রিলায়েন্স এন্টারটেইনমেন্ট ও ড্যাগ ক্রিয়েটিভ মিডিয়া প্রযোজিত এবং সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘জাতিস্বর: A Musical of Memories’ চলতি বছরের ১৭ই জানুয়ারি মুক্তি পায়। এ ছবিটির কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপে অনবদ্যতার পরিচয় দিয়েছেন স্বয়ং পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। অভিনয়ে আছেন প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি, যীশু সেনগুপ্ত, স্বস্তিকা মুখার্জি, রাহুল ব্যানার্জি, রিয়া সেন, আবির চ্যাটার্জি, মমতা শঙ্কর প্রমুখ। আর অতিথি চরিত্রে আছেন জনপ্রিয় গায়ক অনুপম রয়, রুপম ইসলাম প্রমুখ। ইতিমধ্যে ছবিটি ভারতের ৬১তম জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে জিতে নিয়েছে চারটি পুরস্কার- বেস্ট মিউজিক ডিরেকশন: কবির সুমন, বেস্ট প্লেব্যাক গায়ক(পুরুষ): রুপঙ্কর, বেস্ট কস্টিউম: সাবর্ণি দাস, বেস্ট মেকআপ: বিক্রম গায়কোয়াড়। এছাড়াও ছবিটি IMDb তে ৮/১০ রেটিং অর্জন করেছে এবং বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শকদের মনেও দাগ কাটতে সক্ষম হয়েছে।
গল্পের শুরুটা রোহিত (যীশু) ও মহামায়াকে (স্বস্তিকা) ঘিরে। মায়াকে পছন্দ করে রোহিত। রোহিত কলকাতায় বড় হলেও ধনী গুজরাটি পরিবারের ছেলে, পড়েছে পর্তুগিজ স্টাডিজে, বাংলায় আধো আধো কথা বলতে পারে। অন্যদিকে মায়া বাংলায় পড়েছে, বাংলাই তার ধ্যান-জ্ঞান। মায়া রোহিতকে তার ভালবাসা প্রমাণের জন্য শর্ত দেয় রোহিতকে একটি পুরোদস্তুর বাংলা গান লিখে সেটা শুদ্ধ উচ্চারণে গেয়ে শুনাতে হবে। পরে রোহিত উচ্চ শিক্ষার জন্য পর্তুগালে চলে যায়। পর্তুগালে পরিচয় হয় আরেক বাঙালি বোধির (আবির চ্যাটার্জি) সাথে। বোধির সাথে যেমন রোহিতের বন্ধুত্ব গড়ে উঠে, তেমনি বাংলায় কথা বলাটাও অনেকখানি রপ্ত করে নেয়। সেখানে বছর তিনেক কাটিয়ে প্রেজেন্টেশনের কাজের উদ্দেশে রোহিত দেশে ফিরে আসে। প্রেজেন্টেশনের বিষয় বেছে নেয়- ‘The Life and Times of Hensman Anthony’। ছবির মূল কাহিনী এখানেই শুরু।
হেন্সম্যান অ্যান্থনির (অ্যান্থনি ফিরিঙ্গী) জন্মস্থান চন্দননগরে এসে একজন অদ্ভুত মানুষের সাথে পরিচয় হয় রোহিতের। নাম তার কুশল হাজরা, পেশায় অ্যাসিস্ট্যান্ট লাইব্রেরিয়ান। সে রোহিতকে কথা দেয় অ্যান্থনির সাথে দেখা করিয়ে দিবে। মৃত্যুর ১৭৭ বছর পরে অ্যান্থনির সাথে কিভাবে দেখা হবে- এই ভাবনায় কৌতূহলী রোহিত কুশলের কথা মেনে নেয়। কুশল রোহিতকে বাসায় নিয়ে গিয়ে খুলে বলে সব কথা। কুশল দাবি করে, সে পূর্বের জন্মে অ্যান্থনি ছিল। এই ফরাসডাঙ্গায় বনেদী পর্তুগিজ পরিবারে ১৭৮৬ সালে তার জন্ম হয়েছিল। সে প্রায় প্রতিদিনই তার পূর্বজন্মের স্মৃতি-বিস্মৃতিতে হারিয়ে যায়। এভাবে ধীরে ধীরে সে বর্তমানের স্মৃতিকে আর মনে রাখতে পারছে না। প্রথমে কুশলের কথা বিশ্বাস না করলেও একসময় রোহিত মেনে নেয় কুশল হাজরা একজন জাতিস্বর। কুশলকে চিকিৎসার জন্য সে নিয়ে আসে কলকাতায়, কিন্তু বিনিময়ে অ্যান্থনির জীবনের কথা জানতে চায়। কুশল তাতে রাজি হয়।
