অবনী,
এখন রাত বাজে ১২ টা ৩৭, তোমার ঘড়িতে কত বাজবে? মিনিট চারেক বেশি কিংবা কম? আমার জানামতে বেশি হওয়ার কথা। সময় জ্ঞান আমার চেয়ে ঢের বেশি তোমার। শেষ যেই দিন কথা হয়েছিল তুমি বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলে যেন একটা সেকেন্ড এদিক ওদিক হওয়া মানে সমুদ্রের পানির উচ্চতা মিটার পাঁচেক বেড়ে যাওয়া, আর সেই পানিতে তোমার কোন শখের কিছু তলিয়ে যাবে। আচ্ছা জীবনে কি সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ার প্রভাব অনেক বেশি নাকি? এই ব-দ্বীপটা তলিয়ে গেলে কিইবা হবে?
তোমার কি মনে আছে আমি সবসময় একটা জারুল গাছের কথা বলতাম তোমায়? একটা জারুল গাছ, তার উপরে মগডালে বেশ কিছু পার্পল রঙের ফুল? আমি কিন্তু কোনদিন সেই গাছ দেখিনি, কোনদিন ঐ ফুলও ভালো লাগতো না আমার। শুরুতে তো অসম্ভব রকমের বিরক্তি লাগত এই ধরনের ফুল মানুষ পছন্দ করে? কিন্তু তুমি পছন্দ করতে আর সেই পছন্দকে আমি ভালোবাসতে বাসতে কবে যে আমিও জারুল ফুল পছন্দ করা শুরু করেছি আমার তা মনেও নেই।
একবার তুমি খুব কান্না করেছিলে আমার সামনে, মনে হয়তো নেই তোমার। তোমার অদ্ভুত সুন্দর চোখ দুটো যখন লাল টকটকে হয়ে ছিল, কতটা অসহায় কিন্তু অদ্ভুত রকমের সুন্দর দেখাচ্ছিল তোমায় তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। ঐদিনই একটা মোহে পরে গিয়েছিলাম। আমার এই ছোট্ট জীবনে আমি তোমার চোখের প্রেমে যতবার পরেছি তার অর্ধেকবারও যদি আমার অনার্স জীবনের একটা পাঠ্য বইয়ের প্রেমে পরতাম তাহলে নির্ঘাত এত দিনে ঐ বিষয়ে আমার একটা বই বের হয়ে যেত।
তোমার একটা বদ অভ্যাস ছিল। যখন তখন মানুষের চেহারা নিয়ে উদ্ভট সব মন্তব্য করা। একবার এক পানের দোকানদারকে দেখে তোমার আওরঙ্গজেবের মত লাগছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমাকে, আওরঙ্গজেব দেখতে এই পান ওয়ালার মত ছিল? উত্তর দিয়েছিলে, “এই ব্যাটার চেহারার মধ্যে একটা প্যাঁচ আছে, আওরঙ্গজেব নামের মতই প্যাঁচ!” আমি উত্তর শুনে অবাক হয়েছিলাম, কিন্তু যখন দেখলাম তোমার বাসের ড্রাইভারের চেহারা দেখে মনে হয় লোকটা এই যুগের “আলেকজেন্ডার” কিংবা পেপারওয়ালার মাঝে তুমি যখন ইব্রাহিম কার্দি কে খুজে পেতে তখন আমার বিস্ময় আস্তে আস্তে কেটে গিয়ে এই ব্যাপারগুলোই বরং স্বাভাবিক মনে হতে লাগলো। এই তো সেই দিন এক রিক্সাওয়ালা মামাকে নামার আগে বলে আসলাম, “আজ থেকে আপনি তিতুমীর মামা।” কেন বলেছি জানি না, তোমার প্রভাব, বিদঘুটে প্রভাব!
শেষ যেদিন চারুকলায় গিয়েছিলে মনে আছে? তোমার খুব শখ ছিল আঁকাআঁকি করার কিন্তু বকের ঠ্যাং আর কাকের ঠ্যাঙের চেয়ে খুব ভালো কিছু কোনদিন আঁকতে পার নি তুমি। তোমার চিত্রকর্মের একমাত্র সমঝদার মনে হয় আমিই ছিলাম। ভাগ্য ভালো চিত্রকর্ম গুলো নিয়ে তোমার মাথায় প্রদর্শনীর ভূত চেপে বসে নাই! এই পাগলামীটা করলে তুমি তো শেষ হয়ে যেতেই, আমিও ধরা খেয়ে যেতাম তোমার কাছে।
অবনী তোমাকে কোনদিন ভালোবাসি নি আমি। অন্তত আমি স্বীকার করি নি। তুমি অনেকবারই বলেছিলে, কখনও আকার ইঙ্গিতে, কখনও বা প্রায় সরাসরি। কিন্তু তোমাকে কোনদিন বন্ধুর বেশি কিছু ভাবতে পারি নি আমি। আমি তো কোনদিন ভাবিই নি তোমার আর আমার মাঝে বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিছু থাকতে পারে। তুমি একাই সবসময় আকাশ কুসুম ভেবে গেছ। শেষদিন চলে যাওয়ার সময়ও অঝরে কেঁদেছিলে , আমার কিন্তু একটু খারাপ লাগলেও কষ্ট লাগে নি। বরং মনে হয়েছিল কত বোকা মেয়ে? মানুষের জীবনে আবার সত্যিকারের ভালোবাসা বলতে কিছু আছে নাকি? একজনকে ছাড়া আরেকজন বাঁচতে পারে না, এটা কোন কথা ! এই মেয়েটাই দুইদিন পর বাস্তববাদী হয়ে যাবে। স্বামী আর বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করবে। অযথাই এই ছোট্ট সময়ের ইমোশন। কত্ত বোকা মেয়ে !
