সকালে বাস স্টেশনে বাস পেতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। তাই চেষ্টা করি সকালে ঘুম থেকে উঠে যতদ্রুত সম্ভব স্টেশনের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যেতে। ঘুম ঘুম চোখে দৌড়ে বাসে উঠে প্রায় যুদ্ধ করে একটি সিট পেলাম। যাক বাচাঁ গেল। কষ্ট করে দাড়িয়ে যেতে হবে না এই গরম।
“এদের দশ জন কেন? সবগুলোকে পুড়িয়ে মারা উচিত ছিল? এগুলো এক একটি হারামির বাচ্চা। শালারা সব রাজাকার এগুলো সব পাকিস্থানের গোষ্ঠি। ওদের সবগুলোকে যদি কেরসিন দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারত তাহলে আমি খুশি হতাম।”
হঠাৎ করে এই শব্দগুলো আমার কানে আসলো। আমার সামনের সিটে বসে থাকা একজন লোক এই কথাগুলো বলছে। বুঝতে পারলাম ওনি কোন ঘটনাকে ইঙ্গিত করে কথাগুলো বলেছেন। শনিবার মিরপুর কালশিতে দশ জন বিহারি পুড়িয়ে মারার ব্যপারটি সর্ম্পকে তিনি বলছেন।
প্রথমে বিশ্বাস করে কষ্ট হলো একজন মানুষ হয়ে কেমন করে অন্য একজন মানুষকে এভাবে পুড়িয়ে মারার কথা বলতে পারে? আমি কিছু না বলে চুপাচাপ ওনার কথা শুনছি। এক সময় আর সহ্য করতে পারলাম না। আমি বললাম , “ ভাই কিছু মনে করবেন না একটা কথা বলি?”
ওনি উওর দিলে , “ জ্বি বলেন?”
আমি বললাম, “আপনি কি মানুষ? একজন মানুষ হয়ে কেমন করে আপনি অন্য একজন মানুষের এত নিষ্ঠুর ভাবে মৃত্যু কামনা করতে পারেন? এই মানুষগুলোকে পুড়িয়ে মারায় আপনি খুশি হতে পারেন? আপনি মানুষ নাকি জল্লাদ??”
ওনি কিছুক্ষন হা করে তাকিয়ে ছিল আমার দিক। হয়ত ভাবেনি আমি এরুপ কঠিন কোন কথা বলল। কিন্তু আমি তো কঠিন কিছু বলিনি।
তিনি উওর দিল, “ আরে ভাই আর বলবেন না বিহারী অনেক খারাপ, চোরি করে ডাকাতি করে, মানুষ মারে কত কি যে করে শুধু যারা কালশিতে থাকে তারা জানবে।”
আমি বললাম , “ আচ্ছা বাঙ্গালীরা কি চুরি ডাকাতি করে না ? তাই বলে কি সব বাঙ্গালীকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলা উচিত? একজন অপরাধ করলে কি সম্পূর্ন জাতির সবাইকে শাস্তি দেয়া উচিত?”
ওনি কোন কথা বললছেনা। পরে আরও কিছুক্ষন আমার সাথে তর্ক করল। আমি তেমন আগ্রহ দেখলাম না। এই ধরনের মানুষকে বুঝিয়ে কোন লাভ নেই। তাদের চিন্তাধারা হয়ত কখনো পরিবর্তন হবে না।
বাসে থাকা লোকটির মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে দেখলাম অনেকে স্ট্যাটাস দিয়েছে ১০ মানুষ আগুনে পুড়িয়ে মারায় তারা খুব খুশি হয়েছে। কত নিষ্ঠুর আমরা।
এবার আসি আসলে কি ঘটেছিল কালশিতে? মিডিয়া যা বলেছে তা কি আসলে সত্যি?? সামান্য আতশবাতিকে কেন্দ্র করে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল?? ঘর বন্ধ করে আগুন লাগিয়ে শিশুসহ ১০ দশকে মারা হলো।( সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে) বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হচ্ছে না আপনার? রাজনীতি কোন ব্যাপার কি এতে নেই? আচ্ছা চলুন দেখি মিডিয়ি কি বলছে………
১. আতশবাজী নিয়ে কালশী রণক্ষেত্রশিশুসহনিহত১০
প্রথম আলোতে পুলিশ জানায়, ছবিতে দেখুন।
এভাবে লিস্ট করলে লিস্টটা অনেক লম্বা হবে। সব সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশনে দাবি করা হচ্ছে আতশবাজিকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা ঘটেছে।
আমার প্রশ্ন হলো তাহলে মিরপুরের এমপি ইলিয়াস মোল্লার নাম কেন আসছে এই বিষয়ে? বিহারিরা কেন মিছিল করেছে ইলিয়াস মোল্লার ফাঁসি চেয়ে। এই ঘটনায় কি আদৌ কোন রাজনীতি ব্যাপার আছে? এই ঘটনার কি কোন বিচার হবে?
