[১]
পাশের বাসার পিচ্চিঃ “আপু, জানো? আমার আম্মুর বেবি হবে। আমার বোন লাগবে।”
বললাম, “কেন ভাই হলে ভালো হয় না?”
সে বলল, “ওর জন্য তো আমি ভাই আছি-ই। আম্মুর তাহলে ছেলে মেয়ে সব থাকবে।”
এইসব নিয়ে ওর সাথে কথা হচ্ছিলো। এক পর্যায়ে সে বলে, “আচ্ছা আপু, বিয়ে হওয়ার পরে কেন বেবি হয়? বিয়ে হওয়ার আগে কেন হয় না?”
একটু ভাবলাম কীভাবে মিথ্যা না বলে ওর উপযোগী করে উত্তরটা দেওয়া যায়।
আমি তাই বললাম, “ভাইয়া, একটা বাবু যেন সুন্দর করে বেড়ে ওঠে তাই বাবা মা দুজনই যে দরকার! বিয়ের আগের বাবা আর মা দুজন অন্য জায়গায় থাকে।তাই তারা একসাথে বাবুটাকে বড় করে তুলবেন কিভাবে বলো? সেজন্য আল্লাহ নিয়ম করে দিয়েছেন যে, বিয়ে হওয়ার পরই বেবি হতে হয়।”
[২]
কিম্ভুত কিম্ভুত উত্তর পায় শিশুরা যখন জিজ্ঞেস করবে কোথা থেকে সে এল। “তোমাকে হাসপাতাল থেকে কিনে এনেছি।” অথবা, “আকাশ থেকে এসেছো।” “তোমাকে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি।”
অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ‘জন্মকথা’য় সবচেয়ে সুন্দর করে বলেছিলেন, “ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।”
আচ্ছা কয়েকটা গল্প বলি। 🙂
নুহার (বয়স চার) ছোট বোন হবে। ও মাকে জিজ্ঞেস করছে, “আম্মু বাবুটা তোমার পেটের ভেতর কিভাবে গেলো?
আম্মু উত্তর দিলেন, “আল্লাহ দেখলেন যে নুহা খুব একা একা হয়ে গেছে। ওর কোন খেলার সাথী নাই বাসায়। সেজন্য আল্লাহ আরেকটা বাবুকে আম্মুর ভেতর দিয়ে দিলেন যেন তুমি ওর সাথে খেলতে পারো।”
“কিন্তু আল্লাহ কিভাবে দিলেন আম্মু? তোমার পেট কেটে তারপর বাবুটাকে রেখে দিয়েছেন?”
“না তো নুহা! আল্লাহ বাবুর একটা ছোট্ট শরীর মার ভেতর দিয়েছেন। যেটা দেখতে একদম একটা বলের মতো। তারপর বাবুটার আত্মাকে মা-র ভেতর দিয়েছেন। অনেক দিন ধরে বাবুটা একটু একটু করে বড় হচ্ছে। বাবুর হাত, পা, চোখ, নাক সব হবে । যখন ও দেখতে ঠিক একটা সত্যিকার মানুষের বাচ্চার মত হবে তখন ও আর আম্মুর পেটের ভেতর থাকতে চাইবে না। তখন ও কে ডাক্তাররা পেট থেকে বের করে আনবে।”
[৩]
আরেকটা গল্প বলি, হ্যাঁ?
খুবই হিউমিলিয়েটিং সিচুয়েশন তাসনুভাদের বাসায়। প্রবলেম হলো ওর পিচ্চি ভাই খুব পাজি। ও কে রমাদানের মধ্যে একবার নাকি খেতে দেখেছে আর তা বাসার সবার কাছে বলে বেড়িয়েছে। এতে তাসনুভা ভীষণ লজ্জা পেয়েছিলো। তাই এরপর থেকে আর রমাদানে সে ওইদিনগুলোতেও পারতপক্ষে কিছু খায় না। পর্যাপ্ত পানি আর মিনারেল না পাওয়ার কারণে কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে গেলো সে।
আচ্ছা, আরেকজন বাবার কথা বলি। রামাদান মাস চলছে।
সাত বছরের শিশুকন্যা তার বাবাকে বললো, “বাবা একটা কথা চুপিচুপি শুনো। মামণি না আজ রোজা রাখে নি!! আমি মামণিকে দেখেছি একটু আগে পানি খেতে।”
বাবা একটুও বিব্রত না হয়ে বললেন, “মা, তুমি পৃথিবীতে আসার আগে কোথায় ছিলে?”
