The Peacekeeper -বুক রিভিউ

হেড অফিসের কাছে মাইন অপসারনের কাজের জন্য একজন ইঞ্জিনিয়ার চেয়েছিলাম আমরা । এখানে আগেও দুজন ইঞ্জিনিয়ার কর্মরত ছিলেন ।

তারা এখন কোথায় ?

দুজনই মাইনের বিস্ফোরণে মারা গেছেন !!!!

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের মিলিটারি অবজারভার হিসেবে যোগ দিতে গিয়ে সেক্টর হেড এর সাথে যখন সাক্ষ্যাৎ করল তখন তিনি  উপরের তথ্য জানালেন সমির কে !!!!!

অবশ্য সমিরের এই তথ্যে ঘাবড়ে যাবার কোন কারন নেই। সমির- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন মেজর। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে শান্তিমিশনে লোকবল সরবরাহ করা একটা নিয়মিত ঘটনা আর সিরিয়াল অনুযায়ি সবাই এতে অংশ গ্রহন ও করে থাকেন।

সমিরের নাম যখন আসল তখন আর এ নিয়ে সে দ্বিতীয়বার চিন্তা করেনি, কিংবা বলা যায় সেনাবাহিনীর চাকরি করার কারনে দ্বিতীয়বার চিন্তা করার কোন সুযোগ ও ছিলনা।

মিলিটারি অবজারভারদের কোনধরনের অস্ত্র বহনের অনুমতি নেই, নিজেদের এলাকা নিয়ে নিয়মিত রিপোর্ট প্রদান, বিবদমান গ্রুপগুলোর মাঝে আলোচনা চালিয়ে শান্তিরক্ষার চেস্টা করা এই হচ্ছে মোটামুটি মিলিটারি অবজারভারদের কাজ, তিনচার জনের একএকটি গ্রুপ হিসেবে তারা বিভিন্ন এলাকায় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। শুনতে সহজ শোনালেও সব ধরনের যুদ্ধপরিস্হিতি আর বিপদের ঠিকি মোকাবিলা করতে হয় অবজারভারদের আর তাতে জীবনের ঝুঁকি কোন অংশেই কম নয়।

কিনশাসা- কঙ্গোর রাজধানী , এখানে বাংলা হাউজ নামে একটি বাসা অলরেডী পরিচয় পেয়ে গেছে। বাংলাদেশী মিলিটারি অবজারভাররা এখানে থাকেন। সমীরকে সাদরে বরন করে নিল স্বদেশীরা। ভীনদেশে অবস্হান কালে নিজ দেশ থেকে সদ্য আসা একজন মানুষকে দেখলে সবাই যে বেশ ফুরফুরে মেজাজের হয়ে যায় তা বেশ বোঝা গেল আগে থেকেই থাকা বাংলাদেশীদের আচরনে। সমিরকে কেন্দ্র করে চলল তাদের নানা খাদ্য উৎসব আর আড্ডা।সমিরের কিনশাসা জীবন বেশী দীর্ঘস্হায়ী হলনা, মিলোব (Military observer- Milob) হিসেবে তার করনীয় থেকে শুরু করে নানা নিয়ম কানুন এর উপর প্ড়শিক্ষন দেয়া হল সমিরকে- এটাই আগামী এক বছরের জন্য তার রুটিন বলা চলে।

ইকেলা – কঙ্গোর এক গ্রাম। আপাতত শান্ত- যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্হিতী সেখানে , মোটামুটি সব ধর্মেরই মানুষের বাস আছে বলতে  গেলে ঐ গ্রামে, আর লোকজনও বেশ আমুদে- সেটা আরও বেশী টের পাওয়া যায় যখন গ্রামবাসী উৎসবকে কেন্দ্র করে মহিলাদের ফুটবল খেলা আয়োজন করে আর সে খেলার মাঝে গোলকীপার খেলা বাদ দিয়ে বাচ্চাকে সাইডলাইনে বসে দুধ খাওয়ায় আর তার শূন্যতা পূরনের জন্য লোকজন যখন জোর করে আমাদের সমিরকে মাঠে নামিয়ে গোলবারে দাঁড় করিয়ে দেয় !!!!! অথচ এই গ্রামেরই চারপাশে যুদ্ধের চিন্হ বহন করে রয়ে গেছে শতশত মাইন, প্রায়ই যেগুলোর আঘাতে প্রানহানি হয় – তারপরও গ্রামবাসীগুলো বেশ সহজ সরল, নিজেরা ঠিকমতে খেতে না পারলেও মিলোবদের জন্য মাঝে মাঝে আয়োজন করে বিশাল খানা দানার- এই ইকেলাতেই সমিরের প্রথম দায়িত্ব পরে মিলোব হিসেবে।

