যে গরম পরেছে, এই গরমে একটা কোকা-কোলার সুইমিংপুলে ডুব দিয়ে সাতার কাটতে পারলে ভালো হতো, তাই না? বেশী কোকা-কোলা কিংবা সফট ড্রিংক্স খাওয়াটাও শরীরের জন্য ভালো না, এ জন্য আমার আম্মু আমাকে বেশী বেশী লেবুর শরবত বানিয়ে দেয়। লেবুর শরবত বানাতে কি কি লাগে, তুমি নিশ্চয়ই জানো? চিনি, লেবুর রস আর পানি। এই তিনটা উপাদান একসাথে গ্লাসে নিয়ে এরপর ঘুটাও আর ঘুটাও, হয়ে যাবে লেবুর শরবত! আচ্ছা, আমি যদি এই শরবতটাকেই বলি, লেবু-চিনি-পানি’র মিশ্রণ, তুমি কি অসম্মতি জানাবে?
একসাথে কয়েক ধরনের জিনিস মেশালেই সেটা মিশ্রন, একেবারে সোজা বাংলায় এটাই সত্য। তুমি কিংবা আমি যদি বালু, চিনি আর হরলিক্স মেশাই – সেটাও মিশ্রন। আবার কাঠের গুড়ো, হলুদের গুড়া আর কোকা-কোলা মেশালেও সেটাও মিশ্রন। কিংবা মাটি আর লবন হাতে নিয়ে আলু ভর্তার মতো মাখালে সেটাও একটা মিশ্রন। আমরা কি তাহলে বুঝে গিয়েছি না, যে মিশ্রন কাকে বলে?
এবার তাহলে বইতে মিশ্রন এর সংগাগুলো কিভাবে লিখে, একটু দেখি। মুখস্ত করবার দরকার নেই, তুমি স্যালাইন বানাতে গেলে কেউ তোমাকে এই সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করবে না, তুমি নিশ্চিত থাকো।
মিশ্রনঃ একের অধিক বিভিন্ন পদার্থের সংমিশ্রনে যা পাওয়া যায় তাকেই আমরা মিশ্রন বলি।
কঠিন কিছু? মোটেও না! আচ্ছা, আমাকে একটা কথা বলো, সব মিশ্রনই কি এক রকম? লবন আর বালির মিশ্রন যেরকম, লবন-চিনি-পানি দিয়ে বানানো ওরস্যালাইন এর মিশ্রন কি ঐ একইরকম? এরকম একটা ভুয়া প্রশ্ন করাতে তুমি কি আমার উপর রাগ করছো? আমি তো জানিই যে তুমি সব বুঝো, দুইটা যে এক না, এইটা তুমি জানো, আমি জানি। তুমি যদি ভালো ছবি আঁকতে জানো, আমাকে শেখালে খুব উপকার হয়। আমি ছবি আকাতে খুবই খারাপ, বিশ্বাস না হলে এই দেখো!
ছবিটা দিয়ে কি বোঝাতে চেয়েছি ধরতে পেরেছো? এতো তাড়াতাড়ি ধরে ফেললে! দারুন মেধাবী তো তুমি! আমাদের বইগুলোতে যে মিশ্রনকে সমসত্ত্ব আর অসমসত্ত্ব নামে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, আমরা কিন্তু সেটা এর মধ্যেই পড়ে ফেলেছি!
এই যে লবন আর মাটির মিশ্রনের একেক অংশে একেক পরিমান লবন আর মাটি পাওয়া যাচ্ছে, এ কারণে এটাকে বলা হয় অসমসত্ত্ব মিশ্রন। আর স্যালাইনে গ্লাসের পানির যে কোন অংশই খেয়ে দেখা হোক না কেনো, সমান মিষ্টি আর লবনাক্ত লাগছে না? এ কারণেই এটাকে বলা হয় সমসত্ত্ব মিশ্রন। সমান ভাবে মিশে যাওয়া মানেই সমসত্ত্ব, আর সমান ভাবে না মিশে গেলেই অসমসত্ত্ব। পানির মতো সোজা, ঠিক না?