কলকাতায় আসার পর ডাক্তারের সাথে কথা বলে তারা জানতে পারে, মানুষের মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পল জাইরাস নামক অংশটি কোন কারণে উত্তেজিত (aroused) হয়ে উঠলে পুরনো স্মৃতি ফিরে আসতে পারে। এছাড়া পিনিয়াল গ্ল্যান্ড (ত্রিনেত্র) নামক অংশটিও উত্তেজিত হলে এরকমটা ঘটে। অনেক সময় পুরনো স্মৃতি নতুন স্মৃতির স্থলে এমনভাবে জায়গা করে নিতে থাকে যে আক্রান্ত মানুষটি বর্তমানকে পুরোপুরি ভুলে যায়। চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে মানুষ ‘Schizophrenia’ (split personality disorder) তে আক্রান্ত হতে পারে। ডাক্তার এক পর্যায়ে কুশলকে জিজ্ঞেষ করেন, তার পূর্বের স্মৃতিতে কোন ধরণের ট্রমা বা অসম্পূর্ণ কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছে কিনা বা কাউকে সে খুঁজছে কিনা। সে ক্ষেত্রে ঐসব জায়গা পুনঃভ্রমণ অথবা ‘Past life regression’ এর মাধ্যমে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
এদিকে কুশল পূর্বজন্মের স্মৃতিগুলো রোহিতের কাছে বলতে থাকে। সে জানায় কিভাবে অ্যান্থনি কবিগানের জগতে ধীরে ধীরে প্রবেশ করল। অ্যান্থনি সবসময় চেয়েছে গানকে জীবনের পেশা হিসেবে বেছে নিবে। এই উদ্দেশে সে গ্রামের বিভিন্ন লোকগান শুনতে থাকে। এছাড়া সে রাজা গোপীমোহন দেবের দরবারে কবিগানের আসর গুলোতেও নিয়মিত যেতে থাকে। পরে সে সংস্কৃতি শিখে শাস্ত্র ও হিন্দুদের পুরাণ-উপপুরাণ পড়তে থাকে। কারণ কবিগানের আসরে দুই দলের মধ্যে দুর্গার নানা গল্প, সখী সংবাদ (রাধা-কৃষ্ণের ব্রজলীলা), বিরহ, দেব দেবতা, লহর (দুই পক্ষ আক্রমণাত্মক গানের কথায় উভয় পক্ষকে নাজেহাল করত) –এই পাঁচ পর্বে গানের লড়াই হত। ভোলাময়রা, কেষ্টমুচি, রাম বসু, ঠাকুর সিংহ সে সময়কার নামকরা কবিয়াল ছিল। অ্যান্থনির প্রথম প্রতিযোগী ছিল যজ্ঞেশ্বরী (রাম বসুর কথিত বান্ধবি)। যজ্ঞেশ্বরীকে হারানোর পর আর পিছু ফিরতে হয়নি অ্যান্থনিকে।
কিন্তু অ্যান্থনির জীবনে বিশেষ একজন এসেছিল। তার নাম সৌদামিনী। সে সময়ে বিধবা রমণীদের চিতার আগুনে পুড়িয়ে মারা হত। অ্যান্থনি সৌদামিনীকে সেই চিতার আগুন থেকে রক্ষা করে পরে বিয়ে করে। এ কারণে গ্রামের মানুষদের চক্ষুশূল হয়ে উঠে অ্যান্থনি। একবার অ্যান্থনি আর সৌদামিনী মিলে দুর্গাপূজা করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু গ্রামের মানুষেরা বাধা দিয়ে বলে, অ্যান্থনি বিধর্মী। অ্যান্থনি তাদের কথা না মেনে নিজের সিদ্ধান্তে অটুট থাকে। এদিকে দুর্গা পূজার সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর দিনে পরপর কবিগানের আসর।
নবমীর দিন অ্যান্থনির জীবনের শেষ কবিগান হয় ভোলাময়রার সাথে। এর আগে রাম বসু, ঠাকুর সিংহকে হারিয়ে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে তুলেছিল অ্যান্থনি। লহর পর্বে ভোলাময়রা তার গানের কথায় অ্যান্থনিকে নাস্তানাবুদ করে দেয়-
‘তুই জাত ফিরিঙ্গী, জবরজঙ্গি,
আমি পারব না তো তড়াতে,
তোকে পারব না তো তড়াতে,
শোনরে ভ্রষ্ট, বলি স্পষ্ট,
তোর কি ইষ্ট কালি কেষ্ট?
