গত বছর এস.এস.সি. পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর প্রহসনমূলক এই পরীক্ষা ও তার ফল নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিমত ফেসবুকে লিখেছিলাম। বাস্তবতার যেহেতু কোন পরিবর্তন হয় নি ফলে তার প্রেক্ষিতে চিন্তাভাবনাগুলোও একই রয়ে গিয়েছে। সেই কথাগুলোকেই আরেকটু গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করলাম।
অতীত
এস.এস.সি. পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন আমার এবং একই সাথে আমার বন্ধুদের যে অবস্থা হয়েছিল সেই কথা মনে পড়লে আজও অনেক অবাক লাগে। সেই সময় পরীক্ষাটার কতটাই না গুরুত্ব ছিল! শিক্ষাজীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা, প্রথম সনদ প্রাপ্তির পরীক্ষা। কত মাথা ব্যথা এটা নিয়ে। ছেলেকে নিয়ে পরিবারের কত আশা। ছেলের রেজাল্ট নিয়ে গর্ব করবে। ভালো ফল (সোনার এ+) না হলে যে জীবনটাই বৃথা!
যেদিন ফল দিল সেদিন আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই অনেকে তাদের ফল পেয়ে গিয়েছিল। (কতজনের কত লিংক থাকে!) ব্যাপারটা এমন ছিল, জিপিএ ৫ তো সবাই পায়, সোনা পাই নাকি সেটা দেখার বিষয়। আর মানসিক অবস্থা যখন এমন তখন যারা ফল জেনে গেল তাদের চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না! অঘটন ঘটেছে কিছু একটা। জিজ্ঞেস করতেই জানলাম, ইংরেজিতে মিস। প্রথমদিকে কয়েকজনের খবর পেলাম। আস্তে আস্তে দেখলাম, শুধু মিস না, গণ মিস! সেন্ট যোসেফ স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের জীববিজ্ঞান শাখার ৫৭ জনের মধ্যে ৬ জন বাদে বাকি সবার ইংরেজিতে মিস! সেকি অবস্থা! কেউ চিন্তাও করেনি। এক সিরিয়ালে ৫১ জন ছাত্রের ইংরেজিতে এ+ নেই, যেই ইংরেজি সেই ছোটবেলা থেকে পোলাও বিরানির মত খেয়ে আসছি!
সকাল বেলা জিপিএ ৫ এর আনন্দে লাফালাফি, বিকালে সবার চেহারা বাংলা পাঁচ! কি অমানবিক দ্রুততার সাথে সম্পূর্ণ পরিস্থিতির মোচড়! ইমেইলের মাধ্যমে ফল প্রাপ্তির জন্য রেজিস্ট্রেশন করে রাখলেও কোন কারণে সবার গ্রেডশিট ফলাফলের দিনেই চলে আসলেও আমারটা আসলো পরেরদিন। এত সব ভালো ভালো ছাত্ররা বোর্ডের কাছ থেকে যখন এভাবে ফাটা বাঁশ উপহার পেল তখন আগে থেকেই ধরে রেখেছিলাম আমার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হবে না। হয়ও নি। বাবা-মা যখন অতিমাত্রায় আকাংক্ষিত ফলের স্থানে এই ফল দেখলো তখন বাসার পরিস্থিতি কি হতে পারে সবারই বুঝে যাওয়ার কথা।
তবে আমার দুঃখ সোনা না পাওয়া নিয়ে ছিল না। ছিল নটরডেম কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হাতের মুঠো থেকে ফস্কে যাওয়ার ভয়! শিশুকাল থেকে যে কলেজের নাম শুনে আসছি, যে কলেজে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়েছি, সেখানে বুঝি আর পড়া হল না। বোর্ডের এই প্রহসনমূলক পরীক্ষা এবং আরও প্রহসনমূলক ফল যে একজন ছাত্রের স্বপ্ন কিভাবে ধুলিসাৎ করে দিতে পারে সেদিন হাতেনাতে টের পাচ্ছিলাম। তবে সুখের কথা, সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের সুবাদে ভর্তি হতে পেরেছিলাম স্বপ্নের কলেজটাতে। এর জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন না করলেই নয়। বোর্ডের হাজারও অযৌক্তিক পদক্ষেপ এবং নিষেধাজ্ঞা না মেনে, শিক্ষিত জাতি তৈরির উদ্দেশ্যে, বোর্ডের তথাকথিত র্যাংকলিস্টে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করার দিকে নজর না দিয়ে, জ্ঞানচর্চাকে উৎসাহ দিতে তারা সবসময়ই নিজেদের নীতি এবং লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন।