অবনী, লেখাটা তোমাকে দিতে পারবো না। তোমার জীবনের মোড় পাল্টে গেছে। আসলেই স্বামী আর দুই বাচ্চা নিয়ে তুমি সুখেই আছ। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে আমি আটকে গেছি, কখনও বা জারুল ফুলের রঙে, কখনও বা তোমার সেই অদ্ভুত সুন্দর চোখে, কখনও সেই রিক্সাওয়ালার নামে, হয়তো সত্যি বলতে তোমার মাঝে। আমি মারাত্মকভাবে আটকা পরে গেছি। কিন্তু আমি কিছু করতে পারবো না এখন। সময়ের তাগিদে তুমি বদলে গেছ, বদলে গেছি আমিও কিন্তু এই বদলে যাওয়া একটা সময় আমিও চাইতাম কিন্তু এইভাবে কি? ভালো থেক অবনী। আজও আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীতে সত্যিকার ভালোবাসা বলতে কিছু নেই, আসলে ভালোবাসাটা সবার জন্য না। এই যেমন ধর তোমার স্বামী সে হয়তো তোমার ভালোবাসা একদমই পায় নি অথবা হয়তো তুমি তার মাঝেই আসল ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছ। অথবা হয়তো আমিই তোমার ভালোবাসাটা পেয়েছিলাম কিন্তু ধরে রাখতে পারি নি। কিন্তু এখন যদি জিজ্ঞেস করি কে আসলে সুখী ? তুমি ? আমি? নাকি তোমার স্বামী? উত্তর জানি না। আসলে ভালোবাসা বলতে কিছু নেই, ওটা একটা মোহ।একপক্ষের যখন মোহ কেটে যায় আরেকপক্ষ তখন মোহে পরে যায়। আচ্ছা অবনী আমি যদি ভালোবাসার সংজ্ঞাই জানতাম তাহলে আমি কিভাবে এত বড় ভুল করি? নাহ, ভালোবাসা বোধহয় আছে। সত্যিকার ভালোবাসা বোধহয় আছে। হয়তো খুব কম ভাগ্যবান মানুষই তা পায়।
ইতি
প্রহর
১৯.১১.২০১০
অবনীর বারান্দায় একটা ডায়রী পরে আছে, এর ঠিক পাশেই চিঠি হাতে অবনী। আজ বহুদিন পর অবনী কাঁদছে। মাঝখানে কান্না ব্যাপারটার কথা ভুলে গিয়েছিল সে। আজ অবনীর জারুল ফুল দেখতে ইচ্ছে করছে খুব কিন্তু জারুল ফুল তো পাবে না এখন। কামরুলের রজনীগন্ধা খুব পছন্দের। শাহবাগ মোড় থেকে এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা কিনে আনবে আজ। একবার চারুকলায়ও ঘুরে আসবে পারলে। সবশেষে আজিমপুরে গিয়ে প্রহরকে দেখে আসবে একবার, হয়তো এই প্রহর আর কখনো কথা বলবে না। কিন্তু প্রহরের ডায়রী তো আছে, সাথে গোটা পাঁচেক চিঠি। চলবে, অবনীর এই দিয়েই চলবে। জীবনতো প্রায় কেটেই গেল, এই তো আর কয়টাই বা বছর।
লেখায় টুইস্ট থাকবেই, অল্প হলেও থাকবে- ইহা লেখক অক্ষরের পাওয়ার!
‘সত্যিকার ভালোবাসা নাই।’ কথাটা ক্রমবিরতিতে দুই-তিনবার পড়ার পর, আমি যখন মোটামুটি রেডি অ্যাগেইনস্টে তর্ক স্টার্ট করব- চিঠির শেষের দিকটা পড়লাম…নাহ, হইলো না 🙁
গল্প আর কত; বই লেইখা ফেলার সময় হইসে, স্টার্ট কইরা দে… :love:
আমার কবি ভাই ! আপনার কমেন্ট পড়ে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। আচ্ছা টাকা দে, বই লেখা স্টার্ট করে দেই। কারণ সেই বই আসলে আমি ছাড়া কেউ টাকা দিয়ে কিনে পড়বে না, সো তোর টাকাই জলে যাক। :happy:
কোন ভালা কাজ-ই টেকার জন্য আটকায় থাকে না-রে পাগলা! শুরু করে দে…
তুই যদি মনে করিস, বই লেখা ভালো কাজের মধ্যে পড়ে না, তাইলে আমার কিছু বলার নাইক্কা।
আর আমাদের মাথার উপর বাপ্পি’দা আছেন না;
আমারার বটবৃক্ষ! :happy: … :penguindance:
এক কথায় অসাধারণ….। লেখাটা পড়ে মনে হচ্ছিল যেন আমি নিজে একটি চরিত্রের অংশ।
হৃদয় খারাপ বলেনি বই বের করে ফেলো। 🙂
ধন্যবাদ ভাইয়া। :happy:
ই বুক করতে দোষ কি ?
ভালো লেগেছে লেখা।
আরেহ মিয়া ধুর ! ঐ বয়স+ যোগ্যতা কিছুই আসে নাই এখনও। দোয়া কইর যাতে আরও ভালো কিছু লিখতে পারি। :happy:
ভালো লেগেছে রে
সেটাই একটা ইবুক বের করে ফেল 😀
ধইন্যা আপি :happy:
অদ্ভুত রকমের সুন্দর ভাইয়া!!!
একটু বেশিই সুন্দর!!!