আমার বেলা যে যায় সাঁঝ বেলাতে (স্মৃতি ঘাটানো লিখা)

কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করতো, “বাবু, বড় হয়ে কি হবে?” আমি বলতাম, “ হয় জয়নুল আবেদীন আর না হয় আইনস্টাইন!” ছোটোবেলায় ছবি আঁকার পাগল ছিলাম। আর ছিলাম বৈজ্ঞানিক হবার ব্যাপক স্বপ্নে ঘুমন্ত ! ধুমাধুম শুধু ছবি আঁকতাম। আমার জীবনে আঁকে প্রথম সুস্থ্য ছবি হলো, একটা লোক বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় হেঁটে যাচ্ছে। এই ছবি নিয়ে বাসায় ব্যাপক মাতামাতি হয়েছিলো, কারণ ছবিটা আমাকে কেউ এঁকে দেয়নি দেখে দেখে আঁকার জন্য। বারান্দায় বসে বৃষ্টিমুখর এক সকালে রাস্তায় মানুষ দেখে এঁকে ফেলেছিলাম। উল্লেখ্য আমার বয়স তখন চার।

 

নিজের প্রশংসা করছিনা কিন্তু! বলার পেছনে কারণ হলো, এই যে ভাবের উদয় ছোটোকালে আমার মধ্যে ঘটেছিলো তো ছবি আঁকতে হলে তো সময় দরকার! এতো সময় আমার কই? আর তাছাড়া তখন আমি একজন অ-প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিকও বটে ! তো এইসব সৃষ্টিশীল কাজ-কম্ম করবার জন্য আমি বেছে নিয়েছিলাম দুপুরবেলাকে। যখন বাসার সবাই ভাত-টাত খেয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতো, আমি তখন বারাদায় গিয়ে ক্লান্ত দুপুরে তৃষ্ণার্ত কাক কিংবা নির্জন রাস্তায় হেঁটে যাওয়া বিরক্ত পথিকের ছবি আঁকতাম। আরেকটা কাজ করতাম ! তা হলো, বারান্দায় যতো গাছ ছিলো, সেগুলোর উপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালাতাম। একেকদিন একেক মিশ্রন তৈরি করতাম। যেমনঃ একদিন হলুদ গুড়া, জনসন বডি লোশন আর বডি স্প্রে, আরেকদিন সাবান পানি, স্নো-ক্রীম, লেবুর রস – এইসব মিক্সড করে গাছে ঢেলে দিতাম কিংবা আলতো করে গাছের পাতায় মাখতাম। কখনো দেখা যেতো গাছ মরে গেছে তো কখনো পাতা সাদা হয়ে যেতো। কখনো বা পাতাগুলো কুচকিয়ে যেতো। আমি শিওর সে সময় যদি সব লিখে রাখতাম, আজ মেন্ডেলের সাথে আমার নামখানাও উচ্চ মাধ্যমিক জীববিজ্ঞানে জ্বলজ্বল করতো!

 

একদিন হয়েছে কি, বারান্দায় লাইটের হোল্ডার চোখে পরলো। কিন্তু লাইট লাগানো নেই। বয়স তখন সাড়ে চার কি পাঁচ! তো আমি ভাবতে লাগলাম, এখানে বাল্ব লাগালে বাল্ব জ্বলে উঠে, অন্য কিছু লাগালে কি হবে! আমি আবার সবকিছু চোখে দেখায় বিশ্বাসী কিনা, করলাম কি পর্দার রড নিলাম। এরপর একটা কাঠের টেবিল ঠেলে তার উপর উঠে দিলাম রডটাকে বাল্বের হোল্ডারের ভেতর ঢুকিয়ে। সাথে সাথে একটা কান্ড ঘটল!

 

“ধুমমম” করে গগনবিদারী এক আওয়াজ করে উঠলো এবং আমি দেখলাম ড্রইং রুমের সুইচ বোর্ডের থেকে ধোয়া বের হচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি এক দৌড় দিয়ে আম্মুর পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। পরে শুনলাম সারা বিল্ডিং এর কারেন্ট চলে গিয়েছিলো। এখন ভাবলে ভয় লাগে, পায়ের নিচে নিজের অজান্তেই সেই কাঠের টেবিলটা না থাকলে কী হতো!

 

 

এরকম মরতে মরতে বেঁচে যাবার আরও কয়েকটা কাহিনী আছে। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরের ১১তারিখ। এক বড়ভাই (ফাহাদ ভাইয়া) এর সাথে তার নানীবাড়ি রুপগঞ্জ গেলাম। সঙ্গে ছিলো ভাইয়ার আরও ৩ বন্ধু, কিছুক্ষনের মধ্যে তারা ভাইয়াকে পাত্তা না দিয়ে আমার সাথেই আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে পরে এই অবস্থা। তো কাহিনী হলো, খায়া দায়া কাম না থাকলে মানুষ যেটা করে সেটাকে বলে “আকাম”।

