শুরুটা করছি শিরোনামের সাথে একেবারে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ অন্য একটা দৃশ্যপটকে সামনে এনে।
দেশে গুম, অপহরণ, খুন ইত্যাদি অপরাধ অত্যন্ত ভয়ানক হারে বেড়ে গিয়েছে। সম্প্রতি এই ইস্যুতে প্রতি মুহূর্তের মিডিয়া কাভারেজ ছিল চোখে পড়ার মত। ‘চোখে পড়ার মত’ কথাটা বললাম, কারণ ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি যে দেশের মিডিয়াগুলো পুরোপুরি স্বাধীন নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও গত কয়েক সপ্তাহ যাবত দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিউজ হিসেবে সব পত্রিকার পাতা কিংবা সব টিভি চ্যানেলের খবরের বৃহৎ অংশ জুড়ে ছিল গুম-অপহরণ সংক্রান্ত খবর, এবং এর প্রতিক্রিয়ায় নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ জনগণের আন্দোলনের বিষয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি।
বিষয়টা যে এমন গুরুত্ব পাওয়ার দাবী রাখে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। অবশ্যই বিচলিত হওয়ার মত একটা ব্যাপার। এত সংখ্যক জলজ্যান্ত মানুষ প্রতিদিন গুম হয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে এত লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে – একটা স্বাধীন দেশে এই ধরণের রাহাজানি ঘটতেই থাকবে, এটা মেনে নেয়ার মত কোন বিষয় নয়। সুতরাং এটা প্রধান খবর হবে, এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হবে – এতে কোন আপত্তি থাকার কোন কারণ নেই।
কিন্তু আপত্তিটা আমার অন্য জায়গায়, যেটা এই লেখার মূল প্রসঙ্গ। ঐ অপহরণ ইস্যুতে যেমন প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, তেমনভাবে “প্রশ্নপত্র ফাঁস” ইস্যুটা মিডিয়ায় ন্যূনতম গুরুত্বটুকুও পাচ্ছে কি? না, পাচ্ছে না! নিতান্ত এক/দুই কলামের ছোট্ট দু’চারটা নিউজ ছাড়া এখন পর্যন্ত ‘এক্সক্লুসিভ’ ধরণের কোন সরেজমিন রিপোর্ট, ফিচার, সম্পাদকীয় বা উপসম্পাদকীয় পত্রিকাগুলোতে আমার চোখে পড়ে নি! কোন টিভি নিউজের রিপোর্টও নয়, টকশো তো নয়ই! এর মানেটা কী দাঁড়ায়? এর অর্থ কি এই যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার এই প্রচলনের ভয়াবহতা আমরা ঠিক অনুভব করতে পারছি না? আমরা বিচলিত হচ্ছি না! আমাদের নিশ্চয় মনেই হচ্ছে না যে এটাও গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু! নাকি অন্য কিছু…?
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল অবশ্য লিখেছেন। কিন্তু লেখাটাতে সমস্যাটার ভেরিফিকেশন থাকলেও এর সমাধানে এই মুহূর্তে কী করণীয় হতে পারে সে ব্যাপারে কোন দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় নি। উনার কাছে ‘এক্সপেকটেশন লেভেল’টা সঙ্গত কারণেই একটু উঁচু, বিশেষত যখন তিনি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে লিখেন। কারণ ইতোপূর্বে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন সংকটে আমরা উনার সুপারিশ পেয়েছি। আশা করছি এ ব্যাপারেও সামনের লেখায় সেরকম কিছু পাওয়া যাবে।
