ধূসর নির্লিপ্ততা

দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি।
একসময় নিজের ভেতর একধরণের হিংস্রতা কাজ করত। যাকে খুশী ধরতাম, মারতাম, ঝাড়ি দিতাম। এসব করে কেমন যেন একটা পৈশাচিক আনন্দ পেতাম। এখন আর এসব ভাল লাগে না। আজকাল বরং পড়ন্ত বিকেল বেলা জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে পাখিদের নীড়ে ফেরা দেখতে ভাল লাগে, মাঝ রাতে আকাশের তারা গুণতে ভাল লাগে। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, এমন বদলে যাচ্ছি কেমন করে?

আজ ঘুম ভাঙ্গল মা’র বকুনি খেয়ে। বকুনি শুনতে শুনতেই হাত মুখ না ধুয়েই কোনরকমে একটা পাউরুটি মুখে গুঁজে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। মেইন গেটের বাইরে পা রাখতেই অনেকদিন পর সিঁথিকে দেখলাম রিকশা করে যাচ্ছে। ওকে কেমন জানি মন খারাপ করে আছে বলে মনে হল। শুনেছি ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ওর স্বাস্থ্য আগের চাইতে ভাল হয়েছে মনে হয় কিছুটা। লোকে বলে, মেয়েদের বিয়ে হলে নাকি স্বাস্থ্য ভাল হয়ে যায়। ওকে ডাক দিতে ইচ্ছা হয়েছিল একবার, কিন্তু কেন জানি ডাকলাম না! কী লাভ খামোখা ডাকাডাকি করে! ওর মন খারাপ হলেই আমার কী, আর খুশীতে ডগমগ হয়ে থাকলেই আমার কী! নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো আর কত!! এরপর সারাদিন পিচে ঢাকা রাস্তায় ‘একলা চল রে’! সারাদিনে উল্লেখযোগ্য কিছু বলতে এই।

একজনের কথা হঠাৎ খুব জানতে ইচ্ছা করছে। কেন করছে জানি না। আমি চাই ওর কথা ভুলে যেতে, আর ওর কথাই খালি আমার মনে হয়! বিরক্তিকর!! আচ্ছা, ওরও কী এমন করে আমার কথা মনে হয়? মনে না হওয়াটাই সম্ভবত স্বাভাবিক! কারণ… থাক, বাদ দেই ওর কথা!

সেদিন একটা রেইনট্রি গাছের চারা লাগিয়েছি। রেইন্ট্রি গাছ পরিবেশের জন্যে ক্ষতিকর। কিছু কিছু এলারজি জাতীয় রোগের কারণ এই রেইন্ট্রি। তাছাড়া মাটিরও ক্ষতি করে রেইনট্রি। কিন্তু রেইন্ট্রি গাছ দ্রুত বাড়ে, কাঠের মানও খারাপ না। ব্যবসায়িক বিবেচনায় এই দেশে রেইন্ট্রির চাইতে ভাল গাছ কমই আছে। পরিবেশের কথা ভেবে আমার কী! যাই হোক, গাছটা লাগানোর পর থেকে মাথায় কাঠের ব্যবসা করার ভূত ঢুকেছে। কাঠের ব্যবসায় লাভ ভাল।

অনেকদিন হয় বই পড়া হয় না। একসময় প্রচুর বই পড়তাম। কোয়েলহো, মার্কেজ, ওরহান পামুক থেকে শুরু করে শীর্ষেন্দু, সমরেশ, হুমায়ূন, আনিসুল, জাফর ইকবাল – সব পড়তাম। বই পড়ার ব্যাপারে মোটামুটি সর্বভূক শ্রেণীর প্রাণী ছিলাম। কিন্তু বেকার মানুষের বই পড়ার শখ থাকা ভাল না। বুদ্ধিজীবী গোছের মানুষেরা যত যাই বলুক, বাস্তবতা বুদ্ধিজীবীদের মত অত মন্থন বহন করে না! বাস্তবতা চলে পাড়ার চায়ের দোকানে সারাদিন গাল দিয়ে চেচানো লোকটার কথা মত। শখের দাম লাখ টাকা হলেও, ও দিয়ে পেট চলে না। তাই শখের বশে বই পড়ার অভ্যাসটা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। আমি তো আর নোবেল বিজয়ী কোন লেখক হব না! তবে হ্যাঁ, আমি যদি কোনদিন বুদ্ধিজীবী গোছের কেউ হতে পারি, তবে আমাদের গ্রামে একটা লাইব্রেরী তৈরি করব। সেখান থেকে গ্রামের সব লোক বই নিয়ে পড়তে পারবে, কোন টাকা-পয়সা লাগবে না এ জন্যে। বইয়ের পাতায় নূতনের প্রদীপ জ্বলবে, নতুন স্বপ্ন জন্ম নেবে – আমার মত মানসিক রোগী হবে না।

মাথায় কী যেন একটা প্রশ্ন ঢুকেছে। কিন্তু প্রশ্নটা ধরতে পারছি না। মনে হচ্ছে, এই প্রশ্নটার উত্তরের মাঝেই আমার আমিত্ব লুকিয়ে আছে। একটা বই হলে ভাল হত। বই পড়তে থাকলে সহজেই মাথার ভেতর থেকে প্রশ্নটা বের হয়ে আসত। সমস্যা হল, আমার বুকশেলফের সব বই বিক্রি করে দিয়ে সেই টাকা দিয়ে কয়েকটা চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্যে ব্যাঙ্ক ড্রাফট করেছিলাম। একটা চাকরিও হয় নি, কিন্তু আমার বইগুলো ঠিকই হাওয়া হয়ে গেছে! কী আর করা, যাই আকাশের তারা গুণি আর প্রশ্নটা ধরবার চেষ্টা করতে থাকি – কী আছে আর বেকার জীবনের পুনর্বয়নে … … …

২৮ এপ্রিল,
মিয়া ফাজিল চিশত্‌, সিলেট।

অনুজ সম্পর্কে

সাদা কাগজে কালো কালিতে লিখতে গেলে হয়ত লিখতে হবে - প্রথমত আমি রক্ত মাংসে গড়া এক মানুষ, দ্বিতীয়ত চিরন্তন সত্য, মৃত্যুর সাথে করি বসবাস... https://www.facebook.com/CoercedAnuj
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে হাবিজাবি-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

12 Responses to ধূসর নির্লিপ্ততা

  1. হৃদয় বলেছেনঃ

    ‘ধূসর নির্লিপ্ততা’ , বাহ! নামটা তো বেশ 😀 😛

  2. “বাস্তবতা চলে পাড়ার চায়ের দোকানে সারাদিন গাল দিয়ে চেচানো লোকটার কথা মত।” 😀
    জীবনঘনিষ্ঠ লেখা। চারদিকে নির্লিপ্ততা……… 🙁

    • অনুজ বলেছেনঃ

      “মানবিক বিষয়গুলো নিয়ে নির্লিপ্ততা কারও কাম্য হতে পারে না। তবু লোকের মনে যে নিজের স্বকীয়তাকে কেন্দ্র করে নির্লিপ্ততা কাজ করে না, তা নয়” – কথাটা কার ঠিক মনে নাই। কারণটাও জানা নেই।
      খুব বেশী রকমের আপেক্ষিক এই ব্যাপারগুলো।

  3. রুহশান আহমেদ বলেছেনঃ

    পড়তে গিয়ে ‘দি আউটসাইডার’ এর কথা মনে আসলো।

    ভালো লিখেছ।

  4. শারমিন বলেছেনঃ

    নামটা পছন্দ হয়েছে রে
    ভালো লিখা 😀

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।