সেই সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছে। কখনো টিপটিপ করে, কখনো বাতাসকে সাথী করে চারিদিক এলোমেলো করে দিয়ে, কখনও আবার মুষলধারে। বৃষ্টির এমন এলোমেলো ছেলেখেলার মৃদুমন্দ শব্দের মাঝেও কোথায় যেন একটা নিস্তব্ধতা। এই পরিবেশটা যখন আমার মনে পূর্ণিমার ঠিক আগের রাতে নেমে আসা একটি নিকষ কালো অমাবস্যার অনুরণন সৃষ্টি করবার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, ঘড়ির কাটাটা যেন কোন এক বেরসিক মফস্বলবাসী ঠোঁটকাটা লোকের মতন কর্কশ শব্দে জানিয়ে দিচ্ছে সময়টা এখন কেবল সন্ধ্যে সাতটা বেজে ছাব্বিশ মিনিট!
দূরে জলজ শৈবালের নিচে হারিয়ে যাওয়া পুরনো জলাটার পাশে জন্মানো ছোট ঝোপগুলোর আশপাশ থেকে জোনাকি পোকাদের দেহের ঈষৎ সবুজাভ আলো দেখা যাচ্ছে। এই বৃষ্টির মাঝেও ওরা এখানে কী করছে, আর এলই বা কী করে তা কে জানে? হয়ত বৃষ্টির জলতানের সাথে তাল মেলাবার জন্যেই ঝিঁঝিঁ পোকাগুলো ওদের দেশের সব শক্তি নিংড়ে দিয়ে আলোকবাদ্য বাঁজাতেই এসেছে আজ। ওদের শব্দহীন আলোর খেলায় প্রতিবেশের নিস্তব্ধতা যেন নতুন করে পূর্ণতা লাভ করে, মেতে ওঠে জমজমাট মৌনবিলাসের আতশবাজিতে…
আকাশের পুরোটা বুক জুড়ে জমে থাকা থকথকে কালোগুলোকে পেছনে রেখে সেই আতশবাজির ভীষণ উজ্জ্বল আলোর সুতীব্র সমবর্তনে কোন এক অন্ধকারের পথিকের রাতজাগা চোখগুলো হঠাৎ ঝলসে যায়, হয়ত অপবর্তনিক ব্যতিচারের তীব্রতায় পথের পাশের ডাস্টবিনটার দেয়ালের দুয়েকটা ইট ধ্বসে পরে।
মাঝেমাঝে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। সেই যে বর্ষার দিনে গ্রামের বাড়ীর শক্ত তক্তপোষে শুয়ে টিনের চালে টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে আঁকার খাতার ঠিক মাঝের পাতাটায় মেঘের দেশের একমাত্র শ্যামা মেয়েটার ষোড়শী অবয়বখানির নতুন একটি স্কেচ করে ফেলার সরব আনন্দ! কিংবা রমনা পার্কের ময়লা বেঞ্চিতে বসে কৃষ্ণচূড়া গাছটার সরু ডাল বেয়ে এক বিন্দু বৃষ্টির নেমে আসা দেখতে দেখতে হঠাৎ হেঁড়ে গলায় গান গেয়ে ওঠার ইস্টিশনহীন বাউণ্ডুলেপনার অনন্য সুখদর্শন!
বৃষ্টির ঝাঁট এসে পড়ছে আমার গায়ে, টিপটিপ বৃষ্টির অলস ফোঁটাগুলো চেষ্টা করছে আমার স্বল্প ঘনত্বের খাটো চুলের ফাঁকে আশ্রয় নেবার। আমি মাঝে মাঝেই চুলগুলোর মাঝে এলোপাতারি হাত চালিয়ে আগে থেকে আশ্রয় করে নেয়া জলকণাগুলোকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নতুন বৃষ্টিকণাদের স্থান করে দিতে থাকি। দৃষ্টির সীমার মাঝে অনেক দূরে একটা চলন্ত বাসের হেডলাইট ভেসে উঠতে থাকে, আমি আস্তে আস্তে রাস্তার ঠিক মাঝখানটায় গিয়ে দাঁড়াই। ভেজা পথ বলেই হয়ত সতর্ক বাসচালক দ্রুত চালিয়ে আসছেন না আমার দিকে, ধীরে ধীরে বাসের হেডলাইট দু’টো বড় আর স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে, আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি।
আমার সামনে আসতেই বাসটা কর্কশ ভেঁপুর বাঁজাতে বাঁজাতে হঠাৎ থেমে যায়, আমি আস্তে করে বাসটাতে চড়ে বসি। বাস আবারও চলতে শুরু করে। আমি চোখ দু’টো বন্ধ করে ফেলি। বৃষ্টিটা হঠাতই যেন ধনীর আহ্লাদী বালিকার মত থেমে যায়। বাস ছুটে চলেছে অচীনপুরের পথে, যেখানে আমি আর আমার বৃষ্টি রঙের হিসেব ভুলে মনোবিলাসে একে অপরকে শক্ত আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছু দিন বেঁচে ছিলাম…
খুব ভালো লাগলো,
খুবই চমৎকার লিখেছিস। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে লেখাটা পড়ার পর। সেটাই উপভোগ করছি। তাই আর বেশি কিছু লিখলামনা।
শুভকামনা রইল।
টিঙ্কুশ মিঙ্কুশ! 🙂