আমাদের বাঙলা সাহিত্য

আমি তখন বেশ ছোট, ক্লাস এইটে পড়ি। গোলাম মোস্তফা স্যারের বাঙলা ব্যাকরণ ক্লাস চলছিল। ণ-ত্ব বিধানের নিয়ম পড়াচ্ছিলেন স্যার। পড়াবার এক পর্যায়ে স্যার বলছিলেন, ট-বর্গীয় কোন বর্ণের অর্থাৎ ট, ঠ, ড এবং ঢ এর পূর্বে যদি ‘ন্‌’ ধ্বনির আগমন হয় এবং ঐ ‘ন্‌’ সহযোগে যদি কোন যুক্তবর্ণ গঠিত হয়, তাহলে তার বানানে সবসময় ‘ণ’ ব্যবহৃত হবে।

সেদিন রাতে অনেক ঘাটাঘাটি করেও এই ‘ঢ’ বর্ণটির সাথে যায় এই নিয়মের এমন কোন উদাহরণ খুঁজে পেলাম না। পরদিন স্যারকে জিজ্ঞাসা করতে স্যার বললেন, তিনিও আজতক এমন কোন উদাহরণ খুঁজে পান নি। তবে প্রাচীন বাঙলা কবিদের মাঝে তিনি একজনের নাম তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন, যার নাম ছিল ডেণ্ঢণপা। এই একটা বানানেই তিনি এই নিয়মের প্রয়োগ দেখেছিলেন। কবি ডেণ্ঢণপা’র কোন কবিতা আমার পড়া হয় নি। তবে তার নামটিও আমার কাছে কবিতার মতই লাগে! খুব বিদঘুটে ধরণের নাম, অর্থটাও জানা নেই। তবে হ্যাঁ, আমার কাছে যেমন তাঁর নামটি বিদঘুটে বলে মনে হচ্ছে, আমার নামটিও তার কাছে বিদঘুটে কিছু বলেই মনে হত হয়ত! সেটাই স্বাভাবিক। কৈশরের মুখবন্ধ রচনার শেষ প্রান্তে স্যারের মুখে শোনা কবির এই নামটি আমি ভুলি নি, কখনো সুযোগ হলে তার তাঁর লেখায় চোখ বুলাবার ইচ্ছে আছে। জানি নে, সে সুযোগ হবে কিনা!

বাঙলা সাহিত্যের প্রাচীন বা মধ্যযুগে কবি ডেণ্ঢণপা’র মত আরো অনেক কবিই হয়ত ছিলেন, যাদের নামই অনেকটা রহস্যোপন্যাসের মত, কবিতার মত। লুইপাদে, কুক্কুরীপা, ভুসুকুপা, ক্রিংকানর – এমন সুদূর কবিতার মত কবিদের বেশিরভাগের নামই হয়ত আমাদের জানা হয়ে ওঠে নি। সাহিত্যের আলোর তারা আলোকিত করেছেন এই বাঙলার আকাশ, বাঙলার আকাশে ছড়িয়ে দিয়েছেন হাজার আবীরের মেলা। কালের পরিক্রমায় আজ হাজার বছর পর অসংখ্য কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, গল্পকার, গীতিকারের নাম এসেছে – তাদের সাহিত্যরসের আবগাহণ করে অসুন্দর এই জনপদে এসেছে সৌন্দর্য্য, শিল্পিত হয়েছে এই বাঙলা!

আমাদের এই অনন্য বাঙলা সাহিত্য একদিনে গড়ে ওঠে নি, একদিনেও গড়ে ওঠে নি এই সাহিত্য। হাজার বছরের এই পথচলায় তার রূপের পরিবর্তন ঘটেছে, তার রসের মিষ্টতা বেড়েছে, বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হয়েছে তার হৃদয়! বাঙলা সাহিত্য যেন ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠেছে চিরযৌবনা এক অপরূপ সুন্দরী শ্যামামেয়ে!