সমিরের জীবনে যেন নিত্য নতুন চমক নিয়ে হাজির হল এই মিলোবের চাকরি। বহরুপী এই আফ্রিকান সমাজ- যেমন আমুদে তেমনই বর্বর, বিচিত্র তাদের জীবন ধারা, বিচিত্র তাদের ভোজনের সমাহার। বানরের মাথা থেকে অজগর সাপ্তাহিক হাঁটে বেঁচাকেনা হয়না এমন জিনিস খুজে পাওয়া দুষ্কর। গ্রামগুলোতে মেয়েরাই এখন সংসারটাকে ধরে রেখেছে, বাজার সদাই যেন তাদেরই কাজ। আর ক্রেতা ধরার জন্য তাদের বিচিত্র সব কাজ কারবার।

মানুষ এখনও মানুষের মাংস খায় -এ ঘটনা এখনও বর্তমান আফ্রিকাতে। আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করি আফ্রিকান মানুষদের মাঝে এই ভয়ংকর অভ্যাসটা আসলো কি করে !!! আর যায় হউক এই বর্বরতা আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে কখনোত ছিলনা । প্রায়ই মরতে বসা একদল মানুষকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে মিলোব রা , সেখানেই সমিরজানতে পারে এক ভয়ংকর গল্প । লেন্দু গোত্রের লোকজনের আক্রমনে লন্ডভন্ড হয়ে যায় হেমা গোত্রের লোকজনের জীবন। ঘরবাড়ি জ্বালনো বা হত্যা এতেই থেমে থাকেনি তারা। বন্দীদের চোখের সামনে দুদুটো তাজা প্রান তার জবেহ করে ফেলল আর চোখের পলকে চড়িয়ে দিল চুলোতে, সমান্য লবন ছিটিয়ে দিয়ে !!!! মনুষ্য মাংসে আরেকদল মানুষের ভূরিভোজ- কাহিনী এখানেই শেষ নয়, রয়ে যাওয়া অংশ খেতে বাধ্য করা হল তাদেরই স্বগোত্রীয়দের !!!!!! যুদ্ধ মানেই নারীর উপর বর্বরতা, বর্বর আফ্রিকানরাও এর বাইরে নয়…………

ভিন্নভিন্ন দেশের চারজন সেনা কর্তা অবস্হান ইকেলার মিলোব ক্যাম্পে । নিস্তরঙ্গ জীবনে পরিবার পরিজন হীন দিন গুলো তারা নিজেদের মত করে পার করে দেয়। এক একদিন এক এক দেশীয় খাওয়ার আয়োজন আর মাঝে মাঝে জাতিসংঘের অন্যান্য মিশনের লোকদেরকে রাখা হয় তাদের ভোজের আয়োজনে। সমিরের সাথে করে নিয়ে যাওয়া বাংলাদেশী মসলার সুনাম বা দূর্ণাম যায় বলা হউকনা কেন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ইকেলায়, অবাক বিস্ময়ে তারা দেখে সমির কি কি সব রংগীন পাওডার দিয়ে রান্না করছে !!!! থাকতে থাকতে গ্রমবাসীদের সাথে মিলোবদের আত্মিক সম্পর্ক ও তৈরি হয়ে যায় আর তাই প্রয়োজনে তাদের জন্য রক্ত দিতেও মিলোবদের কস্ট হয়না।

মুভিতে বা খেলার মাঠে আফ্রিকানদের আমরা আমুদে জাতি হিসেবেই দেখি, তাদের কাজ কর্ম যে মাঝে মাঝে আসলেই……………