দেড়যুগ-দু’যুগ আগে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় অভিশাপ ছিল “নকল”। এখন যখন সেই নকলের প্রবণতা “প্রশ্নপত্র ফাঁস” দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে গেল, সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে, সেই নকলের ট্র্যাডিশনটাও বোধহয় ‘এত বেশি’ জঘন্য ছিল না! সেকালে যারা নকল করেছে, তারা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর যারা পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়েছে, নিজেদের যোগ্যতায় শেষ হাসিটা তারাই হেসেছে। কিন্তু এখন? একজন পরীক্ষার্থী সে যতই ভাল (এবং নীতিবান) ছাত্র হোক না কেন, যখন সে ফেইসবুকে লগইন করলেই দেখতে পায় যে হোমপেইজে প্রশ্নগুলো ড্যাবড্যাব করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে, তখন কেউ সেটা নীতির জোরে ইগনোর করতে পারে বলে আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। অর্থাৎ এখন ফাঁকিবাজ ছাত্ররা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের পাশাপাশি এ প্রক্রিয়ায় প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদেরও সর্বনাশ হচ্ছে।
যে সরকার উটপাখির মত মুখ গুঁজে রেখে কিছু না দেখার ভান করছে, তাদের সমালোচনা করার রুচিটাও আমার অবশিষ্ট নেই। তাদের উপর কোনরকম চাপ সৃষ্টি না হলে এ সমস্যার সমাধান করার কোন সদিচ্ছা আছে বলে কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাই মিডিয়ার খানিক সমালোচনা করলাম। কিন্তু আসল প্রশ্নটা হচ্ছে, এখন ‘আমাদের’ করণীয়টা কী? প্রায় প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ এই অবস্থায় পরীক্ষা দিচ্ছে। ‘আমরা’ যারা দেশের ‘সাধারণ জনগণ’, তারা তো সবকিছু দেখছি, বুঝতে পারছি। অথচ আমরা ভাবছি আমাদের কিছুই করার নেই! কিন্তু আসলেই কি তাই? গুম-খুনের প্রতিবাদ জানাতে যেমন অনেক মানুষ রাস্তায় নেমেছে, ঠিক সে প্রক্রিয়ায় না হোক, অন্য কোন গঠনমূলক উপায়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের যথাযথ ‘প্রতিবাদ’ কি ‘আমরা’ জানিয়েছি? এমন কোন ‘মুভমেন্ট’ কি ‘আমরা’ হাতে নিচ্ছি যাতে করে এই ভয়ানক অনিয়ম বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়? নাকি তেমন পদক্ষেপ নেয়ার সময় এখনও আসে নি?
শিক্ষা হল জাতির মেরুদণ্ড। দেশের বার্ষিক বাজেটের সবচেয়ে বড় বরাদ্দ দেয়া হয় এই ‘শিক্ষা’ খাতেই। সেই শিক্ষাব্যবস্থার অধঃপতন আজ কতটা ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার সঠিক উপলব্ধি আমরা এখনও করতে পারছি না। এভাবে যদি চলতেই থাকে, তাহলে দশ বছর পর এই জেনারেশন যখন বিভিন্ন চেয়ারে স্থান নিবে, তখন হয়ত আমরা টের পাব। কিন্তু সে সময় আর কিছুই করার থাকবে না। সুতরাং… … …?
এ ব্যাপারে আসলেই গণসচেতনতা দরকার। ছোটো শিশুরাও ন্যায়-অন্যায় বুঝার আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের চক্রে জড়িয়ে যাচ্ছে 🙁
খুব বেশি দুঃখ পাই শুনে… আমারই আশেপাশে অনেক বন্ধুবান্ধবকে তাদের স্টুডেন্টরা তো বটেই, এমনকি স্টুডেন্টদের অভিভাবকরা পর্যন্ত ফোন করে ডাকে, পরীক্ষার আগেরদিন পাওয়া প্রশ্ন সমাধান করে দেয়ার জন্য!! আর সংখ্যাটা বোধহয় কমই, যারা “নীতি”র স্বার্থে এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতে পারছে। 🙁
এখন, অভিভাবক এবং গৃহশিক্ষকদের সচেতনতার অবস্থাই যদি হয় এই, তাহলে শিক্ষার্থীরা সচেতন হবে কীভাবে? নীতিবান হবে কীভাবে? ছোট শিশুরাই বা ন্যায়-অন্যায় বুঝবে/শিখবে কোত্থেকে?