মধ্যযুগে কবিরা লিখে গেছেন রসালো পদাবলি, লিখেছেন মঙ্গলকাব্য! ধীরে ধীরে আধুনিক যুগে এসে পা রাখতে রাখতে সে ধারণ করেছে এক মোহময়ী রূপ। কিন্তু সময় বড্ড হিংসুটে এক সত্ত্বা। ইতিহাসের পাতা থেকে সে মুছে ফেলেছে অনেক লেখকের নাম, যারা একদিন সাহিত্যের রস ছড়াতেন। তবে সময়েরও সাধ্যি হয় না সবার নাম মুছে ফেলবার! অনেকের নাম হাজার ঝড়-ঝাপটার পরও থাকে অক্ষয়। এই যেমন, রবী ঠাকুর, নজরুল, মধুসূদন, জীবনানন্দ, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র কিংবা চণ্ডীদাস, মুকুন্দরাম, ভরতচন্দ্র, আলাওল, কাজী দৌলত, কাহ্নপাদের নাম! মহা শক্তিধর সেই সব লেখকদের উঠোনে ছড়ানো রাশি রাশি শব্দের ভাণ্ডার দিয়ে গড়ে উঠেছে আমাদের আজকেই এই সমৃদ্ধ বাঙলা সাহিত্য! তাদের হাত ধরে হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে আসা বাঙলা সাহিত্যের আজ হৈমশোভার কোন সমাপ্তি নেই! গোপনে বয়ে চলা সময়ের সাথে সাথে আমাদের এই বাঙলা সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছে, ঘটছে; ক্ষুদ্র এক টুকরো তারকা থেকে সে হয়ে উঠছে বৃহৎ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

অনেকে বলেন, বাঙলা সাহিত্যকে একটি কঠিন সময় পার করে আসতে হয়েছে। সে সময়টাকে তারা বলেন বাঙলা সাহিত্যের বন্ধ্যা যুগ বা অন্ধকার যুগ। কিন্তু, সাহিত্য কি কখনও অন্ধকার হতে পারে? সাহিত্য নিজেই তো একটি দ্বীপ জ্বালা আলো, সে কেমন করে অন্ধকারের আঁড়ে রূপ আড়াল করবে? বরং, এটাই বলা ভাল, সেই সময়টুকুর বাঙলা সাহিত্যের প্রামাণ্য নিদর্শণ আমরা খুঁজে পাই না। এটা আমাদেরই ব্যর্থতা। আমাদের ব্যর্থতার বাঙলা সাহিত্যের উপর কেন চাপানো? বাঙলা ভাষা যেহেতু তখন হারিয়ে যায় নি, বাঙলা সাহিত্যও তখন অবশ্যই বর্তমান ছিল আলোর মত! সাহিত্য হল মানুষ, মানুষের ভাষা আর তাদের অনুভূতি। ওর গায়ে কখনও আঁধারের ছোঁয়া লাগে না, হাতে আলোকবর্তিকা নিয়ে সে এগিয়ে চলে!

