একদিন আমি আর টুনি বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। আমাদের শহরের বাইরে একটা নদী আছে- নাম তার কীর্তিনাশা, আমরা সেই নদী দেখতে গিয়েছিলাম । নদীটা শহরের লাগোয়া, তারপরেও কঠোর শাসন আর নজরদারিতে থাকা টুনি আর আমার জন্যে একদিন অসীম সাহস সঞ্চয় করে কোচিং মিস করে রিক্সায় চড়ে নদীর পাড়ে বেড়াতে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
তখন আমরা পড়ি ক্লাস এইটে।
আমরা পরস্পরকে ভালবাসতাম। কিশোরের প্রথম মুগ্ধতা, কিশোরীর প্রথম প্রেম। বাড়িতে উভয়ের কড়া শাসন- ক্লাসরুমের বাইরে এক বিন্দু দেখা করার সময় নেই। এই দিনটির জন্যে আমরা কত দিন আগে থেকে ভেবে রেখেছি। টুনির জন্মদিনে আমরা নদীর পাড়ে যাবো। নদীর পাড়ে তখন কাশফুলের মেলা। তার সৌন্দর্য নিয়ে আমি টুনির সাথে গল্প করি- টুনির চোখে মুগ্ধতা দেখি- আমার চোখে সে খুঁজে ফেরে অদেখা সব সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি।
আগের দিন রাতে আমার ঘুম হয় না। টুনির সাথে আমি এক রিক্সায় উঠবো? এক রিক্সায় এত পাশা-পাশি বসে এতটা সময় কাটাবো? টুনির সাথে আমার ছোঁয়া লেগে যায় যদি? টুনি যদি রাগ করে?
মনে পড়ে একদিন হঠাৎ করে টুনির হাতে আমার হাত লেগে গিয়েছিল- কেমন শিরশির করে উঠেছিল আমার- টুনিরও কি তেমন হয়েছিল? না হয় কেন সে হঠাৎ জমে গিয়েছিল তেমন করে? তারপরে দুইদিন সে আমার সাথে ঠিকমতো কথাটি কয় নি।
রিক্সার ঝাঁকুনিতে যদি টুনির সাথে আমার ঠোকাঠুকি লেগে যায়- আবার কি সে কথা বন্ধ করে দেবে??
*******
সেদিন হঠাৎ করে খুব বৃষ্টি নেমেছিল।
টুনিকে বললাম চলো ফিরে যাই। কিন্তু সে রাজী হল না। পরিচিত শান্ত- শিষ্ট মেয়েটি হঠাৎ পাওয়া স্বাধীনতার ছোঁয়ায় কেমন করে জানি এতটা অশান্ত হয়ে উঠলো।
দুপুর পার হওয়া মফঃস্বলী বিকেল – সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে ভাত-ঘুম দেয়- রাস্তাঘাট হয়ে যায় এমনিতেই ফাকা। তার সাথে হঠাৎ এই প্রবল বৃষ্টি যুক্ত হয়ে জনপদকে আরও জনশূন্য করে দিয়েছিল। অনেকটা সময় আমরা পেয়েছিলাম নিজেদের জন্য- একান্ত নিজস্ব।
টুনি সেই বৃষ্টিতে খুব করে ভিজল- হুটোপুটি, লাফালাফি করে একাকার। আমি বৃষ্টিতে ভিজি না। আমার ভালো লাগা বৃষ্টি দেখায়। টুনি আমাকে ভিজতে বাধ্য করলো- শুধু তাই নয় আমাকে তার সাথে বৃষ্টিতে ভিজে হৈ-হুল্লোড়ও করতে হল । নদীর পাড়ে তখন চাদরের মত বৃষ্টি পড়ছে। সামনের জলে বড় বড় ফোটা- তুমুল বৃষ্টির শব্দ। আশে-পাশে বেশিদূরে দেখা যায় না। কুয়াশার মত বৃষ্টির চাদর পরিচিত জগৎ থেকে আমাদের সরিয়ে রেখেছে। তৈরি করেছে অন্য আরেকটা জগত- যে জগতে আমি, টুনি আর বৃষ্টির শব্দ- সে জগত বিষণ্ণ, বুকে কাঁপন জাগানিয়া- সে জগত ভালোবাসার- সাদা ও ধুসর রঙের।