বর্তমান
সেই দিনগুলো খুব বেশি আগের না, খুব বেশি বড়ও হয়ে যাইনি এর মধ্যে। তবে আজকে যে অবস্থানে আছি, সেই অবস্থান থেকে যারা ফল পেল তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার মত অভিজ্ঞতা রাখি বলে মনে করি। ফল যেটাই হোক, সোনা পাও, রূপা পাও, তামা-কাসা যাই পাও, এখন যদিও এটার গুরুত্ব অনেক মনে হচ্ছে, কিছুদিন পর বুঝতে পারবে, এটার গুরুত্ব কিছুই থাকবে যদি না নিজের জীবনে সফল হও। অবশ্য এই কথাগুলো সবার জন্য প্রযোজ্য না। অনেকেই বাপের সম্পত্তির গর্বিত উত্তরসুরী হবে। কথাগুলো যারা নিজেদের জীবন নিজেরা গড়ে তুলতে চায় তাদের জন্য প্রযোজ্য। এত সোনার ছড়াছড়িতে পার্থক্য নিজেকে সৃষ্টি করে নিতে হবে। অবশ্য পরবর্তী জীবন এখনও আমি দেখিনি, তাই আমি যতদূর এসেছি তার প্রেক্ষিতেই কথাগুলো বলছি।
এই ফল কলেজে ভর্তি হওয়া পর্যন্তই। এরপর কেউ জিজ্ঞেস করবে না রেজাল্ট কি ছিল। শুরু হয়ে যাবে এইচ.এস.সি. এর দৌঁড়ঝাপ। এ তো আরও বড় রণক্ষেত্র! আরও গুরুত্ববহণকারী একটা পরীক্ষা, জীবনের পরবর্তী ধাপ রচনাকারী একটি পরীক্ষা, এত বড় সিলেবাস, অথচ সময় বাস্তবিক অর্থে দুই বছরও থাকবে না। এই পরীক্ষার ফলটাও আগেরমতই। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির একটা টিকেট। ভর্তি হওয়ার পর আর কেউ জিজ্ঞেস করবে না রেজাল্ট রেজাল্ট কি ছিল। আর যদি যেই কাজ তুমি করতে চাও সেই কাজে দক্ষতা অর্জন করতে পারো তাহলে তো কথাই নেই! চাকরি জীবনেও কেবল দক্ষতার জোরেই অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে। ওটাই আসল অর্জন। এইসব সার্টিফিকেটের দুই আনা দামও থাকবে না। তবে দুঃখ, এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষা, এটাও প্রহসন ছাড়া আর কিছুই না।
যেই কথাটা আসলে বলতে চাচ্ছি তা হল, যারা জিপিএ ৫ পায়নি তাদের সুযোগ এখানেই শেষ না। হয়তো নটরডেম কলেজে পড়তে পারবে না, হয়তো নামি দামী কোন কলেজের সাইনবোর্ড লাগিয়ে ঘুরতে পারবে না। কিন্তু কিছু করে দেখানোর মনোবল থাকলে সেটা করে দেখানোর জন্য আরো অনেক বছর বাকি আছে। কেউ তখন মনে রাখবে না কি করেছিলে সেই এস.এস.সি. পরীক্ষায়। জ্ঞান অর্জন করে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা যদি থাকে, তাহলে বোর্ড কেউ হয় না তোমাকে আটকে রাখার জন্য। সুযোগ সামনে আসবে, যোগ্যতা সেখানেই প্রমাণ করবে। বোর্ডের পরীক্ষা কোন মাপকাঠি নয়, নিজেকে ছোট ভাবার কিছু নেই।
আর যারা সোনা পেয়েছে তাদের উদ্দেশ্যেও বলি, অবশ্যই তোমরা প্রশংসনীয় ফল করেছ, অভিনন্দন তোমাদের প্রাপ্য। তবে আনন্দের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেওয়ারও কিছু নেই। ভিড় এতো বেড়ে গিয়েছে যে এত সোনালি বালক/বালিকাকে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ঢাবি এর ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়া ৬০ হাজার কৃতী(!) শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫০% ভর্তি পরীক্ষায় পাশই করতে পারে না! (২০১২-১৩ সেশনের ভর্তি পরীক্ষার পরিসংখ্যান।) তোমাকে যেন হাজারের ভিড়ে খুঁজে পাওয়া যায় সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাও।
