আগের দিনে পরীক্ষার পরে আমরা বাসায় গিয়ে বইয়ের সাথে উত্তর মিলিয়ে দেখতাম। কোচিং সেন্টারে মডেল টেস্টের প্রশ্ন নিয়ে পরীক্ষার পরের দিন সলভ ক্লাস হতো। এখন দিন বদলে গেছে। কোন কিছুই আর আগের মত নাই। আর তাই এখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগের দিন পরবর্তী দিনের পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে সলভ ক্লাস হয়। পরীক্ষার আগের দিন বুয়েটিয়ান ভাইয়াদের ব্যস্ততা বেড়ে আকাশে উঠে যায়। আন্টিদের ফোনের পরে ফোন- ছেলে প্রশ্ন হাতে নিয়ে বসে আছে, তাড়াতাড়ি এসে সলভ করে দিয়ে যাও। তিন মাস আগে ছেড়ে দিয়ে আসা টিউশনি থেকে আচমকাই ফোন আসে- ভাইয়া এই অংকটা কিভাবে করবো? ছাত্রীর মা ফোন দিয়ে মধু মিশিয়ে বলে-অনেক দিন আসো না, আজকে এসে একটু ভাল-মন্দ খেয়ে যাও।
দায়িত্বহীন সরকার- অসভ্য গার্জিয়ান- দুর্নীতিগ্রস্থ ভবিষ্যত প্রজন্ম।
বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাস হয়। বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন, মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন- এসব ফাস হওয়া মোটামুটি রেগুলার ঘটনা। কিন্তু ফাস হলেও এগুলো থাকে অল্প কিছু মানুষের মাঝে সীমাবদ্ধ এবং প্রশ্ন ফাস করে পরীক্ষা দিয়ে সবাই চুপ করেই থাকে- বুক ফুলিয়ে সেটাকে জাস্টিফাই করতে আসে না।
এইবার যেটা হচ্ছে সেটা ইতিহাসের স্বর্নাক্ষরে লিখে রাখার যোগ্য। গনতান্ত্রিক বাংলাদেশে আর কোথাও গনতন্ত্র না থাকলেও প্রশ্ন ফাসের ব্যাপারে ব্যাপক বিস্তৃত গনতন্ত্র দেখা গেল। শহর, বন্দর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে- কোথায় নেই ফাসকৃত প্রশ্ন? ফেসবুকে পেইজ খুলে প্রশ্ন দেয়া হচ্ছে। যাদের ফেসবুক নেই তারা পাচ্ছে মোবাইলে মেসেজে- টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া প্রশ্ন ফাসের উৎসব চলছে- প্রকাশ্যে, নির্লজ্জ ও অশ্লীল ভাবে। সবাই দেখছে শুধু আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর চোখেই কিছু ধরা পড়ে না।
একটা সময় দেশে প্রচুর নকল হতো। কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার্থীদের নকল সরবরাহ করতেন। পরীক্ষা শেষ ঝাড়ু দিলে নকলের বিরাট স্তুপ জমে যেত।
সেই অবস্থা থেকে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে টেনে তুলে এনেছিলেন এহসানুল হক মিলন। দেশের নকলের বিরুদ্ধে তার প্রানান্ত প্রচেষ্টায় একসময় দেশ থেকে নকল অতীত হয়ে গিয়েছিল। জিপিএ সিস্টেম চালু করে তিনি শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক আগ্রহ ও প্রতিযোগীতার সঞ্চার করেছিলেন।
সেই লোকটা এখন মাটি চুরি, ঘড়ি চুরির মামলায় দিনের পর দিন জেলে পচে মরছেন।
আর বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ সাহেব এমন ব্যবস্থা করে দিয়েছেন যে আর নকল করার দরকারই নেই। অবস্থা এমনই ভয়াবহ যে সরকারের অত্যন্ত আস্থাভাজন অধ্যাপক জাফর ইকবাল সাহেবকেও মৃদু গলায় প্রতিবাদ করে কলাম লিখতে হয়। তাও একবার নয় বেশ কয়েকবার।
অন্যায়কে অন্যায় বলে স্বীকার করে নিলেই অন্যায় অর্ধেক সলভ হয়ে যায়। কেউ যদি অন্যায় করার পরেও কোন মর্মযাতনা অনুভব না করে এবং কৃত অন্যায়কর্ম নিয়ে উল্টো গর্বিত ভাব প্রকাশ করে তখন বুঝতে হবে তার ভেতরে আর নৈতিকতা বোধ নেই। সে অন্যায় করে অনুতপ্ত নয় এবং পুনরায় সুযোগ পেলে একই অন্যায় সে আবার করবে।
সরকারের কেউই ব্যাপারটা স্বীকার করছে না। করার কথাও না। ল্যাংটা আবার কবে বাটপারের ভয়ে কাতর হয়?