আচ্ছা, এই যে বললাম ওরস্যালাইন হলো সমসত্ত্ব মিশ্রন, এর মানে কিন্তু লেবুর শরবত থেকে শুরু করে চা-কফি এগুলোও সমসত্ত্ব। আচ্ছা, এগুলো তো সব একই রকম উদাহরণ, ভেবে দেখো তো আর কোন রকম উদাহরণ পাওয়া যায় কি না? এমন কি কোন উদাহরণ আছে, যে সমসত্ত্ব মিশ্রনে আমরা পৃথিবীর সবাই ডুবে আছি, কিন্ত কেউ হঠাত করে সেটা বুঝতে পারছি না? মাথা চুলকাচ্ছো? চুলকাতে থাকো, আমি আরেকটা ছবি এঁকে ফেলি ততোক্ষনে।
জ্বী ! সারা পৃথিবীর আমরা সবাই যে বায়ুমন্ডলে ডুবে আছি, সেই বাতাসও এক প্রকার সমসত্ত্ব মিশ্রন! তোমরা যদি অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড এই গ্যাস গুলোর নাম শুনে থাকো, তাহলে বলি তোমাদেরকে, এই পৃথিবীর সব জায়গার বাতাসের এদের পরিমান সমান –
নাইট্রোজেন – ৭৮.০৯%
অক্সিজেন – ২০.৯৫%
আর্গন – ০.৯৩%
কার্বন ডাই-অক্সাইড – ০.০৩৯%
পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের মোটামুটি সব জায়গায় এই গ্যাস গুলোর পরিমান সমান। তাহলে এটাকেও আমরা সমসত্ত্ব মিশ্রন বলতেই পারি, ঠিক না?
তাহলে শুধু যে ওরস্যালাইন বা শরবতই সমসত্ত্ব মিশ্রন না, তা আমরা বুঝতে পারলাম। এই যে শরবত কিংবা জুস কিংবা স্যালাইন, এই ধরণের তরল পদার্থে দ্রবীভুত মিশ্রনকে দ্রবন ও বলা হয়। তাহলে দ্রবন আসলে কিছুই না, এটা আসলে এক ধরণের সমসত্ত্ব মিশ্রন।
দ্রবন
এই মুহুর্তে আমরা দ্রবন কি, সেটা জেনে গিয়েছি। বই এর ভাষায় যদি বলা লাগে, তাহলে বলতে হয়, “দ্রবন হলো এমন দুই বা ততোধিক উপাদানের তৈরী এক প্রকার সমসত্ত্ব মিশ্রন, যাতে সকল অংশে সমান দশা প্রদর্শন করে”
এরকম কঠিন ভাষায় না লিখলে পরীক্ষায় নাম্বার দিক আর না দিক, তুমি বুঝতে পেরেছো তো, এতোক্ষন যা বক বক করলাম? ভেরী গুড। এবার একটু সামনে আগাই।
ধরো, তুমি চিনির শরবত বানাবে। এক গ্লাস পানি নিলে। এক চামচ চিনি দিয়ে নাড়ালে, চিনি অদৃশ্য হয়ে গেলো। অর্থাৎ, পানির সাথে মিশে গেলো। আরও এক চামচ, আরও এক চামচ। এরকম করতে করতে ৫ চামচ চিনি দিলে। দেখলে সব চিনি মিশে গিয়েছে, তলানীতে কিচ্ছু নেই। এরপর ষষ্ঠবারের মতো আরও এক চামচ চিনি দেয়ার পরে দেখলে, পানিতে চিনি আর মিশে যাচ্ছে না। চিনি নিচে পরে আছে। ব্যাপারটা এরকম হলো কেনো?
এর কারণ হলো, এই এক গ্লাস পানির ক্ষেত্রে এর থেকে বেশী আর চিনি ধারণ করা সম্ভব না, চার চামচের বেশী চিনি সে নিজের মধ্যে মেশাতে পারে না। এই যে চার চামচ চিনির পরে আর চিনি মেশাতে পারে না, এইরুপ দ্রবনকে বলা হয় সম্পৃক্ত দ্রবন। আর চার চামচের আগ পর্যন্ত চিনি দিলেই মিশে যাচ্ছিলো, তখন একে বলা হতো অসম্পৃক্ত দ্রবন। এই ক্ষেত্রে চিনিকে বলা হবে দ্রব আর পানিকে বলা হবে দ্রাবক। অর্থাৎ, দ্রবনে যেটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে সেটি দ্রাবক আর দ্রাবকে যা মেশানো হয়, তাকে বলা হয় দ্রব।
তাহলে, সম্পৃক্ত দ্রবন কি? দ্রাবক যখন দ্রবন তৈরী করতে গিয়ে এমন পরিমান দ্রব ধারণ করে যে আর দ্রব যোগ করলে সে দ্রাবক দ্রবীভুত করতে পারবে না, তখন সেই দ্রবনকে বলা হবে সম্পৃক্ত দ্রবন। আর সম্পৃক্ত হবার আগ পর্যন্ত দ্রাবকে দ্রব দিলে যদি দ্রবীভুত হতে থাকে, তখন তাকে বলা হবে অসম্পৃক্ত দ্রবন।
তোমাদের পাঠ্যপুস্তকে কলয়েড, সাসপেনশন, ইমালসন এর মতো দাঁত ভাঙ্গা আরও কিছু নাম আছে, ওগুলা না জানলে তো সমস্যা! একটু একটু করে, ওগুলোও বুঝে ফেলি আমরা, তাহলে মিশ্রণ পড়া শেষ!