বাঙলা সাহিত্যের একটি খুব বড় অংশ হল কবিতা। একালে আমরা যখন সাহিত্যের মূল দুইটি ধারা দেখি, কবিতা আর গদ্য, ভাবতে অবাক লাগে যে এই মাত্র শ’দুয়েক বছর আগেও বাঙলা সাহিত্যের কোলে কোন গদ্যের বসত ছিলো না! এই দু’শো বছর আগে আমাদের সাহিত্য জগতে গদ্যের চর্চা শুরু। এর আগে বাঙলা সাহিত্যের আর কোন চর্চীই গদ্য লেখার কথা ভাবেন নি, তারা তাদের সব রস ঢেলে দিয়েছেন ছন্দের আঁড়ে! সেই দশম শতক থেকে শুরু করে উনবিংশ শতকের কিছু আগ পর্যন্ত বাঙলা সাহিত্যের পথচলা ছিল কেবল গ্রামীণ পদ্য পথে! এরপর পাঠকের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে গদ্য, গল্প, উপন্যাসের মত আরো অনেক কিছু। বঙ্কিম, শরৎ, মানিক-তারাশঙ্করের মত প্রতাপী লেখকদের গদ্যের ভাষায় আস্তে আস্তে বাঙলা সাহিত্যের একটা শহুরে রূপও জেগে উঠেছে। বিদেশী বাঙলা চর্চী উইলিয়াম কেরি আর তাঁর সহায়ক রামরাম বসু খুব যত্নে গদ্যের জগতে বাঙলার প্রথম পদচিহ্ন অঙ্কন করেন। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র, অক্ষয়কুমার দত্তের হাত ধরে সে জগতে বাঙলা দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। প্যারীচাঁদ মিত্র সে পথচলায় আরও বেগ এনে দেন বাঙলা উপন্যাসের জন্ম দিয়ে। নতুন এ পথে বাঙলা সাহিত্যের পালে হাওয়া দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মত কবিরাও। এসেছেন দীনবন্ধু মিত্র, মীর মশাররফ হোসেন, বিভূতিভুষণেরা- উজ্জ্বল করেছেন বাঙলা সাহিত্যের প্রদীপ। আর এখন এই আধুনিককালে তো পদ্যের ভাষাতেও এসে লেগেছে গদ্যছন্দের ছোঁয়া, সেও আজকাল বেশ বেগবান হয়ে উঠছে। এসেছে নাটক, আত্মজীবনী, প্রহসন, ব্যাঙ্গরচনা, কথোপকথন, অনুবাদ! আজকাল এতে যোগ হয়েছে আরও অনেক বৈচিত্র্য। হুমায়ূন, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, শামসুর রাহমান, আবুল হাসান, গৌতম, জাফর ইকবালের হাত ধরে সে দ্রুত থেকে দ্রুততর বেগে এগিয়ে চলেছে, আমাদের বাঙলা সাহিত্য এক মিষ্টি তরুণী থেকে হয়ে উঠছে এক ভরা যৌবনা মায়াবন বিহারিণী!

অনেকে হয়ত বলেন, এই বেগের তোঁড়ে কাব্যের আবেগে আবার ক্ষত না সৃষ্টি হয়! বাঙলা সাহিত্যের মূল কামনা যেন আঘাত পেয়ে না বসে! তবে কি, সাহিত্যের ধর্মই হল রূপান্তর হওয়া। রূপান্তরেই তার সার্থকতা। সাহিত্যকে তার নিজের দ্রুতিতে চলতে দেয়া উচিত।

বাঙলা সাহিত্যের ব্যাপারে আরও একটি কথা মনে না রাখলেই নয়। এ সাহিত্য জন্ম থেকেই বড় বিদ্রোহী স্বভাবের। জন্ম থেকেই সে জ্বলছে বিদ্রোহের আগুনে। কেনো এ আগুন?

দশম শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন বাঙলা সাহিত্য কেবল আঁতুড় ঘরে ক্ষীণ আলোয় চোখ মেলতে শুরু করেছে, সাধারণ মানুষের মনে সংগোপনে জেগে উঠতে শুরু করেছে বাঙলা সাহিত্য, তখন সংস্কৃত ছিলো সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষের ভাষা, তাদের সাহিত্য চর্চার মাধ্যম। সমাজের উঁচু শ্রেণীর সুবিধেবাদী, স্বার্থপর মানুষগুলো বাঙলা সাহিত্যের এই জন্মকে মেনে নিতে পারেনি। তাই জন্মের সময় থেকেই বাঙলা সাহিত্য তাদের অত্যাচারের কৃপাণ সহ্য করতে করতে বড় হতে থেকেছে। তারপর ফারসি, ইংরেজি, আরবি, পর্তুগীজের দাসত্বও করতে বাধ্য হতে হয়েছে তাকে। কিন্তু বিদ্রোহী বাঙলা সাহিত্য ওদের পরোয়া করে নি, জ্বলে উঠেছে অগ্নিশিখার মত! ধীরে ধীরে উপন্যাস, কথোপকথন, গল্প আর মধুর কাব্যশোভায় সে হয়ে উঠেছে ব্যাপক, ছোট্ট একটি অঞ্চলের সাহিত্য থেকে হয়ে উঠেছে সারা বিশ্বের! অন্তর্জালক যুগের এই দিনে এসে হাজার রঙের দীপাবলি হয়ে বাঙলা সাহিত্য ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়ার প্রতিটি কোণে।