মিলোবদের জন্য সাময়িক কাজ করতে আসা এক আফ্রিকানের আচরনে যেন তারই বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যায়। রান্না শিখিয়ে দিলে সে রান্না করতে পারবে- এই শর্তে রাজি হয়ে সমির তাকে রান্না শেখাতে বসে। যথারিতী বাংলাদেশী মসলার গন্ধে মুগ্ধ হয়ে সে দাবী করে তার পরিবারকে সে এই জিনিস একবারের জন্য খাওয়াতে চায়- এই বলে সমিরের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই হে হাজির করে তার বউ বাচ্ছা কে, আর সমির অবাক হয়ে দেখে সবাই তার ডাইনিং টেবলে বসে আছে খাওয়ার অপেক্ষায় যেন সমিরের গেস্ট। আরো মাথা খারাপ করা ঘটনা ঘটে যখন কাপড় ধুতে গিয়ে সমির একটা হাফ প্যান্ট কোন ভাবেই চিনতে নে পেরে আফ্রিকানের কাছে জানতে চাই এটা কার । আফ্রিকান নিশ্চিন্তে জবাব দেয় এটা আমার। সমিরের মাথা গরম হয়ে যায়, সে আফ্রিকানটাকে দেখাচ্ছিলো কি করে ওয়াশিং পাউডার দিয়ে কাপড় ধুতে হয় আর সে কিনা তার নিজের কাপড়ও বালতিতে দিয়ে দিয়েছে। এর কারন জানতে চািলে স্বভাব সুলব জবাব- তুমিত অনেকগুলো কাপড় ধুবে, সাথে আমার একটা ধুয়ে দিলে কি এমন ক্ষতি !!!!!!

এতকিছুর পরে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই আসলে ভাল, যেমন ভাল এই ইকেলার লোকগুলো। আমার কেমনজানি তাদেরকে আমাদেরই বাংলাদেশের কোন একটা গ্রামের লোক বলে মনে হয়েছে বারবার, অতিথি পরায়ন, হাসিখুশি সহজ সরল। আর তাইতো টোটকা কবিরাজের ব্যবসা ঐ আফ্রিকাতেও জমজমাট। কবিরাজের তেল শুধু আমাদের বাংলাদেশে নয় ঐ আফ্রিকাতেও সমান জনপ্রিয়- লোকজন লাইন ধরে সে ঔষধ কিনে নেয়। ভালবাসার বিনিময়ে তারাও ভালবাসা দিতে জানে, সেটা টের পাওয়া যায় দুইমাস পর সমিরের হঠাৎ বদলির আদেশ আসার পর। সমির পারেনি তার চোখের অশ্রু ধরে রাখতে, হাজার মাইল দূরের এই মানুষগুলো একে একে জড়িয়ে ধরছিলো তাকে, নানা উপহার হাতে করে নিয়ে এসেছিলো তারা । মানুষের ভালবাসা সব দেশে সব অঞ্চলেই আসলে এক রকম, সব ভালবাসাতেই বাধাহীন অশ্রু ঝড়ে পরে দুপক্ষেরই।

ইকেলা থেকে সোজা কিনশাসায় পোস্টিং, সমিরের ভাল লাগেনা, মন পড়ে থাকে ঐ দূর গ্রামে যাদের সাথে তার আর কোনদিনও যোগাযোগ হবার কোন সম্ভাবনা নেই , তাদের ভবিষ্যতই বা কেমন হবে তাও জানার আসলে তেমন অবকাশ নেই কিংবা নিজের ব্যস্ত জীবনে তা নিয়ে হা পিত্যেশ করারও সুযোগ নেই ।

হেডঅফিসে রুটিন জবে হাঁফিয়ে উঠে সমির আর তখনি খবর পায় বিদ্রোহ কবলিত এক অঞ্চলে নিহত হওয়া এক মিলোবের কথা, তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারে মাত্র বছর খানেক আগে বিয়ে করেছিলো সে, টেনশনে সাহস দেখাতে গিয়েই এই হারিয়ে যাওয়া সেই সাথে জানা গেল সে এ্যাম্বুশ থেকে কোনরকমে বেঁচে আসা এক নারী সৈনিকের কথা, স্বামী সন্তানের প্রতিঅনুপম ভালবাসার জোরেই যেন সে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসে।