কলয়েড জিনিসটা কি? আমরা কি মিটার, সেন্টিমিটার এসব চিনি? তাহলে আরেকটু জেনে রাখি, ১ মিটারের ১০০০ ভাগের ১ ভাগকে যেমন মিলিমিটার বলে, একই ভাবে ১ মিটারের ১০০০০০০০০০ ভাগের এক ভাগকে বলা হয় ১ ন্যানোমিটার। অনেক অনেক ছোট, ঠিক না? কোন বস্তুর আকার যদি ১-১০০ ন্যানোমিটার হয় তবে তাকে কলয়েড বলা হয় আর এই কলয়েড দিয়ে তৈরী দ্রবনকে বলা হয় কলয়েড দ্রবন। প্রোটিন অনু, ডিএনএ, আরএনএ অনু, লিপোপ্রোটিন এরা সকলেই কিন্তু কলয়েড।
একটি কলয়েড দ্রবনের দুইটি দশা থাকে। একটিকে বলে ডিসপার্সড দশা আরেকটি হলো ডিসপারশন দশা।
এই যে কলয়েড দ্রবন, এর ডিসপারসড দশা বা কলয়েড কণা যদি কঠিন হয় এবং ডিসপারশন দশা বা মাধ্যম যদি তরল হয়, তবে সে দ্রবনকে বলা হয় সাসপেনশন। যেমনঃ রক্তের প্লাসমাতে যে লোহিত রক্ত কনিকা কিংবা red blood cell (RBC) থাকে, সে RBC ও প্লাসমার দ্রবন এক প্রকার সাসপেনশন, একইভাবে তোমাদের যাদের আব্বু-আম্মুর গ্যাস্ট্রিক আলসারের সমস্যা, তারা দেখবে, তোমাদের আব্বু আম্মু এন্টাসিড নামের একটা সিরাপ খায়। সেটাও কিন্তু সাসপেনশন।
আবার, কলয়েড কণা ও মাধ্যম অর্থাৎ, ডিসপারসড ও ডিসপারশন উভয় দশাই যদি তরল হয়, তবে সে দ্রবনকে বলা হয় ইমালশন। যেমনঃ দুধ। দুধে যে চর্বি থাকে, সেটিও তরল আবার যে পানিতে সে চর্বির কণাগুলো থাকে, সেটিও তরল। চর্বির কনা হলো কলয়েড কণা। আর তাই, চর্বি কণা আর মাধ্যম পানি, উভয়েই তরল হবার কারণে দুধ এক প্রকার ইমালশন দ্রবন। তাহলে এই আলোচনা থেকে বোঝা গেলো, সাসপেনশন আর ইমালশন- উভয়েই কলয়েড দ্রবন। কয়েকটি ছবি দেখি, তাহলে আরও স্পষ্ট হবে –
বাস্তবে এরা কেমন, এবার আসো সেটা দেখি –
তাহলে সমসত্ত্ব মিশ্রনটির সাথে এদের পার্থক্য কোথায়? কলয়েড কণার আকার ১-১০০ ন্যানোমিটার হবার কারণে এদেরকে মাইক্রোস্কোপে দেখা যায়। কিন্তু সমসত্ত্ব মিশ্রণে দ্রবের কোন কণা মাইক্রোস্কোপেও দেখা যায় না।
তোমরা যদি চাও, তাহলে এই মিশ্রন নিয়েই আরও অনেক অনেক কিছু লেখা সম্ভব, এই কলয়েড দ্রবন নিয়েই আরও অনেক অনেক কিছু শেখা সম্ভব। গিবস-ডোনান ইকুইলিব্রায়াম, লায়োফিলিক-লায়োফোবিক কলয়েড আরও কতো কী! তোমরা আমাদেরকে অবশ্যই জানাবে, যদি আমাদের লেখা তোমাদের বুঝতে কষ্ট হয় বা কোন সমস্যা হয়। তোমাদের অনেক ভালো থাকা হোক।
নিশম সরকার
তৃতীয় বর্ষ (K-69)
ঢাকা মেডিকেল কলেজ
নিশম আগেও ভালো টিচার ছিল…এখনও আছে…ভবিষ্যতেও থাকবে,
ইনশাল্লাহ, এই দক্ষতা সময়ের বর্গের সমানুপাতে বাড়বে! 😀 😀
সাসপেনশন, ইমালসন এই টার্ম দুইটা আমারও ক্লিয়ার হয়ে গেল! পড়ে আরও অনেক কিছুই জানতে পারলাম। :happy:
একবার পড়লেই পুলাপানের মগজে পার্মানেন্ট হয়ে যাবে। চালিয়ে যা ব্যাটা… :dhisya: (লেখা বেশীই ভাল্লাগসে, আবেগে ব্যাটা বলছি সাথে ‘তুই’ ফ্রি ছিল! 😛 )
স্কুল পড়ুয়া রসায়ন শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্য পাঠ্য (রেফারেন্স) ।
চমত
স্কুল পড়ুয়া রসায়ন শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্য পাঠ্য (রেফারেন্স) ।