ক্রমেই একদিন হয়ত আপন আবেগ-অনুভূতি, স্বপ্ন, চেতনা নিয়ে আমাদের এই অতি প্রিয় বাঙলা সাহিত্য হয়ে উঠবে কমনীয়া সুন্দর এক অভিনব সাহিত্য স্বত্বা, আকাশের সূর্যের মত সে স্নেহ বিলিয়ে দেবে সারা বিশ্বকে, তখন হয়ত আমি থাকব না, থাকব না আমরা – অসাধারণ বাঙলা সাহিত্যের স্বাদ আস্বাদ করবে এক নতুন পৃথিবী, যাদের কাছে হয়তবা আজকের সাহিত্যিকদের নামও বড্ড রহস্যঘেরা বলে মনে হবে! আমার, আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা সেই বাঙলা সাহিত্যের রসে রসময় পৃথিবী দেখে যেতে পারব না…

অনুজ সম্পর্কে

সাদা কাগজে কালো কালিতে লিখতে গেলে হয়ত লিখতে হবে - প্রথমত আমি রক্ত মাংসে গড়া এক মানুষ, দ্বিতীয়ত চিরন্তন সত্য, মৃত্যুর সাথে করি বসবাস... https://www.facebook.com/CoercedAnuj
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে ইতিহাস, বইপড়ুয়া, সাহিত্য-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

8 Responses to আমাদের বাঙলা সাহিত্য

  1. হৃদয় বলেছেনঃ

    আগেও তো পড়েছি; মাঝের দিকের কিছু অ্যাডিশন লেখাটাকে আরও ইনফরমেটিভ করে তুলেছে। অনেক কিছুই জানতাম না। ভাষার গাঁথুনিও ভালো হয়েছে। সিকুয়্যেল লেখার ইচ্ছে থাকলে, আস্তে-ধীরে লিখতে থাক। খাটতে হবে আর কি! এই ধরণের লেখায় খাটুনী বেশি হলেও এগুলা কাজের লেখা। চেষ্টা নিস…

  2. তুসিন বলেছেনঃ

    বাহ সাহিত্য নিয়ে এত সুন্দর গবেষণাধর্মী লেখা 🙂 আমাদের অনুজ বড় হয়ে গেছে 🙂
    অনেক তথ্য জানা ছিল না। কষ্ট করে লেখার জন্য ধন্যবাদ ।

  3. রুহশান আহমেদ বলেছেনঃ

    খুবই ভালো লেগেছে, নিশ্চয়ই বেশ পরিশ্রমের ফল লেখাটি।

    “সাহিত্য কি কখনও অন্ধকার হতে পারে? সাহিত্য নিজেই তো একটি দ্বীপ জ্বালা আলো, সে কেমন করে অন্ধকারের আঁড়ে রূপ আড়াল করবে? বরং, এটাই বলা ভাল, সেই সময়টুকুর বাঙলা সাহিত্যের প্রামাণ্য নিদর্শণ আমরা খুঁজে পাই না। এটা আমাদেরই ব্যর্থতা। “–রেসপেক্ট!

    বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস, উৎপত্তি সম্পর্কে সচেতনতা দেখে মুগ্ধ হলাম।

    • অনুজ বলেছেনঃ

      অনেকটাই মুখস্তনির্ভর লেখা, সেই ক্লাস এইটে গোলাম মোস্তফা স্যারের ক্লাস করার পর বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে এমন একটা ইম্প্রেশান তৈরি হয়েছিল ভেতরে। ওর ভেতর থেকে বের হয়ে আসা হয় ওঠে নি…

  4. শারমিন বলেছেনঃ

    ভালো লিখা 😀
    অনেক কিছু জানতে পারলুম 😀
    আর এইটা বেশি ভালো হয়েছে আগেরটার থেকে 😛

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।