আমার দাদুকে আমরা কোনদিন কাঁদতে দেখি নি, শুধু একদিন ছাড়া। হয়তো এজন্যই যে বড় হয়ে কাঁদাটা ঠিক শোভন নয়, আর অত ছোট আমাদের সামনে তো নয়ই। কিন্তু তোমরা যদি কেউ আমার দাদুকে চিনতে তাহলে আমার কথা হেসেই উড়িয়ে দিতে, বলতে নিজের ছেলে মরে যাওয়ার পরও যার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়ায়নি সে আবার কীসে কাঁদবে। কথাটা সত্যি, মার কাছে শুনেছি- তার সবচেয়ে ছোট ছেলেটি যে বার অসুখে মারা গেল সেদিন তার চোখে কেউ জল দেখেনি। মা বলে, লোকটা দুঃখ পায়নি সেটা তো হতে পারে না, তবে দশজনকে দেখিয়ে জল ফেলাটা তার ধাতে নেই।
তাহলে এমন কী ঘটলো যে ছোট বড় সবার সামনে সেই একদিন দাদু অমন হড়বড়িয়ে কেঁদে গেলেন,সেদিন কেউ মারাও যায়নি, হারিয়েও যায় নি, সত্যি বলতে কী, কারণটা আমি ঠিক বুঝিই নি।আর কাউকে বুঝিয়ে দিতে বলবো সেটার পরিস্থিতি ছিল না তখন, দাদুর কান্না দেখে বাবা,বড় চাচা,ফুপু আর বাকী সবাই এমন ঘাবড়ে গেছিলো যে তাদের দিকে তাকাতেও আমার অস্বস্তি হচ্ছিলো।
তাহলে ঘটনাটা বলি তোমাদের।সেবার শহরে কী এক ঝামেলা চলছিলো, বাবা আমাকে, আমার ছোট্ট বোন নিমি আর মাকে দাদুর বাড়ি রেখে গেলেন ।ক’দিন পর নিজেও এসে পড়লেন, শহরে নাকি ঝামেলা দিন দিন বাড়ছে।বড় চাচাও শহরে ছিলেন, তিনিও চলে এসেছিলেন। তাতে অবশ্য আমার খুব ভাল হল, বড় চাচার মেয়ে তুশি আপা অনেক মজার মজার খেলা জানতেন। আমাকে আর নিমিকে তিনি সৈন্য বানিয়ে নিজে হতেন সেনাপতি,বাড়ির পেছনের জলপাই বাগানে ছোট ছোট ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকা শত্রুদের বিনাস করতে করতে আমাদের দিন কাটতো,তারপর সন্ধার দিকে যখন পাকা চালতা’র ঝাঝালো গন্ধ আসতো কুয়াশার সাথে, তখন তুশি আপা গল্প করতেন,জলপাই বাগানের পরে যে রাজ্য সেখান থেকে অমন গন্ধ আসছে-ওখানে থাকে এক দঙ্গল রাক্ষস-খোক্কস, আমাদের সেনাবাহিনী যখন আরো বড় হয়ে উঠবে, লোকসংখ্যায় আর গোলাবারুদে, তখন আমরা সেসব রাজ্যে অভিযানে যাব।
রাতে যখন মস্ত করে চাঁদ উঠতো, জ্যোৎন্সায় এমন জ্বলজ্বলে হয়ে উঠতো চারপাশ যে মনে হত আকাশ থেকে কেউ মস্ত পাউডারের কৌটা উল্টে দিয়েছে, সেই সাদা সাদা গুড়োতে মোড়ানো উঠোনে বসে বড়চাচা গল্প করতেন, কত রকমের গল্প যে ছিল তার ঝুলিতে তা এই মারাত্মক গম্ভীর মানুষকে দেখে কখনোই বোঝার উপায় ছিল না।
আমাদের আরো এক আগ্রহ আর আনন্দের এক ব্যাপার ছিল, সেটা হল দাদু সেসময় এক হাতি পালতেন। দেখোতো ওর কথা এখনো বলি নি, সেদিনের ঘটনায় এই হাতিরও কিছু অংশ ছিল। দাদু হাতির কাছে ঘেষতে মানা করতেন তিনি না থাকলে, কারন দাদুই ওকে অনেক দিন ধরে পালছেন তো, আর আমরা তো নতুন, আমাদের চিনতে না পেরে যদি কোন অঘটন ঘটিয়ে বসে-সেই চিন্তা ছিল তার মনে।তুশি আপা অবশ্য বলতেন, ভয়ের কোন কারণ নেই, হাতিরা নাকি দারুন ভাল, আর এই হাতিটার যেহেতু গজদন্ত নেই, তাই এটা মেয়ে হাতি, মেয়ে হাতির মনে খুব মায়া।
পরে অবশ্য বাবার কাছে শুনেছি, এটা ছেলে হাতিই। কিন্তু গজ দাঁত গজায়নি, সব ছেলে হাতির সেটা গজায় এমন কোন কথা নেই।