দ্রষ্টব্য
বোর্ডের পরীক্ষা যে মেধার যথাযথ মূল্যায়ন করতে অক্ষম আমার জীবন থেকে তার দুই-একটা প্রত্যক্ষ উদাহরণ দেই। আমার ব্যাচে নটরডেম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে প্রায় ১৪০০ জনের মত ছাত্র ছিল। কলেজে বড় মাপের পরীক্ষা মূলত তিনটা হত। সবগুলো পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করলে যেটা দেখতাম, প্রথম ১০০ জনের মধ্যে যেসব ছাত্র ছিল তাদের অনেকেই এস.এস.সি. পরীক্ষায় সোনা পায়নি। শুধু প্রথম ১০০ জন না। প্রথম ৫০০ জনের মধ্যেও এরকম অনেক ছাত্র ছিল। আমি নিজে এমন একজন ছাত্র। টেস্ট পরীক্ষার পর আমার র্যাংক ছিল ১২৬। অথচ বোর্ডের বিবেচনায় আমি এই কলেজের ছাত্র হওয়ার যোগ্য ছিলাম না। ১২৬তম হয়ে যদি আমার যোগ্যতা না থাকে তাহলে আমার পিছনের প্রায় ১৩০০ ছাত্রের যোগ্যতা কিভাবে থাকে?
আবার এমন ছাত্রও ছিল যারা সোনা পেয়ে এসে কলেজে ফেল করছে। যেই ছাত্র প্রত্যেক বিষয়ে ৮০ <= নাম্বার পায় সে কোন বিষয়ে ফেল করে কিভাবে? এগুলোর উত্তর আজ সবারই জানা। আরেকটি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে একই অবস্থা দেখা যায়। সেটি হল এইচ.এস.সি. পরীক্ষার ফল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের অবস্থান। হাজার হাজার সোনা পাওয়া ছেলে মেয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম নাম্বার তুলতে পারছে না। অথচ এরাই সব বিষয়ে ৮০ <= নাম্বার পেয়েছে! আবার এমন শিক্ষার্থীও আছে যারা সোনা তো দুরের কথা, জিপিএ ৫ ও পায়নি। তারা আজকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক ভালো ফল করছে।
সারকথা এটাই যে সবই আসলে যার যার নিজের উপর। তুমি তোমাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারবে সেটা তোমার চেষ্টা আর সাধনার উপর নির্ভর করে। অন্য কেউ তোমার ভাগ্যের নির্ণায়ক হতে পারে না। বোর্ডের পরীক্ষার মত প্রহসনমূলক পরীক্ষা তো না-ই!
সারকথা এটাই যে সবই আসলে যার যার নিজের উপর। তুমি তোমাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারবে সেটা তোমার চেষ্টা আর সাধনার উপর নির্ভর করে। অন্য কেউ তোমার ভাগ্যের নির্ণায়ক হতে পারে না। বোর্ডের পরীক্ষার মত প্রহসনমূলক পরীক্ষা তো না-ই!
:clappinghands:
অক্ষর ভাইয়া, এই হাস্যকর একটা পরীক্ষার ফল নিয়ে যখন ছাত্র-ছাত্রীরা কান্নাকাটি করে, অনেকে আবার জীবন শেষ করে ফেলার মত পদক্ষেপও নেয় তখন অনেক দুঃখ হয়। এরা বুঝে না যে জীবনটা এতো সস্তা না। আবার নিজে জিপিএ ৫ পাওয়ায় এদেরকে সান্তনাও দিতে পারি না। অনেকটা এরকম হয়ে দাঁড়ায় যে আমি তো পেয়েছি, এখন ওদের কষ্ট কিভাবে বুঝবো। কিন্তু অভাগাদের কোনভাবেই বোঝানো যায় না জীবনটা এখানেই শেষ না।
সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগে যখন কেউ আত্মহত্যা করে।
মন চায় যারা এমন কাজ করে, তাদের প্রাণ দিয়ে দুই গালে দুটি চড় মারতে। বলদ কোথায়কার। জীবন কত বড়, অথচ পরীক্ষার খাতার দুই নাম্বারের জন্য নিজের জীবন দিতে হবে।