আপনি যথার্থ বলেছেন। গণসচেতনতার কোনই বিকল্প নেই।
ব্যাপারটার গভীরতা চিন্তা করে হতাশ হই। চোখের সামনে ঘটনা ঘটছে কিন্তু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না, আর মিডিয়ার উদাসীনতা নিয়ে কিছু বলার নাই। আর আরেকটা গোষ্ঠীকে আমরা ভুলে যাচ্ছি, তারা হচ্ছেন অভিভাবক গোষ্ঠী। ইনারাও পরোক্ষভাবে কিন্তু এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের পেছনে দায়ী। এ নিয়ে বিশাল কমেন্ট করা যায়। আরেকটা সন্দেহ আছে যেটা আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি কিন্তু যেহেতু ঐটা সন্দেহ কিন্তু বাস্তব কিনা বলা যাচ্ছে না তাই আগেই কমেন্ট করলাম না। দেখি প্রশাসন কি করে।
যাই বল না কেন, দিনশেষে মিডিয়া আমাদের চিন্তাভাবনার বড় একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই তাদের উদাসীনতা নিয়ে বলতেই হয়।
আর “অভিভাবক” আসলে কারা? আমাদের বাবা-মা-ভাই-বোনরাই তো! দুর্ভাগ্য এটাই যে তুমি যা বলেছ, সেটা আসলেও ঠিক! পরোক্ষভাবে উনারা এই প্রক্রিয়াকে উৎসাহিতই করছেন! 🙁
তবে… … … “দেখি প্রশাসন কি করে” – তোমার এই চিন্তাটার সাথে একমত হতে পারলাম না ভাই। এই অপেক্ষায় মুখ বন্ধ করে থাকলে অন্তত এই ব্যাপারে পজিটিভ কিছুর আশা করা যায় বলে এখন আমার মনে হচ্ছে না।
যেদিন লিখেছেন সেদিনই পড়েছি। কী কমেন্ট করবো বুঝতে পারি নাই। আসলে পুরা ব্যাপারটা নিয়েই চরম টেনশনে আছি।
এক বান্ধবীর সাথে কথা বলতেছিলাম, আমরা যদি পরিমলের শাস্তির দাবীতে রাজপথে নামতে পারি তাহলে প্রশ্নফাঁসের বিরুদ্ধে কেন নামতে পারবো না? কেন এটার বিরুদ্ধে সেভাবে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা হচ্ছে না?
ও বলে, কারা নামবে? প্রশ্ন ফাঁস হইলে ত ওই অভিভাবক আর ছাত্রছাত্রীদেরই লাভ! তারাই কি টাকা দিয়া প্রশ্ন কিনে না?
কথাটা মেনে নিতে কষ্ট হলেও ঘটনা সত্য। 🙁
“প্রশ্ন ফাঁস হইলে ত ওই অভিভাবক আর ছাত্রছাত্রীদেরই লাভ! তারাই কি টাকা দিয়া প্রশ্ন কিনে না?”
আপনার বান্ধবীর অভিযোগটা মিথ্যে নয়। কিন্তু মনে মনে একটু হিসেব কষে দেখুন তো, *টাকা দিয়ে* যেসব অভিভাবক বা ছাত্রছাত্রী প্রশ্ন *কিনছে*, তাদের সংখ্যাটা কত হবে? আই মীন, দেশের শব ছাত্রছাত্রী আর তাদের অভিভাবকদের মোট সংখ্যার ঠিক কত শতাংশ হতে পারে? নিশ্চিতভাবে অনুমান করা যায়, প্রশ্ন *কেনাবেচা*র সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু প্রশ্ন একবার বেরিয়ে যাওয়ার পর সেটা *ছড়িয়ে দেয়া*র কাজে পরোক্ষভাবে অনেকে জড়িয়ে পড়ছে। এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু হচ্ছে সবাই, সব ছাত্রছাত্রী।
এই যে আপনিও যেমন বললেন, ” পুরা ব্যাপারটা নিয়েই চরম টেনশনে আছি।” এভাবে আমি-আপনিসহ যারা একটু-আধটু টেনশন করছি, বিড়ালের গলায় ঘণ্টি বাঁধার দায়িত্বটা আসলে তাদের উপরেই বর্তায়। সেক্ষেত্রে একেবারে নিজহাতে সেই বন্দোবস্ত করা সম্ভব না হলেও অন্য যাদের পক্ষে সম্ভব, তাদেরকে অন্তত মোটিভেইট করার উদ্যোগটা তো হাতে নেয়া যেতেই পারে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।