হাতিটার নাম ছিল মানাত, নামটা আমাদের কাছে অদ্ভূত ঠেকতো। দাদুকে একবার জিজ্ঞেস করায় দাদু বলেছিলেন, নামটা তার দেয়া না, তিনি যে লোকের কাছ থেকে কিনেছেন, তার দেয়া।আর এ নামে ও অভ্যস্থ হয়ে পড়ায় নতুন নামকরণ করে সুবিধে হবে না।
দিন আমাদের ভালই কাটছিলো। মানে দাদু বাড়িতে থাকার অর্থ ছিল আমাদের অফুরন্ত ছুটি আর খেলা,গল্প শোনা,হোমওয়ার্ক নেই, স্কুলের যাওয়ার তাড়া নেই,সন্ধার দিকে মা যদিও কিছু পড়তে বলে, সেটাও বেশিক্ষণের জন্য না।
অবশ্য বড়দের ব্যাপারটা একই ছিল না, বাবা অফিস কামাই দিয়ে বসে থেকেও খুব সুখে ছিল বলে মনে হত না, মা, বড়চাচা, চাচী সবাই মাঝে-মধ্যেই গম্ভীর হয়ে নানা কথা বলতেন। রাত জেগে দাদুর জরদগব সাইজের রেডিওতে খবর শুনতেন সবাই।আমাদের অবশ্য বারণ ছিল, তাই ব্যাপারগুলো ঠাহর করতে পারতাম না। তুশি আপা অবশ্য বলতেন,শহরে একপাল খোক্কস এসেছে নিশ্চয়ই।বড়রা শহরে থেকে পালিয়ে রেডিওতে তাই নজর রাখছে খোক্কসগুলো না এদিকটাতেও এসে পড়ে।বাবা-চাচাদের গায়ে জোড় নেই বলে তারা পালিয়ে এসেছে, বাকী মানুষরা নিশ্চয়ই খুব একটা ফাইট দিচ্ছে- বলে তুশি আপা তলোয়ার চালানোর ভঙ্গি করে, আর আফসোস করে বাহিনীটা আরেকটু বড় হলেই হত- আমরাও ফাইট দিতে পারতাম। তবে আমাদের ছোটচাচা মনে হয় তাদের দলের, কারণ তিনি এখনো দাদু বাড়ি আসেননি। আর বড়রা তাকে নিয়ে প্রায়ই নানা দুঃশ্চিন্তা করে।
কিছুদিন পর এমন একটা ব্যাপার শুরু হল যেটার সাথে আমরা কোনদিন পরিচিত ছিলাম না।মা এক সকালে ফিসফিস করে বললেন, আজকে সকালে কোন নাস্তা নেই, এটা নিয়ে মন খারাপ করিস না বাবা!পাকা কুল আছে, এটা খেয়ে নে!
ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটতে লাগলো,খোক্কসদের হামলার কারণেই হয়তোবা দাদুর ব্যবসাপাতি যা ছিল সবই নাকি বন্ধ হয়ে গেছে কথাবার্তায় আমরা আন্দাজ করলাম, তারপর আবার বাড়িতে অনেকগুলো বাড়তি মানুষ। দাদুবাড়ির নানা জিনিসপত্রও কমতে লাগলো,ভারী ভারী সব আসবাব পত্র প্রায়ই লোকেরা এসে নিয়ে যেত, দাদু শুকনো মুখে চেয়ে থাকতেন লোকেরা যাওয়ার পর।
আমাদের ছোটরা এসবে খুব একটা বিচলিত ছিলাম না, কারণ আমাদের যে খুব একটা অসুবিধে হচ্ছিল তা না। তুশি আপা বলতো, এটাকে বলে অভাব, অভাবে নাকি মানুষ মারাও যেতে পারে। কথাটা আমার ঠিক বিশ্বাস হতো না, তুশি আপা অনেক কিছুই বাড়িয়ে বলে।তবে একটা ব্যাপার আমার মনে হল, অভাব থাকলে বড়রা ছোটদের উপর খবরদারি কমিয়ে আনে। কারণ আমরা তখন আগের চেয়েও বেশি বাইরে থাকতে পারতাম, আশেপাশের অনেক ছোট ছেলে পিলের সাথে আমরা মিশতে শুরু করলাম, খেলতাম, এটা প্রথম দিকে খুব বারণ ছিল।
তারও বেশ কিছুদিন পর অভাবটা মনে হয় আমরাও বুঝতে শুরু করলাম, কারন যেসব দিন আটার রুটি হতো সেদিনগুলোতে কেমন যেন একটা ভালো লাগা কাজ করতো, আর ভয় হতো এ দিনটা না আবার কতদিন পরে আসবে, অথচ সেগুলো একটা সময় আমি খেতেই পারতাম না।প্রতিদিন রাতের খাবারে সাদাভাত আর সাথে কীসব যেন খেতে বিস্বাদ লাগলেও আপত্তি করতাম না। কারন সেটা করলে বাকী সবার এমন মন খারাপ হতো যে কী বলবো!