তেমনি ভাবে মিলোবদের জন্য নতুন একটা সাইট রেকি করতে গিয়ে স্হানীয় নেতাদের অসহযোগীতার কারনে আরোও তিনজন সহ প্রায়ই মরতে বসার দুঃসহ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসে সমির, শেষ মুহুর্তে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করতে না পারলে জীবন নিয়ে আর ফিরতে হতনা। যুদ্ধবাজ নেতারা নিজেদের প্রয়োজনেই শান্তি চায়না , আর তার জন্য যে কাউকেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে তাদের বাঁধেনা, আবার সে বেঁচে আসাও হয় স্হানীয় কিছু লোকের উদারতায়, যারা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জীবিত ফিরতে সহায়তা করে সমিরদেরকে।

বাংলাদেশ- বুকের গভীরে খোদাই করা একটি নাম, তার উপর সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষনে এই নামটা তার রক্তবিন্দুতে বহমান। অন্য সব বাংলাদেশীর মতই এই নাম তার কাছেও গভীর ভালবাসার। চলতি পথে সমির মেনে নিতে পারেনা কেউ যখন তাকে ভারতীয় বলে ধরে নেয় কিংবা বাংলাদেশ কে কেউ না চিনলে । ভদ্রতার খাতিরে হয়ত কিছু বলতে পা পারলেও নিজে নিজে জ্বলতে থাকে। আর সেই সাথে অবাক হয়ে আবিষ্কার করে যুদ্ধপীড়িত এই সব দেশের লোকজনও আমাদের মত হিন্দী আগ্রাসনে কি করে আক্রান্ত। পেটে ভাত নেই কিন্তু অমিতাভ বচ্চন আর কাঁটা লাগার ঠিকি ভক্ত তারা, সমিরকে ভেবে নেয় অমিতাভের প্রতিবেশী আর আব্দার করে ভারতীয় ডিভিডির !!!!

নারী- সবসময় সর্বাবস্হায় পুরুষের মস্তিষ্কে আলোড়ন তুলবেই, তা সে প্রেয়সীর বেশে হউক আর আপনজনের মমতানিয়েই হউক। দশবছরের ভালবাসা- দশ বছরের সংসার, শ্রাবন্তী- বুকের গভীরে জায়গা করে নেয়া একটি নাম, সমির একটি বারের জন্যও ভুলতে পারেনা।শাবন্তী যেন তার শক্তি, সাহস- আর ভালবাসা মাঝে মাঝে বোকামিও ডেকে নেয়, তাই মাথার উপর দিয়ে বুলেট যখন শিষ কেটে যায় তখন একটি বার কথা বলার জন্য সমির শ্রাবন্তীকে ফোন করে বসে । আর তখনই বুঝতে পারে এই বিপদের কথা ওকে জানিয়ে কি বোকামিটাই না করল- কিংবা কে জানে প্রিয় মানুষটি তার জন্য কতটা কুঁকড়ে আছে, তাকে কতটা ভালবাসে কতটা ফিল করে – এই সত্যটুকু আবিষ্কারের মাঝে অন্যরকম একটা স্বর্গীয় অনুভূতি আছে, ভালবাসা জানার মাঝেও আছে অনুপম ভাললাগা, হয়ত এই জন্যই পুরুষ নানারকম বোকামিও করে বসে !!!!!

শ্রাবন্তীর এই ভালবাসার শক্তি অসাধারন-তাই ভিনদেশী এক অপরুপার বাড়িয়ে দেয়া ফোন নাম্বার যখন হেলিকপ্টারের বাতাসে উড়ে যায় একটুও মন খারাপ হয়না সমিরের, বরং ভাললাগে এই ভেবে ভুল করার কোন সুযোগ না থাকাই। কি দরকার জীবনে নিজেকে বারবার পরীক্ষার মুখোমুখি করার।

মানুষ মাঝে মাঝে দেশ কালের সীমা রেখা থেকে বের হয়ে আসে, যেমনটি সমিরের জীবনে এসেছিল ফারজানা। ভারতীয় এই নারী বড়বোনের মত মমতা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল সমিরের পাশে সবসময়। শেষ মুহুর্তে হেলিকপ্টার যখন সমিরকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে, এয়ারপোর্টে এসে সমির দেখতে পায় সারারাত নির্ঘহুম কাটানো ফারজানা সেখানে হাজির সুস্হ সমিরকে দেখার প্রত্যাশায়, কিংবা বাইরে প্রচন্ড গোলাগুলি আর মৃত্যভীতি সমিরের সাথে ফারজানাকে ঘুমাতে দেয়নি একটু পরপর ফোন করে সে নিজেকে আস্বশ্ত করছিলো সমির বেঁচে আছে বলে।

