একটি মাত্র দেয়াল। এই দেয়ালের অপর পাশে কি হচ্ছে আমি জানি না। শুধু জানা অপর পাশে বাবার অপারেশন হচ্ছে। কোলন ক্যান্সার নামক এক ভয়ারহ রোগে আক্রান্ত আমার বাবা। সকাল ৯.৩০ মিনিটে বাবাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো।
গল্প-উপন্যাস পড়া কিংবা নাটক সিনেমায় দেখা অপারেশন থিয়েটারগুলো ছবি যেন চোখের সামনে ভাসতে থাকলো। হয়ত একটু পর ডাক্তার এসে বলে সব ঠিক আছে। অপারেশন সফল হয়েছে। আবার পরক্ষণে মনে হয় ডাক্তার এসে বলবে সরি!! আমরা শত চেষ্টা করে আপনার বাবাকে বাচাতে পারলাম না। কত শত চিন্তা উদয় হতে থাকল না বলে শেষ করা যাবে না।
অপারেশন থিয়েটারে পাশে রাখা চেয়ারে আম্মা বসে আছে। আম্মার চোখে জল। কিন্তু তা প্রকাশ করছে না। একটু পর যেন আম্মা কেঁদে উঠবে এরুপ একটি অবস্থা। আমি আম্মার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। আমার আম্মাটা বাবাকে খুব বেশি ভালবাসে। অনেক বেশি। দীর্ঘ ৩৯ বছরে দুইজন একসাথে ছিল এই মায়া কি কম?? জগতে মায়া জিনিসটা বড়ই অদ্ভূত। একজন মানুষ আর একজন মানুষের মায়ার কত সহজেই না পড়ে যায়।
বাবার অপারেশনের কথা শুনে আমাদের অনেক আত্নীয়-স্বজনের ভীড় দেখা যাচ্ছে। প্রায় ২৫ জনের মত লোক জন জড়ো হয়েছে অপারেশন থিয়েটারের সামনে। মামা, চাচা, খালু আন্টি সহ আরও অনেকে।অপারেশন হবে একজনের কিন্তু তার সাথে এত লোকজন দেখে ডাক্তারা বিরক্ত। আমাকে ডেকে বলল এত লোক কেন?? লোক কমান। এত ভীড় করলে কেমন দেখায়।
বাবার অপারেশন শুরু হল দেয়ালের অপর পাশে। আমি বসে আছি । কিছু সময় দাড়িয়ে হাঁটছি। অনেক বেশি টেনশনে থাকলে আমি হাটাহাটি করে। কিন্তু কিছুতে অস্থিরতা কমাতে পারছি না। নিজের স্বপ্নগুলো যেন ভেঙ্গে যেতে থাকল। বাবা সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা মনে পড়তে থাকলো। আমার সহজ সরল সৎ বাবাকে অনেক বেশি মিস করতে থাকলাম। ইচ্ছা করছিল দেয়ালটা ভেঙ্গে বাবা কাছে চলে যাই। বাবাকে জড়িয়ে বলি , “বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন না। আপনি না চাইতের আপনার ছেলে একদিন মস্তবড় মানুষ হবে। আপনার ছেলে প্রতিষ্ঠিত হবে। আপনি গর্ব করে সবাইকে তা বলবেন। দেখে যাবে না?? আপনাকে না দেখালে কি লাভ হবে?? আপনি প্লিজ বেঁচে উঠুন। আপনাকে বাঁচতে হবে। সারা জীবন আমাদের জন্য কষ্ট করে গেছেন নিজের আরামের জন্য কিছু করেনি। তবুও কেন আপনাকে চলে যেতে হবে? আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন। আপনি আবার আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলবেন যেন সব সময় সৎ থাকি এবং মানুষের উপকার করি। বাবা আপনার মত আদর্শবান হতে চাই। তা অবশ্যই দেখে যাবেন। দেখে যাবেন…….দেখে যাবেন………..
কখন যে আমার চোখে জল আসলো আমি বুঝতে পারিনি। যখন বুঝতে পারলাম তখন তাড়াতাড়ি চোখের পানিগুলো মুছে ফেললাম। কেউ যেন না দেখে। বিশেষ করে আম্মা। আমি নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রাখতে চাচ্ছি। আমি যদি ভেঙ্গে পড়ি তাহলে আম্মার কি হবে? আমার চোখে জল দেখলে আম্মা আরও বেশি ভেঙ্গে পড়বে। পরিবারের বিপদের সময় পরিবারের ছেলেদের সব সময় শক্ত থাকতে হবে। শক্ত না থাকলেও অভিনয় করে যেতে হয় যেন এগুলো কোন ব্যাপার না সব ঠিক হয়ে যাবে। এই যেমন আমি অভিনয় করে যাচ্ছি।
ঘড়ির কাটায় সময় একটা। হঠাৎ খবর পেলাম বাবার অবস্থা বেশি ভাল নয়। বারডেম এ একজন বড় ডাক্তার আমার ফুপি হয়। (নামটি বলছি না।) অপারেশন থিয়েটারে তিনি আছে। ফুপির বোন ভিতরে ফোন করে নাকি খবর পেয়েছেন বাবার অবস্থা বেশি ভাল নয়। বাবা আর নাও বেঁচে থাকতে পারেন। বাকিটা আল্লাহ হাতে।
এই খবর শোনার পর আম্মার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। আমি আম্মার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে আর পারলাম না। কি যেন বলছিলাম আম্মা চোখগুলো। যেন এখুণি আম্মার চোখ দুটো বের হয়ে যাবে। যেন এখুন আম্মা মাথা ঘুরিয়ে পরে যাবে।
আমি কিছু সময়ের জন্য দাড়ান্দায় হাটাহাটি করতে লাগলাম। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ডাক্তার বের হয়ে বলল রক্ত লাগবে। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না কেন এখন রক্তের কথা বলছে। ডাক্তার আগে বলেছিল এক ব্যাগ রক্ত লাগবে। আমি বার বার জানতে চেয়েছি আর লাগবে কিনা? ডাক্তার বলেছে না । আমি সেই অনুযায়ী এক ব্যাগ রক্ত যোগার করে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন??….
আগামী পর্বের হয়ত লিখব। এখন আর লিখতে ইচ্ছা করছে না।
পূর্ব প্রকাশ: তুসিনের জল-জোছনায়
তোমার বাবার জন্য অনেক দোয়া, তুসিন।
আমার নিজের বেলায়ই OT রুমের অভিজ্ঞতা আছে। এ প্রসঙ্গে আর কি বলব। এই অভিজ্ঞতাটা ঠিক তিক্ত না আবার মিষ্টিও বলা যাবে না; পানসে একটা অনুভূতি কাজ করে। আমাকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে অজ্ঞান করানো হয় নি, আড়াই ঘণ্টার পুরোটা অপারেশান চোখ খোলা থাকতেই হয়েছে…
ক্যান্সার তো খুব ভয়াবহ ব্যাপার! আঙ্কেলের জন্য মন থেকে অনেক দু’আ রইলো তুসিন। টাইম উইল হিল এভ্রেথিং! 🙂
আল্লাহ! সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ
আপনার বাবার জন্য দোয়া রইলো তুসিন