এবার আসি সেদিনের ঘটনায়।ঘটনার আগের দিন মানাত, মানে আমাদের হাতিটাকে খুজেঁ পাওয়া যাচ্ছিলো না।দাদু অস্থির হয়ে পুরো এলাকা ঘুরে ঘুরে খুঁজলেন,বাবাও তার সাথে বের হয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করলো।রাতের বেলা শুনলাম, দাদু ভীষণ ক্ষেপে হাতিটাকে গালাগালি করছেন- ‘পাজি,বদমাশ কোথাকার, অভাব দেখে পালিয়েছে-নিমকহারাম কোথাকার, তোকে তো কোনদিন কষ্টে রাখিনি, একদিনও না খাইয়ে রাখিনি ।‘
নিঝুম রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দাদুর আহাজারি শুনে কেন যেন খুব ভয় হচ্ছিলো, বড় চাচা বলেছিলেন, মানুষের দুঃসময় বুঝতে পারলে পোষা পশু-পাখি আগে ভাগে পালিয়ে যায়।আমাদের সামনে কি তাহলে আরো খারাপ সময় আসছে।
বাবা বলল, হাতিটাকে বেচে দেয়া উচিত ছিল, তাহলে বরঞ্চ কিছুটা উপকার হত।
-মনে হয় কেনার লোক বসে আছে তোমার জন্য? মা বাবার কথা শুনে ফোস করে বলল।
-তা ঠিক, এই যুদ্ধের বাজারে কেইবা হাতি কিনবে! আর কিনলেও বাবা বেচতো না। আজকে সারাদিন যেভাবে পাগলের মত খুঁজলেন,দেখে খুব খারাপ লাগলো।
পরদিন সকালে শোরগোলে ঘুম ভেঙ্গে গেল।তুশি আপা বললেন, শিগগীর আয়, মানাত ফিরে এসেছে!
আমি তাড়াতাড়ি চোখ ডলে বাইরে গেলাম। দেখি বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে আছে উঠোনে,মানাত ফিরে এসেছে!
তুশি আপা আমার কানে ফিসফিস করে বললেন, কোন একটা ঝামেলা হয়েছে, দাদু সবার সামনে কাঁদছে!
আমি গিয়ে মাকে ধরলাম, মা দাদুর কী হয়েছে?
মা কোন জবাব না দিয়ে নিজেও চোখ মুছলো আচঁল দিয়ে।খানিক পরে বলল, হাতিটা শুড়ে করে পাঁচ টাকা নিয়ে এসেছে যেন কোথা থেকে। এটা দেখেই নাকি দাদু হুহু করে কেঁদে যাচ্ছে।
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে, হঠাৎ করে একদিন আমাদের অভাবও মিটে গেল। আমরাও ফিরে গেলাম শহরে, দাদু তার হাতি নিয়েই ছিলেন।
পরে জেনেছিলাম,হাতিটা দাদু এমন একজন থেকে কিনেছিলেন যে মানাতকে দিয়ে ভিক্ষে করাত। দাদু অনেক কষ্টে সে অভ্যাসটা দূর করিয়ে ছিলেন। কিন্তু আমাদের সে সীমাহীন অভাবে হাতিটার অভ্যাসটা ফের ফিরে আসে-ব্যাপারটা দাদু কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি।
বাবা বলতেন, ব্যাপারটা আমি বড় হলে বুঝবো।
দাদুর সে কষ্টটা বোঝার জন্য আমাকে সত্যি সত্যিই অনেক বড় হতে হয়েছিলো!
( গল্পটা প্রকাশিত হয়েছে কিশোর আলো’র মে মাসের সংখ্যায়, গল্পের ছবিটি জোজো নামের এক আঁকতে ভালবাসা হাতির আঁকা 🙂 )
ছবিটা তো দারুণ ! হাতি দেখি ভালোই আঁকে। অনেকদিন পরে কিশোর গল্প পড়ার সুযোগ হল, খেয়াল করলাম সেই কৈশোরের মতই উপভোগ করি। আপনার লেখা অনেকদিন পরে দেখে ভালো লাগল ভাইয়া। 🙂
ভালো লাগলো গল্পটা…
শুধু ভালো না, বেশ ভালো।
দারুণ লাগলো
আরও চাই
ফেইসবুকে আগেই পড়ে ফেলেছি। বলেও ফেলেছি খুব সুন্দর! দারুণ সুপাঠ্য গল্প। 😀
গল্পটা পড়ে অনেক ভালো লাগলো… চালিয়ে যান ভাইয়া.. 🙂
এত্ত সুন্দর!
অনেক সুন্দর লিখা, পড়ে ভাল লেগেছে।
আরো গল্প চাই চাই চাই 😀
ঝরঝরে সত্যিকারের গল্প!
ভালো লেগেছে খুব…