বহতা নদীর মত সময়ের ও থেমে থাকার অবকাশ নেই। তাই এক বছরের মিশন যেন হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায় । নিজের মানুষের কাছে। নিজের দেশে যে আবেগ সেটা যে অন্য দেশের অন্য মানুষদের কাছে পাওয়া যায়না বিদায় বেলায় সে সত্যই যেন সমির টের পায়। সবাই তাকে বিদায় জানায়, তারপর আবার নিজ নিজ কাজে ফিরে যায়, কোথাও বিচ্ছেদের সুর বাজেনা, সমিরের সে নিয়ে ভাববার অবকাশ থাকেনা, নিজের প্রিয়জনের কাছে ফিরে আসার যে তাড়না তার কাছে অন্য কোন প্রত্যাশার আসলে কোন মূল্যই নেই।

সমির আবিষ্কার করে কিনশাসার মার্কেট আর আমাদের নিউমার্কেট দুটোই যেন এক। শ্রাবন্তীর সাথে বিরক্ত নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে যে শপিং সে শিখেছিল সেটাই যেন বাঁচিয়ে দেয় তাকে আর তাই ২০০ ডলারের পেইন্টিংকে অবলীলায় সে ৫-১০ ডলার দিয়ে কিনে নেয়, মনে মনে ধন্যবাদ জানায় শ্রাবন্তীকে নিউমার্কেটের সকাল গুলোর জন্য । ।

সমির -বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ফরেন এ্যাফেয়ার্স ডিভিশনে কর্মরত ছিল। কঙ্গোয় যাওয়া আর ফিরে আসার দুটো সময়ই ছিল তার জন্য বিষাদ ময়। বেনিনে বিমান দূর্ঘটনায় নিহত পনের সেনা সদস্যের লাশ গ্রহন করার পরপরই সেহাতে পায় কঙ্গো যাবার চিঠি আর ফিরে আসার ঠিক আগ মুহুর্তে খবর পায় নয় বাংলাদেশী সেনার নিরমম মৃত্যু সংবাদ। হেমাদেরকে রক্ষা করার জন্য নিয়োজিত বাংলাদেশী সৈনিকরা একটা হেলিপ্যাডের জায়গা খুজতে গিয়ে লেন্দুদের নির্মম আক্রমনের স্বীকার হয়। পড়তে পড়তে আমার নিজেরই রক্ত গরম হয়ে গিয়েছিল প্রতিশোধ নেয়ার কথা ভেবে, প্রতিশোধ নেয়াও হয় কিন্তু ভুল প্ল্যানিং এ হারিয়ে যাওয়া সেনারতো আর ফিরে আসার নয়। মাত্র নয় জন মিলে অমন দুর্গম জায়গায় অপারেশনে যাওয়া যে কত বড় বোকামি ছিল জীবনের বিনিময়েই যেন তারা সেটা দেখিয়ে দিল !!!!

সমির সুস্হ ভাবেই ফিরে আসে তার শ্রাবন্তীর কাছে। কিন্তু এই ফিরে আসার সাথে সাথে শেষ হয়ে যাওয়া বইটা যেন আমার মাঝে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি করে। কয়েকদিন বুঁদ হয়ে ছিলাম এই বইয়ে , বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর সাব্বির আহসান তার মিলোব জীবনের উপর এই বইটি লিখেছেন। বইটিকে উপন্যাস হিসেবে দাবী করা হলেও আসলে এটা যে তারই একবছরের কঙ্গোর ডায়েরি সেটা বুঝে নিতে কস্ট হয়না। আফ্রিকার নানা অজানা কাহিনী উঠে আসে তার স্বল্প সময়ের বয়ানে।

প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে বইটি নিয়ে বসতাম, শেষ হয়ে যাওয়ায় কেমন শূন্যতা তৈরি হয়, কঙ্গো নিয়ে জানার অতৃপ্তিটা রয়ে যায়।