“কেন আল্লাহর কাছে!”
“হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই! আল্লাহর কাছ থেকে পৃথিবীতে আসার মাঝখানে কোথায় ছিলে?”
মেয়ে এবার বুঝেছে। মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “মামণির ভেতরে।”
“আচ্ছা, তাহলে শুনো মামণি! মানুষের বাবু খুব দামী জিনিস না? যেমন আমাদের কাছে তুমি। তেমন বাবুটা পৃথিবীতে আসার আগে যেখানটায় থাকবে সে জায়গাটাও খুব পরিষ্কার হতে হয় না? না হলে তো ও অসুস্থ হয়ে পড়বে।” মেয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
“আর মা কারা হয় তা তো জানো। মেয়েরাই। সেজন্য প্রতি মাসেই মেয়েরা- যারা বড় হয়েছে- তাদের ভেতর বাবু রাখার যে থলেটা আছে সেটা ফেরেশতারা পরিষ্কার করে দেন। আর ময়লাগুলো যতক্ষণ না পরিষ্কার হচ্ছে ততক্ষণ তাদের নামাজ পড়তে হয় না, রোজা রাখতে হয় না।”
শিশুরা খুব বুদ্ধিমান, কৌতূহলী হয়। আমাদের দেশে শিশুদের সাথে এই বিষয়গুলোতে মিথ্যাচার পুরোপুরি জায়েজ করে রাখা আছে। যেন এটা একধরনের ‘হোয়াইট লাই’। কিন্তু কেন এমন হবে? কেন এই বিষয়গুলো সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয়া হয় না শিশুদের? আমরা চাই বাচ্চারা সত্য কথা বলা শিখুক অথচ নিজেরাই মিথ্যা বলছি। আমাদের এই দ্বৈততা মোটেই কাম্য নয়। স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে ওরা প্রশ্ন করতেই পারে। আমাদের দরকার দায়িত্বশীলতার সাথে উত্তর দেওয়া।
উপরোক্ত বিষয়ে এক সচেতন মায়ের চিন্তা,
“বাচ্চাদের আসলে প্রশ্নের উত্তর কিন্তু খুব বেশি বিস্তারিত দেয়া লাগে না। মোটামোটি একটা উত্তর দেয়া লাগে, যেই উত্তরগুলো অর্থবহ। বাকিটুকু ওরা নিজেরাই ভেবে বের করে, ক্রিয়েটিভ এক্সারসাইজ হয়। উত্তরগুলোতে কোন মিথ্যা থাকে না বলে নিজেদের মধ্যে কনফ্লিক্টে থাকে না, তাই যার তার কাছে উত্তরও খুঁজতে যায় না। আস্তে আস্তে যখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় উত্তরগুলো জানে তখন সেগুলো নিয়ে ওভার অবসেশন তৈরি হয় না।” *
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারেই এখন ইন্টারনেট অ্যাভেইলেবল। এই মুক্ত বিশ্বে আমরা ওদের বাধ দেবো কি দিয়ে? আপনার উপর বিশ্বাস না থাকলে আর কদিন পর শিশুটা আপনার কাছেও জানতে চাইবে না, সোজা গুগল সার্চ করবে। সে কি খালি দরকারী তথ্যটাই পাবে??? :thinking: আপনি ভাবনা চিন্তা ছাড়া দায়সারা গোছের একটা উত্তর না দিয়ে একটু ভাবুন- আপনার শিশুর বয়স, মানস, পরিবেশ চিন্তা করে ওভারঅল একটা সত্য উত্তর দিন আর কিছুটা শিশুর ইমাজিনেশনের উপর ছেড়ে দিন!
বাবামায়েদের সচেতনতা একান্তভাবে কাম্য!