আমরা দুপুরে কাজ কাম না থাকায় গেলাম শীতলক্ষ্যা নদী দেখতে। সেখানে গিয়ে চক্ষু চড়ক গাছ, ব্যাপক সৌন্দর্য্য নদীর।। সবার মাথায় পিনিক উঠসে নদীতে নামবে। নৌকা দিয়ে পার হয়ে ওপাড়ে গিয়ে লুঙ্গী পরলাম। এরপর পাড়ে আস্তে আস্তে নামলাম। আমি তখন সবে সাতার শেখা শুরু করেছি, শুধু ভাসতে পারি আর কী! তো আমি ভেসে থাকার প্র্যাক্টিস করছি, কোন এক বড়ভাই (হারামী, এক নাম্বারের হারামী! ) জানি আমারে বলে “পানি একটুও গভীর না, আরে আয়! আমরা আছিনা” এই কথা বলেই এক টান দিয়ে আমাকে আরও ভেতরে নিয়ে গেলো! ব্যস, কাহিনী শুরু! আমি তো পায়ের নীচে মাটি পাইনা! চোখেও কিছু দেখতেসিনা। ইতোমধ্যেই দম শেষ, নতুন করে যে দম নিয়ে ভেসে থাকবার চেষ্টা করবো, তাও পারছিনা। আমি বারবার চিৎকার করছি, কে শুনে কার কথা! তারা ভাবছে, আমি বোধ হয় তাদের সাথে রসিকতা করছি ( হারামীরা, তোরা কি আমার দুলাভাই যে রসিকতা করবো!) পরে আর পারলাম না। দম পুরা শেষ, শক্তিও শেষ দাপাদাপি করে। শেষবারের মতো বাম হাতটা লম্বা করে উপরে তুলে দিলাম। ডুবে যাচ্ছি এর মধ্যেই কে যেনো হাতটা খপ করে ধরে হেচকা টান! এরপরে সাতার কেটে আমাকে নিয়ে এলো, চোখ খুলে হা করে বড় শ্বাস নিয়ে দেখলাম আমাকে যে বাঁচিয়েছে সে ফাহাদ ভাইয়া। আমি আজও জানিনা, কোন হারামী আমাকে টেনে মাঝখানে নিয়েছিলো।

 

 

আরেকটা কাহিনী বলি। তারিখ মনে নেই, ২০১০ এর কাহিনী। কি একটা কাজে ঢাকা কলেজে গিয়েছিলাম। ফাল্গুন বাস দিয়ে আসার পথে ভাবলাম ক্লাস (কোচিং এর) মাত্র দশ মিনিট হয়েছে, পুরাটা করেই যাই বাসায়। তো, বেইলীরোডের সামনে বললাম থামাতে। ড্রাইভার সামান্য স্লো করলো, যেইনা আমি বাম পা মাটিতে রাখতে গিয়েছি, বাস দিলো টান! আমি হুমড়ি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরলাম। কাহিনী এখানে শেষ হলেও ভালো ছিলো। আমি উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে আছি, ডান কান ঘেষে একটা রিক্সা গেলো। বাম পাশে ইঞ্চিখানেক দূর দিয়ে কয়েকটা প্রাইভেট কার গেলো। আমি যে নড়েচড়ে উঠে বসবো, সেই সাহসটা পাচ্ছিলাম না। উঠে বসলেই যদি মাথাটা গুড়ো করে চলে যায় কোনো বাস! এরপর কিছুক্ষন অপেক্ষা করে তারপর আস্তে আস্তে উঠে ফুটপাতে বসে ছিলে যাওয়া জায়গায় পানি দিয়ে ডলতে লাগলাম। অবাক হলাম, রাস্তায় এতো মানুষ, একটা মানুষ এগিয়ে আসা দুরের কথা, হাড্ডি ভেঙ্গেছে কিনা, তাও জিজ্ঞেস করলোনা !

 

 

এ রকম আরও কিছু ঘটনা থাকার কথা, মনে পরছেনা। আমার আর গোল্ডফিশের মিল একটাই, স্মৃতিশক্তি। মনে পরলে জানাবোনে।

জয়নুল আবেদীনের আঁকা “দুর্ভিক্ষ-১৯৭১” ছবিটি আমি আঁকবার চেষ্টা করেছিলাম। অনেকটা এরকম হয়েছে। তাঁর প্রতি আমার অনেক অনেক ভালোবাসা আর সম্মান আজীবন থাকবে

 

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে স্মৃতিচারণ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

9 Responses to আমার বেলা যে যায় সাঁঝ বেলাতে (স্মৃতি ঘাটানো লিখা)

  1. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    আরে ছবিটা তো অনেক সুন্দর!!!

    ছোটবেলার ঘটনাগুলো কথা চিন্তা করলে কি যে অদ্ভূত লাগে……

    ভালো হয়েছে লেখাটা। চমৎকার বর্ণনা। :clappinghands:

    • নিশম বলেছেনঃ

      :crying: আমি আবার ছুডু হইতে চাই। আমার আর ভালো লাগেনা, এই ভর্তি পরীক্ষা, হেন-তেন, পেরেম-পিরিত, মারদাঙ্গা পড়াশুনা। জীবনটা এলাচ-দারচিনি (তেজপাতার অল্টারনেট) হয়ে যাইতেছে ভাই

      লেখা ভালো লেগেছে জেনে ব্যাপক আনন্দিত :yahooo: :penguindance:

  2. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    দারুণ লেখা!
    মিয়া তুমি তো সিরাম পোংটা আছিলা 😛

    আরও শুনতে চাই!

    (মানুষ তো এমনই হয়ে গেছে! কে মরল কী আসে যায়!)

  3. কিনাদি বলেছেনঃ

    বান্দর পুলার দুর্ঘটনাবহুল লেখা সেইরাম স্বাদের হৈসে :happy:

  4. শিশিরকণা বলেছেনঃ

    :happy: 😛 😯

  5. মুবিন বলেছেনঃ

    ছোটবেলায় আমিও আকাম কুকাম করে চুপচাপ আম্মুর পাশে এসে ভালো ছেলে হয়ে যেতাম।
    :happy:

  6. সামিরা বলেছেনঃ

    জয়নুল আবেদীন নাহলে আইনস্টাইন! 😯
    আমিও আকাম করছি ছোটবেলায়, কিন্তু তোমার তুলনায় কিচ্ছু নাহ্‌!

  7. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    হায়রে নিশম! :thinking:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।