এক বিহারির সাথে আমার এই ব্যাপারে কথা হয়। নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। সে জানায়, “ মূলত কারেন্টের লাইন নিয়ে ইলিয়াস মোল্লার সমর্থিত ছাত্রলীগের নেতাদের সাথে বিহারিদের কথা কাটাকাটি হয়। একবার হাতাহাতি হয়েছে। যে সকল বিহারিরা এই ঘটনায় সক্রিয় ছিল তাদের টার্গেট করে তাদের ঘরের দরজা বন্ধ কররে রাতে আগুন দেয়া হয়। পুলিশ উল্টা আগুন লাগানোকারীদের সাহায্যে করেছে। সকালে যখন আমার এই ঘটনা নিয়ে মিছিলে করে আমাদের উপর লাঠিচার্জ এবং গুলি করা হয়। এতে আমাদের অনেকে আহত হয়। একজনের কানে গুলি লাগে।
সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হয়। আরও অনেকে আছে যাদের টা প্রকাশ হয়নি।”
বাংলানিউজ২৪ এ প্রকাশিত সেই ছবিটি।
ঘটনার ঘটার পর আমাদের দেশের মন্ত্রীরা যা বললো তা আরও হতাশ করলো আমাকে।
রাজধানীর মিরপুরের কালশীতে বিহারি ক্যাম্পে ১০ জন নিহতের বিষয়টিকে ‘দুর্ঘটনা’ বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল। তিনি বলেছেন, এটা একটা দুর্ঘটনা।
এ ঘটনায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ
কাদা ছোরাছোরির অভ্যাসটা আর গেলে না আমাদের সম্মানিত নেতাদের।
দিনশেষ নিজেকে বড় বেশি অনিরাপদ মনে হয় এই দেশে। কয়েকটি প্রশ্ন আনমনে উঁকি দেয় আমার মনে। এই বিচার কি আসলে হবে? সবচেয়ে হাস্য করা হল নিহত দশজন পরিবারকে বিশ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে বলে খবরে প্রচার করা হয়েছে। একটি জীবনের মূল্য কি বিশ হাজার টাকা? জীবন কি এত সস্তা?
সত্যি কি জানি না? এক এক মিডিয়া এক একটা নিউজ প্রচার করছে। সত্য – মিথ্যা খবরের ভিড়ে প্রতিদিন আমরা হারিয়ে যাই। এক সময় সবাই ভুলে যাব এই নিহত বিহারিদের কথা। ভুলে যাব তাদের পরিবারের কষ্টের কথা। কিন্তু যে পরিবারের শিশুরা হারিয়েছে বাবা-মাকে, যে বাবা-মা হারিয়েছে ছোট শিশু সন্তানকে তাঁরা বুঝবে কত কষ্টের অনুভূতি।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের এই কষ্ট কেউ দূর করতে পারবে না। বুঁকের ভিতরে হুহু করে উঠবে তাদের। বিচার পেলে হয়ত একটু শান্তি হবে মন। কিন্তু বিচার তারা পাবে না। এদেশে সঠিক বিচার বলে কোন শব্দ নেই। ক্ষমতার কাছে সবাই মাথা নথ করে।
তথ্যের উৎস:সহায়ক এক
সময়োপযোগী লেখা, আমরা ভাল মন্দ সবকিছুই বায়াসড, কে জানে এর থেকে আমরা কবে বের হতে পারব?
কবে বের হতে পারব তা জানা নেই 🙁
মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
কী যে বলব ভেবে পাই না। পোস্টটা দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। সবাই শুধু বেছে বেছে ঘটনার প্রতিবাদ করে। হিন্দু-মুসলিম-বিহারী-বাঙ্গালি না দেখে কবে মানুষের মৃত্যু দেখব আমরা জানি না।
তবে একদিন হয়ত আমাদের ধারণা, মূল্যবোধের পরিবর্তন হবে।
মন্তব্য দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
তুসিন ভাই সাহসী লিখা , আমার মনের কথাগুলোই আপনার লিখা দিয়ে পরিষ্কার বেরিয়ে এসেছে। ধন্যবাদ সময় বের করে লিখা জন্যে।
মনজু ভাই আপনার মন্তব্য পেয়ে ভাল লাগছে। ভাবিনি আপনি এই লেখাটি পড়বেন। 🙂 কষ্ট করে পড়া এবং মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
ভালো লিখা