কিন্ত আমি অবাক এই জন্যে যে ‘১৪ ব্যাচ অর্থাৎ বর্তমান এইচ,এস,সি পরীক্ষার্থীদের অনেককেই দেখলাম প্রশ্নফাস এবং সেই ফাসকৃত প্রশ্নে পরীক্ষা দেবার ব্যাপারে কোন খারাপ লাগা নেই। অনেকে আবার নানা ভাবে সেটাকে জাস্টিফাই করার ট্রাইও করছে। সৃজনশীল প্রশ্ন অনেক কঠিন- তার মানে এই না যে তোমাকে পড়ালেখা না করে প্রশ্ন খুজতে হবে। গোবর সব সময়ই গোবর, তাতে যতই ফুল চন্দন মেশানো হোক না কেন। আর ভাই তোমরাই একমাত্র কঠিন প্রশ্নে পরীক্ষা দিচ্ছো তা নয়- সবাই কঠিন প্রশ্নেই পরীক্ষা দেয়। পড়ালেখা আবার সহজ ছিলো কোন কালে? কঠিন হলেই যদি ফাস হতে হয় তাহলে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা আর টার্ম ফাইনালের পরীক্ষার প্রশ্ন সবার আগে ফাস হবার দাবিদার।
আশা করা যায় এদের কেউ যদি ফাকতালে বুয়েটে ঢুকে যেতে পারে তাহলে অচিরেই সেই সুসংবাদ পাওয়া যাবে। তারপরে সিজি সমস্যায় আক্রান্ত বুয়েটবাসী বিরাট বিরাট সিজি নিয়ে ইউরোপ, আম্রিকা কুপিয়ে বেড়াবে।
জহরলাল স্যারে একটা ডায়লগ দিতেন আমাদের সময়- “স্যারেরা, আমরা সবাই গোল্ডেন, খালি সরলরেখার সংগা জিজ্ঞেস করলেই পারি না। আমরা আসলে গোল্ডেন, তবে আসল না- ইমিটেশন।”
আমিএখন চিন্তা করি স্যার যদি আমাদের এই কথা বলেন তাহলে এখন স্যার কি বলেন? আমার ধারনা স্যার এখন আর কিছু বলেন না। কারন অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর। স্যার এখন পাথর হয়ে আছেন।
রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলার মাঠে এখন আর সোনা নাই। মাঠ ঘাটের সব সোনা উধাও হয়েছে। সেই সব সোনা এখন জায়গা নিয়েছে মেট্রিক আর ইন্টারের মার্কশীটে। চারিদিকে খালি সোনা আর সোনা। সেই সোনা বাজারে বিকায় না, কাজেও লাগে না- উলটো সোনার ভারে ঘাড় ভেঙ্গে যাবার দশা।
সহমত, কিশোর বয়সের এই অবক্ষয় মেনে নিতে কষ্ট হয়
সমস্যাটা যে সবার সেটা কি আমরা কোন দিন বুঝতে পারি? এই প্রশ্ন পত্র ফাঁস নিয়ে এবং এর পরবর্তী সকল ঘটনা নিয়ে বিরক্ত। শিক্ষামন্ত্রী খোঁড়া যুক্তি দিয়ে যাচ্ছে, আমরা সেটা নিয়ে লাফাচ্ছি, ব্যাচ-ব্যাচ ফেসবুকে যুদ্ধ। কিন্তু কেউই আসলে এগিয়ে আসে না। সবাই লিখছে কিন্তু শিক্ষামন্ত্রি যখন বলে, “ধরিয়ে দিন , সাহায্য করুন” তখন কেউ সামনে গিয়ে ধরিয়ে দেয় না। আবার শিক্ষামন্ত্রি চাইলেই তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে ঠিকই কালপ্রিটদের খুঁজে বের করতে পারেন কিন্তু নাহ তা করবেন না। এইটা সে কেন করে না? এইটা আমি কেন করব? যতদিন আমরা এই কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি বন্ধ না করব ততদিনে ভালো কিছু আশা করতে পারছি না। 🙁