ফেরার পথে আমি টুনিকে আমার খুব প্রিয় একটা জায়গায় নিয়ে গেলাম।
ইট বিছানো একটা লম্বা পথ। দুই ধারে ঘন করা আখ আর পাটের ক্ষেত। ডানে বামে কিছু দেখা যায় না। যখন বৃষ্টি নাম খুব তখন এই রাস্তা ধরে আমি ছাতা মাথায় হেটে যাই। এমনিতেই এই রাস্তায় লোক চলাচল কম- বৃষ্টির সময় সেটা শূন্যে চলে যায়। সমগ্র রাস্তাটা তখন অদ্ভুত নির্জন হয়ে যায়- প্রবল বৃষ্টির শব্দে, বাতাসের সাথে আখ আর পাটের গাছের আন্দোলনের শব্দে- সাদা বৃষ্টির চাদরে ছাওয়া সংকীর্ণ দৃষ্টিসীমার মাঝে লম্বা এই পথটাকে অসীম মনে হয়। তখন আমি অসীম অপার্থিবে হাটার আনন্দ পাই।
আমরা সেই রাস্তা ধরে হাঁটলাম। টুনি এবার আর হুটোপুটি করলো না। কেমন যেন চুপ করে গেল। আমরা পাশা- পাশি হাঁটছিলাম। আচমকাই টুনি তার ডান হাত দিয়ে আমার বাম হাতটা ধরল- ভুল করে নয়, ইচ্ছে করে- ছাড়িয়ে নিলো না। আমার সারা গায়ে কেমন যেন আলোড়ন লাগলো- বুকের ভেতরে কেমন গভীর শুন্যতা। আমার ভয় করতে লাগলো- খুব ইচ্ছে করতে লাগলো হাতটা ছাড়িয়ে নেই। কিন্তু টুনি যদি কষ্ট পায়- থাক হাতটা টুনির হাতে।
সারা রাস্তা এরকম হাতে হাত রেখে নিশ্চুপ পেরিয়ে গেলাম। বৃষ্টির শব্দ, বাতাসের গর্জন- পানি, কাদা বায়ু কিংবা পাটের খেত, ইটের রাস্তা, আধো অন্ধকার ধুসর আলো কিংবা দিগন্ত-জোড়া মেঘ কিছুই আর আমাকে চেতনা দিতে পারলো না।
এক কিশোরীর নরম হাতে আমি অচেতন বাধা পড়ে রইলাম।
*************
কয়েকদিন আগে জরুরী প্রয়োজনে খুব তুষারপাতের মধ্যে বাইরে বেরিয়েছিলাম। একদমই লোকজন নেই। রাস্তার উপর পুরু আস্তরণ। কয়েক ব্লক পার হয়ে দেখি বাচ্চা দুই ছেলে- মেয়ে তুষারপাতের মধ্যে বেরিয়েছে। বাড়ি থেকে এমন সময়ে তাদের বেরোতে দেয়ার কথা না। না বলে পালিয়ে এসেছে নিশ্চয়ই। ছেলেটি খুব দুষ্ট- মেয়েটি শান্ত। বড় বড় মায়া ভরা চোখের মিষ্টি একটি মেয়ে।
আমি ভাবলাম গিয়ে বলি তুষারে এরকম বাইরে থাকলে মারা পরবে- বাসায় যাও। কি ভেবে আবার বললাম না। কিছুক্ষণ পরে নিজেরাই হাত ধরাধরি করে চলে গেল।
