপর ওপারে তাকাবার আগে একটা লঘুমাত্রার সতর্কবাণী, ভিন্ন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেবার মত মানসিক শক্তি আর আত্মবিশ্বাস না থাকলে ওদিকে না তাকানোই ভাল।


চাকরীর সুযোগঃ    

জার্মান ভাষা শেখা থাকলে জার্মানিতে ছাত্র অবস্থায় চাকরি পাওয়া অত্যন্ত সহজ। এদের জন্য সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজের সীমা নির্ধারণ করা থাকে। তবে গ্রীষ্মকালীন তিন মাস ছুটি, যে কেউ কাজে লাগাতে পারেন।একজন ছাত্র পড়াশোনার পাশাপাশি প্রতি মাসে ৮৬ ঘণ্টা কাজের অনুমতি পায়। ৫০-৬০ ঘণ্টা পার্টটাইম কাজ পেলেই মোটামুটি খরচ চালানো যায়। এ ছাড়া ছয় মাস অর্ধদিবস বা তিন মাস পূর্ণ দিবস কাজের অনুমতি ছাত্র ভিসাতে দেয়া হয়। কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট কাজের অভিজ্ঞতা (যেমন – কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, ওয়েবপেজ ডিজাইন বা অন্যান্য) থাকলে খণ্ডকালীন ছাত্র চাকরি বা পড়াশোনা শেষ করার পর চাকরি পেতে যথেষ্ট সহায়ক হয়। জার্মানিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা হলো ইইউ ভিসা (EU Visa)। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত যেকোনো একটি দেশের ভিসা থাকলে আপনি সেই ভিসা ব্যবহার করে যেতে পারবেন অন্যান্য দেশেও। এ ক্ষেত্রে চাকরি, গবেষণা বা ভ্রমণের জন্য ইইউভুক্ত দেশগুলোকে এক দেশ হিসেবে ভাবতে পারেন।


স্থায়ী আবাসন (PR) :
জার্মানিতে নাগরিকত্ব বা স্থায়ী আবাসন পেতে জার্মান ভাষা জানাটা বিশেষভাবে জরুরী। সাধারণত এইসব ক্ষেত্রে ভাষার বি১ পরীক্ষা পাস করতে হয়।

জার্মানিতে পড়তে যাওয়ার ক্ষেত্রে জন্য সবচেয়ে বড় বাঁধা হল ভাষা এবং পড়ার পাশাপাশি থাকা-খাওয়ার খরচটাকে পরিমিত রেখে এগিয়ে যেতে পারা। যারা ভালভাবে ভাষা শিখে, জার্মানির সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে পড়াশোনায় মোটিভেশন রাখতে পারবে বলে আত্মবিশ্বাসী, কেবল তাদেরই জার্মানিতে পড়তে যাওয়া উচিত। এই কথাটা আসলে শুধু জার্মানি না, যে কোন দেশে পড়তে যাবার জন্যেই প্রযোজ্য। যারা কোন পূর্বপ্রস্তুতি না নিয়ে শুধুমাত্র একটা ভিসা নিয়ে ভিনদেশে পাড়ি দেবার আশায় বুক বাঁধে, তাদের জন্যে এখনই সচেতন হওয়া খুব জরুরী। কারণ, এই একটা ভুল সিদ্ধান্তই আপনার জীবনটাকে ধ্বংস করে দেবার জন্যে যথেষ্ট! এখানে সম্ভাবনা যেমন অনেক অনেক বেশী, সেই সম্ভাবনাকে ছুঁতে যেয়ে একটু ভুল হলেই দিতে হয় চরম মাশুল! তাই ভাবিয়া করুন কাজ, করে ভাববার চিন্তাকে ভুলেও প্রশ্রয় দেবেন না।
যেকোন প্রশ্নের জন্যে স্বাগতম!


কিছু গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্ক:
Federal Ministry of Education Research

Steps Towards Germany
Higher Education Compass
TestAS
Bluecard

অনুজ সম্পর্কে

সাদা কাগজে কালো কালিতে লিখতে গেলে হয়ত লিখতে হবে - প্রথমত আমি রক্ত মাংসে গড়া এক মানুষ, দ্বিতীয়ত চিরন্তন সত্য, মৃত্যুর সাথে করি বসবাস... https://www.facebook.com/CoercedAnuj
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , , , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