পাদটীকাঃ
লক্ষ্য করুন!! বিষয়টি এমন যে- এটা রীতিমতো গবেষণার দাবী রাখে- বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটা শিশুর প্রাথমিক Sex Education কেমন হতে পারে। আমার স্বল্প জ্ঞানে ও সামান্য অভিজ্ঞতায় আসলে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করা হয় নি। এখানে উল্লিখিত প্রশ্ন বা তার জবাব কেবলি উদাহরণস্বরূপ। শিশুর বয়স, ধর্ম ইত্যাদি ভেদে আপনার উত্তর ভিন্ন হতে পারে। সচেতন বিজ্ঞ পাঠকের আলোচনা, পরামর্শ ও সমালোচনা আশা করি।
*লেখাটি যখন লিখেছিলাম (২০১২ সালে) সিডনি থেকে সাদিয়া হোসাইন আপু অভিমতটি জানিয়েছিলেন।
লেখাটা প্রিয় স্বরে নিলাম
অসম্ভব সুন্দর একটা লেখা।
বিশেষ করে “মানুষের বাবু খুব দামী জিনিস না? যেমন আমাদের কাছে তুমি। তেমন বাবুটা পৃথিবীতে আসার আগে যেখানটায় থাকবে সে জায়গাটাও খুব পরিষ্কার হতে হয় না? না হলে তো ও অসুস্থ হয়ে পড়বে।” মেয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
“আর মা কারা হয় তা তো জানো। মেয়েরাই। সেজন্য প্রতি মাসেই মেয়েরা- যারা বড় হয়েছে- তাদের ভেতর বাবু রাখার যে থলেটা আছে সেটা ফেরেশতারা পরিষ্কার করে দেন। আর ময়লাগুলো যতক্ষণ না পরিষ্কার হচ্ছে ততক্ষণ তাদের নামাজ পড়তে হয় না, রোজা রাখতে হয় না।””
এই রকম লেখা আরও আসুক। আমরা শিশুদের বড় মনটাকে ছোট না করি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে আজই এই রকম একটা লেখা পড়ছিলাম। ব্রেইন পিকিংস এ।
http://www.brainpickings.org/index.php/2014/05/14/sophie-blackall-the-baby-tree/
যারা অলরেডি আব্বুম্মু কিংবা এ বিষয়ে ভালো জানেন তারা যদি লিখতেন তাহলে আমরা অনেক উপকৃত হতে পারতাম।
“শিশুদের বড় মনটাকে ছোট না করি।”- কঠিনভাবে একমত!
সুন্দর অনুপ্রেরণাদায়ক মন্তব্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
অটঃ ওহ! ব্রেইন পিকিংসের লেখাটা জব্বর! এমন বই যদি বাংলাদেশে পাওয়া যেত কত ভালোই না হত… একটা খসড়া অনুবাদ-মত করেছি, সরবে দিয়ে দেবো পরে। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সময়োপযোগি একটা লেখা। সুন্দর লিখেছেন।
“আমরা চাই বাচ্চারা সত্য কথা বলা শিখুক অথচ নিজেরাই মিথ্যা বলছি। আমাদের এই দ্বৈততা মোটেই কাম্য নয়।” একদম সত্য কথা!
এই বিষয়ে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী গবেষণা হওয়া দরকার।
জ্বি। আপনার সাথে একমত।
খুব সুন্দর লিখেছেন, খুব বেশি সুন্দর।
এভাবে লিখলে পড়ে আনন্দ লাগে, শিখেও,জেনেও।
আপনাদের ভালো লেগেছে জেনে সাহস পাচ্ছি মনে…
অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্যে আন্তরিক ধন্যবাদ
কিছুটা অসুস্থ আমি। কি-বোর্ড হাতে সময় নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করতে পারছি না। আর প্রশংসা…সেটাও না’হয় জমা থাকল 😛 …পরবর্তীতে ইনশাল্লাহ সময় নিয়ে, ধীরে-সুস্থে জানাব। তবে লেখার মর্মার্থ মর্মে উপলব্ধি করে আমার চার বছরের ছোট ভাইয়ের বেলায় খাটানোর চেষ্টা করব; ওর প্রশ্ন করার ফ্রিকুয়েন্সি বয়সের বর্গের সমানুপাতে আর একই সাথে সাথে আমার চুল ছেঁড়ার রেট ঘনমূলের সমনুপাতে কমছে! 🙁 তবে পর্যাপ্ত চুল থাকায় আপাতত পিছু হটছি না 😛