[

কঙ্গো, মধ্য আফ্রিকার একটি দেশ। সোনার হাঁসই বলা যায় তাকে। সোনা, ডায়মন্ড আর নানা প্রাকৃতিক খনিজে ঠাসা তার পেট। আর এই সবই যেন তার নানা দুর্ভোগের কারন। বেলজিয়াম এর কাছ থেকে স্বাধীনতা পেলেও তার উপর বিদেশী শক্তির খড়গ তাই লেগেই থাকে, আর তাদেরই প্ররোচনায় তৈরি হয় নানা যুদ্ধবাজ দল আর উপদলের। ব্লাড ডায়মন্ড – ডি ক্যাপ্রিউর মুভিটা যেন কঙ্গোর বাস্তবতার ট্রেলার । রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের ক্ষমতার মোহে হাতে তুলে দেন অস্ত্র আর বিশ্ব নেতারা তাতে দিয়ে যান ইন্ধন। নিরীহ অশিক্ষিত জনগন হয়ে উঠেন বর্বর যোদ্ধা, রক্তই তাদের নেশা, শিশুরা হাতে নিয়ে ঘোড়ে একে ৪৭ আর গ্রেনেড, ইচ্ছে হলেই উড়িয়ে দেয় যাকে তাকে, ক্ষুধার তাড়নায় নরভোজি হয়ে উঠতেও বাঁধেনা তাদের !!!! নেতারা নিজেদের স্বার্থে , আর অস্ত্রের জোড়ে যখন তখন নিজের প্রদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন যার মুলে আসলেই বিদেশীদের নাড়ানো কলকাঠি ।

 

জাতিসংঘের চেস্টায় কিছুটা শান্তি যখন  ফিরে আসছিলো তখনই প্রতিবেশী রুয়ান্ডার গৃহযুদ্ধ আবারও দুই ভাগে ভাগ করে দেয় কঙ্গোলীজদের। হেমা আর লেন্দু এই দুই ট্রাইবেরই বসবাস কঙ্গো জুড়ে। রুয়ান্ডার ঘটনার সূত্র ধরে লেন্দুরা ঝাপিয়ে পড়ে হেমাদের উপর। দুপক্ষই অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, নিজেদের রক্তে কঙ্গোলীরা মেতে উঠে হোলি খেলায় !!!!!

সোনা আর ডায়মন্ডের খনি তাদের কোন সমৃদ্ধি তো দেয় নাই উল্টো এসবই যেন তাদের জন্য অভিশাপ । গুটিকয় ক্ষমতাধরই দেশটির সব সম্পদের মালিক, তার তাই কিনশাসার রাস্তায় ছুটে চলে সব বিএমডাব্লিউ আর মার্সিডিস, রাতের কিনশাসা আর ইউরোপের কোন শহরের মাঝে পার্থক্য খুব কমই !!!! এক কথায়-

A country with a government whose principal aim was to loot public goods.

http://en.wikipedia.org/wiki/Congo_Crisis

http://www.enoughproject.org/conflict_areas/eastern_congo/roots-crisis

http://en.wikipedia.org/wiki/Ituri_conflict   ]

বইটি বাংলাদেশে প্রকাশ করেছে “সাহিত্য প্রকাশ”, ৮৭ পুরানা পল্টন লেন । দাম- ৩৫০ টাকা ।

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বইপড়ুয়া-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

32 Responses to The Peacekeeper -বুক রিভিউ

  1. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    “A country with a government whose principal aim was to loot public goods.”

    বইটার ঘটনা পড়ে বইটা পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। আর, আবার নতুন করে জানলাম, পৃথিবীর সব জায়গার মানুষই আসলে এক। পার্থক্য শুধু গায়ের রঙ আর ভাষায়।
    🙂

  2. বাবুনি সুপ্তি বলেছেনঃ

    ভাবতেই অদ্ভুত লাগে! অন্য দেশে বিপদের মাঝে থাকা। শেষ কথাটা সব জায়গাতেই সত্য শুধু পদ্ধতি ভিন্ন।

  3. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    আমাদের সেনা কর্মকর্তারা কীভাবে কষ্ট করছেন, রিস্ক নিচ্ছেন আগে জানতামই না!
    স্বজন থেকে দূরে ছাড়াও কত কষ্ট!

    গরীব দেশের সম্পদ থাকা- কত বড় অভিশাপ!