সারাটি দিন আমার মন খারাপ হয়ে রইলো। টুনি বৃষ্টি-পাগল ছিল। সে তুষারপাত দেখে নি- অন্যদের মুখে গল্প শুনে শুনে তার খুব শখ ছিল তুষারপাত দেখার। আমি তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম বুয়েট থেকে পাস করে তাকে আমেরিকা নিয়ে গিয়ে তুষারপাত দেখাবো।
টুনি যদি আমার সাথে আমেরিকা আসতো তাহলে আমাদেরও নিশ্চয়ই এরকম বয়সী ছেলে-মেয়ে থাকতো। তারাও নিশ্চয়ই আজকের এই বাচ্চাদের মত এরকম একটু আধটু পাগলামি করতো- কিংবা আরেকটু বেশি।
অবশ্যই করতো।
********
মহাকালের ধুসর জগতে আমরা সবাই খুবই নগণ্য। কোটি বছরের কোটি মানুষের মাঝে আমাদের কেউ মনে রাখে না। হঠাৎ করে শূন্য থেকে এসে আমরা আবার শূন্যে মিলিয়ে যাই। মাঝে কিছুটা দিন আমরা নিজেদের জীবন দিয়ে গল্প রচনা করি। জীবনের সেই গল্পে কত উত্থান-পতন, কত আবেগ- ভালোবাসা, চাওয়া- পাওয়ার কত দ্বন্দ্ব।
ভালবাসার টুনি আমার- আজ তুমি নেই। কিছুদিন পরে আমিও থাকবো না। একটা সময় পৃথিবীর কারো কাছে আর আমাদের কোন অস্তিত্ব- পরিচয় থাকবে না। কিন্তু সেদিনও মানুষ ভালবাসবে। বৃষ্টি কিংবা তুষারপাতে ভাবুক মন আকুল হবে। সেদিনের অবুঝ মানব-মানবীর মনেও হঠাৎ করে পালানোর ইচ্ছে জাগবো।
দেখবে, তুমি আর আমি সেদিনও ঠিক বেচে থাকবো এরকম প্রতিটি নিখাদ ভালবাসার কাহিনীর মাঝে।
———————-
মিজানুর রহমান পলাশ
১১ই এপ্রিল, ২০১৪
( সরবে লাস্ট পোষ্ট লিখেছিলাম ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৩- এরপরে আর কোথাও কিছু লেখা হয় নি। চাকরি, ঢাকা চিটাগাং এ দৌড়াদৌড়ি- কিভাবে কিভাবে যে মাঝের এত দীর্ঘ সময় কেটে গেল বুঝতেই পারি নি। এত এত ঘটনা ঘটলো মাঝে কেমন যেন ঘুম ঘুম মনে হয়। মনে হয় সব কিছু নিজের অজান্তেই ঘটে যাচ্ছে- স্বপ্নের মত। আজ হঠাৎ করে যখন লিখতে বসলাম দেখি কিছুই মাথায় আসে না। প্রায়ান্ধকার ফাকা অফিসে বসে কেমন যেন মনটা খারাপ হয়ে গেল। গল্পেও হয়তো সেই মন খারাপের ছোঁয়া ঢুকে গেছে। )
ওয়েলকাম ব্যাক ভাইয়া 😀
অনেক দিন পর আপনার লিখা পড়লাম
:welcome: 😛
মন খারাপ করা গল্প কিন্তু ভালো লেগেছে
গল্পটা ভালো লেগেছে..
দুনিয়াটা আসলেই বড় আজব জায়গা। কোত্থেকে এসে অপরিচিত মানুষ পরিচিত হয়ে অতি আপনজন হয়ে যায়। আবার কালের বিবর্তনে এরকম অতি আপনজনও হঠাৎ অপরিচিত হয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে যায়।
লেখালেখি চালিয়ে যান.. 🙂
আসলেই আজকাল আর লেখা আসে না জীবনের দৌড়ে দৌড়োতে গিয়ে। তবে তোমার লেখা ভালো হয়েছে। মন খারাপ করা হলেও। মাঝে মধ্যে লিখিও।