সরবে নিয়মিত লেখা না দিলেও মাঝে-মাঝে সময় করে আসবেন, পড়বেন, মন্তব্য করবেন ; গুণী মানুষের পদচারনা, গুণী হয়ে উঠতে থাকা তরুণ লেখকদের জন্য অনুপ্রেরণার খোরাক যোগায়।
প্রিয়তে নিলাম লেখাটা। শুভকামনা নিরন্তর- ইতিবাচক প্রচেষ্টাগুলো বয়ে চলুক বয়সের সপ্তঘাতের সমানুপাতে! 😀 😀
(ভুলভাল প্রশংসায় বিপন্ন বোধ করার ইমো) 😳
অটঃ তাড়াতাড়ি সুস্থ হোন, দোয়া করি।
সেই তো মিথ্যাই হইল নাকি? আল্লাহ আর ফেরেশতার নাম যোগ করলেই তো মিথ্যা সত্যি হয়ে যায় না। এরকম একটা বানানো গল্পই তো বলা হয়। এখানে শুধু ধর্মের নাম দেয়া হল। এ ছাড়া আর কোন পার্থ্যক্য তো পেলাম না। যা শিখলাম, পিপল উইল ‘লাইক’ ‘এনিথিং’, ইফ রিলিজয়ন ইজ ব্লেন্ডেড ইন্টু ইট।
আল্লাহ ফেরেশতার নাম যোগ কেউ করবে কি করবে না সেইটা তার ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে, তাই না? ওটা নিয়ে রিঅ্যাক্ট করার কোন কারণ দেখি না।
বাচ্চাটা যে ধর্মেরই হোক না কেন বয়স অনুযায়ী বিজ্ঞানসম্মত একটা সত্য জবাব দেয়া যায়, ঠিক? এখানে কেবল কিছু উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। বাচ্চার বয়স ও মানসিক স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে ওভার-অল সত্যটাই জানানোর কথা বলা হচ্ছে বানানো গল্প/মিথ্যা গল্প নয়। 😐
তবুও কিছু শিখতে পারলেন জেনে ভালো লাগলো! :beshikhushi: সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
খুব ভাল্লাগলো ! প্রিয়তে নিলাম ! :love:
:love: :love: উৎসাহ পেলাম… মুনীরাপু…
যাক অনেকদিন পর এই পোস্টের সুবাদে সরবে ঢুকলাম। পোস্টটা সিরিজ করে চালালে মন্দ হয় না কিন্তু !! :love:
আপু বলছেন, তাহলে তো লিখতেই হয়। সিরিজ লিখতে হলে যে ভালো করে একটু স্টাডি করতে হবে। একটু অবসর হয়ে নি-ই- পরীক্ষা শেষে, লেখার চেষ্টা করবো আপু। সাথে থেকেন।
আমার বাসায় তিনটি পিচ্ছি আছে। যাক বাঁচা গেলে। ওরা যদি কোন দিন প্রশ্ন করে তাহলে এই উওর দিয়ে দিব।
অনেক ধন্যবাদ। সুন্দর লিখা। পরবর্তীতে এইরকম আরও লেখা চাই 🙂
অনেক ধন্যবাদ আপনাকেও… :happy:
জ্বি, সময় ও রসদ হাতে পেলে লিখবো
খুব ভালো লেগেছে! আরো আরো লেখা চাই। 😀
উৎসাহদাত্রী কে কৃতজ্ঞতা… :love: :love:
আপনার কাছ থেকে গঠনমূলক সমালোচনা আশা করেছিলাম।
হুম, চিন্তা করার মত ইস্যু।
:thinking:
শুভ চিন্তা!
এই হল সেই লেখা, যেটা পড়ার মাধ্যমে “বইয়ের পাতায় রোদের আলো” নামক একজন ব্লগারের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটেছিল। এর মাত্র কয়দিন পরেই জানতে পারলাম যে সেই ব্লগার এবং রাহনুমা আসলে একই ব্যক্তি! 😀
লেখাটা পড়ে আমি বেশ কিছু বিষয় ভাবতে শিখেছি। একগাদা ভাগ্নে-ভাগ্নি আছে তো! বিভিন্নসময় তাদের “কেন?/কীভাবে”সূচক নানানরকম প্রশ্নেরই সম্মুখীন হতে হয়। সেসব নিয়েই কিছু চিন্তা করার খোরাক পেয়েছি এখান থেকে। অবশ্য এখানে যেসব প্রশ্নের উদাহরণ দেয়া হয়েছে, সেই ধরণের প্রশ্নের সম্মুখীন আমাকে কখনও হতে হয় নি। ট্যালেন্ট পিচ্চিগুলো নিশ্চয়ই এটাও বুঝে যে এই প্রশ্নগুলো করার উপযুক্ত জায়গা মামা নয়! 😛 উপযুক্ত জায়গা বুঝেই হয়ত তারা উপযুক্ত প্রশ্ন করে!
লেখাটা সরবে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। এই ধরণের সচেতনতামূলক লেখা বেশি বেশি ছড়ানো দরকার। দেখে ভালো লাগছে যে অনেকেই লেখাটা পড়েছে।