    দারুণ ঝরঝরে লেখা।
    একটানে শেষ করলাম 😀

  4. শিশিরকণা বলেছেনঃ

    ভালো লাগলো, ভালো লিখেছেন , অনুভুতিগুলোর প্রকাশ অসাধারণ হয়েছে …. :dhisya:

  5. জ্ঞানচোর বলেছেনঃ

    অনেক ভাল লাগলো। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির কাছে, তার চেয়ে জাস্ট কিছুটা এগিয়ে থাকা জনপদের একজন সৈনিকের ভিউ।
    আপনার লেখা চমৎকার লাগল। বুক রিভিউ হিসাবে বই থেকে কিছু কোটেশন থাকলে আরো ভাল লাগত।
    ধন্যবাদ এত ভাল একটা লেখা শেয়ার করার জন্য।

  6. নতুন একটা ছবি হঠাৎ ভেসে উঠলো মনে হলো! এমন কিছু পড়িনি আগে আসলেই! চমৎকার লিখার হাত ভাইয়া!

  7. খাপছাড়া বলেছেনঃ

    চমৎকার লেখনী!! পড়ে অনেক ভাল লাগলো!

  8. অরণ্য নীলিন বলেছেনঃ

    দারুন লাগলো … গর্ব করার মত কাজ করছে আমাদের সেনাবাহিনী ।

  9. কিনাদি বলেছেনঃ

    দারুণ লাগলো 🙂

  10. নীল রঙ পরী বলেছেনঃ

    অনেক জায়গা আছে আফ্রিকায়, যেখানে আমাদের সেনাবাহিনীর মানুষগুলো অক্লান্ত পরিশ্রম করে ওই দেশটাকেও শান্তিতে রাখছে।

    আর্মির ভিতরে থাকতে থাকতে দেখতে পাই প্রায়, বাবারা তাদের সন্তানদের ছেড়ে চলে যায়, এমন সব জায়গায় যেখান থেকে নিয়মিত ফোনটা পর্যন্ত করা যায় না।

    তবুও মেনে নেয়া।
    শ্রদ্ধা জাগে এই মানুষগুলোর প্রতি, যারা এতো এতো মাইল দূরে থেকেও দেশের পতাকাটাকে সমুন্নত রাখছেন।

    লেখা খুব ভাল হয়েছে।

  11. মাসরুর বলেছেনঃ

    সেরকম রিভিউ হয়েছে!! আমার তো মনে হইতেসে এখনি সংগ্রহ করে পড়তে বসি.. 🙂

  12. মুবিন বলেছেনঃ

    অসাধারণ রিভিউ।
    আশা করছি বইটাও অসাধারণ হবে।

    আচ্ছা বইটা কি ব্লগার ডিস্কো বান্দরের লেখা?
    কোথায় যেন দেখেছিলাম এরকম কিছু একটা।

  13. প্রজ্ঞা বলেছেনঃ

    বই পড়ার আগেই বুক রিভিউ পড়লাম!
    ভাবছি, রিভিউ এতো ভাল হলে, বইটা না জানি কি হবে!

  14. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    এই মূহুর্তে বইটা পড়তে না পারার জন্য একরকম আফসোস-ই হচ্ছে।
    ব্লাড ডায়মন্ড মুভিটা দেখেছিলাম। অসাধারণ, পুরো দম বন্ধ করা একটা মুভি। লিওর ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম এই মুভিটা আর ওর ‘বডি অফ লাইগ’ মুভিটা দেখার পর থেকে।
    এই চিত্রপটের বইটা পড়তে তাই লোভ হচ্ছে ভীষণ।

    সেনা কর্মকর্তাদেরকে আমার শ্রদ্ধা।
    কী অপরিসীম কষ্ট সহ্য করতে হয় তাদেরকে, দেশ ও আপনজনকে ছেড়ে গিয়ে।

    এক কথায়, আপনার পোস্টটি দারুণ লাগল আমার। শুধু যদি বানানের প্রতি যদি আরেকটু সদয় দৃষ্টি দেন তবে পরেরবার আরো চমৎকার লেখা পাব আপনার কাছ থেকে- আশা করি।

  15. নিলয় বলেছেনঃ

    “A country with a government whose principal aim was to loot public goods.”

    বইটা পড়তে আগ্রহ হচ্ছে- অসাধারণ রিভিউ! :clappinghands:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।