ভজকে যা তুই যীশু খ্রিষ্ট ঐ শ্রীরামপুরের গির্জাতে।’
অ্যান্থনিও ভোলাময়রাকে যথার্থ জবাব দেন এভাবে-
‘খ্রিষ্টে আর কৃষ্ণে কিছু তফাৎ নাই রে ভাই,
শুধু নামের ফেরে মানুষ ফিরে- এই কথা শুনি নাই…
আমার খোদা যে হিন্দুর হরি সে,
ঐ যে দেখ শ্যাম দাঁড়িয়ে আছে,
আমার মানব জনম সফল হবে যদি রাঙ্গা চরণ পাই।’
এদিকে কবিগানের লড়াই শেষ করে নিজ গ্রামে ফিরে এসে অ্যান্থনি দেখে তার ঘরে আগুন জ্বলছে। সৌদামিনীকে শেষমেশ বাঁচাতে পারেনি অ্যান্থনি। সৌদামিনীর মৃতদেহের পাশে ঢুকরে ঢুকরে কেঁদে উঠে অ্যান্থনি আর মাটিতে লিখে রাখে ‘ক্ষমা মিনি ক্ষমা’।
ছবির শেষ পর্যায়ে রোহিত মায়ার মন ঠিকই জয় করতে পেরেছিল। ব্যান্ডেমোনিয়াম-এর কনসার্টে নিজের লেখা গান শুনিয়ে অবাক করে দিতে পেরেছিল মায়াকে। কিন্তু সেদিনের পর থেকে কুশল রোহিতের কাছ থেকে দূরে সরে যায়, ফিরে যায় চন্দননগরের নিজের বাসায়। রোহিত মায়াকে নিয়ে যায় কুশলের সাথে দেখা করিয়ে দিতে। কিন্তু কুশল ইচ্ছে করেই এমন আচরণ করতে থাকে যে রোহিতের ধারণা হয়, কুশল তার বর্তমান স্মৃতি পুরোপুরি ভুলে গেছে। এভাবেই রোহিত আর মায়ার প্রস্থান ঘটে। তবে ছবির ঠিক এই অংশেই একটা টুইস্ট আছে। কুশল ঠিকই ডাক্তারের কথামত ‘Past life regression’ করতে পেরেছিল। কিভাবে পেরেছিল সেই চমকটা এখানে আর বলছি না। ছবিটি দেখলেই বুঝে যাবেন।
‘জাতিস্বর’ ছবিটির কাহিনী শোনার পরেও ছবিটি দেখতে ভিন্নরকম স্বাদ পাওয়া যায়। ছবিটির প্রত্যেক কলাকুশলীর অসাধারণ পারফরমেন্স ছবিটিকে করে তুলেছে ভিন্নমাত্রার। ছবিটির প্রতিটি গান, গানের সুর সমন্বয়, দৃশ্য ধারণ মনকে ছুঁয়ে যায়। প্রসেনজিৎ, যীশু, স্বস্তিকা এবং অন্যান্য পার্শ্ব অভিনেতারা অনবদ্য অভিনয় করেছেন। চরিত্রগুলো তাদের ব্যক্তিত্বকে পুরোপুরি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও চরিত্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের দ্বন্দ্ব, টানাপোড়ন, মিলন সবমিলিয়ে দারুণ ছিল। আড়াই ঘণ্টা ব্যাপ্তি এই ছবিটি দেখে দর্শকের ভাল লাগবে এই আশ্বাসটুকু দিতে পারি।
শেষ করব ‘জাতিস্বর’ ছবিটির টাইটেল ট্র্যাক ‘জাতিস্বর’ গানটির কিছু কথা দিয়ে:
‘অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোন দাবিদাওয়া,
এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া,
মুহুর্ত যায় জন্মের মতো অন্ধ জাতিশ্বর,
গত জন্মের ভুলে যাওয়া স্মৃতি বিস্মৃত অক্ষর,
ছেঁড়া তালপাতা পুঁথির পাতায় নিশ্বাস ফেলে হাওয়া,
এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া…’
পড়তে গিয়ে ভয়ে দুদ্দার করে চোখ বুলিয়েই চলে আসলাম। এত ঘটনা ফাঁস করে দিলে হবে? 😛 লেখা নিশ্চিত ভালো হয়েছে, তবে পড়বো মুভিটা দেখে ফেলার পর। শুরুতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্পয়লার অ্যালার্ট দিয়ে দিলে খুব ভালো হয়।
আপনি যদি লেখাটা পড়েও থাকেন তবুও নিশ্চিন্ত থাকুন। এই ছবিটির কাহিনীর গভীরতা এত বেশি যে এই লেখায় আমি তার অর্ধেকও ফাঁস করতে পেরেছি কিনা সন্দেহ!
মুভিটা দেখব দেখি 🙂
মুভিটা দেখে কেমন লাগল তা অবশ্যই জানাবেন 🙂
ডাউনলোড দিচ্ছি 🙂
মুভিটা দেখে কেমন লাগল তা জানাতে ভুলবেন না 🙂
ভালোই লেগেছে 🙂
🙂