12 Responses to বিদেশে উচ্চশিক্ষা: হিটলারের জার্মানিতে

  1. শারমিন বলেছেনঃ

    ইনফরমেটিভ লিখা
    অনেক কিছু জানলাম পড়ে 😀

  2. রুদ্রপ্রয়াগ বলেছেনঃ

    বেশ তথ্য বহুল লিখা। অনেক কিছু জানা হল।

  3. জাকির হোসাইন বলেছেনঃ

    দারুণ একটা লেখা 🙂

  4. তুসিন বলেছেনঃ

    অসাধারন এবং তথ্য বহুল লেখা। জামানী
    যেতে ইচ্ছা করছে 🙂

  5. Monaz Haque বলেছেনঃ

    বেশ অনেক খাটুনি করে তথ্যবহুল নিবন্ধটি লেখার জন্যে লেখককে সাধুবাদ দিতে হয় কিন্তু নিবন্ধটির শিরোনামটি দেখে অবাক বিশ্বয়ে আঁতকে উঠলাম, জার্মানিতে প্রায় ১০০ জন জগৎ বিখ্যাত দার্শনিক (হেগেল, কান্ট্,মার্ক্স ইত্যাদির নাম কে না জানে) বিজ্ঞান ও অঙ্ক শাস্ত্রে ও জার্মানদের অতুলোনানীয় অবদান থাকা সত্তেও “হিটলারের জার্মানিতে” শিরোনামটি বড্ড বেমানান, বিশ্ববিদ্যালয় এ লেখাপড়া করা মানুষের তো না জানা নয় যে হিটলার কে যেমন সারা পৃথিবীর মানুষ ঘৃনা করে তেমনি আধুনিক জার্মানরাও চরম ঘৃনা করে, আর যখন ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানির কথা লিখছেন সেটা তো হিটলারের দেশ নয় হিটলার ছিল ১৯৩৩ থকে১৯৪৫ পর্যন্ত নাত্সী জার্মানির শাসক তার সাথে আধুনিক জার্মানির কোনো সম্পর্ক নেই। এই দেশে আমি লেখাপড়া করেছি, শিল্প বিজ্ঞানে অনেক উন্নত এই দেশটি হয়ত “হেগেল এর জার্মানিতে” অথবা “গোয়েথের জার্মানিতে” শিরোনাম ভালো মানাত। “হিটলারের জার্মানিতে” এই শিরোনাম দেওয়ায় পুরো নিবন্ধটি আমার কাছে মূল্যহীন হয়ে পরেছে। আশাকরি লেখক নিবন্ধটির শিরোনাম পরিবর্তন করবেন, ধন্যবাদান্তে মোনাজ হক, বার্লিন

  6. Tanbirul islam বলেছেনঃ

    অনেক সুন্দর এবং তথ্যবহুল একটি লিখা।লেখাটির জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।যদিও ধন্যবাদ যথেষ্ট নয়।

  7. ছায়াবীথি বলেছেনঃ

    খুবি সুন্দর এবং তথ্যবহুল লেখা। কিন্তু, চাকরি নিযে জা লিখেছেন তা কিছু ক্ষেত্রে সত্যি না, আমার ৬ বছর জার্মানি তে থকার অভিজ্ঞটা থেকে বলছি। ছাত্র থাকা অবস্থায় student job করে নিজের খরচ চালানোটা একটা বিশাল বড় stress, যদি আপনি সময়মত পরা সেশ করতে চান। ৮০/৯০% student এখানে এসে ৩ বছরের পরা ৬/৭ বছরে সেশ করে, ২ বছরের masters 4/5 বছরে সেশ করে…তাদের জন্য সম্ভব। তবে, overall খুবি informative লেখা, অনেক শুভকামনা রইল।

    • অনুজ বলেছেনঃ

      আমার নিজের যেহেতু জার্মানিতে যেয়ে পড়াশোনা করার অভিজ্ঞতা নেই (অভিজ্ঞতা অর্জনের ইচ্ছে আছে অবশ্য), আমাকে মূলত নির্ভর করতে হয়েছে বিভিন্ন সোর্স থেকে পাওয়া তথ্য আর এলামনাইদের মতামত থেকে।
      মোটের উপর আমার কাছে মনে হয়েছে, এই ব্যাপারটা অনেক বেশী রিলেটিভ। পড়াশোনার পাশাপাশি জব করতে হলে বাড়তি চাপ আসবে, এটাই স্বাভাবিক। এখন কে, কীভাবে পড়াশোনা আর জবের মাঝে সিঙ্ক্রোনাইজ করতে পারে, সেটাই জরুরী।
      আমি অন্তত ব্যাক্তিগতভাবে একজনকে চিনি, যিনি জার্মানিতে জব করেও কোষবিদ্যায় ডিউ টাইমে এম.এস কমপ্লিট করেছেন এবং অ্যাওয়ার্ড অফ ডিস্টিংশান পেয়েছেন। আবার আরেকজনকে চিনি, যিনি গত তিন বছর যাবত মাস্টার্স করছেন, কিন্তু এখনও শেষ করতে পারেন নি।
      লেখাটা প্রায় দুই বছর আগের, কিছু তথ্য হয়তবা আপডেট করা দরকার।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।